ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ইসমত আরা জুলী

বিজ্ঞানের বিস্ময়কর আবিষ্কার টিকা

প্রকাশিত: ২১:০৭, ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২১

বিজ্ঞানের বিস্ময়কর আবিষ্কার টিকা

মানবদেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা কৃত্রিমভাবে শক্তিশালী করে মারাত্মক সংক্রামক ব্যাধি থেকে মানুষকে রক্ষা করার ব্যবস্থার নামই হচ্ছে টিকাদান। অধিকাংশ টিকা ইনজেকশন প্রদানের মাধ্যমে দেয়া হয়। কারণ এগুলো অন্ত্রের মাধ্যমে শোষিত হতে পারে না। পোলিও, রোটাভাইরাস, টাইফয়েড ও কলেরার টিকা মুখে দেয়া হয়, যাতে এসব মানব অন্ত্রে প্রতিরোধ ব্যবস্থা তৈরি করতে পারে। টিকা গ্রহণের মাধ্যমে মানবশরীরে একটি স্থায়ী প্রতিরোধ ব্যবস্থা তৈরি হয়। কিন্তু এর জন্য অন্তত কয়েক সপ্তাহ সময় লাগে। এটির প্যাসিভ ইমিউনিটির পার্থক্য রয়েছে। কারণ প্যাসিভ ইমিউনিটি (যেমন, মাতৃদুগ্ধ পানের মাধ্যমে) সঙ্গে সঙ্গে কার্যকর হয়। শতকরা কত ভাগ লোককে টিকা দিলে একটি জনবসতিতে হার্ড ইমিউনিটি গড়ে উঠবে তা ভিন্ন ভিন্ন রোগে ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে। যেমন মিজেলস বা হামের ক্ষেত্রে একটি জনবসতির ৯৫% লোককে টিকা দিলে তবেই হার্ড ইমিউনিটি গড়ে উঠবে। বাকি ৫% লোক টিকা গ্রহণকারীদের এই রোগটির সংক্রমণ না ঘটানোর কারণে নিরাপদে থাকবে। একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে, বর্তমান গতিতে যুক্তরাষ্ট্রের জনগণকে করোনাভাইরাসের টিকা দেয়া অব্যাহত থাকলে মোট জনসংখ্যার ৭০%কে দুই ডোজ করে টিকা দিতে আরও নয় মাস সময় লাগবে। আর তখনই যুক্তরাষ্ট্রে হার্ড ইমিউনিটি তৈরি হবে বলে আশা করা যায়। অন্য সব ওষুধপত্রের মতো সব টিকা সমানভাবে কার্যকর বা এটি ১০০ ভাগ নিরাপত্তা দেবে তা বলা যায় না। যখন শরীরে এক ডোজ টিকা প্রদান করা হয় তখন প্রথমবারের মতো শরীর একটি নির্দিষ্ট রোগের প্রতিষেধক টিকার মুখোমুখি হয়। এটি মানবশরীরের রক্তের দুই ধরনের শ্বেতকণিকাকে কার্যকর করে- প্রথমটা হচ্ছে প্লাজমা বি সেল, যা মূলত এ্যান্টিবডি তৈরিতে মনোযোগী হয়। যদিও প্রথম ডোজ গ্রহণ করার পর শরীরে এ্যান্টিবডির স্রোত তৈরি হয়, কিন্তু দ্বিতীয় ডোজ গ্রহণ না করলে এ্যান্টিবডির পরিমাণ দ্রুত কমে যেতে থাকে। রক্তের শ্বেতকণিকায় আছে টি সেল, যারা যে কোন এক ধরনের রোগজীবাণুকে চিহ্নিত করতে ও ধ্বংস করতে সক্ষম। এদের মধ্যে অনেক মেমোরি টি সেল রয়েছে যারা অনেক বছর ধরে কার্যকর থাকে। এর অর্থ হচ্ছে টিকা থেকে প্রাপ্ত রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সারাজীবন থাকে। সপ্তদশ শতাব্দীতে চীনের বৌদ্ধ ভিক্ষুরা সর্পদংশনের বিষক্রিয়া থেকে বাঁচার জন্য সর্পবিষ পান করতেন। এতে সাপের কামড়ের পরও তারা সুস্থ থাকতেন। অতি প্রাচীনকালেও গুটিবসন্তের নির্যাস এ রোগের প্রতিরোধের জন্য ব্যবহৃত হয়ে এসেছে। চীন দেশের লোকেরা এটি ১০০০ খ্রিস্টাব্দে ব্যবহার করত বলে জানা যায়। আফ্রিকা ও তুরস্কেও এটির প্রচলন ছিল বলে জানা যায় যখন রোগটি ইউরোপ ও আমেরিকায় ছড়িয়ে পড়েনি। তবে অন্য এক গবেষণায় জানা গেছে, খ্রিস্টপূর্ব ২০০ সালে এই পদ্ধতির ব্যবহার শুরু হয় এবং এটি প্রাচীন চীন ও ভারতে গুটিবসন্ত প্রতিরোধের জন্য ব্যবহার হতো। ডাক্তার এ্যাডওয়ার্ড জেনার ১৭৯৬ সালে গরুর গুটিবসন্তের নির্যাসকে সাফল্যজনকভাবে মারাত্মক সংক্রামক ব্যাধি গুটিবসন্তের প্রতিষেধক হিসেবে মানব শরীরে প্রয়োগ করেন। তিনি গ্রামের সাধারণ মানুষের টোটকা চিকিৎসা থেকে এই ধারণাটি পেয়েছিলেন বলে জানা যায়। এ্যাডওয়ার্ড জেনার তরুণী গোয়ালিনী সারাহ্ নেমসের হাত ও বাহু থেকে গরুর গুটিবসন্তের নির্যাস সংগ্রহ করেন এবং এটি তিনি জেমস ফিপস্ নামের আট বছরের একটি ছেলের শরীরে প্রয়োগ করেন। প্রথমে ছেলেটির হালকা জ্বর আসে ও সে বগলের নিচে অস্বস্তি অনুভব করতে থাকে। নয়দিনের মাথায় তার ঠাণ্ডা অনুভূত হয় ও সে ক্ষুধামন্দায় ভোগে। কিন্তু পরদিন সে অনেক ভাল বোধ করে । এর ঠিক দুই মাস পর তিনি ছেলেটির শরীরে তাজা গুটিবসন্তের নির্যাস প্রয়োগ করেন। এতে সে সংক্রমিত হয়নি এবং ডাক্তার এ্যাডওয়ার্ড জেনার নিশ্চিত হন যে, ছেলেটির শরীরে রোগটির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে উঠেছে। তিনি গবেষণার ফলাফলটি লিখিতভাবে প্রকাশ করার পর তার আবিষ্কারের খবর দ্রুতগতিতে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ায় এই টিকার ব্যবহারও তাড়াতাড়ি শুরু হয়ে যায়। ১৮০১ সালে এক লাখ মানুষ তার আবিষ্কৃত টিকা গ্রহণ করে। যদিও প্রাণীর শরীর থেকে নেয়া গুটি মানবশরীরে প্রয়োগ নিয়ে চিকিৎসাবিদ ও ধর্মীয় নেতারা তুমুল বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন। ‘ভ্যকসিনেশন’ শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন সার্জন রিচার্ড ডানিং তার ‘সাম অবজারবেশন অন ভ্যাকসিনেশন’ গ্রন্থে ১৮০০ সালে। অষ্টাদশ শতাব্দীতে গুটিবসন্ত রোগে ইউরোপে প্রতিবছর ৪ লাখ মানুষ মৃত্যুবরণ করত। আর বেঁচে যাওয়া মানুষের তিনভাগের একভাগকে অন্ধত্ববরণ করে নিতে হতো। ডাক্তার এ্যাডওয়ার্ড জেনারের আবিষ্কৃত এই