ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

মিলু শামস

বায়ান্ন থেকে তরুণরাই প্রতিবাদী

প্রকাশিত: ২১:০৬, ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২১

বায়ান্ন থেকে তরুণরাই প্রতিবাদী

উনিশ শ’ বায়ান্ন সালের সাতাশ জানুয়ারি পল্টন ময়দানে ভাষণ দেয়ার সময় খাজা নাজিমুদ্দীন বোঝেননি পাকিস্তানের পূর্ব অংশে শীঘ্রই এক ইতিহাস রচিত হতে যাচ্ছে। সাতাশ জানুয়ারি থেকে একুশ ফেব্রুয়ারি- এক মাসেরও কম সময়ে ঘটেছিল তা। ভাষণের শুরুতেই তিনি আটচল্লিশ সালে ঢাকায় মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর রাষ্ট্র ভাষাবিষয়ক বক্তৃতার কিছু অংশ উদ্ধৃত করে আগত জনতাকে মনে করিয়ে দেন, জিন্নাহ উর্দুকেই পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা করার ঘোষণা দিয়েছিলেন এবং তাঁর ইচ্ছা মতে উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। নাজিমুদ্দীন সেদিন বাংলা ভাষার দাবিকে ‘প্রাদেশিকতা’ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। সে সঙ্গে এ তথ্যও জানিয়েছিলেন, আরবী অক্ষরে বাংলা ভাষায় শিক্ষা দেয়ার সরকারী উদ্যোগ সফলভাবে এগুচ্ছে। পরে তিরিশ জানুয়ারি দিনাজপুরে এক জনসভায় ‘প্রাদেশিকতার অভিশাপ’ থেকে পাকিস্তানকে মুক্ত রাখার জন্য জনগণকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে বলেন। এসব তথ্য ইতিহাসে সংরক্ষিত আছে। জনগণ নাজিমুদ্দীনের কথা কিভাবে রেখেছিলেন তাও ইতিহাসেই আছে। নাজিমুদ্দীনের বক্তব্যের প্রথম সংগঠিত প্রতিবাদ আসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের কাছ থেকে। ঊনত্রিশ জানুয়ারি ক্যাম্পাসে প্রতিবাদ সভা করেন তাঁরা। তিরিশ তারিখ প্রতীক ধর্মঘট শেষে আমতলার সেই ঐতিহাসিক প্রতিবাদ সভা। ছাত্রদের এই প্রতিবাদ বিক্ষোভ শেষ পর্যন্ত বাংলা ভাষার দাবি প্রতিষ্ঠিত করলেও এর জন্য চরম মূল্যও দিতে হয়েছিল। স্বাধীনতা ও আত্মমর্যাদার প্রশ্নে এ দেশে তরুণরাই সব সময় সামনের সারিতে থেকেছে। শাহাবাগে সমবেত তরুণদের বিরুদ্ধেও নানা ধরনের বিষোদ্গার হয়েছে। অন্য কোনভাবে তাদের ঘায়েল করতে না পেরে সবচেয়ে স্পর্শকাতর অস্ত্র ধর্মকে ব্যবহার। তারুণ্যের উত্থান দেখে ভয় থেকেই এসব অপপ্রচার। উনসত্তর বছর আগের তরুণরা ফেব্রুয়ারিতে জেগেছিল। তখন কিছু সংবাদপত্র তাদের প্রতি বিষোদগার করেছে। পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী হয়ত বুঝেছিল তরুণদের ফুঁসে ওঠার পরিণাম ভয়াবহ। এও হয়ত বুঝেছিল, ভাষার দাবিতে যারা প্রাণ দিতে পারে ভবিষ্যতে তাদের দাবি আরও ব্যাপক আকারের হতে পারে। ওই আঁচ থেকেই হয়ত পাঁচ ফেব্রুয়ারি সরকার সমর্থিত দৈনিক ডন তাদের সম্পাদকীয়তে লিখেছিল, ‘ভাষা প্রশ্নকে, যুবকদের কাছে যার একটা আবেগময় আবেদন আছে, কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে সংগ্রামে একটি খুব শক্তিশালী হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। যে সব মানুষ কায়েদে আযমের জীবদ্দশায় কোনদিন মাথা তোলার সাহস করেনি তাদেরকেই প্ররোচিত করা হচ্ছে জাতির পিতার উপদেশ অগ্রাহ্য করতে।’ আটচল্লিশ সালে দেয়া জিন্নাহর বক্তব্য উদ্ধৃত করে সম্পাদকীয়তে বলা হয়, ‘সে সময় কেউ সে বক্তব্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেনি। কিন্তু গত সপ্তাহে প্রধানমন্ত্রী নাজিমুদ্দীন যখন সেই একই কথার পুনরুক্তি করেন তখন সেই একই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা তাদের বিক্ষোভ প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে ধর্মঘট করেছে বলে জানা গেছে। কার প্রভাবে এই ছাত্রদের জাতির পিতার বিরুদ্ধে এই অসম্মান প্রদর্শন করতে বলা হয়েছে সেটা কি স্পষ্ট নয়? এই প্রভাব যা আসলে পাকিস্তানের শত্রুদেরই প্রভাব নিশ্চিহ্ন করতে হবে যদি পাকিস্তানকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে টিকে থাকতে হয়। যারা আমাদের রাষ্ট্রের বুনিয়াদকে খর্ব করতে বদ্ধপরিকর তাদের কাছে স্পষ্ট ভাষায় কথা বলার সময় এসেছে।... যারা প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষভাবে প্রাদেশিকতার ওকালতি করে তাদের রাষ্ট্রের শত্রু হিসেবে ঘোষণা করা এবং কোন প্রকার প্রশ্রয় না দেয়া উচিত [পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি (তয় খণ্ড) বদরুদ্দীন উমর]। বায়ান্ন, একাত্তর ও নব্বই-এর অভিজ্ঞতা জানাচ্ছে এ দেশে তরুণরা জাগলে কিছু একটা ঘটবেই। ‘ধর্ম’ অবমাননার অজুহাত দিয়ে সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা যারা করেছে তাদের নৈতিক জোর নেই। তা তাদের আচরণেই প্রকাশিত। কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক মধ্যযুগীয় ধ্যান ধারণার কিছু সংগঠন বছর কয়েক আগেও দেশজুড়ে নানা ধরনের তাণ্ডব চালানোর পাশাপাশি শহীদ মিনারে হামলা এবং জাতীয় পতাকা ছিঁড়ে ফেলার মতো ধৃষ্টতা দেখিয়েছে। দেশ জাতীয়তা জাতীয় পতাকার মর্ম বোঝার ক্ষমতা এদের নেই। ব্রিটিশ ভারতে যে কূপমণ্ডূকতার মধ্যে জন্ম হয়েছিল সেখানেই আটকে আছে তারা। নেপথ্যে যারা তাদের ব্যবহার করে তাদের মনোভাব পরিষ্কার। বাঙালীর অহঙ্কার শহীদ মিনার এখনও কাদের মর্মবেদনার কারণ- দেশের মানুষের কাছে তা অজানা নয়। দেশের মানুষের কাছে এগুলো সব সময়ই পরিষ্কার। অস্বচ্ছ করে রাখেন মূলত রাজনীতিবিদরা। প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে সুবিধাভোগী হওয়ায় তাদের যা করা উচিত তা সঠিকভাবে কখনোই করতে পারেননি। দু’দফায় সামরিক শাসনে অপরাজনীতি বিকাশের চূড়ায় পৌঁছেছিল। জেঁকে বসা সামরিক স্বৈরশাসককে উৎখাত