ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

শাসন ক্ষমতার এক যুগ ॥ পাল্টে যাওয়া বাংলাদেশের গল্প

প্রকাশিত: ২১:০২, ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২১

শাসন ক্ষমতার এক যুগ ॥ পাল্টে যাওয়া বাংলাদেশের গল্প

(গত শুক্রবারের পর) সমুদ্র বিজয় ॥ প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে সীমানা নির্ধারণে দ্বিপাক্ষিক আলোচনা শুরু হয়েছিল ১৯৭৪ সালেই। দ্বিপাক্ষিক আলোচনা শুরু করার পর দ্বিতীয় দফাতেই (২৩ নবেম্বর ১৯৭৪) বাংলাদেশ মিয়ানমারের সঙ্গে ১২ নটিক্যাল মাইল টেরিটোরিয়াল সমুদ্র সীমানা নির্ধারণ করতে সক্ষম হয়েছিল। ১৯৭৪ সালের পর সমুদ্রসীমা নির্ধারণে কোন ফলপ্রসূ উদ্যোগ দেখা যায়নি; উপরন্তু মিয়ানমারের সঙ্গে ১২ নটিক্যাল মাইল এলাকায় সম্মত সীমানা বাধ্যতামূলক চুক্তিতে পরিণত করার পদক্ষেপও নেয়া হয়নি। ২০০৯-১০ সালে মিয়ানমারের সঙ্গে তিন দফা এবং ভারতের সঙ্গে দুই দফা আলোচনায় বসেছে বাংলাদেশ। কিন্তু আলোচনায় ন্যায্যতাভিত্তিক সমাধানের আশু সম্ভাবনা পরিলক্ষিত না হওয়ায় সরকার দায়িত্ব গ্রহণের মাত্র ৫ মাসের মাথায় আইনী পদক্ষেপ গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়। তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে আলোচনার পর মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা বিরোধ নিষ্পত্তি না হওয়ায় ২০০৯ সালের ৮ অক্টোবর সালিশি আদালতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় বাংলাদেশ সরকার। এ প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নির্ধারণের জন্য বাংলাদেশ জার্মানির হামবুর্গভিত্তিক সমুদ্র আইনবিষয়ক আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে (ইটলস) মামলা দায়ের করেছিল। আর ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নির্ধারণের মামলা দায়ের করা হয়েছিল হেগের স্থায়ী সালিশি আদালতে। ভারত ও মিয়ানমার সমদূরত্বের ভিত্তিতে সমুদ্রসীমা দাবি করায় বাংলাদেশের সাগর এলাকা মাত্র ১৩০ নটিক্যাল মাইলে সীমিত হয়ে পড়েছিল। ২০১২ সালের ১৪ মার্চ ট্রাইব্যুনাল উন্মুক্ত আদালতে মামলার দু’পক্ষসহ (বাংলাদেশ ও মিয়ানমার) সকলের উপস্থিতিতে এ বিষয়ে চূড়ান্ত রায় ঘোষণা করে। মিয়ানমারের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের দাবি অনুযায়ী ন্যায্যতার ভিত্তিতে রায় দেয়ায় ২০০ নটিক্যাল মাইল অর্থনৈতিক এলাকা এবং তদুর্ধ মহীসোপান এলাকায় বাংলাদেশের নিরঙ্কুশ ও সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। ভারতের সঙ্গে মামলায় হেগের আদালতেও এই সীমানা প্রতিষ্ঠিত হয়। অন্যদিকে, ৮ জুলাই ২০১৪ ভারতের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আদালতে প্রদেয় রায় প্রকাশ করা হয়। যার মধ্য দিয়ে মিয়ানমারের পর ভারতের সঙ্গেও বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা নির্ধারিত হয়। নেদারল্যান্ডসের স্থায়ী সালিশি আদালতের রায়ে বঙ্গোপসাগরের বিরোধপূর্ণ ২৫ হাজার ৬০২ বর্গকিলোমিটার এলাকার মধ্যে ১৯ হাজার ৪৬৭ বর্গকিলোমিটার সমুদ্র এলাকা পায় বাংলাদেশ। বাকি ছয় হাজার ১৩৫ বর্গকিলোমিটার পেয়েছে ভারত। তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে উভয় রাষ্ট্রের মধ্যে এই সমস্যা বিরাজ করছিল, যা উভয় রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছিল। আন্তর্জাতিক আইনের মাধ্যমে শান্তিপূর্ণভাবে তা নিষ্পত্তি হয়েছে। এই রায়ের ফলে প্রতিবেশী মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নির্ধারণের বিষয়টি সুরাহা হওয়ায় বাংলাদেশ শেষ পর্যন্ত এক লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটারের টেরিটোরিয়াল সমুদ্র, ২০০ নটিক্যাল মাইল একচ্ছত্র অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং চট্টগ্রাম উপকূল থেকে ৩৫৪ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত মহীসোপানের তলদেশে অবস্থিত সব ধরনের প্রাণিজ ও অপ্রাণিজ সম্পদের ওপর সার্বভৌম অধিকার প্রতিষ্ঠা নিশ্চিত করতে পেরেছে। ফলে বিরোধপূর্ণ সমুদ্র এলাকার বিপুল অংশে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে বাংলাদেশের বাধা কেটে গেছে। গভীর সমুদ্রে প্রস্তাবিত ১০টি তেল-গ্যাস ব্লকই পড়েছে বাংলাদেশের সীমানায়। তবে দক্ষিণ তালপট্টি দ্বীপ বঙ্গোপসাগরের যে জায়গাটিতে ছিল তা ভারতের সীমানায় পড়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাহসী, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন এবং জনকল্যাণমূলক দেশপ্রেমী এই সিদ্ধান্ত এদেশের ভৌগোলিক আয়তনের প্রায় সমান এলাকা সম্পদসহ আজ বাংলাদেশের জনগণের অধিকারে এসেছে। উল্লেখ্য, এক নটিক্যাল মাইল=১.৮৫২ কিলোমিটার। বাংলাদেশ-ভারত ছিটমহল বিনিময় ॥ ২০১৫ সালের ৩১ জুলাই ছিল বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার ছিটমহল বিনিময়ের এক ঐতিহাসিক রাত। এইদিন মাঝরাত ছিল দুই দেশের ছিটমহলগুলোতে বসবাসরত ছিটমহলবাসীর মুক্তির রাত। এইদিন রাত ১২টার পর বাংলাদেশের মধ্যে থাকা ১১১টি ছিটমহল আনুষ্ঠানিকভাবে মূল ভূখণ্ডের অংশ হয়ে যায়। অন্যদিকে, ভারতের মধ্যে থাকা বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহল সে দেশের অংশ হয়ে যায়। অবসান ঘটে এগুলোর অধিবাসীদের ৪৪ বছরের অপেক্ষার। ১৯৭৪ সালের বাংলাদেশ-ভারত স্থলসীমান্ত চুক্তি এবং ২০১১ সালের প্রটোকল অনুযায়ী ১৯৪৭ সালের ভারত ভাগের ৬৮ বছর পর দুটি দেশের মধ্যকার সীমান্ত সমস্যার নিষ্পত্তি হয়। এই ৬৮ বছর ধরে ছিটমহলবাসীদের না ছিল কোন রাষ্ট্র বা রাষ্ট্রীয় পরিচয়; না ছিল খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষার মতো মৌলিক অধিকারসহ কোন প্রকার মানবিক অধিকার; না ছিল জীবনের নিরাপত্তা। ছিটমহল বিনিময়ের মাধ্যমে সব ধরনের অধিকারবঞ্চিত ছিটমহলের অসহায় নারী, পুরুষ ও শিশুদের মুক্তির আয়োজন করে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এমন একটি কাজ করলেন যা ইতিহাসের পাতায় লেখা থাকবে। উল্লেখ্য, এই ছিটমহল বিনিময়ের জন্য ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে ১৯৭৪ সালে স্বাক্ষরিত ঐতিহাসিক স্থলসীমা চুক্তিটি দীর্ঘ ৪১ বছর পর ২০১৫ সালের মে মাসে ভারতের পার্লামেন্টের অনুসমর্থন পায়। ২০১৫ সালের ৫ মে ভারতের কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা স্থলসীমা চুক্তিটি হুবহু অনুসমর্থনের অনুমোদন দেয়ার পর ৬ মে সীমান্ত বিলটি রাজ্যসভায় উত্থাপিত হয় এবং সব অনিশ্চয়তা কাটিয়ে সর্বসম্মতিক্রমে তা পাস হয়। রাজ্যসভার ১৮১ সদস্যের সবাই এর পক্ষে ভোট দেয়। এর পরের দিন ৭ মে ভারতের লোকসভায়ও সর্বসম্মতিক্রমে পাস হয় সীমান্ত বিল। করোনা মোকাবেলায় সফলতা ॥ সীমিত সম্পদ ও বিপর্যস্ত স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নিয়ে মহামারী কোভিড-১৯ করোনাভাইরাস মোকাবেলায় সরকার যথেষ্ট সাফল্যের পরিচয় দিয়েছে। এ সাফল্যের স্বীকৃতিও পেয়েছে বাংলাদেশ। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম ব্লুমবার্গের জরিপে বিশ্বে করোনা প্রতিরোধে সফল দেশগুলোর তালিকায় শীর্ষ বিশে উঠে এসেছে বাংলাদেশ। শীতের শুরুতে বিশ্বজুড়ে করোনার প্রকোপ বৃদ্ধি পেলেও যেসব দেশে করোনা আক্রান্ত ও মৃত্যুহার এখনও সহনীয় পর্যায়ে আছে সেসব দেশই এই তালিকায় স্থান পেয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে কেবল বাংলাদেশই এই তালিকায় শীর্ষ ২০ দেশের মধ্যে রয়েছে। তালিকায় ১০০-তে ৫৯ দশমিক ২ নম্বর পেয়ে বাংলাদেশের অবস্থান ২০তম। দক্ষিণ এশিয়ার বাকি দেশগুলোর মধ্যে পাকিস্তান ২৯ ও ভারত ৩৯তম অবস্থানে আছে, অর্থাৎ করোনা মোকাবেলায় দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ শীর্ষ স্থানে রয়েছে। এটি অবশ্যই আওয়ামী লীগ সরকারের জন্য বড় সাফল্য। তবে আরও একটি বিষয় লক্ষণীয় যে, করোনা মোকাবেলায় সফলতার সঙ্গেই বেরিয়ে এসেছে যে, কিভাবে দুর্নীতি স্বাস্থ্য খাতে শাখা-প্রশাখা বিস্তার লাভ করেছে। যদিও বেশ কিছু ক্ষেত্রে সরকার দুর্নীতির তথ্য প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে ত্বরিত পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। করোনা মোকাবেলায় সাফল্যের আরও একটি স্বীকৃতি উঠে এসেছে প্রধানমন্ত্রীকে লেখা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালকের চিঠি। চিঠিতে বলা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রীর সুযোগ্য নেতৃত্বে বাংলাদেশ দেখিয়েছে কিভাবে একের পর এক বলিষ্ঠ পদক্ষেপ গ্রহণ করে কোভিডকে ব্যাকফুটে ঠেলে দেয়া যায়। দীর্ঘ চিঠিতে তিনি প্রধানমন্ত্রীর সরকারের সঙ্গে একযোগে কাজ করে সামনের দিনগুলোতে কোভিডকে পরাজিত করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে চীনের উহান প্রদেশ থেকে পুরো বিশ্বে করোনার প্রাদুর্ভাব ছড়িয়ে পড়ার পর বাংলাদেশ সতর্ক ছিল এই ভাইরাসের ব্যাপারে। কিন্তু ইউরোপজুড়ে করোনাভাইরাস মহামারী আকার ধারণ করলে ইতালী থেকে দলে দলে প্রবাসীরা দেশে চলে আসতে শুরু করে। দেশে এসে তারা কোয়ারেন্টাইনের বিধি-নিষেধ না মানায় বাংলাদেশেও ছড়িয়ে পড়ে করোনাভাইরাস। দেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তি প্রথম শনাক্ত হয় ৮ মার্চ। আর প্রথম মৃত্যু হয় ১৮ মার্চ, ২০২০। তার আগেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ১১ মার্চ কোভিড-১৯ প্রাদুর্ভাবকে মহামারী থেকে বৈশ্বিক অতিমারী হিসেবে ঘোষণা করে। ফলে সরকার করোনা মোকাবেলায় সর্বশক্তি নিয়োগ করে। টানা ৬০ দিন লকডাউন চলে দেশে। এর মধ্যে অর্থনীতিকে টিকিয়ে রাখা এবং দরিদ্র মানুষের জন্য অন্নের সংস্থান করা ছিল কঠিন কাজ। সরকারী ও ব্যক্তি উদ্যোগের সম্মিলিত প্রয়াসে সেই কঠিন কাজ সম্পন্ন করতে সরকার সক্ষম হয়েছে। এ সময় সুযোগসন্ধানীরা দুর্নীতিসহ নানা তৎপরতা চালিয়েছে। কিন্তু সরকার কাউকে ছাড় দেয়নি। ঘটনা উদ্ঘাটনের সঙ্গে সঙ্গে ত্বরিত গতিতে ব্যবস্থাও নিয়েছে। করোনাভাইরাস মহামারী বিশ্ব অর্থনীতিতে এক গভীর ক্ষতের সৃষ্টি করেছে। অনেক দেশের মতো বাংলাদেশের অর্থনীতিও ক্ষতির মুখে পড়েছে। তবে বিভিন্ন নীতি-সহায়তা এবং বিভিন্ন উদারনৈতিক আর্থিক প্রণোদনা প্যাকেজ প্রদানের মাধ্যমে সরকার অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছে। এখন পর্যন্ত সরকার নতুন অনুমোদিত দুটিসহ মোট ১ লাখ ২৪ হাজার ৫৩ কোটি টাকার ২৩টি প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবেলায় নতুন আরও প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণার চিন্তাভাবনা করছে। বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার প্রায় আড়াই কোটি প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে নগদ অর্থসহ বিভিন্ন সহায়তা দিয়েছে। সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতাও বৃদ্ধি করা হয়েছে। এসব প্রণোদনা কর্মসূচীতে অতিদরিদ্র বয়স্ক ও বিধবাদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তাও থাকছে। এসব প্রণোদনা কর্মসূচী যাতে যথার্থভাবে বাস্তবায়ন করা হয় সে দিকটা দেখার জন্য সঙ্কটকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিয়মিত প্রশাসনের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে ভার্চুয়ালি বসেছেন। নিরন্তর সংগ্রাম করে টিকে থাকা বাংলাদেশের লড়াকু মনের উত্তরাধিকারী বঙ্গবন্ধুকন্যার এমন নেতৃত্বের সুফল এখন সারাদেশই পাচ্ছে। সদ্যসমাপ্ত ২০০০ সালের ডিসেম্বর থেকে করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের প্রকোপ পুনরায় বিভিন্ন দেশে বিশেষ করে শীতপ্রধান পশ্চিমা দেশগুলোতে শুরু হয়েছে। তারা নতুন করে আবার লকডাউনের ব্যবস্থা করেছে। তবে ভাল খবর হলো বাংলাদেশে এখনও দ্বিতীয় ঢেউয়ের প্রকোপ শুরু হয়নি। কিন্তু এ সময় সরকারের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ দাঁড়ায় করোনা ভ্যাকসিন নিয়ে এসে টিকা প্রয়োগের মাধ্যমে দেশকে ভাইরাসমুক্ত রাখা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এখানেও দক্ষতা ও বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছেন। বিশ্বে অনেক টিকার ট্রায়ায় চললেও বাংলাদেশের স্বাস্থ্যকর্মীরা আগ্রাধিকার দেন অক্সফোর্ডের উদ্ভাবিত টিকার প্রতি। এই টিকা তৈরির দায়িত্ব পায় ব্রিটেনের জায়ান্ট ওষুধ কোম্পানি এ্যাস্ট্রাজেনেকা। প্রতিবেশী দেশ ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউট এ্যাস্ট্রাজেনেকার সঙ্গে যৌথভাবে এই টিকা উৎপাদনের দায়িত্ব পায়। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে ট্রায়াল অবস্থায়ই বাংলাদেশ সিরাম ইনস্টিটিউটে তিন কোটি টিকার জন্য বুকিং দিয়ে দেয়। অবশ্য এই টিকা প্রাপ্তি নিয়েও নানা জটিলতা সৃষ্টি হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সমালোচকদের মুখে ছাই দিয়ে যথাসময়েই করোনা টিকার প্রথম চালান (৫০ লাখ ডোজ) জানুয়ারি মাসের শেষ সপ্তাহে দেশে এসে পৌঁছায়। এর আগে সেরাম ইনস্টিটিউটে উৎপাদিত আরও ২০ লাখ ডোজ টিকা ভারত সরকার বাংলাদেশকে উপহার হিসেবে দিয়েছে। টিকা দেশে চলে আসার পর সমালোচকরা প্রশ্ন তোলে বেশি দামে টিকা কেনার ব্যাপারে। কিন্তু অজ্ঞতা এখানেই যে, বাংলাদেশ যখন সেরাম ইনস্টিটিউটে টিকার জন্য বুকিং দেয় তখন টিকার উৎপাদন খরচ ও দরদাম নির্ধারিত হয়নি। ফলে চুক্তিতে প্রতি ডোজ টিকার দাম ৪ ডলার ধরা হয়। কিন্তু চুক্তিতে শর্ত রাখা হয় যে, ভারত যে দামে টিকা নেবে বাংলাদেশকেও একই দামে টিকা সরবরাহ করা হবে। শুধু তাই নয়, চুক্তিতে আরও বলা হয়, ভারত যদি ৪ ডলারের বেশি দামে টিকা নেয় তাহলে বাংলাদেশ প্রতি ডোজ টিকার দাম ৪ ডলারই পরিশোধ করবে। ফলে চুক্তির শর্ত অনুযায়ী বাংলাদেশ এখন ২ ডলার করেই টিকার দাম পরিশোধ করবে। এক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী বলে দিয়েছেন যে, দাম কমে যাওয়ায় যে অর্থ সাশ্রয় হবে সেই টাকা ফেরত না নিয়ে সেই টাকার টিকা কিনে নেবে বাংলাদেশ সেরামের কাছ থেকে। বিশ্বের অনেক দেশই এখনও টিকা পায়নি। অনেক বড় বড় দেশ টিকার জন্য হন্যে হয়ে ঘুরছে। দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত ও বাংলাদেশ ছাড়া আর কোন দেশ টিকা সংগ্রহ করতে পারেনি। অথচ ২৭ জানুয়ারি রাজধানীর কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের একজন নার্সকে (সিনিয়র স্টাফ নার্স রুনু ভেরোনিকা কস্তা) করোনাভাইরাসের টিকা দেয়ার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে বহুল প্রতীক্ষিত টিকাদানের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এটিও বাংলাদেশের জন্য এক ‘ঐতিহাসিক’ ঘটনা। দেশের মানুষ যাতে করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে সুরক্ষা পায় সেজন্য সব জেলায় টিকা পৌঁছে দেয়া হয়েছে। সারাদেশে একযোগে ৭ ফেব্রুয়ারি থেকে গণটিকাদান কার্যক্রম শুরু হয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতামত এবং অনুশাসন মেনে। এই টিকাদান কর্মসূচীর মাধ্যমে আরও একবার প্রমাণ হলো আওয়ামী লীগ সরকার মানুষের কল্যাণে কাজ করে। মহামারীতে মৃত্যু, শোক আর সঙ্কটের একটি বছর পেরিয়ে এসে টিকা দেয়ার মধ্য দিয়েই করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ঘুরে দাঁড়াতে চায় বাংলাদেশ। আশা করছি করোনাভাইরাস মোকাবেলায় সরকার যে যাত্রা শুরু করেছে সেটা অচিরেই সফল হবে। উন্নত দেশের স্বপ্ন ॥ অতীতে লক্ষ্যবিহীনভাবে সরকারগুলো দেশ পরিচালনা করেছে। আওয়ামী লীগই দেশের একমাত্র রাজনৈতিক দল যারা প্রথম দেশবাসীর সামনে ‘ভিশন’ বা লক্ষ্য নিয়ে দেশ পরিচালনা করছে। বাংলাদেশকে তারা কোথায় কিভাবে নিয়ে যেতে চায় তার সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা দেশবাসীর সামনে তুলে ধরেছে। পরিকল্পিতভাবে দেশকে উন্নতি ও সমৃদ্ধির দিকে নিয়ে যাচ্ছে। সরকারের লক্ষ্য হচ্ছে সন্ত্রাস, জঙ্গীবাদ নির্মূল করে একটি ক্ষুধা-দারিদ্র্য-নিরক্ষরতামুক্ত অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ বিনির্মাণ করা। ২০৩১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ হবে উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে হবে উচ্চ আয়ের সমৃদ্ধিশালী-মর্যাদাশীল দেশ। ২০২১ সালের পূর্বেই উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছে দেশ। এখন উন্নত দেশের প্রত্যাশিত লক্ষ্যে পৌঁছতে পথ-নকশা তৈরি করা হয়েছে। রূপকল্প ২০৪১-এর কৌশলগত দলিল হিসেবে দ্বিতীয় প্রেক্ষিত পরিকল্পনা ২০২১-২০৪১ প্রণয়ন করা হয়েছে। সর্বশেষ ॥ প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবেলায় বাংলাদেশ এখন অনেক বেশি ‘রেজিলিয়েন্স’। ২০০৮ সালের বৈশ্বিক মন্দা এবং ২০১৩ সালের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সংঘাতের পর সূচকগুলো বেশ খানিকটা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছিল। তবে সরকারের ত্বরিত ও বাস্তবমুখী পদক্ষেপ গ্রহণের কারণে সমাজ এবং রাজনীতিতে দ্রুতই শান্তি ফিরে আসে। ফলে অর্থনীতিও চলে আসে স্বস্তিদায়ক অবস্থানে। বৈশ্বিক মন্দা ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতায় অর্থনীতির রক্তক্ষরণের পর আবারও অর্থনীতির ঘুরে দাঁড়ানোর কৃতিত্ব এ সরকারের। বাংলাদেশের এই নজরকাড়া অর্জনের পেছনে নিঃসন্দেহে নেতৃত্বের বিচক্ষণতার পরশ আছে বঙ্গবন্ধুকন্যার। তাই তিনি সমাজের ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত এক অসাধারণ কল্যাণ বন্ধনে বেঁধে ফেলার সুদূরপ্রসারী উন্নয়ন কৌশল গ্রহণে পিছপা হন না। সর্বশেষ মহামারী করোনা মোকাবেলায়ও অনেক দেশের চেয়ে ভালভাবেই সঙ্কট উত্তরণের দিশা দেখাচ্ছে বাংলাদেশ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের উন্নয়নমুখী কর্মকাণ্ডের ধারাবাহিকতার কারণেই এই দুর্লভ অর্জন সম্ভব হয়েছে। দীর্ঘ একযুগ ধরে একটি গণতান্ত্রিক ও উন্নয়নমুখী সরকার রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে থাকার সুফল পাচ্ছে দেশ। টিকা চলে এসেছে দেশে। ফলে ব্যবসা-বাণিজ্যে আস্থার সূচকে বিরাট উল্লম্ফন ঘটবে। পুরো সমাজ ও অর্থনীতিতে ‘আমরাও পারি’ ইতিবাচক ভাবনাটির সংক্রমণ ঘটবে। মহামারীতে সাময়িক দারিদ্র্য বেড়েছে। তবে প্রণোদনামূলক নীতিগুলোর কারণে দ্রুতই দেশ দারিদ্র্য নিরসনের পুরনো ধারায় ফিরে আসবে। বিদেশী বিনিয়োগের ক্ষেত্রে নতুন সম্ভাবনা তৈরি করবে। সরকার, ব্যক্তি ও বেসরকারী খাত মিলেমিশেই উচ্চ-মধ্যম থেকে উচ্চ আয়ের দেশে উন্নীত হবে বাংলাদেশ। ভবিষ্যতে কারও দয়ায় বাংলাদেশকে আর চলতে হবে না। সরকারের একযুগ পূর্তিতে এমন প্রত্যয়ই রইল। (সমাপ্ত) লেখক : সাংবাদিক
×