ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মিলার ও বড় চাল ব্যবসায়ীদের কব্জায় বাজার আমদানি উন্মুক্ত করার পরামর্শ

নিয়ন্ত্রণহীন চালের বাজার ॥ সিন্ডিকেটের কারসাজি

প্রকাশিত: ২২:০৬, ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২১

নিয়ন্ত্রণহীন চালের বাজার ॥ সিন্ডিকেটের কারসাজি

কাওসার রহমান ॥ সিন্ডিকেটের কারণে নিয়ন্ত্রণে আসছে না চালের বাজার। বরং সরকারের নিয়ন্ত্রিত চাল আমদানির প্রক্রিয়া এই সিন্ডিকেটকে আরও সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। ফলে আমদানির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে চালের দাম। অথচ আমদানির পর উর্ধমুখী ধারায় রাশ পড়ে চালের দাম কমে আসার কথা ছিল। স্থলবন্দর দিয়ে চাল আমদানিও আগের তুলনায় বেড়েছে। কিন্তু কমার পরিবর্তে উল্টো লাফিয়ে বাড়ছে চালের দাম। আর চাল আমদানির অনুমতি প্রদানের পর গত এক মাসে একবার কমলেও চালের দাম বেড়েছে কয়েকবার। বিশ্লেষকরা বলছেন, চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকার ভুল পথে হাঁটছে। এভাবে শর্ত সাপেক্ষে চাল আমদানির নিয়ম করে দেয়ায় শুধু চালকল মালিক ও বড় ব্যবসায়ীরাই চাল আমদানির সুযোগ নিচ্ছেন। আর তারা প্রতিবেশী দেশ থেকে চাল এনে বর্তমান অভ্যন্তরীণ বাজার মূল্যের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বাজারে সীমিত আকারে চাল ছাড়ছেন। ফলে আমদানির পরও চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে আসছে না। এতে বিপাকে পড়েছেন নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষ। তাই এ মুহূর্তে চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে শর্ত উঠিয়ে দিয়ে সবার জন্য চাল আমদানি উন্মুক্ত করে দেয়া উচিত। এতে মুক্ত বাজারের মূল তত্ত্ব প্রতিযোগিতা সৃষ্টি হয়ে বাজারে চালের দাম কমে যাবে। ভেঙ্গে যাবে গুটিকয়েক আমদানিকারকের মাধ্যমে চাল আমদানির সিন্ডিকেট। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাজার নিয়ন্ত্রণে প্রায় এক মাস ধরে ভারত থেকে বেসরকারী উদ্যোগে চাল আমদানি চলছে। এই এক মাসেও কমেনি চালের দাম। উল্টো বরং সারাদেশেই চালের বাজারে উল্লম্ফন দেখা যাচ্ছে। এর কারণ হিসেবে ব্যবসায়ীরা বলছেন, দাম কিছুটা কমার জন্য চালের যে সরবরাহ দরকার ছিল তা হয়নি। ফলে দেশী চালের ওপর চাপ পড়ছে। আর এ চাপের কারণে দাম উর্ধমুখীই রয়ে গেছে। রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে বর্তমানে মিনিকেটের ৫০ কেজির বস্তা ৩০৫০-৩১০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। একইভাবে বিআর আটাশ প্রতি বস্তা ২৪০০-২৫০০ টাকায়, পাইজাম প্রতি বস্তা ২২৫০, ২৩০০ এমনকি ২৪০০ টাকায়ও বিক্রি হচ্ছে। বেশ কয়েক মাস ধরে মিনিকেটের ৫০ কেজির বস্তা ২৭০০-২৮০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছিল। ব্যবসায়ীরা বলছেন, বর্তমানে মোটা চালের দাম ৪৮-৫০ টাকা কেজি। মাঝারি ধরনের চালের দাম ৫৮-৬০ টাকা কেজি এবং চিকন চালের দাম প্রতিকেজি ৬৫-৬৬ টাকা। ডিসেম্বরের দ্বিতীয়ার্ধে এসে বাড়তে শুরু করে চালের দাম। ধাপে ধাপে বেড়ে তা তিন হাজার টাকা ছাড়িয়েছে। এবার বোরো ও আমন মৌসুমে সরকার যে পরিমাণ ধান ও চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছিল তা পূরণ হয়নি। দুই দফা বন্যায় দেশে ধানের উৎপাদন কম হয়েছে। ফলে বাজারে ধানের দাম বেড়ে গেছে। