বিশেষ প্রতিনিধি ॥ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশ গঠনে সকলকে দেশপ্রেমিক হওয়ার আহ্বান জানিয়ে ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে একটি উন্নত ও সমৃদ্ধ দেশে পরিণত করার জন্য তার সরকারের দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। দেশেই যুদ্ধবিমান তৈরির আকাক্সক্ষা প্রকাশ করে তিনি বলেন, আমাদের একটা আকাক্সক্ষা আছে যে, বাংলাদেশেই আমরা আমাদের যুদ্ধবিমান তৈরি করতে পারব। কাজেই এর ওপর গবেষণা এবং আমাদের আকাশসীমা রক্ষা আমরা নিজেরাই যেন করতে পারি সেইভাবেই প্রস্তুতি নিচ্ছি।
মঙ্গলবার যশোরের বিমানবাহিনী ঘাঁটি বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমানে অনুষ্ঠিত বিমানবাহিনীর ১১ এবং ২১ স্কোয়াড্রনকে জাতীয় পতাকা প্রদান অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা এবং প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে আরও কয়েকধাপ এগিয়ে যাওয়ার পদক্ষেপ আমরা নিয়েছি। ইনশাআল্লাহ আমরা এ ব্যাপারে সাফল্য অর্জন করব বলে আমি বিশ্বাস করি। বর্তমানে জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন কার্যক্রম চলমান রয়েছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এ বছর আমরা স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করব। সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনের প্রাক্কালে আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হই নিজেদের দেশপ্রেমিক ও নির্ভীক হিসেবে গড়ে তুলতে। আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় বাংলাদেশকে ২০৪১ সালের আগে উন্নত ও সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে গড়ে তুলব ইনশাআল্লাহ। গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী এই অনুষ্ঠানে যোগ দেন। প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে বিমানবাহিনী প্রধান মাসিহুজ্জামান সেরনিয়াবাত ন্যাশনাল স্ট্যান্ডার্ড প্রদানের লক্ষ্যে ইউনিট কমান্ডারগণের হাতে জাতীয় পতাকা হস্তান্তর করেন। প্রধানমন্ত্রী এ সময় মনোজ্ঞ কুচকাওয়াজ প্রত্যক্ষ করেন। এ সময় তাকে রাষ্ট্রীয় সালাম জানানো হয়। বিমানবাহিনী ঘাঁটি বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমান প্রান্তে এ সময় বিমানবাহিনী প্রধান এয়ার চীফ মার্শাল মাসিহুজ্জামান সেরনিয়াবাত ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে বক্তব্য রাখেন। এ সময় বাহিনীর উর্ধতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে, বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে। বিশ্বায়নের এ যুগে যে কোন দেশের জন্য একটি পেশাদার বিমানবাহিনী অপরিহার্য। তিনি একটি আধুনিক ও চৌকস বিমানবাহিনী গড়ে তোলায় তার সরকারের দৃঢ় অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করে বলেন, এ জন্য ‘ফোর্সেস গোল-২০৩০’ পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। তিনি বলেন, জাতির পিতা যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গড়ে তুলে বাংলাদেশকে স্বল্পোন্নত দেশের পর্যায়ে রেখে যান। সেখান থেকে বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিটা যেন আরও দৃঢ় হয় সে জন্য তার সরকার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। টানা কয়েক মেয়াদের সরকার পরিচালনায় আমরা আজকে উন্নয়নশীল দেশের পর্যায়ে উন্নীত হয়েছি।
