ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

তিস্তা নদী ঘিরে উন্নয়ন প্রকল্প

বঙ্গবন্ধুর পরিকল্পনা মুজিবশতবর্ষে বাস্তবায়নের উদ্যোগ

প্রকাশিত: ২৩:১০, ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২১

বঙ্গবন্ধুর পরিকল্পনা মুজিবশতবর্ষে বাস্তবায়নের উদ্যোগ

জাহাঙ্গীর আলম শাহীন, লালমনিরহাট ॥ স্বাধীনতার ৫০ বছর পর পূর্তি উপলক্ষে সাড়ে আট হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে তিস্তা নদী ঘিরে উন্নয়ন মহাপরিকল্পনার প্রকল্পটি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এই উন্নয়ন প্রকল্পের অর্থের জোগান দিতে চীন সরকারকে গত সপ্তাহে অর্থ মন্ত্রণালয়ের ইআরডি বিভাগ হতে প্রস্তাব দেয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। এই প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম শতবর্ষে তার (বঙ্গবন্ধুর) স্বপ্ন পূরণ হতে যাচ্ছে। তিস্তা নদী নিয়ে এই পরিকল্পনাটি বঙ্গবন্ধু ১৯৭৪ সালে গ্রহণ করেছিলেন। তার সুযোগ্যকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাবার নেয়া তিস্তা মহাপরিকল্পনাটি যুগোপযোগী, আধুনিক অবকাঠামো এবং ভারি শিল্প কারখানা স্থাপনের পরিকল্পনা সংযুক্ত করে রিভাইস প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর এই উদ্যোগকে রংপুরের মানুষ স্বাগত জানিয়েছেন। জানা গেছে, ১৯৭৪ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান উত্তরাঞ্চলের প্রধান প্রমত্ত নদী তিস্তার ভাঙ্গন প্রতিরোধে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনা করেছিলেন। পরিকল্পনা ছিল তিস্তাপাড়ের ভূমি উদ্ধার করা, তিস্তার পানি দিয়ে কৃষিজমিতে সেচ সুবিধা দেয়া, তিস্তাপাড়ে নগরায়ণ ও কৃষিভিত্তিক শিল্প কলকারখানা গড়ে তোলা। বঙ্গবন্ধুর সেই স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যায়। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে বিপথগামী কিছু সেনা সদস্য হত্যা করে। তার হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে তিস্তা মহাপরিকল্পনাসহ রংপুরের উন্নয়ন থমকে দাঁড়ায়। স্বাধীনতার ৪৯ বছর পরেও দেশের দক্ষিণাঞ্চলের সঙ্গে সমান তালে তাল মিলিয়ে রংপুর অঞ্চলের উন্নয়ন ঘটেনি। রংপুর পিছিয়ে যায়। এক সময় দক্ষিণ অঞ্চলের মানুষ জীবন-জীবিকার প্রয়োজনে দলে দলে রংপুর অঞ্চলে কাজ করেছে। এখন উল্টো চিত্র। রংপুরের মানুষ এখন কৃষি শ্রমিকসহ নানা কাজে দক্ষিণাঞ্চলে যায়। পানি উন্নয়ন বোর্ডের পুরনো দিনের নথিপত্রে তিস্তা নদী নিয়ে বঙ্গবন্ধুর পরিকল্পনার তথ্য পাওয়া যায়। বরেন্দ্র অঞ্চলের প্রান্তিক কৃষককে বিনামূল্যে সেচ সুবিধা দিতে তিস্তার পানি ব্যবহার করার চিন্তা ছিল। তাই নদী নিয়ে পরিকল্পনা, গবেষণা ও নদীর প্রাকৃতিক স্রোতধারা বাধাগ্রস্ত না করে নদীশাসনের উদ্যোগ নেয়া হয়। এই উদ্যোগের অংশ হিসেবে ১৯৭২ সালে ফরিদপুরে নদী গবেষণা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করা হয়। ’৭৪ সালে তিস্তা নদী নিয়ে প্রকল্প গ্রহণ করার কথা ছিল বর্তমান লালমনিরহাটের কালীগঞ্জের কাকিনার মহিপুরে। যেখানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তিস্তা দ্বিতীয় সড়ক সেতুটি নির্মাণ হয়েছে। প্রকল্প বাস্তবায়নে সেই সময় করা হয়েছিল নদীশাসন। এখানে প্রকল্প হলে রংপুর অঞ্চলের কৃষি ও কৃষকের ভাগ্যোন্নয়নে দৃষ্টান্ত সৃষ্টি হয়ে থাকত। এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য বাংলাদেশকে কৃষিতে স্বয়ংসম্পূর্ণ করা। উত্তরের কৃষি ও কৃষককে সমৃদ্ধ করা ছিল উদ্দেশ্য। দেশ কৃষি শস্য উৎপাদনে এগিয়ে নেয়াই ছিল লক্ষ্য। