ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

বিকাশ দত্ত

বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ও সর্বস্তরে বাংলা ভাষা

প্রকাশিত: ২০:২১, ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২১

বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ও সর্বস্তরে বাংলা ভাষা

১৯৭১ সালে ১৫ ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমিতে একুশের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ভাষণে বলেছিলেন, ‘আমি ঘোষণা করছি আমাদের হাতে যেদিন ক্ষমতা আসবে সেদিন থেকেই দেশের সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু হবে। বাংলা ভাষার পন্ডিতরা পরিভাষা তৈরি করবেন, তারপর বাংলা ভাষা চালু হবে সে হবে না। পরিভাষাবিদরা যতগুলো গবেষণা করুন আমরা ক্ষমতা হাতে নেয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলা ভাষা চালু করে দেব। সে বাংলা যদি ভুল হয় তবে ভুলই চালু হবে। পরে তা সংশোধন করা হবে।’ বাহাত্তরের সংবিধানেও বঙ্গবন্ধুর ওই বক্তব্যের প্রতিফলন দেখা যায়। বঙ্গবন্ধুর ওই ভাষণ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আন্তরিক প্রচেষ্টায় বাংলা ভাষা আজ বিশ্বের দরবারে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি (৮ ফাল্গুন ১৩৫৮, বৃহস্পতিবার) বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে আন্দোলনরত ছাত্রদের ওপর পুলিশের গুলিবর্ষণে কয়েকজন তরুণ শহীদ হন। তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন রফিক, জব্বার, শফিউর, সালাম, বরকতসহ অনেকেই। তাই এ দিনটি শহীদ দিবস হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। ২০১০ খ্রিস্টাব্দে জাতিসংঘ কর্তৃক গৃহীত সিদ্ধান্ত মোতাবেক প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারি বিশ্বব্যাপী আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করা হয়। তদানীন্তন পাকিস্তান গণপরিষদের সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত গণপরিষদ অধিবেশনে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার প্রথম প্রস্তাবটি দিয়েছিলেন। ১৯৭১-এ যখন মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে দেশ তখন প্রথম সুযোগেই পাকিস্তানী হানাদাররা হত্যা করে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে। সঙ্গে তার ছেলে দিলীপ কুমার দত্ত শহীদ হন সেদিন। বঙ্গবন্ধু ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে স্বাধীনতা ঘোষণা, মুক্তিযুদ্ধ সব কিছুই করেছেন, যা কোন বাঙালীর পক্ষে সম্ভব হয়নি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্য থেকে তা স্পষ্ট বোঝা যায়। ২১ ফেব্রুয়ারি রবিবার রাজধানীর সেগুনবাগিচায় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের অনুষ্ঠান এবং প্রথমবারের মতো ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা পদক-২০২১’ প্রদান অনুষ্ঠান উদ্বোধনকালে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ভাষা আন্দোলন শুরু করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ছাত্ররা। তখন এ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের ছাত্র ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তরুণ ছাত্রনেতা হিসেবে তাঁরই উদ্যোগে তমদ্দুন মজলিশসহ কয়েকটি সংগঠন ভাষা সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোলে। বঙ্গবন্ধু এ আন্দোলন করতে গিয়েই কারাবরণ করেন। অথচ ভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর প্রতিটি পদক্ষেপ মুছে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছে। ভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর অবদান ছিল অনেক জ্ঞানী-গুণী বুদ্ধিজীবী তা মানতে রাজি হতেন না। অথচ এই আন্দোলনের মধ্য দিয়েই স্বাধীনতা আন্দোলনের বীজ বপন করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ভাষা আন্দোলন থেকেই বঙ্গবন্ধু বাঙালীর মুক্তির সংগ্রাম শুরু করেছিলেন এবং তাঁরই নেতৃত্বে আমরা বিজয় অর্জন করি, স্বাধীন রাষ্ট্র পাই, স্বাধীন জাতি হিসেবে স্বীকৃতি পাই। বৈচিত্র্য রক্ষায় পৃথিবী থেকে বিভিন্ন ভাষা হারিয়ে যাওয়া ঠেকানোর ওপর জোর দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ভাষা মানুষের পরিচয়। এ পরিচয় মানুষকে সম্মানিত করে। আমরা রক্ত দিয়ে সম্মান অর্জন করেছি। এটা আমাদের গৌরবময় অর্জন। যে কোন একটি জাতির জন্য ভাষাটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং মায়ের ভাষায় শিক্ষা নিতে পারা ও মায়ের ভাষায় কথা বলতে গেলে সহজে আমরা শিখতে পারি। কিন্তু দুর্ভাগ্য যে, ধীরে ধীরে অনেক ভাষা হারিয়ে যাচ্ছে। তারপরও বিশ্বব্যাপী ভাষার যে বৈচিত্র্য রয়েছে তার সংরক্ষণ, তার চর্চা এবং বিকাশ একান্তভাবে প্রয়োজন। দেশে আজ সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু হলেও উচ্চ আদালতে এর ব্যতিক্রম রয়েছে। তবে আগের চেয়ে উচ্চ আদালতে বাংলায় রায় দেয়ার বিচারপতির সংখ্যা বাড়ছে। বেশ কিছু বিচারপতি বাংলায় রায় প্রদান করলেও সিংহভাগ বিচারপতি এখনও ইংরেজীতেই রায় প্রদান করে থাকেন। নিম্ন আদালতে ব্রিটিশ আমল থেকেই বাংলা ভাষাতেই বিচারকাজ চলে আসছে। উচ্চ আদালতে হাতেগোনা কয়েকজন বিচারপতি বাংলায় রায় প্রদান করে আসছেন। এদিকে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন (২১ ফেব্রুয়ারি কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে) বলেছেন, অচিরেই সুপ্রীমকোর্টের সব রায় বাংলায় দেয়া হবে। আমরা প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে একটি অনুবাদ সেল গঠন করেছি। তারা এরই মধ্যে কাজ শুরু করেছেন। তিনি আরও বলেন, গত ডিসেম্বরে আমরা একটি সফটওয়্যারের ব্যবহার শুরু করেছি। যার ফলে সুপ্রীমকোর্টের সব রায় ইংরেজী থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাংলায় রূপান্তর হচ্ছে। রূপান্তরের কাজ শেষ হলে আমরা আরও গুছিয়ে নেব। উচ্চ আদালতসহ সর্বক্ষেত্রে বাংলার ব্যবহার নিশ্চিত করতে ‘বাংলা ভাষা প্রচলন আইন, ১৯৮৭’ রয়েছে; সেটা পুরোপুরি বাস্তবায়ন না হওয়ায় আদালতসহ বিভিন্ন সরকারী দফতরকে প্রায়ই সমালোচনার মুখে পড়তে হয়। ওই আইনের তৃতীয় ধারায় বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশের সর্বত্র তথা সরকারী অফিস, আদালত, আধা-সরকারী, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান কর্তৃক বিদেশের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যতীত অন্যান্য সকল ক্ষেত্রে নথি ও চিঠিপত্র, আইন আদালতের সওয়াল জবাব এবং অন্যান্য আইনানুগত কার্যাবলী অবশ্যই বাংলায় লিখিতে হইবে।’ ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে দুর্বার আন্দোলনে শরিক হয়েছিলেন সালাম, জব্বার, শফিক, বরকত ও রফিকসহ আরও অনেকে। তাদের রক্তের বিনিময়ে বাঙালী জাতি পেয়েছিল মাতৃভাষার মর্যাদা। আর সে কারণেই ভাষা শহীদদের এবং ভাষার মাসকে সম্মান জানাতে গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টার মামলায় বাংলাতে রায় ঘোষণা করেছে হাইকোর্ট। মাতৃভাষায় কথা বলা, লেখার মধ্যে অন্যরকম মাধুর্য আছে। মনের ভাব প্রকাশ করা যায়। সাধারণ জনগণ থেকে সবাই তা বুঝতে পারে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের আদালতগুলোতে মাতৃভাষায় রায় প্রদান করা হয়ে থাকে। জার্মানি, জাপান, ফ্রান্স, স্পেন, চীন, নেদারল্যান্ডসসহ বিভিন্ন দেশের আদালতগুলোতে মাতৃভাষাতেই রায় প্রদান করা হচ্ছে। প্রায় ৩০০ বছর আগেও যুক্তরাজ্যের আদালতের দাফতরিক ভাষা ছিল ফ্রেঞ্চ ও ল্যাটিন। ওই সময় সেখানকার আদালতে ইংরেজীতে শুনানি হলেও সব নথি লেখা হতো ল্যাটিনে। ১৮৮৬ সালে দেওয়ানি আদালত সৃষ্টির পর থেকে আজ পর্যন্ত