ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মাতৃভাষার মর্যাদা ও অভিব্যক্তির দীনতা

প্রকাশিত: ২১:১৩, ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২১

মাতৃভাষার মর্যাদা ও অভিব্যক্তির দীনতা

২১ ফেব্রুয়ারি ছিল আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। মূলত আমাদের মাতৃভাষা বাংলাকে প্রতিষ্ঠা এবং এর মর্যাদা রক্ষায় আমরা যে ত্যাগের ইতিহাস সৃষ্টি করেছি তা মহিমান্বিত হয়েছে আন্তর্জাতিকভাবে। এক সময় আমরা ২১ ফেব্রুয়ারি শুধু শহীদ দিবস হিসেবে পালন করতাম। পাকিস্তানী ঔপনিবেশিক শাসনামলে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার যৌক্তিক দাবিতে আন্দোলন সংগ্রাম করতে হয়েছে। রাজপথের সংগ্রামে প্রাণ বিসর্জন দিতে হয়েছে। মাতৃভাষা রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিষ্ঠা ও মর্যাদার লক্ষ্যে আত্মদানের ঘটনা ইতিহাসে বিরল। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আগেও যখন ব্রিটিশ উপনিবেশ ছিল, তখনও বাংলা ভাষা ছিল উপেক্ষিত। ইংরেজ শাসকগণ ইংরেজী ভাষাকেই চাপিয়ে দিয়েছিল সর্বক্ষেত্রে। ব্রিটিশ শাসন অবসানের পর পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠী উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে ঘোষণা করে। তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে যেখানে ৯৫ শতাংশ মানুষ বাঙালী হয়ে ওঠে প্রতিবাদমুখর। আন্দোলন, সংগ্রাম, আত্মত্যাগ তথা রক্তাক্ত ইতিহাসের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলা ভাষার মর্যাদা। ভাষা আন্দোলনের সিঁড়ি বেয়েই স্বাধীনতা আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে। আমাদের মহান নেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আন্দোলনের সফল পরিণতি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। তিনিই প্রথম বাংলা ভাষাকে আন্তর্জাতিক ফোরামে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করেন। জাতিসংঘে বাংলায় ভাষণ দিয়ে বাংলা ভাষাকে করেন মহিমান্বিত। এ ইতিহাস সকলেরই জানা। ১৯৭৫ সালে ১৫ই আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে বাঙালী, বাংলা ভাষা তথা আমাদের গোটা সংস্কৃতির ওপরই আঘাত আসতে থাকে। ধ্বংসযজ্ঞ শুরু হয় স্বাধীনতার মূল চেতনার ওপর। পরাজিত শক্তির সেই খেলা চলে দীর্ঘদিন। রাজনৈতিক নানা ঘটনা পরম্পরায় ১৯৯৬ সালে ১২ জুনের জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করে। পথ হারা বাঙালী ফিরে পায় পথ। ধ্বংসস্তূপের ভেতর থেকে বাংলা ভাষাও আত্মমর্যাদা ফিরে পেতে থাকে ধীরে ধীরে। ১৯৯৯ সালেই ইউনেস্কো কর্তৃক স্বীকৃতি লাভ করে ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের। ভাষার জন্য আত্মত্যাগের মহত্ত্ব ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বব্যাপী। বাঙালী ও বাংলা ভাষার প্রতি হৃদয় নিংড়ানো ভালবাসাটুকু ভাগ করে নেয়ার বিশ্বজন স্বীকৃতি বিস্ময়কর ঘটনাই বটে। তবে বর্তমানে মাতৃভাষা বাংলাকেন্দ্রিক নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে এসেও বাংলাভাষা নানাভাবে অবহেলার শিকার হচ্ছে। টানা তিন দফায় শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ শাসন ক্ষমতায়। অথচ বাংলা ভাষার প্রকৃত মর্যাদা রক্ষায় ব্যর্থতার পরিচয় মিলছে অনেক স্থানে। এটা