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়েছে চালকল মালিকরা তথা মিলাররা। ধানের দাম বৃদ্ধির অজুহাতে দফায় দফায় বাড়াচ্ছে চালের দাম। এই পরিস্থিতিতে চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখতে সরকার ডিসেম্বরের শেষ দিকে (২৭ ডিসেম্বর) চালের আমদানি শুল্ক ৬২ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে প্রথমে ২৫ শতাংশ করা হয়। এর ফলে ১২ জানুয়ারি থেকে স্বল্পমাত্রায় ভারতীয় চাল বাংলাদেশে ঢুকতে শুরু করে। পরবর্তীতে চালের শুল্ক আরও ১০ শতাংশ কমানো হয়। বর্তমানে সবমিলিয়ে চালের ওপর ১৫ শতাংশ শুল্ক আরোপিত আছে। কিন্তু তার পরও চালের দাম কোনভাবেই নিয়ন্ত্রণে আসছে না। এক কথায় চালের বাজারকে ‘নিয়ন্ত্রণহীন’ বলে আখ্যায়িত করেছেন চাল ব্যবসায়ী ও ক্রেতারা। নিয়ন্ত্রণহীন দামে এই করোনা মহামারীর মধ্যে মানুষকে চাল নিয়ে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। সবচেয়ে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে খেটে-খাওয়া দিনমজুর নি¤œ আয়ের সাধারণ মানুষকে। মধ্যবিত্তও হিমশিম খাচ্ছে প্রতি মাসে ব্যয়ের বাজেট মেলাতে। এ প্রসঙ্গে কারওয়ান বাজারের চাটখিল রাইস এজেন্সির পরিচালক বিল্লাহ হোসেন বলেন, দেশীয় চালের দাম অনেক বাড়তি। পরিস্থিতি সামাল দিতে চাল আমদানির খবর ছড়ালেও আমদানি করা চাল বাজারে দেখা যায়নি। ফলে দেশীয় চালের দামও আর কমেনি। তিনি বলেন, বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য যে পরিমাণ চাল আসার প্রয়োজন ছিল, ভারত থেকে সেই পরিমাণ চাল আসেনি। ফলে বাজার নিয়ন্ত্রণে আসছে না। ভারত থেকে বেসরকারী উদ্যোগে বেশিরভাগ চালই আসছে দিনাজপুরের হিলি বন্দর দিয়ে। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে দ্রুত চাল খালাসে সরকারী নির্দেশনার পর বর্তমানে এই বন্দর দিয়ে চাল আমদানির ট্রাকের সংখ্যা বেড়েছে। আগে যেখানে দৈনিক ৩০ থেকে ৩৫ ট্রাকে চাল আমদানি হতো, বর্তমানে সেখানে ৪৫-৫০ ট্রাকে আমদানি হচ্ছে। এই বন্দর দিয়ে গত ৯ জানুয়ারি থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত ৩৫৪টি ট্রাকে মাত্র ১৪ হাজার ৫শ’ টনের মতো চাল আমদানি হয়েছে। তা সত্ত্বেও গত এক মাসে চাল আমদানির গতি সন্তোষজনক নয়। এই গতিতে চাল আমদানি হলে কখনোই চালের বাজার স্থিতিশীল এবং নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। তবে আমদানিকৃত চাল প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে খালাসের সব ধরনের ব্যবস্থা নিয়েছে কর্তৃপক্ষ। বন্দর থেকে চাল খালাস করে যেন দ্রুত দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করা যায়, সে ব্যাপারে সচেষ্ট রয়েছে কর্তৃপক্ষ। এ প্রসঙ্গে হিলি স্থলবন্দর আমদানি-রফতানিকারক গ্রুপের সভাপতি হারুন উর রশীদ সাংবাদিকদের বলেন, ভারতের অভ্যন্তরে তীব্র যানজটের