ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

শারমিন সুলতানা তন্বী

কালের বিবর্তনে ভারমুক্ত হবে

প্রকাশিত: ০০:২৫, ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২১

কালের বিবর্তনে ভারমুক্ত হবে

বাঙালী হিসেবে আমাদের অসংখ্য জটিল রসায়নগুলোর মধ্যে সময় সাপেক্ষে প্রাসঙ্গিক একটি হলো বাংলা ভাষার প্রতি নিবেদিত বিসর্জন ও বাংলাকে অস্তিত্ব থেকে ভীষণভাবে বর্জন। আর সমষ্টিগতভাবে এই স্ববিরোধী পরিবর্তনটির ফল হলো এই যে, ফেব্রুয়ারি মাসটি ভাষার মাস, অন্য মাসগুলো ভাষার উপরে ত্রাস। জানা কথার কাসুন্দিই যদি ঘাঁটি তবুও এই কাসুন্দির আলাপন অযৌক্তিক ও অপ্রয়োজনীয় নয়। বলছি বাংলা ভাষার জন্য জীবন দেয়া বাঙালীর অনুরাগ কী রূপে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিপরীতমুখী স্রোতে প্রবাহিত হয়েছে আর সেই স্রোতধারা তার সীমানা কতটা ছাড়িয়েছে তার কথা। আমরা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ইতিহাসের শরণাপন্ন হই ইতিহাসের ধারায় পরিবর্তিত ঘটনাপ্রবাহকে বোঝার জন্য। কারণ ভবিষ্যতের গতিবিধি ইতিহাসই বলতে পারে। অতীত ও বর্তমান কে বিশ্লেষণ করে আমরা ভবিষ্যতের ধরনকে ধরার চেষ্টা করি। এমতাবস্থায় যদি মুক্তবুদ্ধির চারণভূমিতে এই সত্য মাথাচাড়া দেয় যে ইতিহাসের গতিপথ আধুনিকতা নামক স্বেচ্ছাচারিতায় প্রতিনিয়ত বদলায়, অতীতের বোধ ভবিষ্যতের চেতনায় ক্রমাগত ধারহীন হয়ে পড়ে, তবে আমরা তো অবধারিতভাবে ভিত্তিহীন হয়ে পড়ব, হয়ত পড়েছিও অনেকটা। আর এই ভিত্তিহীন বিভ্রান্ত আমরা তা-ই হয়ত শিক্ষিত হয়েও এটা বলতে গর্ববোধ করি যে, আমি আসলে বাংলা তেমন একটা পারি না। অবশ্যই এমন বক্তব্যে অপারগতাজনিত কোন গ্লানি থাকে না, থাকে এক প্রকার অকারণ বীভৎস বড়াই আর সঙ্গে ইংরেজী পারার গৌরবে আত্মহারা অভিলাষ। যে জাতি বাংলা ভাষার জন্য জীবন দিয়েছে সে জাতিই সময়ের বিবর্তনে বাংলার জন্য বরাদ্দ করেছে কেবল একটি মাস, ফেব্রুয়ারি। এ মাসে বাংলা ভাষা কেন্দ্রিক কিছু নৈতিক কথা হবে, কিছু টকশো হবে, কিছু পরিকল্পনা হবে, কিছু স্মৃতিচারণ হবে, কিছু আলোচনা সভায় কী হওয়া উচিত ছিল বা কী হলে ভাল ইত্যাদি আলোচনা হবে আর মূলত হবে কিছুই না। উন্নতির পেছনে ছুটতে ছুটতে আমরা যেমন প্রায়ই ভুলে যাই প্রগতির কথা, তেমনি এটাও আমাদের মনে থাকে না যে, একটা ছোট্ট বৃক্ষের যত্নের প্রয়োজন হয় শাখা-প্রশাখা বিস্তার করে মাটিতে শেকড় বাড়িয়ে ফল দিতে। তাহলে আজকের প্রশ্ন হলো, যে ভাষায় হাসি-কাদি, চিৎকার করি আর যে ভাষায় ভালবাসি সে ভাষার এগিয়ে যাওয়ায় কতটা যত্ন ঢেলেছি ব্যক্তিগত জায়গা থেকে? আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে আমরা ভাষা নিয়ে পড়াশোনা, গবেষণা, লেখা, শিক্ষকতা করা ইত্যাদি প্রতিটা বিষয়কে মূল্যহীনতার এমন একটি জায়গায় এনে ফেলেছি যে, ভাবতেই বড় অদ্ভুত লাগে জীবনটা এই বাংলা ভাষার জন্য দিয়েছিল পূর্বপুরুষেরা! সেদিন কি কেউ জানত যে এদিনের চিত্রটা এমনতর হবে? নাকি সে আত্মবিসর্জন শুধুই ছিল সময়ের প্রয়োজন যার কার্যকারণ এ বেলায় শেষ হয়ে গেছে। অনেকেই এ মাসে আবেগী হয়ে বলবেন যে, না- বাংলা ভাষা গুরুত্বপূর্ণ আজও। কিন্তু বস্তুতই কি তাই? বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা