ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বাংলার বঙ্গবন্ধু

প্রকাশিত: ২০:৫১, ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২১

বাংলার বঙ্গবন্ধু

হিমালয়ের পাদদেশে উত্তর জনপদের নীলফামারী আমাদের শহর। নীলফামারী নাম শুনলেই মানস-পটে ভেসে ওঠে দিগন্তবিস্তৃত ফসলের ক্ষেত। অতীতে এ অঞ্চলে মানুষের শিক্ষার হার জাতীয় শিক্ষার হারের তুলনায় অনেক কম ছিল। অশিক্ষায় এখানকার মানুষ ডায়রিয়া, আমাশয়, টাইফয়েড প্রভৃতি রোগে প্রতিনিয়ত ভুগতে থাকে। আধুনিক চিকিৎসার অভাবে এখানে কবিরাজি ঝাড়ফুঁকের প্রচলন ছিল। শিশু-মৃত্যু, মাতৃ-মৃত্যুর হার স্বাভাবিকের চাইতে বেশি দেখা দিত। এখানকার মানুষের মূল জীবিকা ছিল চাষাবাদ। ঝড়-ঝঞ্ঝা, জলোচ্ছ্বাস কিংবা প্রাকৃতিক দুর্যোগে নীলফামারীর মানুষের সীমাহীন দুর্ভোগ আর জীবন সংগ্রামের কাহিনী এক বেদনাবিধুর মহাকাব্য। বর্তমান অবস্থা থেকে বলা যায় হাজার গুণে অবনতিশীল এক আর্থ-সামাজিক পরিবেশে বৃক্ষরাজি, ফল-ফসল ও চির সবুজের এই শহরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শেষবারের মতো এসেছিলেন ২৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৩। নীলফামারীর আঞ্চলিক ইতিহাসে দিনটি তাই ঐতিহাসিক। জীবন চলার পথে কিছু ভিন্ন ধাঁচের অপ্রতিরোধ্য মহৎ মানুষের সন্ধান পাওয়া যায়, যারা সংখ্যায় নগণ্য কিন্তু স্মরণে ভাস্বর। সেরকম একজন মানুষ ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি যখন যেখানে পদধূলি দিয়েছিলেন সেই স্থান ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই করে নিয়েছে। বঙ্গবন্ধুর সাক্ষাতে ব্যক্তিবিশেষের চিত্ত বিকশিত হয়েছে, হৃদয় শ্রদ্ধায় সিক্ত হয়েছে। অসাধারণ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন, স্বত্বঃস্ফূর্ত, সজ্জন ও আস্থার বরপুত্র ছিলেন তিনি। দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে জেল-জুলুম আর নির্মমতা সহ্য করে সাফল্যের সঙ্গে পাড়ি দিয়েছেন বহু পথ। বাধার বিন্ধ্যাচল অতিক্রম করে পাকিস্তানের নাগপাশ থেকে মুক্ত করে পৃথিবীর মানচিত্রে এঁকে দিয়েছেন স্বাধীন বাংলাদেশের মানচিত্র। ১৯৭৩ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি নীলফামারী সদরের হাইস্কুল সংলগ্ন বড় মাঠের এক জনসভায় বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট নিয়ে কথা বলেন। কিভাবে ২৫ বছর পাকিস্তানীরা আমাদের শোষণ করেছিল, তা দিয়েই তিনি বক্তব্য শুরু করেছিলেন। নীলফামারীর জনসাধারণের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘যে স্বপ্ন আমি কারাগারে নির্জন প্রকোষ্ঠে দেখেছি, যে স্বপ্ন আমি বাংলার গ্রামে গ্রামে ঘুরে ঘুরে দেখেছি, সেই স্বপ্ন আজকে হয়েছে আমার স্বাধীন বাংলাদেশ। কিন্তু একটা জিনিস আজও হয় নাই। সেটা হলো, আমি দেখতে চাই আমার বাংলার মানুষ পেট ভরে ভাত খাক, আমি দেখতে চাই আমার বাংলার মানুষ সুখী হোক। আমি দেখতে চাই আমার বাংলার মানুষ কাপড় পাক। আমি দেখতে চাই আমার বাংলার ছেলে শিক্ষা পাক। আমি দেখতে চাই বাংলার বেকার সমস্যা দূর হোক। আমি দেখতে চাই সোনার বাংলা গঠন হোক। কিন্তু ভাই একদিনে তো পাওয়া যাবে না। সময় প্রয়োজন।’ বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে দেশের দায়িত্ব গ্রহণের এক বছর পর নীলফামারী সফরে এসে যে বক্তৃতা করেছেন, সেই বক্তৃতায় একদিকে দুঃখ-যন্ত্রণার কথা যেমন অনুভব করা যায়, অন্যদিকে তাঁর কণ্ঠে আশার বাণীও শুনতে পাওয়া যায়। ২৫ বছরে পাকিস্তানীরা ৩ হাজার কোটি টাকার সম্পদ লুট করে নিয়েছিল। বঙ্গবন্ধু শূন্য হাতে দেশ শাসন শুরু করেছিলেন, যখন ব্যাংক টাকাও রিজার্ভ ছিলো না। তাই নীলফামারীর ভাষণে তিনি বলেছিলেন- ‘যদি আমি আজ ধান দিতে পারতাম, যদি আজ আমি ডিপ-টিউবওয়েল দিতে পারতাম, যদি আজকে আমি আপনাদের ফার্টিলাইজার দিতে পারতান, যদি আজ আমি বাংলাদেশে পোকা মারার ওষুধ দিতে পারতাম, আমার বাংলাদেশের জন্য কোন অভাব হতো না।’ বঙ্গবন্ধু ধ্বংসস্তূপের মধ্যে দাঁড়িয়ে একটি সমৃদ্ধ উন্নত বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন। দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করতে চেয়েছিলেন তখনই যখন তিনি সবকিছু পৃথিবীর অন্য রাষ্ট্র থেকে কিনে নিয়ে আসতেন। স্বাধীনতার ১ বছর পর দেশে কোন কারখানা নেই, ডিপ-টিউবওয়েল নেই, সার নেই, বীজ নেই। এ রকম একটি অবস্থায় তিনি গ্রামের কৃষকের জন্য পরিকল্পনা গ্রহণ করতে শুরু করেন। বঙ্গবন্ধু নীলফামারীর মাঠে দাঁড়িয়ে বলেন, ১৯৭২ সালে তিনি সোয়া শ’ কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা দিয়ে খাবার কিনেছেন। কারণ, বাংলার মানুষকে তিনি না খেয়ে মরতে দিতে চান না। তিনি কষ্টের সঙ্গে বলেন, সকল কাজ বন্ধ হয়ে যাবে যদি আমরা ফসল উৎপাদন করতে না পারি। বঙ্গবন্ধু আবেগমিশ্রিত কণ্ঠে বলেন, কারখানায় শ্রমিক ভাইয়েরা যদি কাজ না করে, উৎপাদন না করে তাহলে মুজিবুর রহমানকে বেটে খাওয়ালেও দেশের মুক্তি আসবে না। ১৯৭৩ সালে সুযোগসন্ধানী মানুষদের যন্ত্রণায় দেশ পরিচালনা করা কঠিন হয়ে পড়েছিল। তাঁর ভাষণে সেই বিষয়টিও রয়েছে। তিনি বলেন ‘বাচাল, কিছু লোক অনেক কথা বলে থাকেন, যাদের আপনারা চেনেন না। যাদের আপনারা দেখেন নাই, যাদের কথাগুলো শুনেন নাই, দুর্দিনে আপনাদের পাশে তারা দাঁড়ায় নাই। সুযোগসন্ধানী মানুষেরা প্রতিনিয়তই দেশকে অস্থিতিশীল করতে চায়।’ বঙ্গবন্ধু তাদের বিষয়ে সকলকে সচেতন থাকার কথা বলেছিলেন। সে সময় বাংলাদেশে শতকরা ৮০-৮৫ জন লোক গ্রামে বসবাস করতেন। বঙ্গবন্ধু গ্রামকে ভালবাসতেন, গ্রামের কৃষকদের ভালবাসতেন। কৃষিবান্ধব বাংলাদেশে গড়ে তোলার জন্য তিনি চেষ্টা করেন। যুগ যুগ ধরে বাংলার কৃষকদের দিকে কেউ নজর দেয়নি। সকলেই কৃষকদের লুট করে খেয়েছে, শোষণ করেছে। সে কারণে, বঙ্গবন্ধু নীলফামারীর বড় মাঠের জনসভায় প্রতিজ্ঞা করে বলেছিলেন, ‘গতবার যখন আমি ৫০০ কোটি টাকা ডেভেলপমেন্ট দেই, তার মধ্যে আমি ১০৩ কোটি কি ১০১ কোটি বাংলার কৃষকদের জন্য ডেভেলপমেন্টের জন্য বরাদ্দ দিয়েছি।’ বঙ্গবন্ধু নীলফামারী এসেছিলেন ২৫ ফেব্রুয়ারিতে এবং নির্বাচনের তারিখ দিয়েছিলেন ৭ মার্চ ১৯৭৩। সে সময় বঙ্গবন্ধু শুধু বাংলাদেশে নয়, বরং সমগ্র পৃথিবীতেই জনপ্রিয় একজন জননেতা। তিনি ইচ্ছে করলে নির্বাচন না দিলেও পারতেন। কিন্তু গণতন্ত্র, আইনের শাসন ইত্যাদি বিষয়ে তাঁর ভাবনা ছিল অন্যমাত্রার। সে কারণেই প্রকৃত একজন জনগণের নেতা হিসেবে তিনি জনগণের সঙ্গেই থাকতে চেয়েছিলেন। ক্ষমতার মোহ তাকে গ্রাস করতে পারেনি। তিনি নীলফামারীর জনসভা থেকে বলিষ্ঠ কণ্ঠে বলেন যে, নীলফামারীর ভাই ও বোনেরা, নির্বাচন দিয়েছি। নির্বাচন না দিলেও পারতাম। আপনারা আমাকে ৫ বছরের জন্য ভোট দিয়েছেন। কিন্তু আমি তো দেশ শাসন করতে চাই না, জনগণের মত ছাড়া এবং জনগণের কাছে আমি ক্ষমতা ফেরত দিয়ে দিয়েছি। জনগণ ভোট দিয়ে যাদের পাঠাবে তারাই দেশ শাসন করবে। নীলফামারীর জনসভায় জনসমুদ্রে দাঁড়িয়ে তিনি বলেন,- আমি রাজনীতি করি না। আমি চাই মানুষের ভালবাসা, আমি চাই মৃত্যুর পরে শান্তি। আবেগমিশ্রিত কণ্ঠে বলতে শোনা গিয়েছিল- ‘আমার কোনও প্রয়োজন নাই, আমি যা পেয়েছি পৃথিবীর কোন মানুষ তা পান নাই। যে ভালবাসা আমি পেয়েছি কোন দেশের কোন নেতা কোনদিন তা পায় নাই। যে স্নেহ আমি পেয়েছি বাংলার মানুষের কাছ থেকে, কোন যুগে কোন দেশের নেতা পেয়েছে কিনা আমার জানা নাই। আজ প্রাণভরা ভালাবাসা, বাংলার গ্রামে গ্রামে যেখানে আমি যাই সেখানে মানুষের জীবনের মায়া থাকে না। ঝাঁপাইয়া পড়ে আমাকে একুট ছুঁবে, আমাকে একটু দেখবে, আমার সঙ্গে একটু কথা বলবে।’ সাধারণ জনগণের কল্যাণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবস্থান ছিল হিমালয়সম। গগনচুম্বী খ্যাতি আর সম্মানের স্বর্ণচূড়ায় আরোহণ করেও নীলফামারী জনপদের মানুষের প্রতি তিনি ছিলেন সরলভাবে দুর্বল। সম্মান ও ক্ষমতার কোন প্রভাব পরাভূত করতে পারেনি তাঁকে। নিরীহ সাধারণ মানুষের কোমল অসহনীয় চাহনির প্রতি তাকাতেন গভীর অনুরাগে। বঙ্গবন্ধুর দৃষ্টির মধ্যে দ্যুতি ছড়াত। নীলফামারীর সবুজ নির্লোভ সরল মানুষের সঙ্গে তার হৃদয় মিলিত হয়। আকাশ আর জলের অজস্র মিলন-রেখায়; তাঁর সুখ স্মৃতি খেলা করে জলের ওপর মেঘের ছায়ায়। আজকের দিনে বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার নিকট একটাই দাবি, নীলফামারীর মাঠে যেখানে বঙ্গবন্ধু দাঁড়িয়ে ভাষণ দিয়েছিলেন, সেই স্থানটি চিহ্নিত করে বঙ্গবন্ধুর একটি ভাস্কর্য বা ম্যুরাল কি নির্মাণ করা যায় না? লেখক : আইনজীবী ও পিএইচডি গবেষক জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
×