আমি মুচি।
আমার বাপে মুচি।
আমার দাদায় মুচি।
আমার চৌদ্দগোষ্ঠী মুচি।
আমার দাদায় জুতা সেলাই করত গেরামে বসে।
আমার বাবায় করত গঞ্জে বা থানা সদরে বসে।
আমি চলে এসেছি রাজধানীতে।
প্রথম প্রথম বসতাম কাওরান বাজারে।
দিন ভালই চলত, বেশ আয় হতো।
কিন্তু পরিবেশটা ছিল ঘিনঘিনে।
এরপর ভাবলাম।
কাওরান বাজারের এত কাছে এফডিসি।
শুনেছি ওহানে প্রতিদিন ফিলিমের নায়ক নায়িকারা আসে, অইখানে না গেলে কেমনে অয়।
কিন্তু জুতা মালিশ, জুতা সেলাইয়ের কাজ ফেলে ওখানে গেলে তো হবে না?
কি করি?
নায়ক-নায়িকারা কখন আসে-যায় বলার উপায় নাই।
তাছাড়া ভেতরে না গেলে দেখার উপায় নাই।
সবাই নাকি গাড়িতে চড়ে ভেতরে ঢুকে যায়।
তার পরও দিনের শুরুতে ও শেষে প্রতিদিন দুই বার জুতা মালিশের বাক্সটা নিয়া এফডিসির সামনে গিয়ে খাড়াইয়া থাকি।
খোদার তিরিশ দিনই যাই বলতে গেলে।
একদিন গেটের দাঁড়োয়ান কয়- অই মিয়া তোমার কি এটা জুতা মালিশের বাক্স?
আমি কই হু।
হেয় কয়- দেও তো দিহি আমার জুতা মালিশ করে।
তা দেব।
কিন্তু বসব কোথায়?
এগুলো তো খুলে পেতে আসন গেরে বসতে হবে।
দারোয়ানে কয় এইডা কোন সমস্যা এই এফডিসিতে?
তুমি ভেতরে ঢুকো।
কোথায় বসবা বসো।
শেষে দারোয়ানদের জন্য বসার ঘরের দরজার মুখে বসে জুতা মালিশ করলাম খুব সময় নিয়ে, মনোযোগ দিয়ে।
দারোয়ানে কয় কয় টেহা দিমু?
আমি কই, টেহা পয়সা লাগব না।
হেতে কয়, কও কি মিয়া?
তাই লে তো ভালই অইল।
একটা চা খাও।
তা খাওন যায়।
এই তো ভাব জমে গেলে।
চা খেতে খেতেই আরও ক’জন জুটে গেল তাদের জুতা মালিশ করে দিতে হবে।
দারোয়ানে কয় তোমার তো ভালই জমে গেছে।
এর পরে মাঝখানে বেশ কয়দিন ইচ্ছে করেই আর যাইনি।
কি ভাই তুমি যে এই ক’দিন আইলা না?
সময় করে উঠতে পারিনি।
সময় করে উঠতে পারনি মানে?
তোমার জন্য আমার বউয়ের জুতা ব্যাগে করে নিয়া ঘুরতাছি।
ফিতা ছিঁড়ে গেছে।
কই, দেন দেহি।
তারপর বসে গেলাম এফডিসির ভেতরে গিয়ে।
ওই দিনও জুতা মালিশের ভিড়।
শেষে দারোয়ানে কয়- এই মিয়া তুমি এক কাজ কর।
প্রতিদিন বিকেল বেলা তুমি বরং এখানে চলে এসো,
তোমার সবকিছু গুটিয়ে।
পয়সাপাতি খারাপ পাবা না।
আমি মনে মনে কই আমি তো এইডাই চাইছিলাম।
প্রতিদিন এখানে বসে বসে নায়ক-নায়িকাদের অনেককেই দেখা হয়ে গেল।
রাজ্জাকরে দেখলাম
শাবানারে দেখলাম
কবরীরে দেখলাম
ববিতারে দেখলাম
হুমায়ুন ফরিদীরে দেখলাম
মৌসুমীরে দেখলাম
শাবনূরকে দেখলাম
ফেরদৌসকে দেখলাম
আলমগীরকে দেখলাম
এ রকম প্রায় সবাইকে দেখলাম।
এরপর একদিন দেহি কি আমাগো এলাকার বাচ্চু রাজাকারের পুত!
রাজাকারের পুত রাজাকার, আরিফ রাজাকার ঢুকতেছে। আমি হুনছিলাম হেতেও নাকি ফিলিমে ঢুকেছে।
হেতের বাপে বাচ্চু রাজাকার আমাগো বড় একটা জমি দখল কইরা হালাইছে।
একাত্তরে আমার বাবারেও অত্যাচার করছে।
এফডিসিতে ঢুকে আমারে হুনাই হুনাইয়া কয় মুচির বাচ্চা মুচি এখানে কি করে?
এই কথা হুই না আমি আর এক মুহূর্তও দেরি করি নাই।
বাক্স গুটাইয়া হালাইলাম। এফডিসি থেকে বের হয়েই আমাগো এলাকার উকিল সাবরে, বন্দে আলী মিয়াকে ফোন করলাম।
উনি হাইকোর্টে ওকালতি করেন।
ওনার বাপে অইলেন শহীদ মুক্তিযোদ্ধা। উনি ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হবার আগে লন্ডনে গেছিলেন ব্যারিস্টারি পড়তে।
ফিরা আইস্যা দেহেন ওনার বাপে শহীদ।
দেশটাও স্বাধীন।
ওনাকে ফোনে বাচ্চু রাজাকারের পোলা আরিফ রাজাকারের কথা কইলাম।
ওনারা যে আমাদের জমি দখল করে আছে হেইডাও কইলাম।
উনি আমারে কইল, কালকে হাইকোর্টে তার চেম্বারে দেখা করতে।
উনিই আমাকে বুদ্ধি দিলেন তুমি বরং হাইকোর্টের আশপাশে জুতা পালিশ করতে পার। আর আমাদের জমির কেসটাও উনি মামলায় লড়বেন।
উনি আমাকে জানালেন বাচ্চু রাজাকারের নামে যুদ্ধাপরাধের মামলা হচ্ছে।
আমি যেন অই মামলায় সাক্ষী দেই।
আমি তো এক পায়ের ওপর খাড়া।
এরপর থেকে আমি হাইকোর্টের সামনেই জুতা মালিশ করি।
টাকা পয়সা ভালই কামাই।
এর মধ্যে করোনা এসে সব গুবলেট করে দিল।
কোর্ট-কাছারি তো চলে না।
যাও খুলল, তাও আবার ডিজিটাল না ফিজিটাল, কম্পিউটারে কোটঁ চলে।
তা তো বুঝলাম।
কিন্তু কোর্টে যদি মানুষ না আহে জুতা মালিশ করব কে?
জুতা মালিশ না করলে টেহা দেব কে?
কোর্ট না হয় ডিজিটাল অইল।
কিন্তু জুতা মালিশ কি ডিজিটাল সম্ভব?
ওনারা আছেন খালি নিজেগোর ভাল নিয়া।
আমগো মুচিগোর ভালডা কি কেউ দেখব না?
আমরা মুচিরা কি মানুষ নয়?
আরো পড়ুন
শীর্ষ সংবাদ: