ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

# যানজটে নাকাল যাত্রীরা # রাস্তা বন্ধ করে আন্দোলন চালানোয় ক্ষোভ

সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে দিনভর রাজধানীজুড়ে জনদুর্ভোগ

প্রকাশিত: ১৯:৩৭, ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২১

সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে দিনভর রাজধানীজুড়ে জনদুর্ভোগ

স্টাফ রিপোর্টার ॥ দিনভর রাজধানীজুড়ে জনদুর্ভোগ শেষে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভের মুখে স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত সাত কলেজের চলমান পরীক্ষাগুলো নেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। বুধবার বিকালে শিক্ষামন্ত্রী, শিক্ষা উপমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্টদের উপস্থিতিতে এক জরুরি বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত হয়। সাত কলেজের পরীক্ষা নেয়ার দাবিতে সকাল থেকে আন্দোলনে নামেন শিক্ষার্থীরা। রাজধানীর শাহবাগ, সাইন্সল্যাব, নীলক্ষেত সহ বিভিন্ন এলাকায় অবস্থান নেয় তারা। যানবাহন চলাচলে বাঁধা সৃষ্টি করে। আন্দোলনের প্রভাবপড়ে গোটা নগরজুড়ে। দুপুরের পর গোটা ঢাকা শহর যানজটে কার্যত অচল হয়ে যায়। মতিঝিল থেকে ফার্মগেট যেতে সময় লাগে কয়েক ঘন্টা। চরম দুর্ভোগের মুখে অনেক যাত্রীকে পায়ে হেঁটে পথ চলতে দেখা গেছে। বিকালের দিকে দাবি পূরণের আশ^াসে অবরোধ তুলে নেয়া হলেও যানজটের তীব্র প্রভাব ছিল রাত অবধি। প্রশ্ন ওঠতেই পারে জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করে আন্দোলন করা নিয়ে। যোগাযোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশে^র অন্যান্য দেশে রাস্তায় আন্দোলন হয়। কিন্তু যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক থাকে। অর্থাত কোন ভাবেই যেন জনদুর্ভোগ সৃষ্টি না হয় এ ব্যাপারে সবাই সচেতন থেকে কর্মসূচী চলে। কিন্তু আমাদের দেশে একেবারেই ব্যক্তিক্রম। রাজনৈতিক বা সামাজিক যে কোন কর্মসূচীতেই জনদুর্ভোগ চরমে ওঠে। গত মঙ্গলবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সাত কলেজের চলমানসহ সব পরীক্ষা স্থগিত ঘোষণা করে। এ ঘোষণার পর মঙ্গলবার রাত ৮টা থেকে সোয়া ১০টা পর্যন্ত শতাধিক শিক্ষার্থী নীলক্ষেত মোড়ে অবস্থান করেন। পরে রাত সোয়া ১০টার দিকে তাঁরা চলে যান। বুধবার সকাল থেকে তাঁরা আবার অবস্থান নেন। শিক্ষার্থীদের অবরোধ নীলক্ষেত মোড় থেকে সায়েন্স ল্যাব হয়ে শাহবাগ সহ আশপাশের সড়ক পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত সাতটি বড় সরকারি কলেজের পরীক্ষা স্থগিতের প্রতিবাদে রাজধানীর নীলক্ষেত মোড় দ্বিতীয় দিনের মতো অবরোধ শুরু করে বিক্ষোভ করেন শিক্ষার্থীরা। বুধবার সকাল নয়টা থেকে নীলক্ষেত মোড়ে কয়েক শ শিক্ষার্থী অবস্থান নেন। এ কারণে নিউমার্কেট-আজিমপুর সড়কের উভয় পাশে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। পরিস্থিতি মোকাবেলায় রাস্তার মোড়ে মোড়ে ব্যাপক সংখ্যক পুলিশ মোতায়েন করা হলেও তারা আন্দোলনকারীদের বাঁধা দেননি। তেমনি শিক্ষার্থীদের বিক্ষুদ্ধ পরিস্থিতির মুখে যান চলাচল স্বাভাবিক করার চেষ্টা চালাতে দেখা যায়নি পুলিশকে। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে সাত কলেজের শিক্ষা কার্যক্রম তদারকির দায়িত্বপ্রাপ্ত (ফোকাল পয়েন্ট) আই কে সেলিম উল্লাহ ঢাকা কলেজ ও ইডেন মহিলা কলেজের বেশ কয়েকজন শিক্ষক নিয়ে ওই এলাকায় যান। তিনি জানান, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে সাত কলেজের অধ্যক্ষদের ডাকা হয়েছে। সেখানে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত আসবে বলে তিনি আশা করেন। বিকালে শিক্ষা মন্ত্রণালয়েল পক্ষ থেকে জানানো হয়, সাত কলেজের চলমান পরীক্ষাগুলো অব্যাহত থাকবে। স্থগিত হওয়ার পরীক্ষাগুলোর তারিখ পরে জানিয়ে দেয়া হবে। তবে শর্ত দেয়া হয়েছে, পরীক্ষা চলাকালে কলেজগুলোর হোস্টেল খোলা যাবে না এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে পরীক্ষায় অংশ নিতে হবে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে এর আগে মঙ্গলবার বিকেলে সাত কলেজের প্রধান সমন্বয়ক ও অধ্যক্ষদের এক সভায় সাত কলেজের সব পরীক্ষা ২৪ মে পর্যন্ত স্থগিত করা হয়েছিল। ওই সিদ্ধান্তের পর তাৎক্ষণিকভাবে স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার এবং হল-ক্যাম্পাস খুলে দেয়ার দাবিতে নীলক্ষেত মোড় অবরোধ করে বিক্ষোভ রশুরু করেন শিক্ষার্থীরা। সকাল ৯টার দিকে আন্দোলনরত নীলক্ষেত মোড়ে অবস্থান নিয়ে সড়ক অবরোধ করলে নিউ মার্কেট-আজিমপুর সড়কের উভয় পাশে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। ফলে আশপাশের সড়কগুলোতে যানজটের সৃষ্টি হয়। পরে শিক্ষার্থীদের একটি অংশ সায়েন্স ল্যাবরেটরি মোড়ে অবস্থান নিলে সিটি কলেজ থেকে শাহবাগ পর্যন্ত সড়ক বন্ধ হয়ে যায়। মতিঝিল থেকে মীরপুর বা সাভারগামী যানবাহনগুলো বিপাকে পড়ে। এক পর্যায়ে যানজট শহরজুড়ে ছড়াতে থাকে। ঘন্টার পর ঘন্টা রাস্তায় বসে থাকতে হয় যাত্রীদের। গাবতলী থেকে সাইন্সল্যাব বা নীলক্ষেতগামী যানবাহনগুলো ফার্মগেট দিয়ে পুলিশ ঘুরিয়ে দিলেও যানজট কমেনি। অতিরিক্ত গাড়ির চাপে অচল হয়ে যায় সবকিছু। বন্ধ হয়ে যায় ট্রাফিক সিগন্যাল পর্যন্ত। সাভার থেকে আসা এক যাত্রী বলেন, বিশেষ প্রয়োজনে মতিঝিল কাজ ছিল। সেখান থেকে যাত্রাবাড়ি হয়ে বাসায় ফেরার কথা ছিল। কিন্তু পথেই পেলাম যানজট। তারপর বিকল্প উপায়ে মতিঝিল গেলেও নির্ধারিত সময় লেষে পৌঁছানোর কারণে কোন কাজই করতে পারিনি। বিকল্প পরিবহনের চালক দুলাল জানালেন, এক ঘন্টার রাস্তা তিন ঘন্টাতেও যাওয়া যাচ্ছে না। এমনিতেই মীরপুর থেকে মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রো রেলের কাজ চলায় সড়ক সরু হয়ে গেছে। তার উপর বাড়তি যানবাহনের চাপ মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘায়ের শামিল। দুপুরে নীলক্ষেত মোড়ে গিয়ে দেখা গেছে, শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন শ্লোগান দিয়ে রাস্তায় বসে ছিল। তেমনি যানবাহন চলাচলে অনেকটাই কঠোর ছিল তারা। মাঝে মাঝে দু’একটি এ্যাম্বুলেন্স ছাড়লেও গণপরিবহন চলাচল করতে দেয়া হয়নি। পুরো সড়ক ছিল যানবাহনশূণ্য। সবকিছু বন্ধ করে আন্দোলন কেন এমন প্রশ্ন শিক্ষার্থীরা বলেন, আমাদের দাবি যৌক্তিক। তাই মাঠে আসতে বাধ্য হয়েছি। যে কোন গণদাবি আদায়ে মাঠের আন্দোলনে কিছুটা জনদুর্ভোগ হয়। এটা সত্যি। এজন্য তারা সবার কাছে দুঃখ প্রকাশ করেন। আন্দোলনকারীদের মুখপাত্র আবু বকর বলেন, হঠাৎ করে চলমান পরীক্ষা স্থগিত খরে দেয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের খামখেয়ালি মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই ধরনের সিদ্ধান্ত সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা প্রত্যাখ্যান করছে। চলমান পরীক্ষাসমূহ রুটিন অনুযায়ীই নিতে হবে। অন্যথায় আমাদের আন্দোলন চলবে। তিতুমীর কলেজের তৃতীয় বষের ওমর ফারুক বলেন, আমাদের পরীক্ষা কয়েকটা শেষ হয়েছে। আরও চারটা পরীক্ষা বাকি আছে। পরীক্ষার জন্য আমরা অনেকে এই মহামারীর মধ্যে প্রত্যন্ত এলাকা থেকে ঢাকায় এসে মেসে উঠেছি। অনেকেই আর্থিক সঙ্কটে আছে। এর মধ্যে এ ধরনের হঠকারী সিদ্ধান্ত, আমাদের হতাশ করেছে, দুশ্চিন্তায় ফেলেছে। রাজধানী ঘুরে দেখা গেছে, মতিঝিল, দৈনিক বাংলা, পুরানা পল্টন, গুলিস্তান, মৎস্যভবন, সেগুনবাগিচা, কাকরাইল, নয়া পল্টন, শাহবাগ, কাওরান বাজার, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় এলাকা, মালিবাগ, মৌচাক, মগবাজার, ফার্মগেট, কাওরান বাজার, বাংলামোটর, ধানমন্ডি, কলেজগেট, মোহাম্মদপুর, আজিমপুর, নিউ পল্টন, কামরাঙ্গিরচর এলাকার সব অলিগলিতে দিনভর যানজটে মহা ভোগান্তি দেখা গেছে। ট্রাফিক পুলিশের সদস্য বলছেন, যেসব সড়কে যানবাহনের বেশি চাপ ছিল সেসব এলাকার গাড়ি বিকল্প পথে চলাচলের ব্যবস্থা করা হয়েছে। তবে বিভিন্ন সড়কে যানবাহনের বেশি চাপ থাকায় জনদুর্ভোগ হয়েছে একথা বলার আর অপেক্ষা রাখে না। অনেক স্থানে রোগি নিয়ে এ্যাম্বুলেন্স দাঁড়িয়ে থাকলেও ছাত্ররা রাস্তা ফাঁকা করে দিতে রাজি ছিল না। পরে আইনশৃঙ্খখলা বাহিনীর অনুরোধে এ্যাম্বুলেন্স যাওয়ার সুযোগ করে দেয়া হয়। সোমবারই শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি জানান, ঈদুল ফিতরের পর ২৪ মে থেকে দেশের সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শ্রেণিকক্ষে পাঠদান শুরু হবে। এর আগে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের টিকার আওতায় আনা হবে। ২৪ মে পর্যন্ত কোন বিশ্ববিদ্যালয় কোনো ধরনের পরীক্ষা নিতে পারবে না। ২৪ মের পরে পরীক্ষাগুলো নেয়া হবে। আর অনলাইনে যেভাবে ক্লাস চলছে, ওই সময় পর্যন্ত সেভাবেই চলবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলো আগামী ১৭ মে থেকে খুলে দেয়া হবে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর চাপ কমিয়ে শিক্ষার মান বাড়াতে ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে ঢাকার সাতটি সরকারি কলেজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করা হয়। এরপর থেকে ঢাকা কলেজ, ইডেন মহিলা কলেজ, সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ, কবি নজরুল কলেজ, বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ, মিরপুর সরকারি বাংলা কলেজ ও সরকারি তিতুমীর কলেজের ভর্তি পরীক্ষা, পাঠ্যসূচি ও পরীক্ষা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পরিচালিত হচ্ছে।
×