করে নব্বইয়ে গণঅভ্যূত্থানের মধ্য দিয়ে যে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল জামায়াত-শিবির প্রশ্নে তা কি কোন মৌলিক পরিবর্তন আনতে পেরেছিল? বরং আরও কৌশলী টোপ শাসক শ্রেণীর রাজনৈতিক দলগুলোকে একটু একটু করে গ্রাস করেছে। তরুণদের শক্তি সীমাহীন। ক্ষমতা এবং ক্ষমতার বাইরের শাসক শ্রেণীর রাজনীতিকরা তা বোঝেন। তাদের প্রতিবাদের ঢেউ কোথা থেকে কোনদিকে গড়ায় তা প্রেডিক্ট করা মুশকিল। তরুণ প্রজন্ম রাজনৈতিক চালাকি, সুবিধাবাদী ভণ্ডামির স্বরূপ বোঝে। প্রথাগত কোন রাজনৈতিক ছাতাকে তারা ভরসা করে না। তারা নিজেদের পায়ে ভর করে চলার সাহস অর্জন করেছে। আর এরাই এ মুহূর্তে বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার শতকরা পঁয়ষট্টি ভাগ। এদের শক্তিকে গুরুত্বের সঙ্গে মূল্যায়ন না করলে চিহ্নিত দেশবিরোধীদের অস্তিত্বের সঙ্কট তো হবেই, মুখোশধারীদেরও মুখ লুকানোর জায়গা থাকবে না। শোনা যায়, দু’হাজার সতেরয় গণজাগরণ মঞ্চসহ সারাদেশের সব আন্দোলন নষ্ট করতে নাকি পাঁচ শ’ কোটি টাকার ফান্ড নিয়ে মাঠে নেমেছিল একটি চক্র। এসব টাকার জোগান দিয়েছে বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান। নানা ধরনের ধ্বংসাত্মক কাজের পাশাপাশি এ টাকার এক বড় অংশ নাকি ব্যয় হয়েছিল বিভিন্ন সুবিধাভোগীর ‘মুখ বন্ধ’ করার কাজে। তরুণদের মুখ বন্ধ করা যায় না, ভয় অন্যদের নিয়ে। তিন শ’ সদস্যের সুইসাইড স্কোয়াডও নাকি আন্দোলন নস্যাতের কাজে নেমেছিল। ধর্মভিত্তিক যে দলটি গঠিত হয়েছিল জার্মানির নাৎসী বাহিনীর অনুকরণে। নাৎসীদের হিংস্রতার সঙ্গে তাদের হিংস্রতার মিল শুধু নয়, তাদেরকে তারা ছাপিয়ে গিয়েছিল- উনিশ শ’ একাত্তর তার বড় প্রমাণ। স্বাধীন বাংলাদেশে সুবিধাবাদের রাজনীতির ভেলায় চেপে নির্বিঘ্নে একচল্লিশ বছর পার করে দিয়ে তারা হয়ত ভেবেছিল এমন মসৃণ পথেই তারা এগুতে থাকবে। কিন্তু যুদ্ধাপরাধীর বিচার এবং তা নিয়ে তরুণ প্রজন্মের বলা নেই কওয়া নেই কঠোর অবস্থানে তারা বিস্ময়ে বিমূঢ়। এ দেশের মানুষের মনের গভীরে তাদের প্রতি ক্ষমাহীন ঘৃণার তল তারা পরিমাপ করতে পারেনি। একচল্লিশ বছরে একটি প্রজন্ম একেবারে অন্য রকমভাবে বেড়ে উঠেছে সে হিসাব বোধহয় তাদের ছিল না। শাসক শ্রেণীর অন্য দলগুলোর ছিল কি? বিস্মিত তারাও। অনেকে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে হয়ত ভেবেছিলেন, এ অল্প বয়সীরা আর কতদূর যাবে। এক সময় তাদের উত্তেজনা ফুরিয়ে যাবে। এমন ভাবনা যে ভুল উনিশ শ’ বায়ান্ন সালই তার প্রমাণ। সে সময়ও ছাত্র-তরুণদের প্রতিবাদ সমাবেশকে অনেকে তাচ্ছিল্যের সঙ্গে উড়িয়ে দিয়েছিল। কিন্তু তাদের ডাকে সেই যে পূর্ব পাকিস্তান জেগেছিল তা চূড়ান্ত রূপ পেয়েছিল একটি স্বাধীন ভূ-খণ্ড অর্জনের মধ্য দিয়ে।
×