ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

খাদ্য নিরাপত্তায় উন্নত জাতের ধান আবাদ করছেন জুমিয়ারা

প্রকাশিত: ২৩:০৪, ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২১

খাদ্য নিরাপত্তায় উন্নত জাতের ধান আবাদ করছেন জুমিয়ারা

ওয়াজেদ হীরা ॥ খাগড়াছড়ি সদর উপজেলার ভাইবোনছড়া এলাকার মংশি মারমা জুম চাষ করেন কয়েক দশক। সর্বশেষ যে ফলন পেয়েছেন তাতে জুমে এবার ভাল ধান হয়েছে এবং ৮ মাস চালের যোগান আসবে তার, তাই চিন্তাও কম। স্থানীয় জাতের পাশাপাশি এবার হাইব্রিড জাত চাষ করেন তাতে বেশ ভাল ফলন পান। উন্নত জাতের ধান চাষে অংলা মারমার এবার জুমের ফলন ভাল হয়েছে। জুমে ধান ও শাক-সবজি ভাল হয়েছে অংলা মারমার। পার্বত্য অঞ্চলে পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে হয় জুম চাষ। খাদ্য নিরাপত্তায় বিভিন্ন প্রকার স্থানীয় ধানের পাশাপাশি হাইব্রিড ধানও চাষ করেছেন জুমিয়ারা। ধানের পাশাপাশি লাউ, মিষ্টি কুমড়া, শসা, বাঙ্গি, ঢেঁড়স, ভুট্টা, পুঁইশাকসহ নানা শাক-সবজিও চাষ করেছেন জুমিয়ারা। জুম চাষীদের মূলত জুমিয়া নামে ডাকা হয়। পাহাড়ের ঢালকে চাষাবাদ উপযোগী করে বৈশাখ-জ্যেষ্ঠ মাস থেকে ধান ও বিভিন্ন শাক-সবজির বীজ বপন করেন জুমিয়ারা। বৃষ্টির পানি সেচ কাজে ব্যবহার করে ফলানো ফসল কাটা করা হয় ভাদ্র-আশ্বিন থেকে। কয়েক দশক আগেও এ চাষাবাদে জুমিয়াদের আগ্রহ থাকলেও দিন দিন তা কমছে। তবে জুম চাষীরা যেন ভাল উৎপাদন করতে পারে সে লক্ষ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামে গবেষণা কার্যক্রম করছে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি)। আর ব্রি’র পরামর্শে অনেক জুম চাষী উন্নত জাত আবাদ করে সফলও হয়েছেন। সামনে আরও বেশি করে উন্নত জাতের ধান আবাদের প্রস্তুতিও নিচ্ছেন। খাদ্য নিরাপত্তা উৎপাদন বৃদ্ধিসহ পাহাড়ে কয়েকটি কার্যক্রম হাতে নিয়েছে কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীন এই প্রতিষ্ঠানটি। জানা গেছে, পার্বত্য চট্টগ্রামের খাগড়াছড়ি, বান্দরবান ও রাঙ্গামাটি এই তিন জেলাতে চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, তঞ্চঙ্গ্যা, লুসাই, পাংখো, বম, ম্রো, খিয়াং, খুমি, চাক এই ১১টি নৃ-গোষ্ঠীসহ বাঙালীরা বাস করে আসছে যাদের প্রধান পেশা কৃষি। এ সকল অঞ্চলের জুম চাষীরা সনাতন পদ্ধতিতে জুমচাষ করে থাকে। ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের কর্মকর্তারা জানান, উপযুক্ত উচ্চফলনশীল জাত ও উৎপাদন উপকরণ সঠিক মাত্রায় ব্যবহার না করার কারণে তারা কাক্সিক্ষত ফলন পান না। