ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

নানা জটিলতায় অকার্যকর হয়ে আছে নতুন আইন

মেরিন ফিশিং সেক্টরে নৈরাজ্য ও স্বেচ্ছাচারিতা

প্রকাশিত: ২৩:০৩, ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২১

মেরিন ফিশিং সেক্টরে নৈরাজ্য ও স্বেচ্ছাচারিতা

মোয়াজ্জেমুল হক ॥ নব সংশোধিত সামুদ্রিক মৎস্য আইন-২০২০ সম্পূর্ণভাবে অকার্যকর হয়ে আছে। অনিয়ম, দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতা ও নৈরাজ্যের কবলমুক্ত করতে মেরিন সেক্টর নিয়ে নতুন আইন প্রণীত হয়েছে। অথচ, সে আইনেও সৃষ্টি হলো একাধিক জটিলতা। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের পক্ষে নতুন এ আইন পুনঃ সংশোধনের প্রক্রিয়া গ্রহণ করা হলেও সেটাও ঝুলে আছে। এর ফলে মেরিন ফিশিং সেক্টরজুড়ে ইতোপূর্বেকার ন্যায় স্বেচ্ছাচারিতা ও নৈরাজ্য চলমান রয়েছে। ডীপ সী ফিশিং ভেসেল মেরিনার্স ফোরাম, এক্স ক্যাডেট এ্যাসোসিয়েশনসহ এ সেক্টরের সঙ্গে জড়িত সংশ্লিষ্টদের পক্ষে অবিলম্বে নতুন প্রণীত সামুদ্রিক মৎস্য আইন পুনঃসংশোধন করে তা কার্যকর করার দাবিতে ইতোমধ্যে মৎস্য ও পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়সহ সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরকে অবহিত করা হয়েছে। উল্লেখ করা যেতে পারে, ১৯৮৩ সালে প্রণীত সামুদ্রিক মৎস্য আইনের কারণে স্বেচ্ছাচারিতা, জটিলতা, অনিয়ম, দুর্নীতি ও নানা অপকর্ম চলমান থাকায় এ আইনের সংশোধনের দাবি ওঠে। দীর্ঘ প্রক্রিয়া শেষে ২০২০ সালের ডিসেম্বর মাসে সংশোধিত সামুদ্রিক মৎস্য আইন সংসদে উত্থাপনের পর তা পাস হয় এবং তা সঙ্গে সঙ্গে কার্যকর হওয়ার কথা। কিন্তু নব প্রণীত আইনেও অনিয়ম ও স্বেচ্ছাচারিতার সুযোগ থাকায় বাণিজ্যিক ফিশিং, ট্রলার মালিক ও শ্রমিকরা তাৎক্ষণিক ধর্মঘটে যায়। ফলে সাগরে মাছ ধরা বন্ধ হয়ে যায়। এ ঘটনায় মন্ত্রণালয়ের পক্ষে মৌখিকভাবে নতুন এ আইন আপাতত কার্যকর হবে না জানান দিলে ধর্মঘটের অবসান ঘটে। এর ফলে এ সেক্টর চলছে পুরনো আইনেই। সাগরে মৎস্য আহরণে সব ধরনের নৌযানের সেইলিং পারমিশন প্রদান করা হচ্ছে। সূত্র জানায়, দেশের মেরিটাইম সেক্টরে অপারেশনাল জাহাজের সংখ্যা রিভার ট্রেডে ১২০০০, ওশান ট্রেডে মার্চেন্ট জাহাজের সংখ্যা ৫০, ফিশিং ভেসেলের সংখ্যা ২৫২। এক্ষেত্রে দেশের মোট বাণিজ্যের ৮৭ ভাগ পরিবাহিত হয় জাহাজযোগে। এক্ষেত্রে মেরিন ফিশিং সেক্টরে প্রথমত জাহাজ তৈরির অনুমতি, তৈরি, রেজিস্ট্রেশন, সার্ভে, মেরিন ফিশিং লাইসেন্স ইস্যু এবং সেইলিংয়ের অনুমতি প্রক্রিয়ায় বর্তমানে স্বেচ্ছাচারিতা ও নৈরাজ্য অব্যাহত। সূত্র জানায়, নতুন আইন প্রণীত হওয়ার পর তা কার্যকর হওয়ার আগেই স্থগিত হয়ে যায়। এরপর মন্ত্রণালয়ের পক্ষে নতুন করে সংশোধনের কিছু ধারা, উপধারা তৈরি করা হয়। এ ধারা-উপধারাও আপত্তিকর হওয়ায় তা নিয়ে মেরিন সেক্টরের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলো সরকারের কাছে তাদের বক্তব্য প্রেরণ করেছে। কিন্তু সবই এখন ঝুলে গেছে। এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে ডীপ সী ফিশিং ভেসেল মেরিনার্স ফোরামের প্রধান সমন্বয়ক ক্যাপ্টেন শামসুল ইসলাম রাশেদী জানান, নতুন প্রণীত আইনে ২৩টি বিধির অধিকাংশ বিধি-উপবিধিতে আপত্তিকর ও অগ্রহণযোগ্য বিষয়াদি রয়েছে। তাঁর মতে, আলোচ্য সামুদ্রিক মৎস্য বিষয়ক আইন ২০২০ এবং সামুদ্রিক মৎস্য বিষয়ক বিধিমালা ২০২১-এ প্রয়োজনীয় পরিশোধন, পরিবর্তন-সংযোজন করা হলে দেশের ফিশিং সেক্টরে অগ্রগতি আসবে। পাশাপাশি সামঞ্জস্যপূর্ণ একটি মেরিন ফিশিং ভেসেল চলাচল আইন ও মেরিন ভেসেল ফিশিং চলাচল বিধিমালা প্রণয়ন করা গেলে গোটা এ সেক্টর উপকৃত হবে। এদিকে সরকারী সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, নতুন প্রণীত আইনে নানা অসামঞ্জস্য রয়েছে। এ আইন প্রণয়নকালে যা পরিলক্ষিত হয়নি। ফলে নতুন করে সংশোধনীর খসড়া তৈরি করা হয়েছে। অথচ, এ খসড়া নিয়েও নানা আপত্তি তুলেছে ডীপ সী ফিশিং ভেসেল মেরিনার্স ফোরাম। তাদের যত আপত্তি তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। উল্লেখ করা যেতে পারে, দেশের ৭১০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে কোস্টাল বেল্টের ৩২ শতাংশ এলাকার জনপদ ৪৭ দশমিক ২১১ বর্গকিলোমিটার বেষ্টিত হয়ে আছে উপকূল অঞ্চল। বর্তমান সরকারের আমলে ১ লাখ ১৮ হাজার ৪১৩ বর্গ নটিক্যাল এলাকার সামুদ্রিক অর্থনৈতিক অঞ্চলের অধিকারী হয়েছে দেশ। সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে সামুদ্রিক সম্পদ এবং সামুদ্রিক ৪৭৫ প্রজাতির মৎস্যের সুষম আহরণের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন এবং আয়োডিনসমৃদ্ধ সামুদ্রিক মৎস্য প্রোটিনের যোগানদানের প্রক্রিয়া। সূত্র মতে, নতুন প্রণীত আইনটি হতে পারত ‘বাংলাদেশ ফিশিং ভেসেল চলাচল আইন-২০২০।’ কিন্তু তা হয়নি। এ আইনে বহু অপ্রত্যাশিত এবং অগ্রহণযোগ্য ধারা সংযোজিত হয়েছে। যে কারণে মেরিন ফিশিং পেশায় জড়িত জাহাজ মালিক, অপারেটর, মেরিন অফিসার, নাবিক, ফিশ মার্কেটিংয়ে জড়িতসহ গোটা কমিউনিটিতে একটি অস্বস্তিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়ে আছে। নতুন আইনে আন্তর্জাতিক কনভেনশনসহ আইএরও-আইএমও নির্দেশিত ফিশিং সংক্রান্তে অন্যান্য কনভেনশনের নির্দেশনার প্রতিফলন ঘটেনি। এ আইনে ফিশিং ভেসেল অফিসার নাবিকদের চাকরি, ট্রেনিং, ওয়েজেস, মেডিক্যাল ফ্যাসিলিটি, পারিবারিক সোশ্যাল সিকিউরিটিসহ পেশাগত আইনী সুরক্ষা নিশ্চিত হয়নি। বরং বিভিন্ন ক্ষেত্রে অপরাধের শাস্তির নামে জেল -জরিমানা, উচ্চমূল্যের অর্থদণ্ড এবং বিনা প্ররোচনায় গ্রেফতার, সে-ই ব্রিটিশ আমলের ক্রিমিনাল প্রসিডিউর এ্যাক্ট ১৮৯১-এর আওতায় মেরিন ফিশিং কার্যক্রমের কল্পিত অপরাধের বিচারকে অন্তর্ভুক্ত করে এ সেক্টরের সঙ্গে জড়িতদের অপমানজনক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সূত্র জানায়, সরকারের ব্লু ইকোনমি বা সুনীল অর্থনীতি প্রসারে মেরিন ফিশিং সেক্টর অন্যতম মূল চালিকা শক্তি। এছাড়া মেরিটাইম আইনসমূহের মূল প্রতিপাদ্য হচ্ছে প্রথমত, সেফটি অব লাইফ এ্যাট সী, দ্বিতীয়, সেফটি অব প্রপার্টি এ্যাট সী, তৃতীয়ত, সেফটি অব মেরিন এনভায়রনমেন্ট, চতুর্থ, সেফটি অব সী রিসোর্সেস। নতুন আইনে এসব বিষয় কার্যকর হওয়ার ক্ষেত্রে ব্যাপক প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়ে আছে। এছাড়া এসব বিষয়ের মধ্যে বিভিন্ন ধারায় আপত্তিজনক বক্তব্য সংযোজিত হয়েছে। সূত্র জানায়, বাংলাদেশে চলমান ইনল্যান্ড শিপিং অডির্ন্যান্স ১৯৭৬-এর সারসংক্ষেপ, বাংলাদেশ শিপিং এ্যাক্ট ২০২০-এর সারসংক্ষেপ, মেরিন ফিশারিজ অডির্ন্যান্স ১৯৮৩ এবং সামুদ্রিক মৎস্য আইন ২০২০-এর তুলনামূলক চিত্র নিয়ে পর্যবেক্ষণে আনা বাঞ্ছনীয়। এক্ষেত্রে ফিশিং ভেসেল যোগ্যতাসম্পন্ন শিপ সার্ভেয়ার, শিপ রেজিস্ট্রার, শিপ এক্সামিনার প্রক্রিয়াটি চলছে গোঁজামিল দিয়ে। ডীপ সী ফিশিং ভেসেল মেরিনার্স ফোরামের পক্ষে বৃহস্পতিবার জানানো হয়, নতুন প্রণীত আইনের বিধিতে অগ্রহণযোগ্য কিছু সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে। এছাড়া আর্টিশনাল ও যান্ত্রিক মৎস্য নৌযান, ফিশিং শার্ট, সরকার ঘোষিত মৎস্য জলসীমা নিয়ে যে ধরনের শব্দ বা বিষয় ব্যবহার করা হয়েছে এর কোন বাস্তব অস্তিত্ব নেই। সবচেয়ে বিস্ময়কর হচ্ছে, নতুন আইনে বাংলাদেশ সামুদ্রিক জলসীমায় বিদেশী মৎস্য নৌযানের প্রবেশে বাধা শিরোণামের বিধিতে বিদেশী ফিশিং ভেসেলকে অনুমতি নিয়ে বা লাইসেন্স নিয়ে দেশীয় জলসীমায় আসার সুযোগ করে দেয়া হয়েছে।
×