কারণে সঠিক সময়ে চালগুলো দেশে প্রবেশ করতে পারছে না। ফলে চাহিদামতো চাল আমদানি করা যাচ্ছে না। তবে আমরা রফতানিকারদের ওপর চাপ প্রয়োগসহ বিভিন্ন উপায়ে চাল আমদানির চেষ্টা করছি। এক লাখ টনের অধিক চালের এলসি দেয়া রয়েছে। তিনি বলেন, ‘বর্তমানে চালের দাম বাড়ার কারণ হচ্ছে, শুধু আমদানির ওপর নির্ভরশীলতা। মিলার ও আড়তদারদের কাছে যে চাল মজুত রয়েছে, তারা তা বাজারে ছাড়ছে না। আমদানিকৃত চালের সঙ্গে তারা যদি সঠিকভাবে জমাকৃত চাল ছেড়ে দেয়, তবে অবশ্যই দাম কমে আসবে।’ এর আগে খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন বর্ডারে চালের ট্রাক আটকে আছে, এলেই দাম কমবে। ভারত থেকে আমদানি করা চাল স্থলবন্দরে খালাসে দেরি হওয়ায় তা এখনও বাজারে প্রবেশ করেনি। এ কারণেই অসাধু ব্যবসায়ীরা বাড়তি দামে তা বিক্রির সুযোগ নিচ্ছে। দেশের চালের মোকামগুলোতেও সরকারের বিভিন্ন সংস্থার নজরদারি আছে। তিনি আরও বলেছিলেন, কোন সিন্ডেকেট নেই, আমদানির ক্ষেত্রে এলসি দুই চার পাঁচ জনকে দেয়া হয়নি, ৪০০ জনের পর ব্যবসায়ীকে আমদানির অনুমতি দেয়া হয়েছে। যখন অসাধু ব্যবসায়ী দেখছেন বর্ডারে চাল আটকে পড়ছে সহজে আসছে না এ সুযোগে তারা বাড়তি দামে বিক্রির সুযোগ নিচ্ছে। এর কয়েক দিন পরই অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সীমান্তে চাল খালাসের নির্দেশনা দেয় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড। বর্তমানে অগ্রাধিকার ভিত্তিতেই ভারত থেকে আমদানিকৃত চাল খালাস করা হচ্ছে। কিন্তু তারপরও ফল হয়েছে উল্টো। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে খালাসের পরও বাজারে চালের দাম আরও বেড়ে গেছে। হিলি স্থলবন্দরেই গত কয়েক দিনের ব্যবধানে সব ধরনের চালের দাম কেজিতে ২-৩ টাকা বেড়েছে। তার প্রভাবে দিনাজপুরের বাজারগুলোতেও চালের দাম কেজিতে ২-৪ টাকা বৃদ্ধি পেয়েছে। এই মূল্য বৃদ্ধির পেছনেও কাজ করছে সিন্ডিকেট। মূলত বড় বড় চাল ব্যবসায়ী ও চালকল মালিকরা নামে বেনামে সরকারের কাছ থেকে চাল আমদানির বরাদ্দপত্র নিয়েছে। আবার ছোটখাটো যে সকল ব্যবসায়ী বরাদ্দপত্র পেয়েছে সেগুলোও তারা বড় ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করে দিচ্ছে। কারণ তারা বড় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে পেরে উঠবে না। তাই তারা কিছু মুনাফা নিয়ে বরাদ্দপত্র বিক্রি করে দিয়ে আমদানি প্রক্রিয়া থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে, আবার কিছু ছোট ব্যবসায়ীরা যারা সত্যিকার অর্থে চাল আমদানি করতে চেয়েছিল কিন্তু বড়দের সঙ্গে পেরে উঠবে না বিধায় এলসি খোলা থেকে বিরত রয়েছে। ফলে বড় ঘুরে ফিরে সেই বড় চাল ব্যবসায়ীরাই চাল আমদানিও নিয়ন্ত্রণ করছে। তারা বরাদ্দ পাওয়া কোম্পানির নামে এলসি খুলছে ঠিকই তবে চাল আমদানি করে নিজেদের জিম্মায় রাখছে। সবমিলিয়ে, খাদ্যমন্ত্রী যতই বলুন না কেন সিন্ডিকেট নেই, বড় মিলারদের কারসাজির কারণেই যে চালের বাজার নিয়ন্ত্রণহীন তা এখন সবত্রই দৃশ্যমান। বেসরকারী পর্যায়ে চাল আমদানিতে ধীরগতি ॥ খাদ্য মন্ত্রণালয়ের অনুমতি সাপেক্ষে গত জানুয়ারি থেকে ১৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৩২০টি প্রতিষ্ঠানকে মোট ১০ লাখ টন চাল আমদানির পারমিট ইস্যু করেছে আমদানি ও রফতানি প্রধান নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় (সিসিআইই)। এর মধ্যে ১৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৫ লাখ ৬২ হাজার টন চালের এলসি খোলা হয়েছে। আর বেসরকারী খাতের মাধ্যমে আমদানিকৃত চাল দেশে পৌঁছেছে মাত্র প্রায় দেড় লাখ টন। খাদ্য মন্ত্রণালয় বলছে, সরকারী এবং বেসরকারী মাধ্যমে অন্তত ১৫ লাখ টন চাল আমদানির পরিকল্পনা নেয়া হয়। যার মধ্যে বেসরকারী খাতের মাধ্যমে ১০ লাখ টন চাল আনার পরিকল্পনা রয়েছে। ওই পরিকল্পনা থেকে শর্ত সাপেক্ষে এ পর্যন্ত ৩২০টি প্রতিষ্ঠানকে ১০ লাখ ১৭ হাজার ৫০০ টন চাল আমদানির অনুমতি দেয়া হয়েছে। ১৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুযায়ী ৩২০ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ২৩৬টি প্রতিষ্ঠান শর্ত মেনে চাল আমদানির এলসি খুলেছে। এ সময় পর্যন্ত চাল আমদানির জন্য ৫ লাখ ৬২ হাজার ৮৮৪ টন চাল আমদানির এলসি খোলা হয়েছে। আমদানি ও রফতানি প্রধান নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় জানায়, তারা ৬ জানুয়ারি থেকে ১১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৩২০টি প্রতিষ্ঠানকে প্রায় ১০ লাখ টন চাল আমদানির পারমিট দিয়েছেন। সর্বোচ্চ ৫ শতাংশ ভাঙ্গা দানাবিশিষ্ট বাসমতি নয় এমন সিদ্ধ চাল শর্তসাপেক্ষে আমদানির অনুমতি দেয়া হয়েছে ব্যবসায়ীদের। কয়েক দফা বাড়িয়ে চাল আমদানির জন্য এলসি খোলার অনুমতি গত ১৫ ফেব্রুয়ারি শেষ হয়েছে। এর মধ্যে ২৩৬টি প্রতিষ্ঠান এলসি খুলতে সমর্থ হয়েছে। বাকি যারা পারেননি তাদের অনুমতি বাতিল হয়ে গেছে। যারা এলসি করেছেন পরবর্তীতে তাদের মধ্য থেকেই চাল আমদানির অনুমতি দেয়া হবে বলে জানা গেছে। উল্লেখ্য, চলতি অর্থবছর সরকারের বিভিন্ন কর্মসূচী চালানোর জন্য ডিসেম্বর-জুন মেয়াদে প্রায় ১৩ লাখ টন খাদ্যের প্রয়োজন হবে। অথচ গুদামে খাদ্য মজুদ আছে মাত্র সাড়ে ৭ লাখ টন। মন্ত্রণালয় জানায়, সরকারের কর্মসূচীর জন্য চলতি অর্থবছর আরও ১৩ লাখ ১৯ হাজার টন খাদ্যের প্রয়োজন পড়বে। সরকারী মজুদের ভরসাও আমদানি ॥ বোরোর পর আমন মৌসুমেও ধান-চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা পূরণে ব্যর্থ সরকার। বাজারে ধান-চালের মূল্য বেশি থাকায় এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। ফলে সীমিত হয়ে আসছে মজুতের পরিমাণ। সরকারের সামনে তাই শেষ ভরসা আমদানি। খাদ্য অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, গত বোরো মৌসুমে সরকার নির্ধারিত পরিমাণে ধান-চাল সংগ্রহ করতে না পারায়, আমন মৌসুমে সাড়ে ৮ লাখ টন খাদ্যশস্য সংগ্রহ করতে চেয়েছিল। এর মধ্যে ২ লাখ টন ধান এবং সাড়ে ৬ লাখ চাল কেনার লক্ষ্য ঠিক করেছিল। গত ৭ নবেম্বর শুরু হওয়া সংগ্রহ অভিযান শেষ হবে ২৮ ফেব্রুয়ারি। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৮ লাখ টনের মধ্যে সংগ্রহ হয়েছে মাত্র ৬১ হাজার টন। যা লক্ষ্যমাত্রার মাত্র ৮ শতাংশ। জানা গেছে, গত ৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ধান সংগ্রহ হয়েছে ৮ হাজার ২৭৪ টন। সিদ্ধ চাল ৫২ হাজার ৫৫১ টন এবং আতপ চাল সংগ্রহ হয়েছে ২ হাজার ৯৫০ টন। গত বোরো মৌসুমে সাড়ে ১৯ লাখ টন খাদ্যশস্য সংগ্রহের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হলেও তার অর্ধেকও পূরণ করা যায়নি। চালকল মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ অটো মেজর এ্যান্ড হাসকিং মিল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক কে এম লায়েক আলী বলেন, এবার বোরো-আমন দুই মৌসুমেই বাজারে চালের দাম বাড়তি ছিল। এ কারণে মিলাররা সরকারের ধান-চাল সংগ্রহে আগ্রহ দেখাননি। সংগ্রহ লক্ষ্য পূরণ না হওয়ায় সরকারী গুদামে চালের মজুতও তলানিতে নেমে গেছে। গত ৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৬ দশমিক ৬৯ লাখ টন চাল মজুত আছে। এর মধ্যে চাল ৫ দশমিক ২৮ লাখ টন, আর গম ১ দশমিক ৪১ লাখ টন। কর্মকর্তারা বলছেন, একদিকে করোনাভাইরাস অন্যদিকে দফায় দফায় ঝড়-বন্যায় মজুতের ওপরে চাপ পড়েছে। আবার বোরো সংগ্রহও হয়নি। সব মিলিয়ে মজুত কমেছে। এমন পরিস্থিতিতে সরকার মজুদ বাড়াতে বিভিন্ন দেশ থেকে ১০ লাখ টন চাল আমদানির প্রক্রিয়া চালু রেখেছে। সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ ॥ চালের দাম বৃদ্ধিতে সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ বেড়েছে। সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগে পড়েছে নি¤œ ও মাধ্যম আয়ের মানুষেরা। তারা বলছে, চালের দাম যদি এত বাড়ে, তাহলে গরিব মানুষেরা বাঁচবে কি করে? বর্তমানে সীমিত ও নি¤œ আয়ের মানুষ এমনিতেই পরিবারের সব ব্যয় মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে। দরিদ্র পরিবারের অনেকে ঋণ করে ব্যয় মেটাতে বাধ্য হন। এ দুর্ভোগ দীর্ঘ সময় চললে এর অনিবার্য পরিণতি হিসেবে দরিদ্র পরিবারের সদস্যরা পুষ্টিহীনতায় ভুগবে। হিলি বাজারে চাল কিনতে আসা ভ্যানচালক সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা আশা করছিলাম, ভারত থেকে চাল আমদানি হওয়ার ফলে দাম কমে আসবে। কিন্তু আমদানি হলেও চালের দাম কমবে কী, আরও বাড়ছে। এতে করে আমাদের মতো গরিব মানুষের খুব কষ্ট ভোগ করতে হচ্ছে। সারাদিন ভ্যান চালিয়ে যে আয় হয় তাতে করে এত দামে চাল কিনে খাওয়া অসম্ভব ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। তাই খুব কষ্টে আছি।’ একই বাজারে চাল কিনতে আসা শ্রমিক রেজাউল ইসলাম বলেন, ‘আমরা দিনমুজর মানুষ। অন্যের বাড়িতে কামলা দিয়ে খাই। চালের দাম যেভাবে বাড়ছে, তাতে করে আমাদের সংসার তো চলে না। এক কেজি চাল কিনতে হচ্ছে ৪৫ টাকা বা তারও বেশি দামে।’ অপর দুই ক্রেতা রহিমা বেগম ও নজরুল ইসলাম বলেন, ‘কয়েক দিন আগেও চাল কিনেছি, তাতে করে ভারত থেকে চাল আসার কারণে দাম ৪-৫ টাকা করে কম ছিল। হঠাৎ করে আবারও দাম কেজিতে ৪-৫ টাকা করে বেড়ে গেছে, এতে আমাদের মতো নিম্ন আয়ের মানুষ খুব সমস্যায় আছে।’ অপরদিকে সুনামগঞ্জ পৌর শহরের পুরাতন বাসস্ট্যান্ডে ফজরের আযানের আগে ওএমএসসের চাল নিতে আসেন সাজেদা খাতুন (৩২)। শুধু সাজেদা খাতুন নয়, রাকি বেগম, পলি বেগম, জামাল মিয়া, ফজলু মিয়াসহ শতাধিক অসহায় মানুষ মধ্যরাতে ঘুম থেকে জেগে তাদের ছেলেমেয়েদের মুখে খাবার তুলে দেয়ার জন্য সরকারী ওএমএসসের চালের দোকানের সামনে বসে থাকেন। সাজেদা খাতুন বলেন, ফজরের আযানের আগে পাঁচ কেজি চালের জন্য বাড়ি থেকে বের হয়ে চালের দোকানের সামনে বসে থাকি। কখনও চাউল পাই, আবার কখনও পাই না’। জেলার জলিলপুর গ্রাম থেকে আসা ফজলু মিয়া বলেন, সরকার প্রতিদিন যে চাল দেয় তা কেউ পায় আর কেউ পায় না। ডিলারের দোকানে চাল কেনার জন্য কাড়াকাড়ি শুরু হয়ে যায়। গরিব মানুষের সংখ্যা বেশি তাই চাল-আটার বরাদ্দ বাড়ানো প্রয়োজন। প্রত্যেক ব্যক্তি এক সঙ্গে পাঁচ কেজি চাল বা আটা কিনতে পারেন। পাঁচ কেজি চালের দাম ১৫০ টাকা ও আটার দাম ৯০ টাকা। লক্ষণশ্রী ইউনিয়নের বাসিন্দা জামাল মিয়া জানান, ‘বাজার থাকি চাউল কেনার সামর্থ্য নেই। বাজারের এক কেজি মোটা চাউলের দাম ৪৫ টাকা। এত টাকা দিয়া চাউল কিনমু ক্যামনে। ইতার লায় সরকারী চাউলের লাগি তিন মাইল পথ পারি দিয়া টাউনে আই’। করিম মিয়া বলেন, কোনসময় চালের এত দাম ছিল না। এবার ৩০ টাকার চাল ৪৫ টাকা দিয়ে কিনতে হচ্ছে। এবার আয়-রোজগার কম কিন্তু চালের দাম বেশি। চাল কিনলে বাজার করার পয়সা থাকে না। চালের বাজারে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, স্থানীয়ভাবে চাল কিনতে পারছেন না তারা। আমদানি করা চাল এখনও সুনামগঞ্জের বাজারগুলোতে আসেনি। দিনাজপুর থেকে মোটা বালাম চাল এনে বিক্রি করছেন। স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত চালের দাম অনেক বেশি আবার অন্যদিকে আড়তগুলোতে সে পরিমাণ চাল মজুত নেই। তাই চালের দাম আগের চেয়ে অনেক বেড়ে গেছে। জেলার নুতনপাড়া এলাকার ওএসএস ডিলার রতন লাল ধর বলেন, ১৫ দিনে চালের চাহিদা দ্বিগুণ হয়েছে। প্রতিদিন ভোর থেকে দুপুর পর্যন্ত চাল নিতে আসেন অসংখ্য গরিব অসহায় মানুষ। সবাইকে চাল বা আটা দেয়া যায় না। এক টন চাল বা এক টন আটা নিমিষেই শেষ হয়ে যায়। তাই বরাদ্দ বাড়ানো প্রয়োজন। শুল্ক হার হ্রাসই কী যথেষ্ট ॥ দেশের কৃষকদের উৎপাদিত ধান ও চালের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতের লক্ষ্যে আমদানি নিরুৎসাহিত করতে চালের আমদানিশুল্ক বাড়িয়ে ৬২.৫ ভাগ করে সরকার। এতে ২০১৯ সালের ৩০ মে থেকে বন্দর দিয়ে চাল আমদানি বন্ধ হয়ে যায়। এ বছর আমনের ভরা মৌসুমে চালের দাম বেড়ে লাগামহীন হয়ে পড়ে। দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে ভারতসহ বিভিন্ন দেশ থেকে চাল আমদানির সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। এজন্য প্রথম দফায় শুল্ক ৬২.৫ ভাগ থেকে কমিয়ে ২৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়। পরবর্তীতে ৭ জানুয়ারি রাতে চাল আমদানিতে শুল্ক ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশ করে পৃথক আদেশ জারি করে এনবিআর। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, চালের ওপর আরোপনীয় আমদানি শুল্ক ক্ষেত্রে বিদ্যমান ২৫ শতাংশ থেকে ১০ শতাংশ পরিমাণ এবং সমুদয় রেগুলেটরি ডিউটি থেকে শর্ত সাপেক্ষে অব্যাহতি প্রদান করা হইল। এই প্রজ্ঞাপনে আওতায় চাল আমদানির পূর্বে প্রতি চালানের জন্য খাদ্য মন্ত্রণালয় কর্তৃক মনোনীত কর্মকর্তা থেকে লিখিত অনুমতি নিতে হবে। এটি অবিলম্বে কার্যকর হবে এবং আগামী ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত চালের ওপর নতুন শুল্ক হার বলবৎ থাকবে। তবে বিশেষজ্ঞ এবং অভিজ্ঞ চাল ব্যবসায়ী বলছেন, বাজার নিয়ন্ত্রণে যদি চাল আমদানি করতেই হয় তাবে শুল্ক হার আরও কমাতে হবে। ২০১৭ সালে হাওরে বন্যার কারণে ফসলহানি হলে সরকার ওই সময় লাগামহীন চালের মূল্য নিয়ন্ত্রণে চালের শুল্ক হার শূন্যে নামিয়ে এনেছিল। ওই বছর সরকারী হিসাবে হাওরে বন্যার কারণে ১০ লাখ টন চাল উৎপাদন কম হয়েছিল। তাতেই ওই বছর দেশে চাল আমদানি হয়েছিল ৪০ লাখ টন। এত চাল আমদানির পরও চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি। এবছর উত্তরবঙ্গে তিন দফা বন্যায় আউশ ও আমন ফসলের অনেক ক্ষতি হয়েছে। এতে ১৫-২০ লাখ টন চাল উৎপাদন কম হয়েছে। তাই এ ঘাটতি পূরণে শুল্ক হার শূন্যে নামিয়ে আনা না হলেও অন্তত ৫ শতাংশে নামিয়ে আনা উচিত। তাহলেই কেবল ভারতীয় চালের সুফল পাওয়া যাবে। আর এবারের চালের বাজার নিয়ন্ত্রণের জন্য অন্তত ৫০ থেকে ৬০ লাখ টন চালের প্রয়োজন হবে। এবং ব্যাপকভাবে এই চাল আমাদনির মাধ্যমে বাজার সয়লাব করে দিতে হবে, যাতে দেশীয় চালের ওপর থেকে নির্ভরশীলতা কমে যায়। তাহলেই চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব। বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকারীভাবে খোলা বাজারে চাল বিক্রি করে কখনও চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। বড়জোর মুষ্ঠিমেয় কিছু নিম্ন আয়ের মানুষ চাল কিনতে পারে। তারা হয়তো স্বস্তি পায়। কিন্তু সিংহভাগ মানুষই (নিম্ন ও মধ্যম আয়ের) ওই কর্মসূচীর বাইরে থেকে যায়। এদের সকলের কাছে সরকারের পক্ষে কোনভাবেই চাল পৌঁছে দেয়া সম্ভব নয়। তাই সরকারীভাবে চাল আমদানি করে সেই চাল ওএমএসের মাধ্যমে বিক্রি করে বাজারে অতীতেও কখনও নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি, ভবিষ্যতেও যাবে না। এ প্রসঙ্গে অর্থনীতিবিদ ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী বলেন, ‘আমাদের সামনে এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ হলো- ২০০৭-২০০৮ সালে ব্যাপাক আকারের বিডিআর দিয়ে ডাল-ভাত কর্মসূচী চালিয়েও চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি। ফলে বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে হলে উম্মুক্ত আমদানিই একমাত্র সমাধান। যা বাজারে প্রতিযোগিতা সৃষ্টি করে চালের দাম সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে আসতে পারে।’ এ প্রসঙ্গে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেছেন, ‘চালের যে সমস্যা চলছে তা থাকবে না। এটা সহনীয় হবে। আগামী এপ্রিলের প্রথম দিকে বোরো ধান উঠে যাবে। এরই মধ্যে আমরা ১০ লাখ টন খাদ্য আমদানির উদ্যোগ নিয়েছি। ইতোমধ্যে প্রায় সাড়ে তিন লাখ টন খাদ্য এসেছে। আশা করছি, এক মাসের মধ্যে চালের বাজার স্বাভাবিক হবে।’
×