শেখ হাসিনা বলেন, করোনাভাইরাস সারাবিশ্বের অর্থনীতির গতিকে স্থবির করে দিলেও তার সরকার সীমিত সামর্থ্য নিয়েই এই অর্থনীতিকে গতিশীল রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছে এবং বিভিন্ন প্রণোদনা দিয়ে অর্থনীতির চাকা সচল রেখেছে। তিনি বলেন, করোনার কারণে সরকার মুজিববর্ষের অনেক কর্মসূচী বাস্তবায়ন না করতে পারলেও সাধারণ মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনে প্রতিটি গ্রামের মানুষ যেন শহরের সব সুবিধা পায় সেটা নিশ্চিতকরণ এবং তাদের ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়া এবং চিকিৎসা সেবার ব্যবস্থা করা, সুপেয় পানি এবং স্যানিটেশনসহ পয়ঃনিষ্কাশনের ব্যবস্থা, চলাচলের সুযোগ সৃষ্টি- এসব কিছু নিয়েই আমরা ব্যাপক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে যাচ্ছি। যার সুফল বাংলাদেশ অবশ্যই পাবে।
তিনি বলেন, জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকীতে দেশের মানুষের জন্য এটাই আমাদের উপহার থাকবে, প্রতিটি গৃহহারা মানুষ ঘর পাবে, প্রতি ঘরে বিদ্যুতের আল জ্বলবে এবং সকলে উন্নত জীবন পাবে। এ সময় তিনি করোনার টিকা গ্রহণ করা হলেও মাস্ক ব্যবহার করা, হাত ধোয়া এবং সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার মতো বিষয়গুলো মেনে চলতে দেশবাসীর প্রতি তার আহ্বান পুনর্ব্যক্ত করেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতির পিতার সুদূর প্রসারী কর্মপরিকল্পনা ও দূরদৃষ্টিকে সামনে রেখেই তার সরকার ‘ফোর্সেস গোল-২০৩০’ প্রণয়ন করে। ইতোমধ্যে তার সরকার বিমানবাহিনীতে সংযোজন করেছে মিগ-২৯সহ বিভিন্ন ধরনের ফাইটার বিমান, সর্বাধুনিক এ্যাভিওনিক্স সমৃদ্ধ পরিবহন বিমান, ইউটিলিটি হেলিকপ্টার, যুগোপযোগী প্রশিক্ষণ বিমান, উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন এয়ার ডিফেন্স রাডার, ভূমি থেকে আকাশে নিক্ষেপণযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র, নতুন নতুন ঘাঁটি, ইউনিট ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান।
সরকার প্রধান শেখ হাসিনা আরও বলেন, কর্মকর্তাগণের প্রশিক্ষণে উৎকর্ষ আনতে বিমানবাহিনী একাডেমির জন্য এই ঘাঁটিতে নির্মাণ করা হয়েছে আন্তর্জাতিক মানের ‘বঙ্গবন্ধু কমপ্লেক্স’। মহাকাশ গবেষণা, দেশের বিমানবাহিনী এবং বেসামরিক বিমানকে দ্রুত এগিয়ে নেয়ার লক্ষ্যে আমরা প্রতিষ্ঠা করেছি ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এ্যাভিয়েশন এ্যান্ড এ্যারোস্পেস বিশ্ববিদ্যালয়’। তিনি বলেন, এই সকল কার্যক্রম বিমানবাহিনীর সক্ষমতাকে বহুলাংশে বৃদ্ধি করেছে। আজ বাংলাদেশ বিমানবাহিনী দেশে ও দেশের বাইরে এক সম্মানজনক অবস্থায় উন্নীত হয়েছে।
শেখ হাসিনা বলেন, যেহেতু জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনেও বাংলাদেশ ভূমিকা রাখছে, সেক্ষেত্রেও বিমানবাহিনীকে উপযুক্ত করে আমরা গড়ে তুলছি। আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সঙ্গে এ্যারোনটিক্যাল সেন্টারও নির্মাণ করেছি। আমার একটা আকাক্সক্ষা আছে এই বাংলাদেশেই একদিন আমরা যুদ্ধ বিমান তৈরি করতে পারব। কাজেই এর ওপর গবেষণা করা এবং আমাদের আকাশসীমা সংরক্ষিত রাখার কাজটা আমরা নিজেরাও যাতে করতে পারি সেইভাবে আমরা প্রস্তুতি নিচ্ছি।
প্রধানমন্ত্রী ন্যাশনাল স্ট্যান্ডার্ড পাওয়া ইউনিট দু’টির সদস্যদের উদ্দেশে বলেন, পতাকা হলো জাতির স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, সম্মান ও মর্যাদার প্রতীক। তাই পতাকার মান রক্ষা করা সামরিক বাহিনীর সকল সদস্যের পবিত্র দায়িত্ব। তিনি বলেন, জাতীয় পতাকা পাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করা যে কোন ইউনিটের জন্য একটি বিরল সম্মান ও গৌরবের বিষয়। ১১ স্কোয়াড্রন প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই বিমানবাহিনীর ক্যাডেটদের মৌলিক উড্ডয়ন প্রশিক্ষণ প্রদানের মতো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব সুচারুভাবে