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করায় ৪৬ বছর পরেও তিস্তা পরিকল্পনা মুখথুবড়ে পড়ে ছিল। শেষ পর্যন্ত রংপুরের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনে পুনরায় বঙ্গবন্ধুর নেয়া পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হতে যাচ্ছে। এই পরিকল্পনা বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দূরদর্শিতার বহির্প্রকাশ ছিল। কাকিনার মহিপুরের পরিবর্তে দোয়ানিতে তিস্তা ব্যারাজ সেচ প্রকল্প ১৯৮৯ সালে করা হয়। ফলে তিস্তা সেচ প্রকল্পে পানির রিজার্ভ অর্ধেকে নেমে আসে। তিস্তা সেচ প্রকল্প এখন প্রায় অকার্যকর হওয়ার পথে। পানির অভাবে সেচের আওতা কয়েক গুণ হ্রাস পেয়েছে। কাকিনায় সেচ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে সেচের আওতা প্রায় দুই গুণ বেড়ে যেত। শুষ্ক মৌসুমে নদীর পানির রিজার্ভ থাকত দ্বিগুণ। তিস্তা নদীর ভাঙ্গন থাকত না। তিস্তা নদীর মূল স্রোতধারা বজায় থাকত। উত্তরাঞ্চলের কৃষিনির্ভর অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি সূচক স্থায়ীভাবে উর্ধমুখী থাকত সব সময়। চলতি বছরের ১৪ জানুয়ারি জেলা প্রশাসকের হলরুমে বঙ্গবন্ধু জন্মশতবর্ষে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ভূমিহীনদের নতুন গৃহ হস্তান্তর করেন প্রধানমন্ত্রী। অনুষ্ঠানে জেলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক মোঃ মতিয়ার রহমানের প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জানান, তিস্তা মহাপরিকল্পনাসহ দেশের সব নদ-নদী আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে খনন করা হবে। এদিকে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় ও অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের অর্থ সংগ্রহ করতে কয়েকটি দেশের সঙ্গে কথা হচ্ছে। প্রকল্পের অর্থ সরকার বৈদেশিক ঋণ, বৈদেশিক বিনিয়োগ, যৌথ বৈদেশিক অংশীদারিত্ব ও যে কোন সহজ শর্তে পেতে উন্নয়ন সহযোগী খোঁজা হচ্ছে। নেদারল্যান্ডস, চীনসহ কয়েকটি দেশ তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। তাদের সঙ্গে সরকার টু সরকার দ্বিপক্ষীয় আলাপ-আলোচনা চলছে। অর্থ পাওয়া না গেলে সেক্ষেত্রে সরকার অভ্যন্তরীণ সম্পদ হতে অর্থে জোগান দিয়ে তিস্তা পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করবে। এমন আভাস প্রধানমন্ত্রীর দফতর হতে পাওয়া গেছে। লালমনিরহাট পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলীর দফতর সূত্রে জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দারিদ্যপীড়িত জেলা লালমনিরহাটকে অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ করতে তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের দাফতরিক কাজ অনেক দূর এগিয়ে নিয়েছেন। এই প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় সাড়ে আট হাজার কোটি টাকা। প্রকল্প পরিকল্পনা ও নদী পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে। এই