ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

মাদারীপুরে শতবর্ষী মাকে রাস্তায় ফেলে ঢাকায় ফিরে গেলো মেয়ে

প্রকাশিত: ১৪:৫৮, ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২১

মাদারীপুরে শতবর্ষী মাকে রাস্তায় ফেলে ঢাকায় ফিরে গেলো মেয়ে

নিজস্ব সংবাদদাতা, মাদারীপুর ॥ ঢাকার নিজের বাসা থেকে এনে মাদারীপুরের শিবচরে প্রায় শতবর্ষী বৃদ্ধা মাকে রাস্তার পাশে ফেলে আবার ঢাকায় ফিরে গেলো নিজের মেয়ে পার্বতী রানী মন্ডল। সন্ধায় ক্ষুধা-তৃষ্ণায় কাতরাতে দেখে আনোয়ার নামের এক ভ্যান চালক মায়ের মমতায় তাকে উদ্ধার করে নিজের বাড়িতে যায়। পরের দিন বৃদ্ধার দেয়া ঠিকানায় তার এক আত্মীয়ের বাড়িতে পৌছে দেন ভ্যান চালক আনোয়ার। বর্তমানে নাতনীর বাড়িতে আপাতত আশ্রয় হয়েছে সহায় সম্বলহীন বৃদ্ধা শ্যামপ্রিয় বৈরাগীর। বৃদ্ধা শ্যামপ্রিয় বৈরাগী ও তার পারিবারিক সুত্রে জানা গেছে, শিবচর উপজেলার শিরুয়াইল ইউনিয়নের সাদেকাবাদ গ্রামের মৃত রাজমোহন বৈরাগীর স্ত্রী শ্যামপ্রিয় বৈরাগী। শ্যামপ্রিয় বৈরাগী, মেয়ে পার্বতী, সরস্বতী, ছেলে কুমোদ বৈরাগী, সত্য বৈরাগী ও নিত্য বৈরাগীকে রেখে প্রায় ৩০ বছর আগে রাজমোহন বৈরাগী মারা যান। সেই থেকে ২ মেয়ে ও ৩ ছেলেকে নিয়েই ছিলেন শ্যামপ্রিয় বৈরাগী। ৩ ছেলের মধ্যে বড় ছেলে কুমোদ বৈরাগী গত ১৯ বছর আগে মারা যায়। মেঝো ছেলে সত্য বৈরাগী কিডনী রোগে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘদিন ধরে বিছানায় পড়ে আছেন। ঢাকাতে স্ত্রীর উপার্জনের টাকায় কোনমতে চিকিৎসা চলছে তার। ছোট ছেলে নিত্য বৈরাগী কলকাতায় পাড়ি দিয়ে নিরুদ্দেশ আছেন বহু বছর ধরে। ছোট মেয়ে সরস্বতী বিয়ের পর থেকেই স্বামীর সাথে কলকাতায় থাকেন। তার সাথেও পরিবারের তেমন যোগাযোগ নেই। আর শ্যামপ্রিয় বৈরাগীর বড় মেয়ে পার্বতী মন্ডল ঢাকার আগারগাঁও থানার তালুকদার রোড এলাকার চতুর্থ তলার একটি ফ্লাটে স্বামীর সাথে বসবাস করেন। তার স্বামী দিনা মন্ডলের রয়েছে লোহার গ্রীলের ব্যবসা। গত প্রায় ৪ বছর আগে পার্বতী তার মা শ্যামপ্রিয় বৈরাগীকে নিজের কাছে রাখার জন্য গ্রামের বাড়ি সাদেকাবাদ থেকে ঢাকায় নিয়ে যায়। প্রথম অবস্থায় মেয়ের বাসায় সুখ ও শান্তিতেই ছিলেন শ্যামপ্রিয় বৈরাগী। ২০২০ সালে করোনা শুরুর পর থেকে বৃদ্ধা মাকে ঘর থেকে সরিয়ে বাসার বেলকনির খালি জায়গায় স্থান করে দেয় মেয়ে পার্বতী ও তার পরিবার। বেলকনিতেই তাকে খাবারও দেওয়া হতো। চোখের জলে খেয়ে না খেয়ে বেলকনিতেই দিন পার করছিলেন বৃদ্ধা শ্যামপ্রিয়। তবে এতেও যেন বোঝা হালকা হচ্ছিল