ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

শফী আহমেদ

সেলিম-দেলোয়ার স্মরণে

প্রকাশিত: ২০:৫০, ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২১

সেলিম-দেলোয়ার স্মরণে

২৮ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাসে একটি বিভীষিকাময় দিন। ১৯৮৪ সালের এই দিনটি ছিল এ দেশের ছাত্রসমাজের জন্য এক বেদনাময় অধ্যায়। তখন দেশে সামরিক শাসন। সেদিন বিকেলে ছিল ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের মিছিলের কর্মসূচী। শ্রমিক-কর্মচারী ঐক্য পরিষদ আহূত ধর্মঘট সফল করার লক্ষ্যে ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের অন্তর্ভুক্ত সব ছাত্র সংগঠনের পৃথক পৃথক মিছিল বিকেল ৪টার মধ্যে মধুর ক্যান্টিন এবং তৎসংলগ্ন এলাকায় পৃথকভাবে সমবেত হয়। কেন্দ্রীয় নেতারা মধুর ক্যান্টিনের বারান্দায় দাঁড়িয়ে বক্তৃতা করে সমাবেশকে উজ্জীবিত করেন। এরপর মূল মিছিল শুরু হয়। সেদিনের কথা মনে হলে আজও শরীর শিউরে ওঠে। কেন জানি না সেদিন মন অজানা আশঙ্কায় ভারাক্রান্ত ছিল। মিছিলে যেতে ইচ্ছা করছিল না। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের নেতা মিছিলে না গেলে কি হয়? কয়েকজন বন্ধুকে আমার মনের অবস্থা খুলে বলেছিলাম। কিন্তু তারাও অনুরোধ করল– যা হয় হবে, মিছিলে থাক। ডান-বাম খেয়াল রাখ। মধুর ক্যান্টিনের পাশেই ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউটের মাঠে আমাদের জমায়েত ছিল। সেই জমায়েতে বক্তব্য দিলাম। বললাম, যে কোন প্রতিকূল পরিবেশ মোকাবেলা করতে হবে। তারপর খণ্ড খণ্ড মিছিল মধুর ক্যান্টিনের সামনে সমবেত হলো। নেতারা বক্তব্য রাখলেন। কবি মোহন রায়হান আবৃত্তি করলেন একটি বিপ্লবী কবিতা– ‘আমাদের মৃত্যুর জন্য আজ কোন পরিতাপ নেই/আমাদের জন্মের জন্য আজ কোন ভালবাসা নেই/ আমাদের ধ্বংসের জন্য আজ কোন প্রতিকার নেই/ আমাদের সবকিছু আজ শুধু ছলনার/ ব্যর্থতার ক্লেদ নিয়ে আসে/ আজকে এখানে একজন শিক্ষক জন্মাক/ আজকে এখানে একজন বুদ্ধিজীবী থাক/ আজ নবজন্ম হোক এ দেশের লেখক-কবির/ আর তারা অন্ধকারে ঝলসিত আগ্নেয়াস্ত্রের মতো/হোক স্পর্ধিত; স্পর্ধিত হোক/আজ তারা স্পর্ধিত হোক।’ মিছিলটি শুরু হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরির সামনে দিয়ে রোকেয়া হল পেরিয়ে টিএসসির পাশ দিয়ে কার্জন হলের দিকে এগোতে থাকে। মিছিলের সামনে ছিলেন কেন্দ্রীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের নেতা ডাকসু ভিপি আক্তারুজ্জামান, খন্দকার মোহাম্মদ ফারুক, মুনির উদ্দীন আহমেদ, ফজলে হোসেন বাদশা, আনোয়ারুল হক, আবদুল মান্নান, মুশতাক হোসেন, মুকুল বোস প্রমুখ। মিছিলটি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ইমার্জেন্সি পেছনে রেখে কার্জন হল পার হয়ে ফুলবাড়িয়ার দিকে অগ্রসর হয়। দাঙ্গা পুলিশ মিছিলের সামনে ও পেছনে অবস্থান নেয়। এ যেন মিছিল নয়, পুলিশী ঘেরাওয়ের মধ্যে একটি চলমান কারাগার। তার পেছনেই ছিল