ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ড. এসএম জাহাঙ্গীর আলম

বিতর্কের উর্ধে রাখতে হবে দেশপ্রেমিক সশস্ত্র বাহিনীকে

প্রকাশিত: ২০:৪৯, ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২১

বিতর্কের উর্ধে রাখতে হবে দেশপ্রেমিক সশস্ত্র বাহিনীকে

বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী গৌরবময় ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। এই বাহিনীকে কোন বিতর্কে জড়ানো উচিত নয়। দেশ ও জাতির স্বার্থে সশস্ত্র বাহিনী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। আমাদের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে এই বাহিনী দিয়েছে বীরত্বের পরিচয়। এদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষায় সদা-সর্বত্র সশস্ত্র বাহিনী সচেষ্ট। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাক হানাদার বাহিনী বাংলার নিরীহ মানুষের ওপর তাণ্ডবলীলা শুরু করলে, অস্ত্র হাতে তুলে নেয় বিদ্রোহী ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট। সেনা, নৌ, বিমান, বিডিআর (সাবেক), পুলিশ, আনসার বাহিনী হানাদার বাহিনীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে একযোগে। তাদের সঙ্গে যোগ দেয় বাংলার মুক্তি সংগ্রামী নারী-পুরুষসহ সর্বস্তরের মুক্তিপাগল মানুষ। সুশিক্ষিত বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী বাংলার স্বাধীনতার জন্য ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছে। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে বাঙালী জাতি ছিনিয়ে আনে চূড়ান্ত বিজয় স্বাধীনতার। প্রকৃতপক্ষে এ বিজয়কে ত্বরান্বিত করেছিল ১৯৭১ সালের ২১ নবেম্বরের সম্মিলিত আক্রমণ। মুক্তিযুদ্ধের স্মারক রক্ষিত হয়েছে চট্টগ্রামের ভাটিয়ারির মিলিটারি একাডেমিতে। অন্যদিকে নেভাল একাডেমিতে নির্মাণাধীন রয়েছে বঙ্গবন্ধু কমপ্লেক্স। ১৯৭২ সালের এপ্রিল মাসে বাংলাদেশ প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদর দফতর অবলুপ্ত হয় এবং প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে তিন বাহিনীর পৃথক পৃথক সদর দফতর প্রতিষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশের সংবিধানের চতুর্থ পরিচ্ছেদের ৬১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী বাংলাদেশ প্রতিরক্ষা কর্মবিভাগসমূহের সর্বাধিনায়ক রাষ্ট্রপতির ওপর ন্যস্ত করা হয়েছে এবং আইনের দ্বারা তার প্রয়োগ নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারের ১১ বছরে সশস্ত্র বাহিনীর আধুনিকায়নে আন্তরিক কর্মযজ্ঞ দেখা দিয়েছে। ইতোপূর্বে ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার সরকারই তৎকালীন সশস্ত্র বাহিনীর জন্য অত্যাধুনিক ও অন্যান্য আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহ করে। পেশাদারিত্ব বাড়ানোর জন্য ইতোমধ্যে ন্যাশনাল ডিফেন্স কলেজ, ওয়ার কলেজ, আর্মড ফোর্সেস মেডিক্যাল কলেজসহ গুরুত্বপূর্ণ বেশ কিছু ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করে। জনবল বাড়ানোর জন্য একটি কম্পোজিট ব্রিগেড, একটি পদাতিক ব্রিগেড, স্পেশাল ওয়ার্কস ব্রিগেড ও বেশ কয়েকটি বিভিন্ন ধরনের ব্যাটালিয়নসহ অন্যান্য উন্নয়ন কর্মসূচী বাস্তবায়ন করা হয়েছে। ২০০৯ সালে সরকার গঠনের পর নতুন কিছু সামরিক সরঞ্জাম কেনা সম্পন্ন করা হয়। তখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘ মহাসচিবের সঙ্গে সাক্ষাতের সময় ফোর্স কমান্ডার বা নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের পদের সংখ্যা বাড়ানোর জন্য অনুরোধ জানিয়েছিলেন। সৈনিকদের কল্যাণের জন্য গ্যারিসনের বা তার আশপাশে পরিবারের সঙ্গে বসবাসের কোটা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। অফিসারদের হাউজিং প্লট দেয়ার প্রক্রিয়া শেষ হয়ে গেছে অনেক আগেই। ২০০৯ সালে বিজিবির সদর দফতর পিলখানায় জঘন্যতম ও পৈশাচিক হত্যাকাণ্ডে যেসব সেনা কর্মকর্তা শহীদ হয়েছেন তাদের পরিবারের জন্য সরকার নানাবিধ উন্নয়নমূলক কাজ করেছে এবং আরও কাজ এগিয়ে চলছে। অন্যদিকে হত্যাকারীদের শাস্তি দেয়ার জন্য দ্রুত বিচার কার্যক্রম সম্পন্ন করা হয়েছে। ২০১৩ সালের ৫ নবেম্বর রায় ঘোষণার মধ্য দিয়ে মেধাবী ও কর্মে নিযুক্ত সেনা কর্মকর্তাদের প্রতি বর্তমান সরকার প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন সম্মানজনকভাবে শেষ হয়েছে। কক্সবাজারে বিমান বাহিনীর ঘাঁটি উদ্বোধন করা হয় ২০১১ সালের এপ্রিল মাসে। ২০১৪ সালের ১১ জুন কয়েকটি হেলিকপ্টার ক্রয় চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে। ২৭ নেভাল একাডেমিতে বিপুলসংখ্যক বিদেশী শিক্ষার্থী অধ্যয়ন করছে। বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের একটি উৎসে পরিণত হয়েছে প্রতিষ্ঠানগুলো। তাছাড়া এখান থেকেই প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা জাতিসংঘের শান্তি মিশনে অংশগ্রহণ করছেন প্রতিবছর। জাতিসংঘ সনদের ষষ্ঠ অধ্যায়ে আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষা এবং সপ্তম অধ্যায়ে শান্তি প্রয়োগের বিধান রয়েছে। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রম সংঘর্ষে লিপ্ত দুপক্ষের সম্মতি এবং মতৈক্যের ওপর ভিত্তি করে শুরু হয়। শান্তিরক্ষা বাহিনীকে সংশ্লিষ্ট পক্ষসমূহ কর্তৃক অনুমোদিত একটি শান্তি চুক্তি বা শান্তি ব্যবস্থা বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে মোতায়েন করা হয়। এ পর্যন্ত জাতিসংঘের ৬৮টি মিশনের মধ্যে ৫৪টিতে ১ লাখ ১৮ হাজার ৯৮৫ জন বাংলাদেশী শান্তিরক্ষী সদস্য অংশগ্রহণ করেছেন। শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে এই মুহূর্তে বাংলাদেশের সদস্য সংখ্যা প্রায় ৮ হাজার ৯৩৬ জন, যা বিশ্বের সর্বোচ্চ। ১৯৯৮ সালে ইরাক-ইরান শান্তি মিশনে যোগদানের মধ্য দিয়ে এদেশের সেনাবাহিনীর ১৫ জন সদস্য জাতিসংঘের পতাকাতলে একত্রিত হয়। বাংলাদেশ নৌ ও বিমান বাহিনী শান্তি মিশনে যোগ দেয় ১৯৯৩ সালে। বাংলাদেশ পুলিশ ১৯৮৯ সালে জাতিসংঘ পরিবারের সদস্য হয় নামিবিয়া মিশনের মধ্য দিয়ে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর শান্তিরক্ষীরা মিশন এলাকায় বিবাদমান দলকে নিরস্ত্রীকরণ, মাইন অপসারণ, সুষ্ঠু নির্বাচনে সহায়তা প্রদান, সড়ক ও জনপথ এবং স্থাপনা তৈরিতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে। কঙ্গো, নামিবিয়া, কম্বোডিয়া, উগান্ডা/রুয়ান্ডা, লাইবেরিয়া, হাইতি, তাজিকিস্তান, কসোভো, জর্জিয়া, পূর্ব তিমুর প্রভৃতি স্থানে শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর নাম সমুজ্জ্বল । উল্লেখ থাকে যে, জাতিসংঘ শান্তি মিশনে বাংলাদেশের সেনা, নৌ, বিমান বাহিনীর মোট ৯৬ জন সদস্য শহীদ হয়েছেন। পুলিশ সদস্য শহীদ হয়েছেন ১৪ জন। অন্যদিকে ২০০০ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ১৮ বছরে শান্তিরক্ষা মিশনের মাধ্যমে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর আয় হয়েছে ২০ হাজার ৪৩৮ কোটি ৮৩ লাখ টাকা। মূলত বিশ্বের বিভিন্ন যুদ্ধবিধ্বস্ত এলাকায় শান্তি প্রতিষ্ঠা ও মানবাধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ইতোমধ্যে জাতিসংঘের বিশ্বস্ত এবং পরীক্ষিত বন্ধু হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। বিশ্বে সকল প্রান্তের দুর্গত, নিপীড়িত ও নিরীহ মানুষের সেবায় বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর হাত সর্বদা প্রসারিত। সংঘাতপূর্ণ ও প্রতিকূল পরিস্থিতিতে নিজেদের জীবনের চরম ঝুঁকি নিয়েও তারা আর্তমানবতার সেবা করে চলেছে। ১৯৭১ সালে সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনী সম্মিলিত হয়েছিল জনতার সঙ্গে। সেই ঐতিহাসিক সম্পর্ক অর্থাৎ জনতা ও সশস্ত্র বাহিনীর পারস্পরিক সুসম্পর্ক আমাদের বর্তমান প্রজন্মের জন্য একটি উদ্দীপক। জাতির প্রয়োজনে অর্পণ করা কঠিন দায়িত্ব পালনে সশস্ত্র বাহিনীর নিষ্ঠা ও আন্তরিকতা অনন্য। দেশের প্রতিরক্ষার জন্য প্রশিক্ষণ আর জনগণের জন্য ভালবাসা- এই দুটি বিষয়কে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর দেশপ্রেম। শান্তিপ্রিয় জাতি হিসেবে আমাদের পররাষ্টনীতি হচ্ছে সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়। প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সুসম্পর্ক রক্ষা করা এজন্যই প্রয়োজন। পাশাপাশি স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য আমাদের সুশিক্ষিত এবং পেশাদার সশস্ত্র বাহিনী থাকাটা অন্যতম শর্ত। আজকের পরিবর্তনশীল বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তিন বাহিনীর ধ্যান-ধারণা, চিন্তা-চেতনার আধুনিকায়ন তথা ডিজিটাল করে যাচ্ছে বর্তমান সরকার। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আমাদের সশস্ত্র বাহিনী জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে অংশগ্রহণ করছে। এই ধারা অব্যাহত এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সমুন্নত রাখার জন্য সশস্ত্র বাহিনী অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধা, সাবেক কর কমিশনার ও পরিচালক- বাংলাদেশ স্যাটেলাইট (ইঝঈখ)
×