সুগভীর চক্রান্ত কিনা সে প্রশ্নও সামনে আসছে। বাংলা ভাষার সংস্কৃতি বিকাশে সীমাহীন শৈথিল্য ভাবিয়ে তুলছে। আধুনিক তরুণ প্রজন্মের মধ্যেও বাংলা ভাষা ব্যবহারে যেন অনীহা। প্রশাসনযন্ত্রের কর্তাব্যক্তিরা বাংলা ভাষা উপেক্ষা করে ইংরেজী ব্যবহারেই যেন স্বচ্ছন্দ্যবোধ করেন। ইংরেজী জানা, ইংরেজীতে কথা বলাটা যেন অনেকটাই গৌরবের। মাতৃভাষা বাংলাকে প্রাধান্য দিয়ে অন্য ভাষায় পারদর্শিতা কোন অপরাধ নয়, কিন্তু বাংলাকে কেন উপেক্ষা করা হবে? উল্লেখ্য, গত বছর আকস্মিকভাবে চাল, আলু, পেঁয়াজের দাম বেড়ে যায়। এ অস্বাভাবিক বৃদ্ধির কারণ খতিয়ে দেখতে কৃষিমন্ত্রী কৃষি গবেষণা কাউন্সিলকে নির্দেশ দেন। কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের কর্তা ব্যক্তিরা সরকারের বিভিন্ন গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞ কৃষি অর্থনীতিবিদ্দের নিয়ে ১ মাসব্যাপী গবেষণা করে ৪০ হাজার শব্দের একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেন ইংরেজী ভাষায়। প্রশ্ন জাগে কাদের উদ্দেশ্যে ইংরেজীতে প্রতিবেদন প্রকাশ করা হলো? কৃষিমন্ত্রী মহোদয়ও আনন্দের ঢেকুর তুলেছেন এই মর্মে যে, তার অধীনস্ত কর্তা ব্যক্তিগণ কত জ্ঞান গরিমার অধিকারী! এটা রাষ্ট্রের কাছে অহংকারের বিষয় হতে পারে। কিন্তু আমাদের কাছে মনে হয়েছে এটা বাংলাভাষা বিরোধী একটা ষড়যন্ত্র এতে একটা ফাঁকি রয়েছে। আমরা প্রায়ই পত্রিকায় সরকারী বিভিন্ন সংস্থার টেন্ডার বিজ্ঞপ্তি ইংরেজীতে দেখতে পাই। আদালতের অধিকাংশ বিচারের রায় ইংরেজীতে প্রকাশ করা হয়। আইনজীবীগণ দাফতরিক চিঠিও লেখেন ইংরেজীতে। এসব দেখে মনে হয় না আমরা স্বাধীন বাংলাদেশে বসবাস করছি। আমাদের অনেক মন্ত্রী এমপি আমলাদের বক্তৃতাবাজিতেও বাংলার পাশাপাশি ইংরেজীতে বাক্য প্রকাশ লক্ষ্য করি। কেউ কেউ ভুল ইংরেজী বললেও বক্তা নিজেকে নিয়ে গৌরববোধ করেন। যে ফোরামে ইংরেজী বলেন সেখানে হয়তো ইংরেজী ভাষা হৃদয়ঙ্গম করার মতো লোকসংখ্যা প্রায় শূন্যের কোঠায়। কোন কোন মন্ত্রী মহোদয় টকশো’তে ইংরেজী বলেন, যার কোন প্রয়োজনই পড়ে না। এ ক্ষেত্রে বক্তা নিজেকে যতই অহংকারী ভাবুন আসলে এগুলো অভিব্যক্তির দীনতা। রাষ্ট্রীয়ভাবে সর্বত্র বাংলা ব্যবহারের কথা থাকলেও বাংলা ভাষা ব্যবহারে যে অনীহা তৈরি হয়েছে এবং দিনে দিনে তা বেড়েই চলছে-এর প্রকৃত কারণ খুঁজতে হবে। এর একটি প্রধান কারণ হয়তো হতে পারে ইংরেজী না জানলে ভাল চাকরি পাওয়া যায় না। চাকরি পাওয়ার যোগ্যতার ক্ষেত্রে যদি ইংরেজী ভাল জানাই প্রধান মাপকাঠি হয়, তবে মাতৃভাষা মর্যাদার কথা বলে লাভ কী? যে ভাষার জন্য রক্ত ঝড়ল, সংগ্রাম আন্দোলনের ইতিহাস সৃষ্টি হলো, তার মর্যাদার ক্ষেত্রে রাষ্ট্র যদি উদাসীন হয়, তবে আমাদের গৌরবে কালিমার আচর পড়বে। ব্যাংক, বীমা, বেসরকারী বড় বড় দেশীয় কোম্পানিতেও বাংলাভাষার ব্যবহার নেই। যে জন্য বর্তমান শিক্ষিত তরুণ প্রজন্ম বাংলা ভাষাকে উপেক্ষা করে যাচ্ছে। আজকালের একটি উচ্চশিক্ষিত তরুণ বাংলায় পদের সংজ্ঞা, বাক্যের সংজ্ঞা জানে না। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও এগুলো শেখানো হয় না সেভাবে। বাংলা গানের প্রতিও অনীহা। রবীন্দ্র-নজরুল সঙ্গীত প্রায় উঠেই গিয়েছে। এ ভাবে চলতে থাকলে দেখা যাবে রবীন্দ্র, নজরুল, সুকান্ত, শরৎচন্দ্র, শামসুর রাহমান, আব্দুল হাই, ড. শহীদুল্লাহ্ বরণ্যে ভাষা শিল্পীদের সবাই ভুলেই যাবে। ২১ ফেব্রুয়ারিতেই কেবল আমাদের মনে পড়ে মাতৃভাষা বাংলা এবং একে ভালবাসতে হবে। বাংলাদেশে যে সকল বিদেশী মিশন রয়েছে তাদের সঙ্গে আমাদের রাষ্ট্রীয় কর্তাব্যক্তি এবং শিক্ষিত সমাজের যারা যোগাযোগ রক্ষা করে চলেন তারা ইংরেজী ভাষা ব্যবহার করতে বাধ্য হন। কিন্তু আমরা কেন বিদেশী মিশন কর্তাদের বাংলা ভাষা ব্যবহারে বাধ্য করি না? আমরা যদি ওদের সঙ্গে বাংলা ভাষায় কথা বলি এবং ওদের কাছে বাংলায় চিঠি লিখি তবে তারাই বাংলা শিখতে বাধ্য হবে। আমরা আমাদের ভাষার মর্যাদা রক্ষা করে চলতে পারলে বিদেশীরাও আমাদের ভাষাকে মর্যাদা দিতে বাধ্য হবে। এখানে চাকরিতে আসার আগে বাংলা শিখেই আসবে। জাপান, কোরিয়া, চীন, ইতালি, জার্মানি, ফ্রান্স এসব দেশের উচ্চ শিক্ষিতরা ইংরেজীকে কখনও প্রাধান্য দেয় না। রাষ্ট্রীয় সকল কাজ নিজ দেশীয় ভাষায় সম্পাদন করে। আমাদের মধ্যে একটা হীনম্মন্যতা কাজ করে। সচিব, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, উকিল, উচ্চ শিক্ষিত লোকদের ইংরেজী জানে বলে উঁচুদরের মানুষ মনে করি। এটা মনে করার কোন কারণ নেই। যিনি মাতৃভাষার সাধক, মাতৃভাষা বাংলাকে প্রাধান্য দেন, তিনিই মর্যাদাবান। তাকেই বেশি সম্মান দেয়া উচিত। চাকরির যোগ্যতার ক্ষেত্রে শুদ্ধ করে মাতৃভাষা জানা লোকদের অগ্রাধিকার দেয়া উচিত। তবেই এই দৈন্যতা কাটবে। ব্রিটিশ শাসন থেকে শুরু করে পাকিস্তানী শাসন পর্যন্ত কিছু সামন্তবাদী ক্ষমতা ছাড়া আমাদের কোন রাজনৈতিক ক্ষমতা ছিল না। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে স্বাধীনতার পর রাজনৈতিক ক্ষমতা আমাদের হস্তগত হয়। ক্ষমতা পেয়ে আমরা কী করেছি? আগামীতে কী করব? আমাদের গণতন্ত্র, আমাদের সংবিধান মানুষের কাছে অনেক বড় বড় বিষয়ে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। প্রত্যেক নাগরিক সংবিধান অনুযায়ী কর্মানু-শীলনের একজন সহায়ক। যে ক্ষমতা আমাদের রয়েছে তার সদ্ব্যবহার খুবই জরুরী। যেহেতু মাতৃভাষাই আমাদের ক্ষমতাকে প্রলুব্ধ করেছে তাই এর মর্যাদা রক্ষায় আবার আন্দোলন শুরু করতে হবে। বাংলা ভাষাকে অবহেলা করে ক্ষমতাধর ব্যক্তিবর্গ জনগণের যে অপকার করছে তা এক ধরনের ভ্রষ্টাচার। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের কাজ হবে জনগণকে মাতৃভাষাভিত্তিক শক্তিশালী করা, তাকে দুর্বল করে রাখা নয়। সরকারী কর্তাব্যক্তি যিনি ইংরেজীতে দুর্দান্ত তাকে পদোন্নতি দিয়ে ক্ষমতাধিকারীযুক্ত পদে বসানো হলো, নরই হোক আর নারীই হোক তার সমগ্র দৃষ্টিভঙ্গিই পাল্টে যাবে। তখন সে নিজেকে প্রভু মনে করবে। সে মাতৃভাষা বাংলাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ক্ষমতার অপব্যবহারে মত্ত হয়ে উঠবেই। তার মধ্যে ঔপনিবেশিক চেতনা কাজ করবে। সহজ সরল ভাল বাংলা জানা কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দিলে বাংলা ভাষার মর্যাদা অক্ষুণ্ন থাকবে। মমত্ববোধও বেড়ে যাবে। সাধারণ মানুষের তার প্রতি তৈরি হবে অবিচল আস্থা ও বিশ্বাস। সুতরাং মাতৃভাষা বাংলার প্রতি গুরুত্ব দিয়ে প্রশাসনে কাঠামোগত পরিবর্তন আনতে হবে। কথায় কথায় ইংরেজীওয়ালাদের হাত থেকে দেশ ও দেশের ভাষাকে রক্ষা করতে হবে। কর্মকর্তাসহ একশ্রেণীর মানুষের অভিব্যক্তির দীনতা আর দেখতে চাই না। লেখক : আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক [email protected]
×