ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

শাকিল আহমেদ মিরাজ

বিতর্কে আইপিএল বনাম দেশপ্রেম

প্রকাশিত: ২১:৫১, ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২১

বিতর্কে আইপিএল বনাম দেশপ্রেম

ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ (আইপিএল) না দেশ, কোনটা আগে- বিতর্কটা পুরনো। অর্থ, গ্ল্যামার, জনপ্রিয়তায় ভারতের ঘরোয়া এই টি২০ আসরের শিকড় এখন অনেক গভীরে। সত্যটা বুঝতে পেরেই সূচী নির্বাচনে অন্য দেশগুলোর দ্বিপক্ষীয় সিরিজ এড়ানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা এবং অনুরোধ দুটোই করে আসছিল ইন্ডিয়ান বোর্ড (বিসিসিআই)। কিন্তু মহামারী করোনার কারণে এলোমেলো হয়ে পড়া আইসিসি এফটিপির (ফিউচার প্ল্যান ট্যুর) মাঝে ছয় মাসেরও কম সময়ে দু’দুটি আইপিএল অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। আগামী এপ্রিল-মে মাসে হবে টুর্নামেন্টটির ১৪তম আসর। এ সময়ে ইংল্যান্ড সফর করবে নিউজিল্যান্ড, টেস্ট খেলতে বাংলাদেশ যাবে শ্রীলঙ্কায়। আইপিএলকে প্রাধান্য দিয়ে ওই সিরিজে খেলবেন না সাকিব আল হাসান। ফের প্রশ্ন উঠেছে টাইগার অলরাউন্ডারের দেশপ্রেম নিয়ে। এই বিতর্কে নাম আছে বেন স্টোকস আর কেন উইলিয়ামসনের মতো তারকার! পক্ষে যুক্তি দেখিয়েছেন জনি বেয়ারস্টো। আছে ব্যতিক্রমও। ইংল্যান্ডের জো রুট যেমন দেশের খেলা থাকায় এবারও আইপিএলের নিলাম থেকে নাম প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। প্রোটিয়া পেসার কাগিসো রাবাদা জানিয়েছেন, ওই সময় পাকিস্তান যদি দক্ষিণ আফ্রিকা সফর করে তবে তিনি দেশকেই প্রাধান্য দেবেন। আইপিএল নিলামের পর থেকেই নতুন করে আলোচনাটা জমে উঠেছে। এমনিতেই করোনার ধাক্কা সামলে খেলা হচ্ছে নিয়মিত। দম ফেলার ফুরসত পাচ্ছেন না ক্রিকেটাররা। আজ আন্তর্জাতিক সিরিজ, কাল এই ফ্র্যাঞ্চাইজি টুর্নামেন্ট, এভাবেই চলছে তাঁদের দিন। আন্তর্জাতিক কোন সিরিজের মধ্যে ফ্র্যাঞ্চাইজি কোন টুর্নামেন্ট হচ্ছে, এমনও নজির দেখা যাচ্ছে। আর এই কারণেই খেলোয়াড়রা আইপিএল খেলবেন, না জাতীয় দলের ম্যাচ খেলবেন, এ নিয়ে জমে উঠেছে তর্ক-বিতর্ক। আইপিএল খেলার জন্য আসন্ন শ্রীলঙ্কা সফরে টেস্ট না খেলার সিদ্ধান্ত দিয়েছেন সাকিব। বলা যায়, আলোচনাটা নতুন করে উঠেছে টাইগার অলরাউন্ডারের কারণেই। ‘সে (সাকিব) ইতোমধ্যে আমাদের একটি চিঠি দিয়েছে। যেখানে সে আইপিএলে অংশ নেয়ার কারণে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে টেস্ট সিরিজ না খেলার কথা জানিয়েছে। আমরা তাকে অনুমতি দিয়েছি। যদি কেউ খেলতে না চায় (দেশের হয়ে টেস্ট) তাহলে কাউকে জোর করার কোন মানে নেই।’ বলছিলেন বাংলাদেশ ক্রিকেট অপারেশন্স কমিটির চেয়ারম্যান আকরাম খান। অথচ সাকিব এক সময় তার ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে জানিয়েছিলেন, তার কাছে আইপিএলের চেয়ে দেশ বড়! আইপিএল খেলার জন্য শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে টেস্ট না খেলার সিদ্ধান্ত দিয়েছেন সাকিব আল হাসান। বলা যায়, আলোচনাটা নতুন করে উঠেছে সাকিবের কারণেই। আইপিএল খেলার জন্য শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে টেস্ট না খেলার সিদ্ধান্ত দিয়েছেন সাকিব আল হাসান। সাবেক অধিনায়ক রকিবুল হাসান বলেন, ‘সাকিব শ্রীলঙ্কাকা যাচ্ছে না, এটা তার ব্যক্তিগত কারণ নয়। এ সিদ্ধান্তটা আগেই হয়েছিল। আইপিএল এবং ক্রিকেট বোর্ড তাকে চিন্তাভাবনা করে এনওসি (নো অবজেকশন সার্টিফিকেট) দিয়েছে। আইপিএল অনেক টাকার ব্যাপার। আমি মনে করি, সাকিবের জায়গা থেকে জাতীয়তাবোধটা আরেকটু বেশি দেখানো হলে বিষয়টা ভাল হতো।’ তিনি আরও যোগ করেন, ‘শ্রীলঙ্কা সফরে টেস্ট সিরিজে সাকিবের না থাকায় দলের ভারসাম্য নষ্ট হবে নিশ্চিত। জাতীয় দলের ক্ষতি হবে। আর জাতীয় দলের ক্ষতি মানে দেশের ক্ষতি। সেদিক থেকে আমি সাকিবের কাছে আরও দেশাত্মবোধ আশা করেছিলাম। কারণ তরুণ প্রজন্মের কাছে সে একজন আইডল।’ প্রসঙ্গত ফেব্রুয়ারি-মার্চের নিউজিল্যান্ড সফরে থাকছেন না সাকিব। পিতৃত্বকালীন ছুটি নিয়ে সে সময় সন্তানসম্ভবা স্ত্রীর পাশে থাকবেন তিনি। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত আইপিএল নিলামে ৩ কোটি ২০ লাখ রুপিতে সাকিবকে দলে ভেড়ায় কলকাতা নাইট রাইডার্স। পরদিনই সাকিবকে শ্রীলংকার বিপক্ষে টেস্ট সিরিজ খেলতে না চাওয়ার ছাড়পত্র দেয় বিসিবি। বিষয়টি নিয়ে দেশের ক্রীড়াঙ্গন বেশ উত্তাল। এখনো নিশ্চিত না হলেও আইপিএলে খেলতে যাওয়া বিদেশি ক্রিকেটারদের করোনা পরীক্ষা এবং কোয়ারেন্টাইনের সময়সীমার কারণে মার্চের শেষ দিকে কিংবা মাঝামাঝি সময় ভারতে পাড়ি জমাতে হতে পারে। এদিকে নিউজিল্যান্ড সফরে বাংলাদেশে মাঠে নামবে ২০ মার্চ থেকে। যদি মার্চের মাঝামাঝি কিংবা শেষের দিকে ভারতের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমাতে হয় তাহলে বাংলাদেশের বিপক্ষে সিরিজে উইলিয়ামসন, ট্রেন্ট বোল্ট, লুকি ফার্গুসন, মিচেল স্যান্টনার, কাইল জেমিসনের মতো ক্রিকেটারকে পাবে না নিউজিল্যান্ড। দেশটির ক্রিকেট বোর্ডও (এনজেডসি) ইতোমধ্যে তাদের অনুমতি দিয়েছে। সেক্ষেত্রে শুধু বাংলাদেশই নয়, ইংল্যান্ডের বিপক্ষে লর্ডস টেস্টেও তাদের না খেলার সম্ভাবনাই বেশি। আধুনিক এই সময়ে স্পিরিট অব ক্রিকেটের অনন্য নিদর্শন স্থাপন করা নিউজিল্যান্ড অধিনায়ক কেন উইলিয়ামসনও পড়েছেন এই বিতর্কের ফাঁদে। কারণ আইপিএলের সময়টাতে দুই টেস্টের সিরিজ খেলতে ইংল্যান্ডে পাড়ি জমাবে কিউইরা। কি করবেন তিনি?, ‘সম্ভবত এটি পছন্দসই ব্যাপার নয় (দেশের হয়ে টেস্ট খেলার পরিবর্তে আইপিএল)। যুগে যুগে আপনি অনেক পরিকল্পনা করতে পারেন এবং খুব কম সময়েই সেটির বাস্তবায়ন ঘটে। বাস্তবতা হচ্ছে পেশাদার ক্রিকেটার হিসেবে আমাদের যেকোন পরিস্থিতির সঙ্গেই মানিয়ে নিতে হয়। এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে এখন অপেক্ষা করতে হবে, দেখতে হবে কী ঘটতে চলেছে, কখন তারিখ চূড়ান্ত হতে যাচ্ছে।’ চলতি বছরের ২ জুন ইংল্যান্ড সফর করবে নিউজিল্যান্ড। যদিও আইপিএলের সূচী এখনও চূড়ান্ত হয়নি। তবে সম্ভাব্য তারিখ হিসেবে এটি শুরু হবে এপ্রিলের মাঝামাঝি বা শেষ সময়। যা পুরো মে মাস ধরে চলবে। সেক্ষেত্রে টুর্নামেন্টির প্লে-অফ হতে পারে জুনের শুরুর দিকে। আইপিএলের কারণে ঐ টেস্টে ইংল্যান্ড দলে থাকবেন না জোফরা আর্চার, জস বাটলার, বেন স্টোকসের মতো ক্রিকেটার। সাকিব, স্টোকদের হয়ে কথা বলেছেন জনি বেয়ারস্টো, ‘যারা আইপিএল খেলতে চায়, তাদের আপনি আটকাতে পারেন না। দেখুন, এটা ক্রিকেটেরই অংশ। আপনার এমন খেলোয়াড়ও থাকবে, যাদের টেস্ট খেলার চুক্তি আছে (লাল বলের চুক্তি), আবার কারও কারও ওয়ানডে খেলার চুক্তি আছে জাতীয় দলের সঙ্গে। আমার মনে হয় যাদের সঙ্গে বোর্ডের সাদা বলের চুক্তি আছে, তারা আইপিএল খেলতে চাইবে, আর আপনি তাদের আটকাতে পারবেন না।’ বলেন সানরাইজার্স হায়দরাবাদের এই ইংলিশ রিক্রুটার। ব্যতিক্রম উদাহরণও আছে। দেশকে প্রাধাণ্য দিয়ে টেস্ট অধিনায়ক জো রুট এবারের আইপিএলের নিলাম থেকে নাম প্রত্যাহার করে নেন। নিলাম থেকে নাম প্রত্যাহার করে রুট বলেছিলেন, ‘এটা কঠিন সিদ্ধান্ত। আইপিএলে খেলার জন্য আমি উদগ্রীব ছিলাম। আশা করি, সেটা করতে পারতাম। কিন্তু চলতি বছরে টেস্ট সূচীর কথা ভেবে, মনে হয়েছে এটা ঠিক সময় নয়। সুতরাং আমি সকল শক্তি আইপিএলে দিতে চাই না। সেটা ধরে রাখতে চাই। আমার কাছে ইংলিশ ক্রিকেটকে সেবা দেয়া অগ্রাধিকার। সুতরাং কঠিন সিদ্ধান্তটা নিতে হলো। আশা করি, আগামী বছর আইপিএলের সঙ্গে যুক্ত হতে পারব।’ একই সময়ে পাকিস্তান ক্রিকেট দলের দক্ষিণ আফ্রিকা সফরের কথা রয়েছে। দলটির তারকা পেসার কাগিসো রাবাদা জানিয়েছেন, সেটি হলে তিনি আইপিএল নয়, দেশকেই প্রাধান্য দেবেন। ২৫ বছর বয়সী এ প্রোটিয়া পেসার বলেন, ‘আমার কাছে দেশ সবার আগে। আইপিএলের শুরুর সময়ে যদি পাকিস্তানের বিপক্ষে আমাদের সিরিজ অনুষ্ঠিত হয়, তাহলে আমি হয়তো আইপিএলের এক সপ্তাহ মিস করবো। ভারতে দিল্লী আমার ঘর, কিন্তু জাতীয় দলের খেলা আমার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।’ ধারণা করা হচ্ছে ৪টি টি২০ ও ৩টি ওয়ানডে ম্যাচের সিরিজ আগামী ২ থেকে ১৬ এপ্রিলের মধ্যে হবে। শেষ পর্যন্ত যদি ওই সময়ই হয় তাহলে আইপিএলের শুরু দিকে থাকতে পারবেন না রাবাদা। দিল্লী ক্যাপিটালস শুরুতে পাবে না প্রোটিয়া পেসারকে। আর এ নিয়ে কোন আফসোসও নেই এ পেসারের। অথচ আরব আমিরাতে অনুষ্ঠিত ২০২০ আইপিএলের সর্বোচ্চ উইকেট শিকারি ছিলেন রাবাদা। দিল্লীর হয়ে ১৭ ম্যাচে নিয়েছিলেন ৩০টি উইকেট। দুটি ম্যাচে পেয়েছেন ৪টি করে উইকেট। সেই রাবাদার কাছে আইপিএলের নয়, দেশ বড়।
×