ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

তছলিম হোসেন হাওলাদার

ব্ই ॥ গভীর বোধের কথামালা

প্রকাশিত: ০০:৩১, ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২১

ব্ই ॥ গভীর বোধের কথামালা

নিভৃতচারী কবি ইকবাল পারভেজ। তার কবিতা যাপনের অভিঘাতকে প্রাধান্য দেয়। সহজ-সরল শব্দ গেঁথে তিনি কবিতা লিখেন। কিন্তু তার ভাব-কল্পনা মোটেই সহজ-সরল নয়। এ জন্য পাঠককে মাথা ঘামাতে হবে। উদাহরণ হিসেবে তার লেখা ‘আমার যতো উচ্চারণ’-এর নাম কবিতাটি তুলে ধরছি : ‘ব্যঞ্জনবর্ণ নিজে নিজে উচ্চারিত হতে পারে না/তুমি আমার স্বরবর্ণ/আমার যত উচ্চারণ/তোমায় ঘিরে।/তুমি অব্যয়/ও এবং/আমাদের বর্ণমালার জীবন।’ এ কবিতাটি পড়ে যে কারোরই মনে হবে এতো খুবই সহজ। মনে হবে যেন সবই বুঝে ফেলেছি। কিন্তু বুঝতে কি পেরেছি? আমার মনে হয় পঙ্ক্তিগুলো তিনি তার সহধর্মিণীকে উদ্দেশ করে লিখেছেন। আবার মনে হলো কথাগুলো তার গোপন প্রিয়ার জন্য সাজিয়েছেন। তবে মজার বিষয় হলো এই, কবিতার কথা বুঝতে পারা না-পারা নিয়ে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হলেও এর বুনন-রীতির উৎকর্ষতা নিয়ে কোন প্রশ্ন জাগে না। আর এই কবিতায় যে উপমা ব্যবহার করা হয়েছে তা খুব উঁচু মনে হয়। নাম কবিতার মতো চমৎকার কবিতা আরও আছে এই বইতে। তেমনি একটি কবিতা হলো ‘রেডিও’। প্রথম স্তবকে ইকবাল পারভেজ লিখেছেন : ‘রেডিও অন সকাল ছ’টা/কালামে পাক থেকে পাঠ করেন ক্বারি মোঃ হাবিবুল্লা/এই হারামজাদারা উঠোছ না.../তোগো পড়া নাই লেখা নাই/আমাদের ঘরে যুগপৎ দুই রেডিও বাজে দিনরাত/কোনোটাই বন্ধ হয় না আর।’ এই কবিতায় আমাদের বাস্তব জীবনের দুটো ধারা পাই। একটি হলো আধ্যাতিকতা এবং অন্যটি দৈনন্দিন যাপন। যেমন: একদিকে ক্বারি হাবিবুল্লাহ কালামে পাক শোনান, অন্যদিকে স্ত্রী বাচ্চাদের বকাবকি করে পড়ায় তাগিদ দেয়। অবশ্য কবি লেখার শেষাবধি আঙুল উঁচিয়েছেন স্ত্রীর দিকেই, বলেছেন ‘আমাদের ঘরে যুগপৎ দুই রেডিও বাজে দিনরাত’। দুটি রেডিওর একটি হলো রেডিও, অন্যটি তার স্ত্রী! কবিতার শেষ দিকে তার উল্লেখও আমরা পাইÑ ‘রেডিও মানে স্ত্রী/অমন মধুর।’ জীবনবাস্তবতা সম্পর্কে কবি পুরোপুরি জ্ঞাত। তাই ‘সম্পর্ক’ কবিতায় তিনি মন্তব্য করতে পারেন : ‘সম্পর্কের নাম সেতু/এপার ওপার ভেসে থাকা এক কুমির।/কুমিরের পিঠে চড়ে নদী পার হওয়ার নাম জীবন।’ ‘আমার যত উচ্চারণ’ কাব্যগ্রন্থে কবি ইকবাল পারভেজের দর্শনবিদ্ধ কিছু কবিতার চরণ আমাকে মুগ্ধ করেছে। দুটি উদাহরণ দিচ্ছি : ক) ‘একদিন দেখি, গুলিস্তান মোড়ে/শূন্য কিলোমিটারের মাইলফলক এক/চিন্তায় গেছি পড়ে/পথের এ শুরু না শেষ/শূন্য কিলোমিটারে দাঁড়িয়ে থাকা আমি এক পথিক।’ (কবিতা : শূন্য) খ) ‘একদিন ঈশ^রের মুখোমুখি দাঁড়াবো যখন/অবাক চোখে দেখবো/অবিকল আমারই মতন/দাঁড়িয়ে আছেন আমার ঈশ^র।’ (কবিতা : আয়না) আগেই উল্লেখ করেছি, ইকবাল পারভেজের কবিতা পড়লে মনে হবে ভাব খুব সহজ-সরল। কিন্তু কবিতার প্রকৃত ভাব-উদ্ধার করা সহজ নয়। তার কবিতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো ‘রাজনীতি’। এই রাজনীতি হলো বঙ্গবন্ধু, বাংলাদেশ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতি অঙ্গীকারাবদ্ধ থাকার রাজনীতি। তাইতো তার কবিতার শিরোনাম হয় ‘জয় বাংলা’। আরেকটি উল্লেখযোগ্য কবিতা ‘মুক্ত বাংলাদেশ’। এই কবিতায় কারো নাম উল্লেখ না করেই বলা হয়েছে কবি কাজী নজরুল ইসলামের কথা, যাকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নাগরিকত্ব দিয়ে বাংলাদেশে ফিরিয়ে এনেছেন। তাঁর স্লোগান ছিল জয় বাংলা (কবিতার)। আবার অন্য একজন রাষ্ট্রপ্রধানও পাকিস্তান থেকে একজনকে ফিরিয়ে এনে দিয়েছেন নাগরিকত্ব। এর নামও কবিতায় উল্লেখ করা হয়নি। কিন্তু এর স্লোগান ছিল ‘জিন্দাবাদ’। এই স্লোগান দিয়েই আমরা লোকটাকে চিনি। তিনি হলেন, বাংলাদেশের শত্রু, গণদুশমন গোলাম আজম। কবিতায় কবি জয় বাংলার জয়ের প্রত্যাশী। তাইতো তিনি আহ্বান জানানÑ ‘যুদ্ধে চলো, ভোটে চলো/জয় বাংলা বলো/স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করছি একবার/এবার যুদ্ধ করবো বারবার।’ বইটির সার্বিক সাফল্য কামনা করছি।
×