থেকে শুরু করে চাকরি পাওয়ার আগে ও পরে সর্বত্রই বাংলা জানার মূল্য নেই, বাংলা ভাষায় পড়ার বাজার দর নেই। দেশটা বাংলা বলে সব না হলেও অনেক প্রতিষ্ঠান বাংলা লালন করতে বাধ্য হয়, কিন্তু সেটা বাধ্য বাধকতার জায়গা থেকে পালন সর্বস্ব, এতে ধারন করা বা বয়ে নিয়ে যাওয়া হয় না আদৌতে। আর ভাষার সবচেয়ে বেশি অসম্মানটা হয় ব্যক্তিগত পর্যায় থেকে। আমরা স্বপ্নই দেখি আমাদের সন্তান ইংরেজী তে কথা বলতে পারলেই হয়, আর কিছু জানুক আর না জানুক। কিন্তু প্রজন্ম যে আমাদের কী ভয়ানকভাবে বাংলায় পিছিয়ে যাচ্ছে তা নিয়ে ঐতিহ্যবাহী জাতি হিসেবে আমাদের কোন মাথাব্যথা নেই। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অনেকে জানেনই না যে সন্তানকে ঠিক কেন তিনি বা তারা ইংরেজীর দিকে ঠেলে দিচ্ছেন। শুধু ভাষা শেখার জন্য? নাকি সাহিত্য শেখার জন্য? সে প্রশ্নের উত্তর তো আরও জটিল। যে জাতি নিজের সাহিত্যই জানে না, সে যাবে অন্যের সাহিত্য শিখতে বা শেখাতে! অর্থাৎ কোন এক অজানা অভিপ্রায়ে ইতিহাসের সত্যকে আমরা সময় ও প্রয়োজন সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় বা অপ্রয়োজনীয় করে দিয়েছি। কথায় বলে বাংলা আমার, কাজে করে ইংরেজীর জয়জয়কার। খুব সম্ভবত পৃথিবীতে একমাত্র বাঙালীই নিজ মাতৃভাষাকে অপমান করে সগৌরবে আত্মঘাতী হয় অবলীলায়। আর শুধু লোক দেখানো সংস্কৃতির অংশ হিসেবে ফেব্রুয়ারি পালন করতে বইমেলার চত্তর কাটে আর ড্রয়িংরুমে রাখা সাজানো লাইব্রেরির ছবির বিজ্ঞাপন দেয় সামাজিক অবস্থান ঠিক রাখতে। আর পরক্ষণেই যদি শোনো নিজেদের কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা নিয়ে পড়ছে তখনি সে শিক্ষার্থীর যোগ্যতা নিয়ে মনে মনে বা কখনও কখনও সামনে প্রশ্ন তোলে। এতে যে সেই শিক্ষার্থীর অপমানের চেয়ে মাতৃভাষার অপমানটা বেশি হয় তার দায় অবশ্য কারও নয়। কেউ বিশেষ মর্যাদা কিংবা বিশেষ সহায়তা দিয়ে বাংলা ভাষার চলার পথ প্রস্তুত করে না কোনভাবেই। টিকে থাকার লড়াই সবার যেখানে সমান সেখানে যেন অস্তিত্বকে সমুন্নত রাখার দায় কারোই নেই। এই যদি হয় ভাষাপ্রেমী ইতিহাসের ধারাবাহিকতা, তবে তো হুমকির মুখে সকলমূলমন্ত্র যা আজ না হলেও কাল জায়গা হারাবে নতুন কিছুর আবির্ভাবে। সেই সঙ্গে অস্তিত্ব সঙ্কটে ভুগবে জাতীয় ও ব্যক্তিগত সকল ভিত্তি। আর প্রজন্ম জানবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সব বদলায়। এটা ভুল নয়। সবই ঠিক। কাল যেটা ছিল জীবনের মূলমন্ত্র আজ সেটা সেকেলে। আজকের শিশুর ভুবনে রাজত্ব করবে কালের অপরিণামদর্শী আগ্রাসন। ফেব্রুয়ারিও কালের বিবর্তনে ভারমুক্ত হবে, বাংলা ভাষা চলমান প্রবাহ হারিয়ে রয়ে যাবে স্থিত প্রত্যয় হয়ে যার নব নব প্রশাখার উদ্বোধন না হলেতার জন্য দায়ী থাকবে না কেউই। শহীদের আত্মত্যাগ রয়ে যাবে কেবলি সময়ের দাবির দখলে। আন্তর্জাতিক ভাষার বিপক্ষে নয়, মাতৃভাষার পক্ষে বলছি- আমরা মর্যাদা দিতে ভুলে গেছি নিজেদেরই অস্তিত্বকে। বই মেলার দর্শক হয়ে ভিড় করে নয়, পাঠক হয়ে এটা বোঝার উপযুক্ত সময় বহু আগে পেরিয়ে গেছে যে, আমরা সঠিক ধারায় প্রবাহিত হচ্ছি না বোধহয় কোথাও কোথাও। বাকিটা অনুধাবনের ও করণীয় নির্ধারণের দায় ব্যক্তি ভেদে আপেক্ষিক।
×