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে জুম চাষীদের জুমে উৎপাদিত ধানে তাদের বছরের ৫-৭ মাস চলে। বাকি মাসগুলোর খাদ্য সংস্থানের জন্য বিভিন্ন কাজকর্ম যেমন, বয়ন, হস্তশিল্প, দিনমজুরি, রাজমিস্ত্রী, গাড়িচালনা, নার্সারি ইত্যাদি কাজ করে অত্যন্ত কষ্টে দিনাতিপাত করতে হয়। অন্যান্য এলাকার মতো পাহাড়ী জনগোষ্ঠীর সারাবছরের খাদ্যের যোগান নিশ্চিত করতে এবং জুমচাষ পদ্ধতি উন্নয়নের মাধ্যমে এর উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে উদ্যোগ নেয় বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট। ব্রি সীমিত পরিসরে ‘পাহাড়ী অঞ্চলে নেরিকাসহ অন্যান্য উন্নত ধানের জাতের গ্রহণযোগ্যতা ও লাভজনকতা নির্ধারণ’ কর্মসূচীর অর্থায়নে পার্বত্য তিন জেলার বিভিন্ন উপজেলায় পাহাড়ের ঢালে তথা জুমে এবং পাহাড়ের পাদদেশে সমতলে বিগত তিন বছরে (জুলাই ২০১৭-জুন ২০২০) গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করেছে এবং বর্তমানে সরকারী অর্থায়নে গবেষণা কাজ চলমান আছে। একাধিক তথ্যে জানা গেছে, দেশের মোট আয়তনের শতকরা ১২ ভাগ পাহাড়ী এলাকা যার শতকরা ৯ ভাগ শুধুমাত্র রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান এই তিন পার্বত্য এলাকাজুড়ে অবস্থিত। পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের আবহাওয়া ও মাটির বৈশিষ্ট্য জুমচাষের জন্য উপযোগী। এখানকার প্রায় ৪০ হাজার পরিবার প্রত্যক্ষভাবে জুমচাষের সঙ্গে সম্পৃক্ত এবং এ অঞ্চলের আদিবাসীরা যুগ যুগ ধরে তাদের সুপ্রাচীন ঐতিহ্য ধরে রাখতে বংশ পরম্পরায় জুমচাষ করে আসছে। এই চাষাবাদে নারী-পুরুষ উভয়ই সারাবছর বিভিন্ন কাজে আত্মনিয়োজিত থাকে। পাহাড়ের ঢালে একটা ধারালো দা দিয়ে ছোট ছোট গর্ত করে তারমধ্যে অনেক রকম ফসলের বীজ একসঙ্গে মিশিয়ে বুনে আবাদ করা হয়। পাহাড়ের জঙ্গলাকীর্ণ জমির জঙ্গল কেটে রোদে শুকিয়ে তাতে আগুন লাগিয়ে নির্বাচিত জমিকে কৃষিজ উৎপাদনের আওতায় আনা হয়। আদি কৃষিপ্রথার এ পদ্ধতিকে এজন্য অনেকে জঙ্গল কাটা ও পোড়ানো কৃষি পদ্ধতি হিসেবে আখ্যায়িত করেন। জুমচাষ একই জমিতে বছরের পর বছর ধরে অবিরামভাবে করা হয় না বিধায় একে স্থানান্তরিক কৃষি পদ্ধতিও বলা হয়ে থাকে। জুমিয়ারা জুমে একসঙ্গে প্রায় ৩০ থেকে ৩৫টি ফসলের আবাদ করে থাকে। কেউ কেউ আবার তাদের জুমে মাত্র ১৭/১৮টি ফসলও করে থাকেন। বান্দরবানের লামা উপজেলার মিনঝিড়ি পাড়ার চাতিং চাকমা বলেন, আমি প্রায় ২০টি ফসল একসঙ্গে চাষ করি। অন্য কিছু করার সুযোগ কম থাকে তাই এটিই ভরসা। জানা গেছে, এখন পর্যন্ত