ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

আপীল বিভাগে চূড়ান্ত বিচারের অপেক্ষা

প্রকাশিত: ২২:৫২, ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২১

আপীল বিভাগে চূড়ান্ত বিচারের অপেক্ষা

বিকাশ দত্ত ॥ বিডিআর (বর্তমানে বিজিবি) বিদ্রোহের ঘটনায় ৫৭ সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জনকে হত্যা মামলাটি দুই ধাপে বিচারিক আদালত ও হাইকোর্টে সম্পন্ন হয়েছে। এখন সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রীমকোর্টের আপীল বিভাগে চূড়ান্ত বিচারের অপেক্ষায়। ইতোমধ্যে দুটি ধাপে বিচারিক আদালত ও হাইকোর্টে বিচার প্রক্রিয়া শেষ হয়েছে। এদিকে হাইকোর্টের রায়ে যারা খালাস পেয়েছেন এবং মৃত্যুদণ্ডের পরিবর্তে যাদের যাবজ্জীবন হয়েছে, সেই সমস্ত আসামিদের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড চেয়ে আপীলের অনুমতি চেয়ে আবেদন করেছে রাষ্ট্রপক্ষ। অন্যদিকে আসামিপক্ষ মৃত্যুদণ্ডের সাজা বাতিল চেয়ে আপীল আবেদন করেছে। আসামিপক্ষের আপীল আবেদন এখনও শেষ হয়নি। এখন পর্যন্ত রাষ্টপক্ষ ২০টি এবং আসামিপক্ষ ৫১টি মিলে মোট ৭১টি আপীল আবেদন করেছে। আসামি পক্ষের আপীল আবেদন শেষ হলেই এ মামলার আপীল শুনানি শুরু হবে। যে সমস্ত আসামি এখনও আপীল আবেদন করেনি তারা বিলম্ব মার্জনা চেয়ে আপীল করার সুযোগ পাবে। বিলম্ব মার্জনা চেয়ে যদি আবেদন করে তাহলে তারা আপীল বা লিভ টু আপীল ফাইল করতে পারবে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০৩ আসামির পক্ষে এখন পর্যন্ত ৫১টি আপীল ও লিভ টু আপীল দায়ের করা হয়েছে। হাইকোর্টের রায়ে যারা খালাস পেয়েছেন এবং মৃত্যুদণ্ডের পরিবর্তে যাদের যাবজ্জীবন হয়েছে, সে রকম ৮৩ আসামির সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড চেয়ে ২০টি লিভ টু আপীল (আপীলের অনুমতি চেয়ে আবেদন) করেছে রাষ্ট্রপক্ষ। সব মিলিয়ে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত দুই পক্ষের ৭১টি আপীল ও লিভ টু আপীল দায়ের করা হয়েছে। এর মধ্যে ৩৯টি লিভ টু আপীল অর্থাৎ আপীলের অনুমতি চেয়ে আবেদন। আর ৩২টি সরাসরি আপীল আবেদন। এ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন জনকণ্ঠকে বলেছেন, ডিসেম্বরের দিকে আসামিপক্ষ আপীল আবেদন করেছে। আর আমরা পিটিশন দাখিল করেছি। আসামিদের আপীল আবেদন এখনও সম্পন্ন হয়নি। ওদের ফাইল রেডি হলেই আপীল শুনানির জন্য উদ্যোগ নেয়া হবে। সব ফাইল হলে শুনানির তারিখ নির্ধারণের জন্য আমরা যাব। সুপ্রীমকোর্ট রুলস অনুযায়ী তারিখ নির্ধারণের জন্য আপীল বিভাগের চেম্বার জজ আদালতে আবেদন করতে হয়। আমরা সে আবেদন করব। আমাদের প্রত্যাশা থাকবে হাইকোর্ট বিভাগ যে রায় দিয়েছে তা আপীলে বিভাগেও যেন বহাল থাকে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে মনে হয়েছে হাইকোর্টের রায় ঠিক হয়নি, আমরা সেটি দেখাব। এই কারণে আপীল করা হয়েছে। আশাকরি এ বছরের শেষের দিকে এর শুনানি শুরু হতে পারে। অন্যদিকে আসামিপক্ষের আইনজীবী এ্যাডভোকেট আমিনুল ইসলাম জনকণ্ঠকে বলেছেন, আমরা আপীল আবেদন করেছি। আমি ৪৮টি এবং অন্যরা ৩টিসহ মোট ৫১টি। অন্যদিকে রাষ্ট্রপক্ষ করেছে ২০টি। আপীল শুনানির ক্ষেত্রে উভয়পক্ষকে প্রত্যেকটা আপীলের সারসংক্ষেপ জমা দিতে হবে। এখন যারা লিভ টু আপীল ফাইল করেছেন তাদের সেই লিভ টু আপীল গ্রহণ করলে তাদেরও সারসংক্ষেপ জমা দিতে হবে। আমার মনে হয় আপীল শুনানি শুরু হতে আগামী বছর লেগে যাবে। বিডিআর (বর্তমানে বিজিবি) বিদ্রোহের ঘটনায় ৫৭ সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জনকে হত্যা মামলাটি দুই ধাপে সম্পন্ন হয়েছে। এখন সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রীমকোর্টের আপীল বিভাগে আপীল করার পালা। ইতোমধ্যে রাষ্ট্র ও আসামিপক্ষ মিলে ৭১টি