পুলিশের পুলিশবিহীন একটি ট্রাক। আমরা ঠিক আন্দাজ করতে পারিনি কী ঘটতে যাচ্ছে আমাদের ভাগ্যে! মিছিল এগিয়ে যাচ্ছে। তৎকালীন ফুলবাডিয়া বাস স্ট্যান্ডের কাছাকাছি পৌঁছতেই আকস্মিক পুলিশবিহীন শুধু চালক চালিত ঘাতক ট্রাকটি ফুল স্পিডে পিছন থেকে মিছিলের ওপর চালিয়ে দেয়া হলো খুনী জান্তার নির্দেশে। বর্বর ট্রাকের ধাক্কায় আমরা একে অপরের নিচে চাপা পড়লাম। গগনভেদী মর্মন্তুদ আর্তনাদে বর্বর খুনী ট্রাকের চাকায় পিষ্ট হয়ে ঘটনাস্থলে শহীদ হলেন ছাত্রলীগ নেতা ইব্রাহীম সেলিম ও দেলোয়ার হোসেন। চিরদিনের মতো পঙ্গু হয়ে গেলেন আমাদের সংগ্রামের সাথী বাসদ ছাত্রলীগের নেতা আবদুস সাত্তার খান, ছাত্রলীগ নেতা হাবিবুর রহমান হাবীবসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কয়েকজন ছাত্রকর্মী। সে এক নিষ্ঠুরতম হত্যাযজ্ঞ! সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে গণতন্ত্র অর্জনের লড়াইয়ের এক রক্তাক্ত অধ্যায়। পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ব্যবহার করল, নির্বিচারে লাঠিচার্জ করল। কে নেতা কে কর্মী সেই লাঠিচার্জে কোন বাছবিচার ছিল না। মিছিলটি ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল। হতচকিত আমরা কোন কিছু বুঝে ওঠার আগেই এই নির্মম নিষ্ঠুর-পৈশাচিক হত্যাকাণ্ড ঘটে গেল চোখের পলকে। সেলিম, দেলোয়ারের লাশ পুলিশ ছিনিয়ে নিয়ে গেল ঢাকা মেডিক্যালের মর্গে। আমরা যে যার মতো ছিটকে পড়লাম। কিছুক্ষণ পর আমরা কয়েকজন নিজেদের আবিষ্কার করলাম এফএইচ হলের পেছনের দিকে। কবি মোহন রায়হান স্লোগান ধরলেনÑ‘খুন হয়েছে আমার ভাই, খুনী তোর রেহাই নেই।’ সদ্য খুন হয়ে যাওয়া রক্তাক্ত শহীদদের তাজা খুন যেন আমাদের রক্তে দাউ দাউ আগুন জ্বেলে দিল। প্রতিশোধের প্রচণ্ড ক্রোধ আর ঘৃণায় আমরা জ্বলে উঠলাম। আমাদের গলা ফাটানো স্লোগান দিগি¦দিক ছড়িয়ে পড়ল। রাস্তার দুপাশের মানুষ হতবিহ্বল হয়ে জানতে চাইল কী হয়েছে? আমাদের মাত্র কয়েকজনের মিছিল হাজারে পরিণত হলো। বাংলা একাডেমিতে বইমেলা চলছিল। আমরা স্লোগান দিতে দিতে বইমেলায় ঢুকে গেলাম। বইমেলার হাজার হাজার মানুষের বুঝতে বাকি রইল না যে, অবৈধ খুনী জান্তা আবার ছাত্রদের রক্তে বাংলার মাটি ভিজিয়ে, ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে ক্ষমতায় টিকে থাকতে চায়। কবি মোহন রায়হান বাংলা একাডেমির বইমেলার তথ্য কেন্দ্রের মাইক দখলে নিয়ে সেই খুনের ঘটনা বর্ণনা করে আহ্বান জানালেন, ‘স্বৈরশাহী এরশাদের এই ঘৃণ্য, বর্বর হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে, ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে আমরা একুশের বইমেলা বন্ধ ঘোঘণা করছি। সেইসঙ্গে মেলায় উপস্থিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রী এবং সর্বস্তরের জনগণকে বইমেলার তথ্য কেন্দ্রের সামনে এসে আমাদের প্রতিবাদ মিছিলে যোগ দেয়ার অনুরোধ জানাচ্ছি।’ ঘোষণা শুনে মুহূর্তে শত শত ছাত্র-ছাত্রী এবং সাধারণ মানুষ বাংলা একাডেমির তথ্য কেন্দ্রের সামনে ছুটে এসে আমাদের সঙ্গে যোগ দিল। বন্ধ হয়ে গেল বইমেলা। সেলিম, দেলোয়ারের হত্যার কারণে সে বছর আর বইমেলা হয়নি। ‘জ্বালো, জ্বালো আগুন জ্বালো, খুনী এরশাদের গদিতে আগুন জ্বালো একসাথে, খুন হয়েছে আমার ভাই খুনী এরশাদের রেহাই নাই, এরশাদের চামড়া তুলে নেবো আমরা, এ্যাকশন, এ্যাকশন ডাইরেক্ট এ্যাকশন’ এমন বিভিন্ন স্লোগানসহকারে বিরাট মিছিল নিয়ে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের সব হল প্রদক্ষিণ করে ওই হত্যার প্রতিবাদ এবং শ্রমিক-কর্মচারীদের ডাকা হরতাল সফল করার আহ্বান জানাই। ওদিকে শহীদদের লাশ তাদের গ্রামের বাড়িতে পুলিশ পাহারায় পাঠানো এবং দাফন করা হয়। সারাদেশ এই জঘন্য, বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে ফুঁসে ওঠে। স্বৈরাচারবিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলনে ছাত্র-জনতা-শ্রমিক-কর্মচারী ঐক্য সুসংহত করে তোলে। আজ সেলিম-দেলোয়ারের শহীদ হওয়ার দিনে তাদের গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি। সেলিম-দেলোয়ারের আত্মদান সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনকে আরেক ধাপ এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ সামরিক শাসন জারি হওয়ার পর থেকে ১৯৯০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত অপ্রতিরোধ্য গণতান্ত্রিক সংগ্রামে আমাদের হারাতে হয়েছে বহু নেতা-কর্মীকে। অথচ সেলিম-দেলোয়ারসহ অসংখ্য শহীদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত গণতন্ত্র বারবার মুখ থুবড়ে পড়েছে অশুভ শক্তির ষড়যন্ত্রে। আজকের বাস্তবতায় বলতে হয়, বাংলাদেশের নানা ক্ষেত্রে অন্যায়, অবিচার, অনিয়ম, ঘুষ, দুর্নীতি, বিতর্কিত কর্মকাণ্ড কোনভাবেই গণতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো পুরোপুরি বিকশিত হয়নি। নানারকম কেলেঙ্কারিতে দেশের মানুষ বিব্রত। আমরা যেমন সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে জীবন বাজি রেখে আন্দোলন করেছিলাম, সেরকমভাবে গণতান্ত্রিক, মানবিক ও অসাম্প্রদায়িক শক্তিকে আবার ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। বর্তমান সরকারের আমলে বিভিন্ন ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন হলেও কোন কোন ক্ষেত্রে দুর্নীতি ও বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের কারণে সরকারের উন্নয়নের সুফল ম্লান হতে চলেছে। তবুও মুজিববর্ষে আমরা আশা করব, বঙ্গবন্ধুর যে চেতনা, যার ভিত্তিতে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল, সেই চেতনাকে ধারণ করে আমাদের সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। সেলিম দেলোয়ারদের রক্ত যেন বৃথা না যায়। সাড়ে তিন দশক আগের সেই বিভীষিকাময় দিনটি হোক আমাদের চেতনার আলোকিত বাতিঘর। লেখক : স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের ছাত্রনেতা, আওয়ামী লীগ নেতা
×