কাজটি দুই বছর ধরে মাঠ পর্যায়ে করেছে চীনা প্রতিষ্ঠান চায়না পাওয়ার। প্রকল্পটি হবে আধুনিক ও দৃষ্টিনন্দন। প্রকল্পের আওতায় তিস্তা নদীর দুই পাড় মিলে ২২০ কিলোমিটার উচুঁ গাইডবাঁধ নির্মাণ করা হবে। বাঁধের দুই পাশে থাকবে সমুদ্র সৈকতের মতো মেরিন ড্রাইভ। পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে নদীর পাড়কে গড়ে তোলা হবে। নদীপাড়ের রাস্তা দিয়ে পণ্য পরিবহন করা হবে। গড়ে তোলা হবে হোটেল, মোটেল ও রেস্টুরেন্ট। নির্মাণ করা হবে ১৫০ মেগাওয়ার্টের সৌরবিদ্যুত কেন্দ্র। গড়ে তোলা হবে কৃষি খামার। বিশ্ববিদ্যালয়, আধুনিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। ভারি ও মাঝারি শিল্প প্রতিষ্ঠান। তথ্যপ্রযুক্তি কেন্দ্র। বিদেশী পর্যটকদের টানতে এক্সক্লুসিভ পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলা হতে পারে। এখানে আধুনিক শহর গড়ে উঠবে। নদীর দুই পাড়ের প্রশস্ততা কমে মাত্র দুই কিলোমিটার হবে। নদীর মূলস্রোত ধারার সঙ্গে সমন্বয় করে ছোট ছোট শাখা-প্রশাখা নির্মাণ করে পুনরায় মূলস্রোত ধারায় সংযোগ করে দেয়া হবে। এতে নদী ভাঙ্গন ও বন্যা হতে মুক্ত থাকবে। নদী পাড় হয়ে উঠবে মনোমুগ্ধকর প্রকৃতিনির্ভর সৌন্দর্যময় স্থান। তিস্তার নদীগর্ভে চলে যাওয়া কয়েক লাখ হেক্টর বালুচর উদ্ধার হবে। চরগুলো হয়ে উঠবে বন্যামুক্ত ফসলের মাঠ। নদীপাড়ে গৃহহীন মানুষের গৃহ নির্মাণ করে দেয়া হবে। গড়ে তোলা হবে আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর পোশাক কারখানা। জেলা প্রশাসক মোঃ আবু জাফর জানান, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় প্রকল্প বাস্তবায়নে কাজ করছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে জেলাকে শিক্ষা ও সম্পদে সমৃদ্ধ করবে। ঘুচে যাবে এই অঞ্চলের দারিদ্র্য। লাখ লাখ শিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত বেকার যুবক ও যুব মহিলাদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। এদিকে ইআরডি সূত্রে জানা গেছে, তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে আন্তর্জাতিক পানিসম্পদ বিভাগ ও পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের মধ্যে এমওই স্বাক্ষর হয়েছে। প্রজেক্ট প্রপোজাল পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে জমা হয়েছে। প্রজেক্ট বাস্তবায়নে সম্ভাব্য ব্যয় সাড়ে আট হাজার কোটি টাকা ধরা হয়েছে। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের মহাপরিচালক এএম আমিনুল হক জানান, তিস্তা নিয়ে প্রকল্পটি চীনের স্বল্প সুদের সহজ শর্তে ঋণ সহায়তায় বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রস্তাবে দুই বছর আগে চীনের প্রতিষ্ঠান চায়না পাওয়ার পরিকল্পনা বাস্তবায়নে জরিপ করে। যার মধ্যে রয়েছে ডেল্টাপ্ল্যান ২১০০, ক্লাইমেট এ্যাডাপটেশন সেন্টার প্রতিষ্ঠা ও তিস্তা রিভার কমপ্রিহেনসিভ ম্যানেজমেন্ট এ্যান্ড রেস্টোরেশন প্রজেক্ট। ইআরডির অতিরিক্ত সচিব শাহরিয়ার কাদের সিদ্দিকী জানান, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে তিস্তা মহাপরিকল্পনার প্রস্তাব পেয়েছি। দাফতরিক কাজ শুরু হয়ে গেছে। অর্থ সংগ্রহে কূটনৈতিক তৎপরতা চলছে। প্রকল্পে অর্থ বিনিয়োগের আগ্রহ অনেকে দেখিয়েছে। প্রস্তাবগুলো পর্যালোচনা করা হচ্ছে।
×