আপীল আবেদন করা হয়েছে। এখনও বেশ কিছু আসামি আপীল আবেদন করবে বলে জানা গেছে। হাইকোর্টের রায়ে মৃত্যুদণ্ডসহ মোট ৫৫২ জনকে বিভিন্ন ধরনের দণ্ড প্রদান করা হয়। দেশের ইতিহাসে এটি সর্ববৃহৎ রায়। গত ৮ জানুয়ারি তিন বিচারপতির স্বাক্ষরের পর পূর্ণাঙ্গভাবে রায়টি ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়। মোট ২৯ হাজার ৫৯ পৃষ্ঠার রায়। ২০১৭ সালের ২৬ ও ২৭ নবেম্বর দুদিন ধরে এ রায়টি প্রদান করা হয়। এর আগে ২০১৫ সালের ১৮ জানুয়ারি থেকে বিচারপতি মোঃ শওকত হোসেনের নেতৃত্বে তিন সদস্যের বিশেষ (বৃহত্তর) বেঞ্চে ডেথ রেফারেন্স ও আপীল শুনানি শুরু হয়ে ২০১৭ সালের ১৩ এপ্রিল ৩৭০ কার্যদিবসে শেষ হয়। বেঞ্চের অন্য দুইজন বিচারপতি হলেন বিচারপতি মোঃ আবু জাফর সিদ্দিকী ও বিচারপতি মোঃ নজরুল ইসলাম তালুকদার। রায় ঘোষণার ৭৭৪ দিনের মাথায় বিডিআর হত্যা মামলার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করা হয়েছে। ২০২০ সালের ৮ জানুয়ারি হাইকোর্টের বৃহত্তর বেঞ্চ এ মামলার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করে। বিচারপতি মোঃ শওকত হোসেন, বিচারপতি মোঃ আবু জাফর সিদ্দিকী ও বিচারপতি মোঃ নজরুল ইসলাম তালুকদারের সমন্বয়ে গঠিত একটি বৃহত্তর বেঞ্চ ২০১৭ সালের ২৭ নবেম্বর চাঞ্চল্যকর এ হত্যা মামলায় আসামিদের আপীল ও ডেথ রেফারেন্সের শুনানি করে রায় দেন। নিয়ম অনুযায়ী, হত্যা মামলায় হাইকোর্টের রায় প্রকাশের পর আপীল বিভাগে আপীল করতে পারবে উভয়পক্ষই। এরপর আপীলের বিচারের মধ্য দিয়ে বিচার প্রক্রিয়া চূড়ান্তভাবে সম্পন্ন হবে। ২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি পিলখানায় ওই হত্যাযজ্ঞে ৫৭ সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জন প্রাণ হারান। ২০১৩ সালের ৫ নবেম্বর পিলখানায় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সদর দফতরে বিদ্রোহের ঘটনায় সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জনকে হত্যার দায়ে ১৫২ আসামির ফাঁসির রায় দেয় বিচারিক আদালত। ঢাকার অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ মোঃ আখতারুজ্জামান বকশীবাজারে আলিয়া মাদ্রাসা মাঠে স্থাপিত অস্থায়ী এজলাসে এ মামলার রায় ঘোষণা করেন। ২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেয়া বিডিআরের উপসহকারী পরিচালক তৌহিদুল আলমসহ (৫৫) বাহিনীর ১৫২ জওয়ান ও নন কমিশন্ড কর্মকর্তার মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেয়া হয় রায়ে। পাশাপাশি তাদের প্রত্যেককে এক লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। বিচারিক আদালতে দেয়া মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দণ্ডিতদের মধ্যে ১৩৯ জনের মৃত্যুদণ্ড হাইকোর্টে বহাল রাখা হয়েছে। এছাড়া একজন মারা গেছেন। বাকি ১২ জনের মধ্যে আটজনের সর্বোচ্চ সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন ও অন্য চারজনকে বেকসুর খালাস দেয়া হয়। যাবজ্জীবন দেয়া হয়েছে ১৮৫ জনকে। তার মধ্যে একজন মৃত্যুবরণ করেছেন। ১৩ বছর করে সশ্রম কারাদণ্ড দিয়েছেন দুজনকে। ১৫৭ জনকে ১০ বছর করে কারাদণ্ড দিয়েছেন। এর মধ্যে দুজন মারা গেছেন। ১৩ জনকে সাত বছর করে, ১৪ জনকে তিন বছর করে, এক বছর করে কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে দুজনকে। মোট ৫৫২ জনকে সাজা এবং ২৮৩ জনকে খালাস দেয়া হয়েছে। মোট মারা গেছেন ১৪ জন। ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি বিডিআর (বর্তমানে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ-বিজিবি) বিদ্রোহের ঘটনা ঘটে। ওই বিদ্রোহের সময় ৫৭ সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জন নিহত হন। আসামির সংখ্যার দিক থেকে এটিই দেশের ইতিহাসে বৃহত্তর মামলা।
×