ধান, সবজি, অর্থকারী ফসল, ফল, মসলা ইত্যাদির জন্য বছরের বেশিরভাগ সময় জুমিয়ারা জুমের ওপর নির্ভরশীল। এ কারণেই পাহাড়ী এলাকার স্থানীয় জনগণ জুমচাষকেই খাদ্য ও জীবন রক্ষার একমাত্র অবলম্বন হিসেবে গ্রহণ করেছে। খাগড়াছড়ির দীঘিনালা উপজেলার সীমানা পাড়া এলাকার জুমিয়া সজীব ত্রিপুরা বলেন, আগে আমরা জুমে শুধু স্থানীয় ধানের চাষ করতাম। গত বছর আমরা হাইব্রিড ধানের পাশাপাশি উচ্চ ফলনশীল জাতের শাক-সবজিও চাষ করে ফসল ভাল পেয়েছি। এদিকে, জুমচাষীদের খাদ্য নিরাপত্তায় উদ্যোগ হিসেবে কৃষিমন্ত্রণালয়ের গবেষণা সংস্থা ব্রি নানামুখী উদ্যোগ নিয়ে কাজ করছে। পাহাড়ী বিশাল এলাকাকে খাদ্য উৎপাদনের যথাযথ অংশীদার করার লক্ষ্যে জুমে পাহাড়ীয়াদের প্রচলিত সিস্টেমকে বিঘ্নিত না করে তাদের স্থানীয় জাতের পাশাপাশি ব্রি উদ্ভাবিত উচ্চ ফলনশীল আধুনিক আউশ বিআর- ২৬, ব্রি ধান-৪৮, ব্রি ধান-৮২, ব্রি ধান-৮৩ এবং ব্রি ধান-৮৫ জাতের চাষ করছে এবং কৃষকেরা জাতগুলোর তুলনামূলক উচ্চফলনশীলতার জন্য গ্রহণ করেছে। ব্রি থেকে জানা গেছে, আধুনিক উচ্চফলনশীল জাতের গড় ফলন প্রতি হেক্টরে ৩.৫০ টন যেখানে তাদের চাষকৃত স্থানীয় জাতের গড়ফলন প্রতি হেক্টরে ২.০ টন। আসন্ন আউশ মৌসুমে জুমে সম্প্রতি উদ্ভাবিত ব্রি ধান-৯৮ এবং ব্রি হাইব্রিড ধান ৭ অন্তর্ভুক্ত করা হবে। জুমচাষীরা জানিয়েছেন, জুমচাষে কোন সার ব্যবহার করা হয় না। তবে কিছু কিছু কৃষক কিছু ইউরিয়া সার ব্যবহার করলেও তা আবার কার্যকর ও বিজ্ঞান সম্মতভাবে করে না। এই চাষকৃত ধানের পুষ্টি উপাদান সরবরাহের লক্ষ্যে ব্রি মাধ্যমে সার ব্যবস্থাপনার ওপর গবেষণা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে বলে জানা গেছে। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. শাজাহান কবীর জনকণ্ঠকে বলেন, আমাদের সারাদেশের খাদ্য উৎপাদন কিভাবে আরও বৃদ্ধি পাবে নতুন জাত আসবে এসব নিয়েই গবেষণা কার্যক্রম চলে। গবেষণা কার্যক্রমেরই একটি অংশ পাহাড়ে গবেষণা করা। টেকসই কৃষি উন্নয়নের একটি প্রধান লক্ষ্য হলো ২০৩০ সালের মধ্যে ক্ষুধা নির্মূল করা এবং সবার জন্য খাদ্যের সরবরাহ নিশ্চিত করা বিশেষ করে দরিদ্র মানুষের জন্য খাদ্য ও পুষ্টির সরবরাহ নিশ্চিত করা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনায় কৃষিবান্ধব নীতি প্রণয়ন ও সময়োপযোগী বিভিন্ন প্রযুক্তি ব্যবহার নিশ্চিতের পদক্ষেপ গ্রহণ করায় দেশ খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। আমাদের কৃষিমন্ত্রীর সার্বিক দিক নির্দেশনায় আমরা কাজ করছি যাতে খাদ্যের কোন ঘাটতি না থাকে।
×