নিম্ন আদালতে সিংহভাগ মামলাতে বাংলাতেই বিচার কাজ চলছে। বাংলাতেই রায় প্রদান করা হচ্ছে। কেউ কেউ ইংরেজীতেও রায় লিখছেন। ভাওয়াল সন্ন্যাসী নিয়ে অনেক নাটক, সিনেমা হয়েছে। সেই ভাওয়াল সন্ন্যাসী মামলার আর্জি ১৯৩০ সালে বাংলাতেই লেখা হয়। এমনকি বিবাদীপক্ষে তার জবাবও বাংলাতেই লেখা হয়েছিল। বেশ কয়েকজন সিনিয়র জেলা জজের সঙ্গে আলাপ করে দেখা গেছে তারা বিচারকাজ বাংলাতেই করছেন। রায়ও বাংলাতেই দিচ্ছেন। তাদের সাফ কথা আমরা রায় ইংরেজীতে দেইনি। আমার কোন অসুবিধা হয়নি। এতে করে বাদী-বিবাদী সবাই মামলার বিষয়বস্তু বুঝতে পারে। রায় নিয়ে কোন আইনজীবীর কাছে দৌড়াতে হয় না। আইনজীবীরা বলেছেন, আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যাবে। উচ্চ আদালতে বাংলা চালু একদিনে হবে না। অনেকেই বাংলায় রায় দিচ্ছেন। আস্তে আস্তে এই প্রচলন চালু হবে। বেশিরভাগ আইন ব্রিটিশ আমলের। সে সমস্ত নজির বিএলডি, ডিএলআর এগুলো ইংরেজীতে রয়েছে। এসব বাংলা হওয়া উচিত। সংসদে আইনগুলো বাংলা করার উদ্যোগ নেয়া দরকার। সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালুর সদিচ্ছা নিয়ে ১৯৮৭ সালে জাতীয় সংসদে পাস হয় বাংলা ভাষা প্রচলন আইন। এরপরও সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচলন হয়নি। সুপ্রীমকোর্টের উভয় বিভাগে বাংলা ভাষার ব্যবহার বাধ্যতামূলক করতে আইন কমিশন সরকারের কাছে সুপারিশ পাঠালেও তাও কার্যকর হয়নি। সংবিধানের ৩ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা।’ এ বিধান যথাযথভাবে কার্যকর করতে বাংলা ভাষা প্রচলন আইন করা হয়। উল্লিখিত আইনের ৩ (১) ধারায় বলা হয়েছে, ‘এ আইন প্রবর্তনের পর বাংলাদেশের সর্বত্র তথা সরকারী অফিস-আদালত, আধা-সরকারী ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান কর্তৃক বিদেশীদের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যতীত অন্যান্য সব ক্ষেত্রে নথি ও চিঠিপত্র, আইন-আদালতের সওয়াল-জওয়াব এবং অন্যান্য আইনানুগ কার্যাবলী অবশ্যই বাংলায় লিখতে হবে।’ এরপরও আদালতের ভাষা হিসেবে বাংলা তার কাক্সিক্ষত মর্যাদা পায়নি। দেওয়ানি ও ফৌজদারি কার্যবিধি আইন, দন্ডবিধি, সাক্ষ্য আইন ইত্যাদি সেই সময় প্রণয়ন করা হয়েছিল এবং সাধারণ আইনী কাঠামোয় ব্রিটিশ আইনসভা ১৮৬১ সালে ভারতীয় হাইকোর্ট আইন প্রণয়ন করে যার মাধ্যমে তিনটি প্রেসিডেন্সি শহরে (কলকাতা, বোম্বে ও মাদ্রাজ) প্রতিষ্ঠিত বিদ্যমান সুপ্রীমকোর্ট প্রতিস্থাপন করে হাইকোর্ট স্থাপন করা হয়। হাইকোর্ট প্রতিষ্ঠার পর দেওয়ানি ও ফৌজদারি আদালতের একটি নিয়মিত ক্রমঅধিকারতন্ত্র দেওয়ানি আদালত আইন, ১৮৮৭ এবং ফৌজদারি কার্যবিধি আইন, ১৮৯৮-এর মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। ভারতীয় উপ-মহাদেশের দেওয়ানি ও ফৌজদারি আদালতে বিদ্যমান বর্তমান ব্যবস্থার আইনগত ভিত্তি হচ্ছে এই দেওয়ানি আদালত আইন, ১৮৮৭ এবং ফৌজদারি কার্যবিধি আইন, ১৮৯৮। ইংরেজরা চলে যাবার পর এখনও নিম্ন আদালতে বাংলা ভাষাতেই বিচারকাজ চলছে। ভাওয়াল সন্ন্যাসী মামলাটি একটি ঐতিহাসিক মামলা। মামলাটি শুরু হয় ১৯৩০ সালে আর শেষ হয় ১৯৪৬ সালে। আদালতে প্রকাশ্যে বিচারকার্য শুরু হয় ১৯৩৩ সালের ২৭ নবেম্বর। বিচারক পান্না লাল বসু ১৯৩৬ সালের ২৪ আগস্ট ৫৩২ পৃষ্ঠার রায় দেন। উভয়পক্ষে সাক্ষ্য দেন ১৫৪৮ জন। এর মধ্যে বাদীপক্ষে ১০৬৯ জন। প্রমাণ হয় আলোচিত সন্ন্যাসীই ভাওয়ালের মেজ কুমার রমেন্দ্র নারায়ণ রায়। উচ্চ আদালত সূত্রে জানা যায়, বেশ কয়েকজন বিচারপতি বাংলায় রায় লিখে যাচ্ছেন। এই সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। পাশাপাশি সুপ্রীমকোর্টে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে একটি অনুবাদ সেল গঠন করা হয়েছে। এর ফলে এখন থেকে বাংলাতেই রায় পাওয়া যাবে। লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক
×