না মেয়ে পার্বতীর। তাই গত ১৮ ফেব্র“য়ারি মেয়ে পার্বতী মন্ডল ঢাকা থেকে একটি গাড়িতে করে বৃদ্ধা মা শ্যামপ্রিয় বৈরাগীকে গ্রামের বাড়ি শিবচরের সাদেকাবাদ এলাকায় নিয়ে আসে এবং ওই এলাকার একটি কাঁচা রাস্তার পাশে মাকে ফেলে ঢাকায় ফিরে যায় পার্বতী। রাস্তার পাশে পড়ে ক্ষুধা-তৃষ্ণায় কাঁদছিলেন অসহায় শ্যামপ্রিয়। ওইদিন সন্ধার দিক স্থানীয় এক ভ্যান চালক আনোয়ার মিয়া তাকে দেখতে পেয়ে নিজ বাড়িতে নিয়ে যায়। পরে বৃদ্ধা শ্যামপ্রিয় মাদবরচর ইউনিয়নের ডাইয়ারচর গ্রামের তার বড় ছেলের মেয়ে নাতনী রিতা রানী মন্ডলের শশুর বাড়ির কথা বলে। পরের দিন শুক্রবার ভ্যান চালক আনোয়ার বৃদ্ধাকে তার নাতিন জামাই ডাইয়ারচর গ্রামের দয়াল মন্ডলের ছেলে জগদীশ মন্ডলের বাড়িতে পৌছে দেয়। বর্তমানে সেখানেই নাতনির আছেন শ্যামপ্রিয় বৈরাগী। ভ্যান চালক আনোয়ার মিয়া বলেন, ‘গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় সাদেকাবাদ রাস্তার পাশে মায়ের বয়সী বৃদ্ধাকে পড়ে থাকতে দেখে অসুস্থ্য অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে আমার বাড়িতে নিয়ে যাই। তিনি তার নিকটাত্মীয় মাদবরচর ইউনিয়নের ডাইয়ারচর গ্রামের দয়াল মন্ডলের ছেলে জগদীশ মন্ডলের কথা বলে। তাই শুক্রবার সকালে আমি তাকে তার আতœীয়ের বাসায় পৌছে দেই।’ বৃদ্ধার নাতিন জামাই জগদীশ মন্ডল বলেন, ‘পৃথিবীতে সন্তান দেখেছি। এমন নিষ্ঠুর সন্তান কোথাও দেখিনি। প্রায় শতবর্ষী বৃদ্ধা মাকে কিভাবে রাস্তার পাশে ফেলে দিয়ে গেল। এটা আমি বুঝে উঠতে পারছি না।’ বৃদ্ধার নাতনী রিতা রানী মন্ডল বলেন, ‘নিজের বয়স্ক ভাতার টাকা উত্তোলন করে আমার দাদী তার এই মেয়েকে দিয়েছে। সেই মেয়ে মাকে নিজের বাসায় নিয়ে অনেক কষ্ট দিয়েছে। যদি নিজের মায়ের ভরণ-পোষনের এতই কষ্ট হচ্ছিল তাহলে আমার বাড়িতে রেখে গেলেও পারতো। তা না করে রাস্তায় ফেলে গেলো কেন ?’ শ্যামপ্রিয় বৈরাগী বলেন, ‘অনেক আগেই চোখের জল ফুরিয়ে গেছে। এখন আর কাঁন্না করার শক্তি নেই। মেয়ের বাসায় চার বছর ধরে ছিলাম। করোনার পর থেকে ফ্লাটের খোলা বেলকনিতে থাকতে হয়েছে। কষ্ট সহ্য করতে না পেরে রাত জেগে একা একা কাঁন্না করেছি। আমার পেটের মেয়ে আমাকে গাড়িতে করে তুলে এনে রাস্তার পাশে এভাবে ফেলে যাবে কখনো বুঝে উঠতে পারিনি। তবুও চাই ওরা সুখে থাকুক।’ বৃদ্ধার মেয়ে পার্বতী মন্ডলের স্বামী দিনা মন্ডলের মোবাইল নম্বরে ফোন দিয়ে সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি কথা না বলে ফোন কেটে দেন। পরবর্তীতে একাধিকবার ফোন দিলেও তিনি আর রিসিভ করেননি।’
×