ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

আওয়ামী লীগে ভ্রাতৃকলহ

প্রকাশিত: ২১:০৯, ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২১

আওয়ামী লীগে ভ্রাতৃকলহ

বড় জাহাজে ফুটো হলেও ডুবতে সময় লাগে। কিন্তু ডুবতে যে হয় তার বড় প্রমাণ টাইটানিক জাহাজের ডুবে যাওয়া। বড় রাজনৈতিক দল একসময় বড় জাহাজের মতো ডুবে যায়। তার প্রমাণ ভারতের কংগ্রেস দল। স্বাধীনতা আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী এত বড় দল, যে দলে নেতা ছিলেন গান্ধী ও নেহেরুর মতো নেতা, ইন্দিরার মতো নেত্রী, সেই দল আজ ভারতের রাজনীতিতে কেবল খাবি খাচ্ছে। ইন্দিরার পুত্রবধূ, পৌত্র, পৌত্রী মিলেও ক্রমাগত জলসেচন করেও তরী তীরে তুলতে পারছেন না। কংগ্রেসের এই ভাঙ্গন শুরু হয়েছিল নরসিমা রাওয়ের প্রধানমন্ত্রিত্ব ও দলীয় নেতৃত্বের আমলে। কপালে সিঁদুর, মুখে রামনাম, নরসিমা কংগ্রেসকে ধর্মনিরপেক্ষতার রাজনীতি থেকে সরিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। তারপর কংগ্রেস আর ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শের দিকে ফিরতে পারেনি। গান্ধী, নেহেরুর নাম ব্যবহার করে, দলে আবার নেহেরু-পরিবারের নেতৃত্ব ফিরিয়ে এনেও কংগ্রেসকে বাঁচানো যায়নি। ভোট পাবেন এই আশায় বিজেপির অনুকরণে সোনিয়া গান্ধী, রাহুল গান্ধী, প্রিয়াঙ্কা মিলে শিবমন্দিরে গিয়ে বার বার ধর্ণা দেয়ার পরও কংগ্রেসের ভোট মেলেনি। আগামী সাধারণ নির্বাচনে কী হয় তা এখন দেখার রইল। কংগ্রেসে ভাঙ্গন ধরার একটা বড় কারণ, ইন্দিরা গান্ধী যতটা লৌহ কঠিন হাতে দলের ঐক্য ধরে রাখতে পেরেছিলেন, সোনিয়া বা রাহুল গান্ধী তা পারেননি। কংগ্রেসে দুর্নীতি ঢুকেছিল প্রবলভাবে। মনমোহন সিংয়ের মতো একজন ভাল মানুষের প্রধানমন্ত্রিত্বের আমলেও কংগ্রেস সরকারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির ব্যাপক অভিযোগ ওঠে। কংগ্রেস সরকার এই অভিযোগ খণ্ডন করতে পারেনি। কংগ্রেস দলও অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও দুর্নীতিতে জর্জরিত হয়ে ওঠে। নেহেরু বেঁচে থাকতে কামরাজ কমিশন গঠন করে দলের অধিকাংশ প্রৌঢ় ও প্রবীন নেতাকে দল থেকে ছাঁটাই করেছিলেন। দলের ভেতর কঠোরভাবে সংস্কার চালিয়ে দলকে খাড়া রেখেছিলেন। তারপর ইন্দিরার আমলে কংগ্রেস দুই ভাগ হয়ে যায়। আদি কংগ্রেস ও ইন্দিরা কংগ্রেস। আদি কংগ্রেসের এখন পাত্তা নেই। ইন্দিরার কঠোর ব্যক্তিগত নিয়ন্ত্রণে দলের শতাব্দী কালের গণতান্ত্রিক বিকাশ বন্ধ হয়ে যায়। দলের ভাঙ্গন সোনিয়া বা রাহুল বন্ধ করতে পারেননি। দলকে আত্মকলহ ও দুর্নীতি মুক্তি করতে পারেননি। তার ফলে এত বড় দলের আজ ডুবন্ত টাইটানিকের অবস্থা। ভারতের কংগ্রেসের বর্তমান পরিণতির কথা আজ এ জন্যেই উল্লেখ করলাম যে, ভারতের কংগ্রেসের কাছ থেকে বাংলাদেশের আওয়ামী লীগ শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে। সময় থাকতে শিক্ষা গ্রহণ করতে না পারলে আওয়ামী লীগেরও ভারতের কংগ্রেসের পরিণতি বরণ করতে হবে। আজ শেখ হাসিনার ব্যক্তিত্ব ও নেতৃত্বগুণে আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের বিশাল দল এবং ক্ষমতাসীন দল। আগামীকালই শেখ হাসিনা দলের নেতৃত্ব ও প্রধানমন্ত্রিত্ব থেকে অবসর নিলে এই দলের ভাগ্যে কী ঘটবে, তা বলা খুব মুশকিল নয়। পরবর্তীকালে কংগ্রেসের মতো পরিবারতন্ত্রের নেতৃত্ব