ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

মাইলফলক অর্জন ॥ এলডিসি থেকে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা

প্রকাশিত: ২২:৫৮, ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২১

মাইলফলক অর্জন ॥ এলডিসি থেকে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা লাভকে মাইলফলক অর্জন হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেছেন, ‘এই অর্জন বিগত ১২ বছরের পরিশ্রম, পরিকল্পনা ও প্রচেষ্টার ফল। বাংলাদেশের জন্য এই উত্তরণ এক ঐতিহাসিক ঘটনা। এই কৃতিত্ব এ দেশের আপামর জনসাধারণের। সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আমরা এই মাইলফলক অর্জন করতে পেরেছি।’ স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের গৌরব নতুন প্রজন্মকে উৎসর্গ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেছেন, ‘আমি এই অর্জন উৎসর্গ করছিÑ দেশের নতুন প্রজন্মকে। যারা আজকের বাংলাদেশকে আরও সামনে এগিয়ে নিয়ে উন্নত-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ হিসেবে গড়ে তুলবে।’ উন্নয়নশীল দেশের চ্যালেঞ্জ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, উন্নয়নশীল দেশের চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলার জন্য আমরা এখন থেকেই পদক্ষেপ নিচ্ছি। ওই চ্যালেঞ্জ নিতে যা যা দরকার তা করতে আমরা প্রস্তুত। শুক্রবার রাতে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের জন্য জাতিসংঘের চূড়ান্ত সুপারিশ লাভ করায় শনিবার বিকালে সংবাদ সম্মেলন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রী গণভবন থেকে এই সংবাদ সম্মেলনে যুক্ত হন। আর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্র থেকে সাংবাদিকরা এতে যোগ দেন। এ সময় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে অর্থমন্ত্রী ছাড়াও বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠ কন্যা শেখ রেহানা এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের উপস্থিত ছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব আহমদ কায়কাউস সংবাদ সম্মেলনটি সঞ্চালনা করেন। কান্নাজড়িত ভারী কণ্ঠে তার উপস্থাপনা শুরুতেই সবার দৃষ্টি কাড়ে। এরপর প্রধানমন্ত্রীর হাতে স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের জন্য জাতিসংঘের চূড়ান্ত সুপারিশপত্র তুলে দেন তিনি। এরপর প্রধানমন্ত্রী বক্তব্য শুরু করেন। বক্তব্যের পর তিনি সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে প্রায় এক বছর পর আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি। তবুও সরাসরি না, ভার্চুয়ালি। আজ অবশ্য আমি আপনাদের সামনে উপস্থিত হয়েছি, একটি মহৎ এবং গৌরবোজ্জ্বল প্রত্যয়নের সুসংবাদ দেয়ার জন্য। বাংলাদেশ গতকাল (শুক্রবার, ২৬ ফেব্রুয়ারি) স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের জন্য জাতিসংঘের সুপারিশ লাভ করেছে। আমরা উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার পূর্ণ যোগ্যতা অর্জন করেছি।’ তিনি বলেন, ‘সমগ্র জাতির জন্য এটা অত্যন্ত আনন্দের এবং গর্বের। আমাদের এই উত্তরণ এমন এক সময় ঘটল, যখন আমরা সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন করছি। আমরা মহান স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনের দ্বারপ্রান্তে। এ সময় বাংলাদেশের জন্য এই উত্তরণ এক ঐতিহাসিক ঘটনা।’ শেখ হাসিনা বলেন, ‘জাতির পিতা মাত্র সাড়ে তিন বছরে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে ধ্বংসস্তূপের মধ্য থেকে টেনে তুলে স্বল্পোন্নত দেশের কাতারে নিয়ে গিয়েছিলেন। স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তিতে তারই হাতে গড়া আওয়ামী লীগ দেশকে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদায় উন্নীত করেছে। এই কৃতিত্ব এ দেশের আপামরা জনসাধারণের। সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আমরা এই মাইলফলক অর্জন করতে পেরেছি। এই শুভ মুহূর্তে আমি দেশ ও দেশের বাইরে অবস্থানরত বাংলাদেশের সকল নাগরিককে অভিনন্দন জানাচ্ছি। আমাদের উন্নয়ন সহযোগীদের ধন্যবাদ জানাচ্ছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘জাতির পিতার কন্যা হিসেবে, একজন নগণ্য সেবক হিসেবে এই কৃতিত্ব অর্জনের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকতে পেরে আমি নিজেকে ধন্য মনে করছি। মহান আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া জ্ঞাপন করছি। আমি এই অর্জনকে উৎসর্গ করছিÑ আমাদের দেশের নতুন প্রজন্মকে। যারা আজকের বাংলাদেশকে আরও সামনে এগিয়ে নিয়ে উন্নত-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ হিসেবে গড়ে তুলবে।’ করোনাভাইরাস মোকাবেলা ॥ বাংলাদেশে করোনাভাইরাস মোকাবেলায় সফলতার পেছনে কোন ম্যাজিক লুকিয়ে আছে জানতে চাইলে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এটা কোন ম্যাজিকের কিছু না। যখন যেভাবে বলেছি, সবাই মেনে চলেছে। সবাই সম্মিলিতভাবে কাজ করায় এটা হয়েছে। এটা বাংলাদেশের মানুষের সম্মিলিত ম্যাজিক।’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘করোনা সারাবিশ্বকে স্থবির করে দিয়েছিল। জনগণের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ যে, আমরা যখন যেভাবে বলেছি, সবাই মেনে চলেছে। আমরা সময়োচিত যেসব পদক্ষেপ নিয়েছি, বিশেষ করে অর্থনীতির ক্ষেত্রে। মানুষের যেন কষ্ট না হয় সেটা দেখেছি। আর্থিক প্রণোদনা দিয়েছি। সব শ্রেণীর মানুষ সহায়তা পেয়েছে। তখনও গবেষণা চলছে, আগাম অর্থ দিয়ে করোনার টিকা কেনার ব্যবস্থা নিয়েছি। তিনি বলেন, ‘সরকারের সব সদস্য, প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, আমার দলের নেতাকর্মী, ছাত্রলীগ-যুবলীগ-কৃষকলীগসহ সহযোগী সংগঠনের সদস্য প্রত্যেকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করেছে। যাকে যখন যে কাজ করতে বলেছি করেছে। সহযোগিতা-ত্রাণ পৌঁছে দিয়েছে। আমার কোন ম্যাজিক নয়, এটা বাংলাদেশের মানুষের ম্যাজিক। আমার বাবা মানুষের ভাগ্য উন্নয়নের জন্য নিজের জীবন দিয়ে গেছেন। কাজেই এটা আমার দায়িত্ব। আন্তরিকতা, দায়িত্ববোধটাই আসল।’ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ॥ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে লেখক-সাংবাদিকদের নির্যাতন ইস্যুতে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়েছি, ডিজিটাল নিরাপত্তা দেয়াও আমাদের দায়িত্ব। কেউ যেন সন্ত্রাস-জঙ্গীবাদে না জড়াতে পারে, সেজন্য ডিজিটাল নিরাপত্তা অপরিহার্য।’ তিনি আরও বলেন, ‘সমালোচনা যারা করছেন, তারা করবেনই। তবে তারা সবকিছু কি অনুধাবন করছে? আমার বয়স এখন পঁচাত্তর হয়েছে, এই ৭৫ বছরে সবাইকে চেনা হয়ে গেছে। আজকের এই দিনে আমি অন্য কিছু বলতে চাই না। শুধু এটুকুই বলব, কারো মৃত্যুই কাম্য নয়। তবে সেটাকে উদ্দেশ্য করে অশান্তিও কাম্য নয়। অসুস্থ হয়ে মারা গেলে কী করার আছে?’ আইনের অপব্যবহার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আইন তার আপন গতিতে চলে। কোনটা অপপ্রয়োগ আর কোনটা প্রয়োগ তা আপেক্ষিত ব্যাপার। কেউ অপরাধ না করলে বিচার হবে না। ডিজিটাল বাংলাদেশ হয়েছে বলেই এই করোনার মধ্যেই দেশের অর্থনীতির চাক সচল রাখতে পেরেছি। আপনি আইনের সুযোগ নেবেন, কিন্তু সেই সুযোগ যেন মানুষের জন্য ক্ষতিকর না হয়। তিনি আরও জানান, আমার বয়স ৭৫ বছর। সেই স্কুল জীবন থেকেই তো রাস্তায় নেমেছি। ৬২ সাল থেকে পথে পথে মিছিলে মিছিলে যোগ দিয়েছি। কাজেই এ দেশের সবাইকে আমার মোটামুটি চেনা আছে-শুধু আমি এইটুকু বললাম। কে কোথায় কি বলে সেটা আমার জানা আছে। কারও মৃত্যু কাম্য নয়, কিন্তু মৃত্যুকে কেন্দ্র করে কোন অশান্তির সৃষ্টি করাও কাম্য না। বাংলাদেশে ৩ নবেম্বর জেলখানায় চার জাতীয় নেতাকে নির্মমভাবে হত্য করা হয়েছিল। তো সেরকম কোন ঘটনা তো ঘটেনি এখনও। যারা সে হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছিল তাদের সঙ্গে তো অনেকেই গাঁটছাড়া বেঁধেছিল আমি দেখেছি। এখন কেউ অসুস্থ হলে মারা গেলে কী করার আছে। এ সময় তিনি আক্ষেপ করে বলেন, সব কিছু গায়ে মাখলে চলবে না। দেশের জন্য কাজ করতে চাই। বাংলাদেশকে একটি পর্যায়ে তুলে দিয়ে যেতে চাই। এটাই আমার চাওয়া। কে কি বলল সেটা আমার কাছে বড় কথা নয়। ২০২৪ সালের নির্বাচনে অংশ নেবেন কিনা, এমন প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘২০২৪ আসলে তখন সিদ্ধান্ত নেবো, কী করব। উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের জন্য ২০২৬ সাল পর্যন্ত তার মান ধরে রাখতে হবে। এজন্য আমাদের নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে, সব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে প্রস্তুত। আমার মনে হয়, এই কথার মধ্যে সব উত্তর আছে।’ আল-জাজিরা প্রসঙ্গ ॥ আল-জাজিরার খবরের প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমার কোন প্রতিক্রিয়া নেই। দেশবাসী বিচার করবে এই খবর কতটা মিথ্যা, কতটা বানোয়াট। বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনীদের ইনডেমনিটি দিয়ে বিদেশে পাঠানো হয়েছে, দূতাবাসে চাকরি দেয়া হয়েছে, সংসদে বসানো হয়েছে। যারা এসব করেছে তাদের সম্পর্কে আপনাদের কি ধারণা তা আমি জানিনা। তবে আমি তাদের বিচার করেছি। যুদ্ধাপরাধীদের উপদেষ্টা বানানো হয়েছে, সরকারে বসানো হয়েছে। আমি তাদের বিচার করেছি। যারা এই বাংলাদেশকে অন্ত্র আর মাদক চোরাচালানের স্বর্গরাজ্য বানাতে চেয়েছিল, তারা এটাকে মানবে কী করে? তিনি বলেন, ২০০১ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত দেশে কী পরিস্থিতি ছিল? সেই বিশৃঙ্খল অবস্থায় আমরা সরকার গঠন করি। তারপর একটার পর একটা অঘটন। এসব মোকাবেলা করেই আমরা বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল দেশ করতে সক্ষম হয়েছি। এটাকে স্থায়ী, টেকসই করতে হবে। আমরা পারব। কারণ আমাদের অর্জন অনেক বেশি। আবার আমাদের প্রস্তুতিও আছে। তিনি বলেন, যারা অস্ত্র চোরাচালানে জড়িত তারা চাইবে বাংলাদেশের বদনাম করতে। দেশকে বিপদে ফেলতে। কারণ তাদের সুবিধা নষ্ট হয়ে গেছে। তাদের সেই প্রচেষ্টা উপেক্ষা করে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে। সব কিছু মোকাবেলা করার সক্ষমতা আমাদের আছে। আরও ৩ কোটি ডোজ টিকা ॥ করোনাভাইরাস মহামারী মোকাবেলার লক্ষ্যে আরও তিন কোটি ডোজ টিকা আমদানির নির্দেশ দেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেছেন, দেশেও যাতে টিকা উৎপাদন করা যায়, সে ব্যবস্থাও সরকার নিচ্ছে। এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ইতোমধ্যে আমি নির্দেশ দিয়েছি, আরও তিন কোটি ডোজ কেনার জন্য। যাতে করে আমাদের যেটা আছে, সেটা প্রথম ডোজ দেয়ার পর দ্বিতীয় ডোজ আমরা শুরু করব, সঙ্গে সঙ্গেই যেন আবার টিকা আমাদের হাতে এসে যায়, একটা মানুষও যাতে এই টিকা থেকে বাদ না যায়, তার ব্যবস্থা আমরা নিচ্ছি। আমরা আগেভাবে চুক্তি করেছিলাম বলেই অনেক দেশের আগে আমরা টিকা প্রদান কর্মসূচী চালু করতে পেরেছি। তিনি বলেন, আমরা যখন টিকার কিনতে চুক্তি করি, তখনও এ টিকা গবেষণার পর্যায়ে ছিল। আমরা এ্যাডভান্স টাকা দিয়ে বুকিং করে ফেলি, যাতে যেখানেই পাওয়া যায়, আমরা আগে কিনে আনব, আমার দেশের মানুষকে সুরক্ষা দেব, এটা আমাদের নীতিগত সিদ্ধান্ত। উল্লেখ্য, তিন কোটি ডোজ টিকা কিনতে গত বছরের শেষভাগে (২০২০) চুক্তি করেছিল সরকার। এর মধ্যে জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে দুই দফায় ৭০ লাখ ডোজ টিকা দেশে এসেছে। এর বাইরে ভারত সরকারের উপহার হিসেবে এসেছে ২০ লাখ ডোজ টিকা। আগামী জুনের মধ্যে মাসিক কিস্তিতে বাকি টিকা সরবরাহ করার কথা সেরাম ইনস্টিটিউটের। এছাড়া বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নেতৃত্বাধীন প্ল্যাটচফর্ম কোভ্যাক্স থেকেও চলতি বছরের প্রথমার্ধে সোয়া এক কোটি ডোজ করোনাভাইরাসের টিকা পেতে পারে বাংলাদেশ। দেশেও টিকা তৈরির উদ্যোগের কথা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যেসব কোম্পানি টিকা তৈরি করেছে, তাদের অনুমতি নিয়ে দেশেই টিকা উৎপাদনের পরিকল্পনা আমরা করেছি। কোন দেশ যদি উৎপাদন করতে না পারে, প্রয়োজনে আমাদের দেশ উৎপাদন করতে পারবে, আমি আমাদের বিভিন্ন ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিকে ইতোমধ্যে বলেছি যে কারা কারা এটা করতে পারবে, তার জন্য প্রস্তুত থাকা এবং এখানে সিড যাতে আনা যায়, তার ব্যবস্থা করা যায় কি না, সেটাও আমরা দেখছি। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, প্রাইমারী থেকে শুরু করে উচ্চ শিক্ষা পর্যন্তÑ সকল স্কুল-কলেজের সব শিক্ষক-কর্মচারী এবং যারা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে বা হোস্টেলে থাকবে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নিয়ম অনুযায়ী যে বয়সীদের টিকা দেয়া যায়, তাদের সবাইকে টিকার আওতার আনার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এটা আমরা দেব, কারণ আমরা আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুব দ্রুত খুলতে চাই। পড়াশোনার পরিবেশটা ফিরিয়ে আনতে চাই। সবাই যাতে টিকা নেয়, সেজন্য গ্রাম পর্যন্ত প্রচার চালানো হচ্ছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, মানুষকে সুরক্ষা দেয়া- এটা তো আমার কর্তব্য, আমি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শুধু না, আমি জাতির পিতার কন্যা, এটা হচ্ছে সবচেয়ে বড় কথা। সেই হিসেবে আমি মনে করি, আমার এটা কর্তব্য, আমরা করে যাচ্ছি। অবশ্যই টিকা নেবেন প্রধানমন্ত্রী ॥ এ সময় প্রধানমন্ত্রী নিজে কবে টিকা নেবেন সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের উত্তরে সরকার প্রধান বলেন, ‘আমি টিকা অবশ্যই নেব, কিন্তু তার আগে দেশের কত পার্সেন্ট মানুষ নিতে পারল, কতজনকে দিতে পারলাম, সেটা আমি আগে দেখতে চাই। কারণ আমার একটা টিকার জন্য যদি আরেকটা মানুষের জীবন বাঁচে, সেটাই তো সবচেয় বড় কথা, তাই না? ’ নিজের বয়স এখন ৭৫ বছর, সে কথা মনে করিয়ে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমি খোঁজ নিচ্ছি, আমাদের একটা টার্গেট করা আছে, এই সংখ্যা পর্যন্ত আগে আমি নির্দিষ্টভাবে দেব, এটা যখন হবে, তারপরে আমারটা আমি নেব, যদি টিকা বাঁচে।’ শেখ হাসিনার হাত ধরেই কি উন্নত বাংলাদেশ ॥ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরেই ২০৪১ সালে উন্নত বাংলাদেশ উন্নত দেশে প্রবেশ করবে এমন এক আশাবাদী প্রশ্নে তিনি বলেন, ২০৪১ সালে আমার বয়স হবে ৯৫ বছর। ওই বয়সে কী আমি কাজ করতে পারব? নতুন প্রজন্ম কাজ করবে। নতুন প্রজন্মই দেশকে উন্নত দেশে নিয়ে যাবে। সেই পরিকল্পনাও আমরা করে ফেলেছি। এখন সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করলেই বাংলাদেশ উন্নত দেশে উঠে আসবে। তিনি বলেন, উত্তরবঙ্গে এখন মঙ্গা নেই। দক্ষিণে ব্যাপক কর্মযজ্ঞ হচ্ছে। আমরা এমনভাবে কাজ করছি যাতে মানুষের কোন কষ্ট হবে না। বাংলাদেশ উন্নত দেশ হবে। তখন আমি বুড়ো হয়ে যাব। কাজ করতে পারব না। এ সময় তিনি সাংবাদিকদের জানান যে, ছোট বোন শেখ রেহানার কাছ থেকে তিনি প্রথম এই সুখবরটি পান। রাত সাড়ে ৯টার দিকে শেখ রেহানা এই খবর দেন প্রধানমন্ত্রীকে। তার আগে শেখ রেহানা সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখছিলেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, উন্নয়নশীল দেশ হতে কি কি করতে হবে, সেই পরিকল্পনা আছে সরকারের। বাংলাদেশ অদূর ভবিষ্যতে তার উন্নয়নের কাজ নিজস্ব অর্থে করবে বলে জানান তিনি। প্রারম্ভিক বক্তব্য ॥ তার আগে লিখিত বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী উল্লেখ করেন, পাকিস্তান রাষ্ট্রের পূর্ববঙ্গ কেবল অবহেলিতই ছিল না, এখানকার সব সম্পদ নিয়ে যাওয়া হতো, অথচ প্রায় ৫৬ ভাগ মানুষের জন্য ব্যয় করা হতো ৩০ থেকে ৩৫ ভাগ সম্পদ। এ বৈষম্যের বিরুদ্ধে জাতির পিতা প্রথম সোচ্চার হন এবং আন্দোলন শুরু করেন। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ৯ মাসের যুদ্ধে পরাজয় নিশ্চিত জেনে সব অবকাঠামো ধ্বংস করে রেখে যায় পাকিস্তানীরা। সে সময় বাংলাদেশ উন্নয়নের মহাসড়কে প্রবেশ করে জাতির পিতার হাত ধরে। কিন্তু দুর্ভাগ্য তিনি সব কাজ শেষ করে যেতে পারেননি। ১৫ আগস্ট জাতির পিতাসহ আমার পরিবারের সবাইকে হত্যা করা হয়। সে সময় প্রতিরাতে বাংলাদেশে কার্ফু থাকত, খরা, বন্যা, দুর্যোগের দেশ ও ভিক্ষুকের দেশ হিসেবে বিশ্বের কাছে পরিচিত ছিল। সব সময়ের মতো গ্রাম ছিল অবহেলিত। দুর্ভিক্ষ লেগেই থাকত। শেখ হাসিনা আরও বলেন, আমি নিজে ছয় বছর দেশে আসতে পারিনি, জিয়াউর রহমান আসতে দেননি। জনগণের রায় নিয়ে আমি দেশে ফিরি। তারা রেহানার পাসপোর্ট ফেরত দেয়নি। তিনি আরও জানান, ’৯৬ সালে মানুষের রায় নিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে। ২০০১ সালে আমরা ক্ষমতায় আসতে পারিনি। বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় আসে। ২০০৯ সালে আমরা আবার সরকার গঠন করি, কৃতজ্ঞ তাদের প্রতি ভোট দিয়ে জনগণের সেবার করার সুযোগ দিয়েছে। জাতির পিতা শেখ মুজিব অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখছিলেন। এক যুগ আগের বাংলাদেশ আর আজকের বাংলাদেশ এক নয়। আজকের বাংলাদেশ বদলে যাওয়া বাংলাদেশ। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। তিনি আরও বলেন, একটি মানুষও বাংলাদেশে ভূমিহীন ও গৃহহীন থাকবে না। প্রায় আড়াই কোটি মানুষকে নগদ ও অন্যান্য সহযোগিতা দেয়া হয়েছে। করোনাভাইরাসের কারণে ২০২০ সাল ছিল সঙ্কটময়। এত সঙ্কট পেরিয়ে টিকাদান কর্মসূচী শুরু করেছি। আমাদের এ অর্জনকে সুসংহত ও টেকসই করতে হবে। শেখ হাসিনা লিখিত বক্তব্যে বলেন, ‘এক যুগ আগের বাংলাদেশ আর আজকের বাংলাদেশ এক নয়। আজকের বাংলাদেশ এক বদলে যাওয়া বাংলাদেশ।’ বদলে যাওয়া এই দেশকে বুঝতে আর্থিক এবং অন্যান্য সূচকগুলোর দিকে সবাইকে দৃষ্টি দেয়ার পরামর্শ দেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০০৮-০৯ বছরে জিডিপির আকার ছিল মাত্র ১০৩.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০১৯-২০ সালে তা ৩৩০.২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছে। ২০০৮-০৯ বছরে রফতানি আয়ের পরিমাণ ছিল ১৫.৫৭ বিলিয়ন ডলার। আর ২০১৮-১৯ বছরে তা ৪০ দশমিক পাঁচ-চার বিলিয়ন ডলারে বৃদ্ধি পায়। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২০০৮-০৯ বছরের ৭ দশমিক চার-সাত বিলিয়ন মার্কিন ডলার থেকে বৃদ্ধি পেয়ে বর্তমানে ৪৪ দশমিক শূন্য-তিন বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে। ২০০১ সালে দারিদ্র্যের হার ছিল ৪৮.৯ শতাংশ এবং হত-দারিদ্র্যের হার ছিল ৩৪.৩ শতাংশ। ২০১৯ সালে দারিদ্র্যের হার কমে দাঁড়িয়েছে শতকরা ২০.৫ ভাগ এবং হত-দারিদ্র্যের হার ১০.৫ শতাংশে। ২০০৯-১০ সালে বিদ্যুতের স্থাপিত ক্ষমতা ছিল ৫,২৭১ মেগাওয়াট। বর্তমানে বিদ্যুত উৎপাদন সক্ষমতা ২৪ হাজার ৪২১ মেগাওয়াটে উন্নীত এবং বিদ্যুত সুবিধাভোগী জনসংখ্যা ৪৭ থেকে ৯৯ শতাংশে উন্নীত হওয়ার কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী। খাদ্য উৎপাদনে বাংলাদেশের স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের বিষয়টি তুলে ধরে তিনি বলেন, বাংলাদেশ বিশ্বে ধান উৎপাদনে তৃতীয় এবং মাছ-মাংস, ডিম, শাকসবজি উৎপাদনেও স্বয়ংসম্পূর্ণ। অভ্যন্তরীণমুক্ত জলাশয়ে মাছ উৎপাদন বৃদ্ধির হারে বাংলাদেশ দ্বিতীয় স্থানে এবং ইলিশ উৎপাদনকারী ১১ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান প্রথম। উন্নয়ন অভিযাত্রায় ’ডিজিটাল বাংলাদেশ’-এর সুবিধা শহর থেকে প্রান্তিক গ্রাম পর্যায়েও বিস্তৃত হওয়ার কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী। ‘বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট’-এর সুবিধা কাজে লাগিয়ে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তনের কথাও তিনি বলেন। করোনাভাইরাস মহামারীর এই সময়ে গণটিকাদানের বিষয়টি তুলে ধরেন তিনি। শেখ হাসিনা বলেন, স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের ফলে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশ একটি প্রত্যয়ী ও মর্যাদাশীল দেশ হিসেবে জায়গা করে নেবে। তবে এ অর্জনকে সুসংহত এবং টেকসই করার ওপর জোর দেন তিনি। এ লক্ষ্যে অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা গ্রহণ, পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, কর্ণফুলী টানেল, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত প্রকল্প, মহেশখালী-মাতারবাড়ি সমন্বিত উন্নয়ন প্রকল্পসহ বেশকিছু মেগাপ্রকল্প বাস্তবায়ন, ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল, দুই ডজনের বেশি হাইটেক পার্ক এবং আইটি ভিলেজ নির্মাণের কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী। শেখ হাসিনা বলেন, বাঙালী বীরের জাতি। মাত্র নয় মাসে আমরা আমাদের স্বাধীনতার লাল সূর্যকে ছিনিয়ে এনেছি। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি আমাদের এই উন্নয়নের গতিধারা অব্যাহত থাকলে বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশ অচিরেই একটি উন্নত-সমৃদ্ধ মর্যাদাশীল দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে। আসুন, দলমত-নির্বিশেষে জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর এ মাহেন্দ্রক্ষণে আমরা সকলে ঐক্যবদ্ধভাবে বাংলাদেশকে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার করি।
×