পদ্ধতি পরবর্তী দুই শ’ বছর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটায়। ফলে পরবর্তীতে গুটিবসন্তের মতো প্রাণসংহারি সংক্রামক ব্যাধি সম্পূর্ণভাবে নির্মূল হয় বিশ্ব থেকে। ফ্রান্সের জীববিজ্ঞানী, অণুজীববিজ্ঞানী ও রসায়নবিদ লুই পাস্তুর ১৮৮১ সালে এনথ্রাক্সের একটি টিকা আবিষ্কার করেন, যা পরবর্তীতে ভেড়া, ছাগল ও গরুর ওপর সফলভাবে প্রয়োগ করা হয়। এরপর ১৮৮৫ সালে জলাতঙ্ক নিয়ে গবেষণা করার সময় তিনি প্রথমবারের মতো মানুষের জন্য তার তৈরি প্রথম টিকা নিয়ে পরীক্ষা করেন। এই টিকাটি তিনি তৈরি করেন খরগোশের দুর্বল ভাইরাস দ্বারা যা এই প্রাণীর মেরুদণ্ড থেকে সংগ্রহ করা হয়। লুই পাাস্তুরের তৈরি জলাতঙ্ক টিকা এর পরে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করে। ১৯৩০-এর পুরো দশক ধরে ডিপথেরিয়া, টিটেনাস, এনথ্রাক্স, কলেরা, প্লেগ, টাইফয়েড, যক্ষ্মা এবং আরও অনেক প্রাণসংহারি রোগের প্রতিবিষ ও টিকা আবিষ্কার নিয়ে কাজ চলতে থাকে। লুই পাস্তুর জীবন্ত কিন্তু দুর্বল কলেরা টিকা ও এনথ্রাক্স টিকা মানবশরীরে প্রয়োগ করার মাধ্যমে ( ১৮৯৭ ও ১৯০৪ সালে) টিকা প্রদান এবং উন্নয়নের ক্ষেত্রে একটি যুগান্তকারী সাফল্যকে স্পর্শ করেন। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষে প্লেগের টিকা আবিষ্কার হয়। ১৮৯০ ও ১৯৫০ সালের মধ্যে জীবাণুঘটিত রোগের টিকা আবিষ্কার অগ্রগতিতে ব্যাপক প্রসার লাভ করে। এ সময়ের বেসিলে-ক্যালমেটে-গিওয়েরিন (বিসিজি) টিকা আবিষ্কার একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা, যা বর্তমান সময়েও ব্যাপকভাবে ব্যবহার হচ্ছে। ১৯২৩ সালে আলেকজান্ডার গ্লেইনি ফরমালডিহাইডের মাধ্যমে টিটেনাস টক্সিনকে অকার্যকর করার একটি নিখুঁত পদ্ধতি আবিষ্কার করেন। একই পদ্ধতি পরে ডিপথেরিয়ার টিকা তৈরিতে ১৯২৬ সালে ব্যবহার করা হয়। কিন্তু হুপিং কাশির টিকা তৈরিতে অনেক লম্বা সময় লেগে যায়। ভাইরাল টিস্যু কালচার পদ্ধতি ১৯৫০-১৯৮৫ এ সময়ের মধ্যে অনেকখানি উন্নতি করে। (অকার্যকর) পোলিও টিকা ও সাবিন (জীবন্ত ও দুর্বল মুখ দিয়ে নেয়ার) পোলিও টিকা আবিষ্কারের পথ উন্মোচিত হয়। গণটিকাদান কর্মসূচীর সফলতার কারণে পৃথিবীর অনেক দেশ থেকে পোলিও সম্পূর্ণভাবে নির্মূল হয়েছে। মাম্পস ও রুবেলার দুর্বল ধরনের ভাইরাস এসব রোগের টিকা উৎপাদনে ব্যবহার করা হয়েছে। যদিও টিকাদানের মাধ্যমে মানব সমাজে সার্বিক জনস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে একটি ইতিবাচক প্রভাব প্রমাণিত সত্য, কিন্তু শুরু থেকেই এই সফল