সম্পন্ন করে আসছে। পাশাপাশি বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, বাংলাদেশ নৌবাহিনী এবং বন্ধুপ্রতীম রাষ্ট্রসমূহের সামরিক বৈমানিকগণকেও এই স্কোয়াড্রন সাফল্যের সঙ্গে প্রশিক্ষণ দিয়ে আসছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২১ স্কোয়াড্রন বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর সম্মুখ সারির নিবেদিত আক্রমণাত্মক স্কোয়াড্রন। এই স্কোয়াড্রন এফটি-৬ এবং এ-৫ যুদ্ধবিমান পরিচালনার মাধ্যমে যাত্রা শুরু করে। পরবর্তীকালে ২০১৫ সালে এই স্কোয়াড্রনে সংযুক্ত হয় ৪র্থ প্রজন্মের ইয়াক-১৩০ কম্ব্যাট ট্রেইনার বিমান যা ২১ স্কোয়াড্রনকে আকাশসীমা প্রতিরক্ষার দায়িত্বে আরও শক্তিশালী ও নির্ভরযোগ্য করে তোলে। বর্তমানে এই স্কোয়াড্রন আমাদের আকাশ প্রতিরক্ষা শনাক্তকরণ অঞ্চলের সর্বোচ্চ শেষ সীমানায় পর্যবেক্ষণ মিশন পরিচালনা করে যা সত্যিই প্রশংসার দাবিদার।
সরকার প্রধান বলেন, ১১ স্কোয়াড্রনকে বৈমানিকদের মৌলিক উড্ডয়ন প্রশিক্ষণ প্রদানে এবং ২১ স্কোয়াড্রনকে দেশের আকাশসীমা প্রতিরক্ষায় অনন্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ আজ স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতীক ‘জাতীয় পতাকা’ প্রদান করা হলো। তিনি ১১ স্কোয়াড্রন এবং ২১ স্কোয়াড্রনের সকল সদস্যকে অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, কর্মদক্ষতা, পেশাদারিত্ব এবং দেশসেবার স্বীকৃতি হিসেবে যে পতাকা আজ আপনারা পেলেন তার মর্যাদা রক্ষা এবং দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য, আন্তর্জাতিকভাবে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে যখন দায়িত্ব পালন করেন, আমি মনে করি আপনারা সবসময় যে কোন ত্যাগ স্বীকারে সদা প্রস্তুত থাকবেন। বাংলাদেশের মানমর্যাদা যেন সবসময় বৃদ্ধি পায় সেদিকে বিশেষ দৃষ্টি রেখে আপনারা আপনাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করবেন।
বিমানবাহিনীর জনসেবামূলক কর্মকাণ্ডেরও প্রশংসা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিমানবাহিনী তার মূল কার্যক্রমের পাশাপাশি সবসময়ই জাতি গঠনমূলক কর্মকাণ্ডে নিজেদের নিয়োজিত রাখে। বর্তমান করোনাভাইরাসের কারণে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে বিমানবাহিনীর হেলিকপ্টারযোগে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল হতে কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত উল্লেখযোগ্য সংখ্যক রোগীকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় স্থানান্তর করা হয় এবং বিমানবাহিনীর এ কার্যক্রম বর্তমানেও অব্যাহত রয়েছে।
শেখ হাসিনা এ প্রসঙ্গে আরও বলেন, কোভিড-১৯ এর কারণে উদ্ভূত বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক ফ্লাইট বন্ধ হয়ে গেলে বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশে আটকেপড়া লোকজনকে নিজ নিজ দেশে প্রত্যাবর্তনের জন্য বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর তত্ত্বাবধানে চার্টার্ড ফ্লাইট পরিচালনা করা হয়। লেবাননে সংঘটিত ভয়াবহ বিস্ফোরণের কারণে উদ্ভূত পরিস্থিতিতেও বিমানবাহিনীর পরিবহন বিমানের মাধ্যমে মানবিক সহায়তা প্রেরণ করা হয়।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় এবং বিভিন্ন বৈদেশিক মিশনে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর সদস্যরা আত্মত্যাগ, কর্তব্যনিষ্ঠা ও পেশাদারিত্বের মাধ্যমে বাংলাদেশের জন্য বয়ে আনছে সম্মান ও মর্যাদা যা বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিকে উজ্জ্বল করেছে। এই সুনাম অক্ষুণ্ন রাখতে আপনারা একনিষ্ঠভাবে কাজ করে যাবেন- এটাই আমার প্রত্যাশা।