দ্বারাও এই দলকে রক্ষা করা কঠিন হবে। দুর্নীতি ও অন্তর্দ্বন্দ্ব বাংলাদেশের আওয়ামী লীগেও প্রবলভাবে উপস্থিত। দল দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকায় তাতে হাইব্রিড নেতাকর্মীর সংখ্যাধিক্য ঘটেছে। ক্ষমতার অপব্যবহার, দুর্নীতি ও সন্ত্রাসের অভিযোগ বহু আওয়ামী লীগ নেতা, মন্ত্রী ও এমপি এবং উপজেলা চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে রয়েছে। সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে বড় ধরনের অভিযান চালাচ্ছে। অনেক রুই-কাতলা ধরাও পড়েছেন। কিন্তু দুর্নীতির বিষবৃক্ষের মূলোচ্ছেদ ঘটেনি। দুর্নীতির মূলোচ্ছেদ ঘটাতে হলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আরও কঠোর হতে হবে। মাতৃহৃদয় নিয়ে দল পরিচালনা ও সরকার পরিচালনা ঠিক হবে না। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী শেরে বাংলা ফজলুল হককে বলেছিলেন, ‘তুমি দেশের শাসক হিসেবে অযোগ্য। কারণ, তুমি মায়ের হৃদয় নিয়ে শাসন চালাতে চাও।’ আমাদের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিত্ব ও যোগ্যতা অতুলনীয়। কিন্তু দেশ শাসনে ও দল পরিচালনায় তিনি অনেক সময় মায়ের হৃদয়ের পরিচয় দেন। এটা দেশ ও দল দু’য়ের জন্যই ক্ষতিকর। দলের দুর্নীতিবাজ কিছু কিছু রাঘববোয়াল ধরা পড়েছে, কিন্তু অনেক রাঘববোয়াল দলের ভেতরে স্নেহ ও প্রশ্রয় পেয়ে দেশের ক্ষতি করে চলার সুযোগ পাচ্ছে। এরা দলকে ডোবাচ্ছে। দেশকেও ডোবাচ্ছে। এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া না হলে আওয়ামী লীগ ভারতের কংগ্রেসের পরিণতি থেকে রক্ষা পাবে না। এ কথাটা আমি বার বার লিখছি। আওয়ামী লীগের শুভাকাক্সক্ষী বলেই লিখছি। কারণ, বর্তমান সময়ে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় না থাকলে বিকল্প কোন শক্তিশালী গণতান্ত্রিক দলের অনুপস্থিতিতে দেশে বিএনপি-জামায়াত অথবা বিএনপি-হেফাজত সরকার ক্ষমতায় আসবে। দেশে আধা তালেবানি শাসন প্রতিষ্ঠা হবে। করোনার চাইতেও এই বিপদ ভয়াবহ। আওয়ামী লীগ করোনা ঠেকিয়েছে, সঙ্গে এই বিপদ ঠেকাবারও সময় থাকতে ব্যবস্থা করুক। আওয়ামী লীগে ঐক্যের অভাব এবং অভ্যন্তরীণ কোন্দল প্রবল। তার প্রমাণ পাওয়া যায় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে দলের ভেতর থেকেই বিদ্রোহী প্রার্থীদের নির্বাচনে দাঁড়ানো এবং তাদের সংখ্যাধিক্য দেখে। সম্প্রতি এই আত্মকলহ দলের একেবারে উচ্চপর্যায়ে ভ্রাতৃকলহে পরিণত হয়েছে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের ছোট ভাই, নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ পরিষদের আওয়ামী লীগ দলীয় মেয়র মির্জা আবদুল কাদেরের হঠাৎ কালাপাহাড়ের মতো অভ্যুত্থান এবং সরকার ও দলের বিরুদ্ধে, নিজের ভাইয়ের বিরুদ্ধে সত্য-মিথ্যা অভিযোগ তুলে মিডিয়ার হিরো হয়ে ওঠার পেছনে কী কারণ রয়েছে, তা আমি জানি না। বিএনপি যা এতকাল পারেনি, কাদের মির্জা তা পেরেছেন। তিনি দলের এবং আপন ভাইয়ের যে ক্ষতি করেছেন, তা বিএনপি-জামায়াত করতে পারেনি। তাকে নাকি আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। এখন বহিষ্কার করা হলে কি হবে? কাদের মির্জা তার বাকযুদ্ধ এবং মাঠের যুদ্ধ থেকেও নিবৃত্ত হয়েছেন। কিন্তু একটি এঁড়ে ষাড়ের মতো রাজনীতির ব্যাপারে ঢুকে বাগানের যা ক্ষতি করেছেন, তা অপূরণীয়। রাজনীতিতে