কার্যক্রমের বিরুদ্ধে কিছু ধর্মীয় ও সামাজিক গোষ্ঠী পৃথিবীর সব দেশে সব সময়ই সক্রিয় রয়েছে। গবেষকরা মানবশিশুর শৈশবের অনেক প্রাণঘাতী রোগকে চিহ্নিত করেন (যেমন, মিজেলস, মাম্পস ও রুবেলা) এবং এসব রোগের টিকা রোগ কমানোর ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে সক্ষম হয়। আরও অনেক নিত্যনতুন গবেষণা ও প্রযুক্তি বর্তমান সময়ে টিকা আবিষ্কারের ক্ষেত্রে নতুন গতি সৃষ্টি করেছে। ডিএনএ প্রযুক্তি বিশ্বের প্রথম সারির বিজ্ঞানীদের নতুন পথের সন্ধান দিয়েছে। অসংক্রামক রোগ যেমনÑমাদকাসক্তি ও এলার্জির জন্য টিকা আবিষ্কারের গবেষণা শুরু হয়েছে। চিকিৎসা বিজ্ঞানে এ্যাডওয়ার্ড জেনার, লুই পাস্তুর ও মাওরিস হিলম্যান টিকা গবেষণা এবং আবিষ্কারের ক্ষেত্রে অগ্রপথিক হিসেবে বিবেচিত হন। আর এ্যাডওয়ার্ড জেনারকে টিকা আবিষ্কারের জনক হিসেবে পশ্চিমা বিশ্বে গণ্য করা হয়। গত এক বছর ধরে পৃথিবীব্যাপী যে করোনা অতিমারীর দাপটে কোটি কোটি মানুষ আক্রান্ত হয়েছে ও লাখ লাখ মানুষ মারা গেছে তার নাম হচ্ছে কোভিড-১৯। এই প্রাণঘাতী ভাইরাসের টিকা আবিষ্কারের জন্য শত শত নিবেদিত বিজ্ঞানী তাদের হাজার হাজার কর্মঘণ্টা পরীক্ষাগারে ব্যয় করেছেন। অবশেষে গত ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ থেকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের তৈরি কোভিড-১৯ টিকা মানবশরীরে প্রয়োগ শুরু হয়েছে। এই টিকা মারাত্মক প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে মানুষের শরীরে প্রতিরোধ ব্যবস্থা তৈরি করবে। কোভিড-১৯ অতিমারী শুরু হওয়ার আগেই করোনাভাইরাসের মতো অন্য দুটি রোগ মিডল ইস্ট রেস্পিরেটরি সিনড্রোম (মার্স) ও সিভিয়ার একুইট রেস্পিরেটরি সিনড্রোমের (সার্স) জন্য টিকা আবিষ্কারের কাজ দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলছিল। ওই দুটি রোগের টিকা তৈরির জন্য গবেষণালব্ধ ফলাফল ২০২০-এর শুরু থেকেই কোভিড-১৯ রোগের টিকা তৈরির ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে। এখন পর্যন্ত জনগণকে দেয়ার জন্য ১০টি টিকা অনুমোদন পেয়েছে। এগুলো হচ্ছে- দুটি আরএনএ টিকা ( ফাইজার-বায়োট্যাক টিকা ও মডার্না টিকা), চারটি প্রচলিত টিকা (বিবিআইবিপি-করভি টিকা, বিবিভি ১৫২ টিকা, করোনাভ্যাক টিকা এবং ডব্লিউআইবিপি টিকা), তিনটি ভাইরাল ভেক্টর টিকা (স্পুটনিক ভি টিকা, অক্সফোর্ড-এ্যাস্ট্রাজেনেকা টিকা ও এডি-৫ এনকভ টিকা) এবং একটি পেপটাইড টিকা (এপিভ্যাক করোনা টিকা)। তথ্যসূত্র : ইন্টারনেট লেখক : সাহিত্যসেবী ও অনুবাদক
×