ভাইয়ে ভাইয়ে বিরোধ হয়। ঘনিষ্ঠ আত্মীয়দের মধ্যেও রাজনৈতিক বিরোধ ঘটে। পাকিস্তানে জেনারেল আইয়ুবের সরকারের বিরোধী দলের নেতা ছিলেন তার ভাই বাহাদুর খান। রাজীবের স্ত্রী সোনিয়া যখন কংগ্রেসের নেত্রী, তখন তার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন সঞ্জীবের স্ত্রী মেনকা গান্ধী। এ রকম উদাহরণ অনেক আছে। কিন্তু তাদের কেউ রাজনৈতিক মতবিরোধকে ব্যক্তিগত গালাগালিতে পরিণত করেননি। এদিক থেকে কাদের মির্জা রাজনীতিতে চরম ধৃষ্টতার একটা উদাহরণ স্থাপন করলেন। তার অভিযোগগুলোর অনেক কিছু হয়তো সত্য। কিন্তু অভিযোগগুলোকে তিনি যেভাবে গালাগালিতে পরিণত করেছেন, তাতে তিনি সাময়িকভাবে মিডিয়ার হিরো হতে পারেন, কিন্তু তার অভিযোগ নিয়ে আলোচনার কোন সুযোগ রাখেননি। তিনি পাগলা হাতির মতো কলাবাগানে ঢুকেছেন। কলা খেতে পারেননি। বাগান তছনছ করেছেন। তার এই পাগলামির উদ্দেশ্যটা কী তা এখনও বোঝা যায়নি। কেউ বা কোন মহল উদ্দেশ্য নিয়ে তাকে উসকানি দিয়েছে কিনা তা হয়ত অদূর ভবিষ্যতে জানা যাবে। তবে এই মুহূর্তে তার পাগলামি আওয়ামী লীগ এবং তার বর্তমান সাধারণ সম্পাদকের রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের কোন ক্ষতি করেছে কিনা, তা যাচাই করা দরকার। করে থাকলে তার ‘ব্যক্তিগত চিকিৎসা’ নয়, রাজনৈতিক চিকিৎসা প্রয়োজন। ওবায়েদুল কাদেরকে তার সাংবাদিক জীবন থেকে আমি চিনি। শিক্ষিত ও মার্জিত স্বভাবের মানুষ। রাজনীতিক হিসাবেও তার যোগ্যতা, দক্ষতা ও মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের প্রতি অবিচল নিষ্ঠার প্রমাণ তিনি দিয়েছেন। একটা ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের ভেতরের ঐক্য ও সংহতি ধরে রাখা কষ্টকর। এই দুরূহ কাজটি তিনি পারবেন বলেই শেখ হাসিনা তাকে আস্থার সঙ্গে তাকে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক করেছিলেন। তিনি সেই আস্থার সম্মান রেখেছেন। হঠাৎ এক রোগের আক্রমণে তার জীবন সংশয় হয়েছিল। বিদেশে দীর্ঘ চিকিৎসার পর তিনি আরোগ্য লাভ করেন। অনেকেই মনে করেছিলেন এই ভয়ানক অসুস্থতার পর তিনি দলের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করতে পারবেন না। কিন্তু দুর্বল শরীরেও তিনি দল পরিচালনায় সবল ভূমিকা রেখেছেন। ফলে তিনি দলের সাধারণ সম্পাদক পদে এখনও আছেন। ভবিষ্যতেও থাকবেন বলে আশা করি। স্বাধীনতার পর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের পদে প্রয়াত জিল্লুর রহমানের পর ওবায়দুল কাদেরকেই আমি সেরা সাধারণ সম্পাদক মনে করি। বাম ও ডান রাজনীতিতে তার হেলাদোলা নেই। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় তার দৃঢ় অবস্থান। ভবিষ্যতের জন্যও তিনি আওয়ামী লীগের এক সম্পদ। এই উদীয়মান নেতৃত্বকে আঘাত করে তার ছোট ভাই মির্জা কাদের ভাল কাজ করেননি। তিনি কাদের উসকানিতে কাজটি করেছেন তা জানা গেলে বোঝা যেত, কাদের মির্জা দলের ভেতরের না বাইরের শত্রুদের দ্বারা প্ররোচিত হয়েছিলেন। দল গোছানোর এটাই সময়। আওয়ামী লীগ একটি বিশাল দল, ক্ষমতাসীন দল। তাতে ভারতের কংগ্রেসের মতো পতনের বড় বড় রোগ দেখা দিতেই তার চিকিসা প্রয়োজন। আওয়ামী লীগে সাংগঠনিক সংস্কার প্রয়োজন। শুদ্ধি অভিযান প্রয়োজন। দলে এই সাম্প্রতিক ভ্রাতৃকলহ আওয়ামী লীগ নেতৃত্বকে এই সতর্ক বাণীই জানাচ্ছে। লন্ডন, ২৩ ফেব্রুয়ারি, মঙ্গলবার, ২০২১ ॥
×