ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

নাজনীন বেগম

সর্বস্তরে মাতৃভাষার চর্চা

প্রকাশিত: ২১:০৮, ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২১

সর্বস্তরে মাতৃভাষার চর্চা

১৯৫২ সালে ঘটে যাওয়া ভাষা আন্দোলনের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট আমাদের গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। ২১ ফেব্রুয়ারি মাতৃভাষার জন্য মূল্যবান জীবন উৎসর্গ করা তাও জাতীয় মর্যাদার মহিমান্বিত পর্ব। প্রায় সত্তর বছর হতে চলল ভাষার জন্য আত্মবলিদান দেয়ার রক্তাক্ত পথ পরিক্রমার, যা স্বাধীনতা সংগ্রামের বীজ বপনে নিয়ামক শক্তির ভূমিকায় ঐতিহাসিক দায়িত্বও পালন করে। স্বাধীনতার প্রেক্ষাপট যেমন ভাষা আন্দোলন তেমনি এই ঐতিহাসিক পর্বেরও আছে এক সাবলীল, গভীর পটভূমি। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় প্রদীপ জ্বালানোর আগে সলতে পাকানো। অবিভক্ত, অসাম্প্রদায়িক ভারতের সামগ্রিক সমাজ ব্যবস্থাই ছিল এক অচলায়তন বদ্ধ আবহ। শত রাজবংশের উত্থান পতনের মধ্যেও এই গতিহীন সমাজে সাধারণ মানুষের জীবন যাত্রা এক কঠিন আবর্তে অনড় ছিল। ভারতের দুর্ভেদ্য বর্ণাশ্রম প্রথায় মানুষে মানুষে ব্যবধান তৈরি হয়েছে সেটা যেমন ঠিক বিপরীতে বংশানুক্রমিকভাবে রাজা-বাদশাদের ক্ষমতার দ্বন্দ্ব, মর্যাদার লড়াই, ব্যক্তিত্বের সংঘাতে অনেক রক্তাক্ত পরিক্রমা চলমান থাকলেও সাধারণ মানুষের মধ্যে কোন বিপ্লব, বিদ্রোহ, দানা বাঁধেনি। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একচেটিয়া ব্যবসা বাণিজ্য ছাড়াও ক্ষমতার লিপ্সা তাদেরকে প্রথমেই সম্পদশালী বাংলা, পর্যায়ক্রমে অবিভক্ত ভারতকে নিজেদের আধিপত্যে আনতে প্ররোচিত করে। ১৭৫৭ সালে ক্লাইভের হাতে বাংলার পতনে ব্রিটিশ রাজত্বের যে অশুভ পাঁয়তারার সূচনা সেটাই সময়ের গতিতে পুরো ভারতকে কব্জা করার এক ঐতিহাসিক পালাক্রম। এখানে বস্তুবাদী সমাজ নির্দেশক কার্ল মার্কসের উক্তি স্মরণ করা যায়- ব্রিটিশরা ভারতের উপর যতই দুর্দশা চাপাক তা আগের তুলনায় তীব্রতর হোক না কেন স্থবির ভারতীয় সমাজকে নাড়া দেয়ার জন্য ব্রিটিশ ছিল ইতিহাসের অচেতন অস্ত্র। এক জায়গায় কাল থেকে কালান্তরে স্থির, অটল থাকা ভারতীয় সমাজ শুধু যে নড়ে উঠল তা কিন্তু নয়- ইউরোপীয় নতুন ও আধুনিক সভ্যতার নব দিগন্তের অনুগামীও হলো। শিক্ষা, সংস্কৃতি ও মনন জগতের প্রবল আলোড়নে ঊনবিংশ শতাব্দীর যে আলোকিত অভ্যুদয় তাও ব্রিটিশ শাসকের অভাবনীয় প্রভাব, প্রতিপত্তি। কিন্তু বিপরীত স্রোতও অবিভক্ত ভারতের দ্বন্দ্ব, সংঘাতের যে অশনিসঙ্কেত চেতনায় গেঁথে দেয় তাকেও কোনভাবে অস্বীকার করার উপায় থাকে না। অষ্টাদশ শতকে ভারতে চলছিল মুসলমান রাজাদের শাসন আর একাধিপত্য। ফলে পলাশীর যুদ্ধ থেকে শুরু করে ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহ যাকে কার্ল মার্কস প্রথম স্বাধীনতার সংগ্রাম বলে অভিমত দেন। ফলশ্রুতিতে সবই ব্রিটিশরা কেড়ে নিয়েছিল মুসলমানদের কাছ থেকে। ফলে প্রথম থেকে মুসলমানদের বিদ্বেষ আর বিরূপ মনোভাব ছিল ব্রিটিশদের প্রতি। ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুতে যে নবজাগরণীয় বলয় বিদগ্ধদের নতুন আলোর সন্ধান দেয় সেখানে হিন্দু জ্ঞানী ব্যক্তিত্বের নব অভ্যুদয় ইতিহাসের এক অনন্য মাইলফলক। অভেদ্য সমাজ কাঠামোর মধ্যে থেকেও যেখানে বিভেদের আলামত ছিল না সেখানে নতুন করে সম্প্রদায়গত বিভাজন মাথা চাড়া দিতেও সময় লাগেনি। আর এটাই ছিল ভারতীয় উপমহাদেশের দ্বিজাতিতত্ত্বের সুতিকাগার। যা ক্রমশ হিন্দু মুসলমান দুই সম্প্রদায়কে শুধু দূরে ঠেলে দেয়ানি বরং ধর্মের ভিত্তিতে ব্রিটিশ তাড়ানোর সংগ্রাম, আন্দোলন দানা বাঁধতে সহায়তা করে। ব্রিটিশরাও কূটকৌশলে এমনটাই চেয়েছিল যাতে ধর্মীয় ভেদ বুদ্ধিতে দুটি সম্প্রদায় আলাদা রাষ্ট্রে পৃথক হয়ে পড়ে। বাস্তবিক সেটাই ঘটে। ভারত-পাকিস্তান দুই ধর্মের জনগণ দ্বিধাবিভক্ত হয়ে যে নতুন রাষ্ট্রের অভ্যুদ্বয় ঘটায় সেখানে সাধারণ মানুষের মুক্তির আকাক্সক্ষা কতখানি ফলপ্রসূ হয়েছিল ঔপনিবেশিক শাসনের করাল গ্রাস থেকে রক্ষা পেয়ে? আজ অবধি যার সুরাহায় কোন যৌক্তিক সমাধান পাওয়া যায়নি। হিন্দু মুসলমান সংঘর্ষ বাধা এবং দুই পক্ষের মৌলবাদী অপশক্তির চরম আত্মপ্রকাশ এখনও সাম্প্রদায়িক মতভেদকে জিইয়ে রেখেছে, প্রয়োজনে তাকে শক্তিশালী করে তুলে সাধারণ মানুষের জীবনে বিষবাষ্প ছড়াতে এতটুকু পিছপা হয়নি। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তা হয়েছে আরও ভয়ঙ্কর। ক্ষেত্রবিশেষে অস্তিত্ব সঙ্কটেরও প্রশ্ন উঠেছে। ফলে শুরুতেই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা নিয়ে যে বিতর্ক এবং অসঙ্গতি দৃশ্যমান হয় তা হবার কথাই ছিল না। সিংহভাগ জনগণের ভাষা বাংলা। কিন্তু পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠী অত্যন্ত সুচতুর কৌশলে উর্দুকেই পাকিস্তানের একমাত্র ভাষা হিসেবে ঘোষণা দিতে এতটুকুও ভাবেনি। ১৯৪৮ সালে জিন্নাহ কর্তৃক ঘোষিত সেই রাষ্ট্র ভাষা উর্দুর বিরুদ্ধে সম্মুখ সমরে সেদিন বঙ্গবন্ধুই তার তর্জনী উঁচিয়ে ঘোরতর আপত্তি জানান। সদর্পে বলতে কুণ্ঠিত হননি- বাংলাও হবে পাকিস্তানের আরও একটি রাষ্ট্রভাষা। ততদিন পর্যন্ত বাঙালী মুসলমান বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় পাকিস্তানের সঙ্গে একাত্ম থাকলেও ভাষার প্রশ্নে তাদের সাংস্কৃতিক চৈতন্য প্রবলভাবে নড়ে ওঠে। এক সংহত বোধ আর আবহমান বাংলার সমৃদ্ধ চেতনায় পরিপুষ্ট মাতৃভাষার প্রতি তাদের অকৃত্রিম জাগরণ ভাষা আন্দোলনের অনিবার্য শক্তি তৈরি করে। যাকে অভিহিত করা হয় বাঙালী মুসলমানদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের লড়াই। সঙ্গত কারণে আপামর বাঙালী আর পেছন ফিরে তাকায়নি। দুর্বার, অপ্রতিহত গতিতে অমীমাংসিত ভাষার প্রশ্নকে ভিত্তি করে স্বাধিকার আদায়ের সংগ্রামে নিজেদের নিঃশর্ত নিবেদনে কোন কার্পণ্য করেনি। মাতৃভাষার জন্য রক্তের বন্যায় ভাসিয়ে দেয়া পৃথিবীর ইতিহাসেও এক অনন্য নজির। সমৃদ্ধ বাংলা ভাষাকে একাত্ম করে বাঙালীরা অধিকার আদায়ের লড়াইকে যে মাত্রায় তীব্র থেকে তীব্রতর করে তোলে সেখানে একটি স্বাধীন মাতৃভূমির স্বপ্ন ছাড়া আর কোন বিকল্পও থাকে না। সঙ্গত কারণে পুরো ষাটের দশক ছিল লড়াই-সংগ্রামের এক বিক্ষুব্ধ অভিযাত্রা যার অনিবার্য গতি ছিল একটি স্বাধীন, সার্বভৌম রাষ্ট্রের আকাক্সিক্ষত স্বপ্ন। পুরো সময় জুড়ে ছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ভাষা আন্দোলনের লড়াইয়ে তিনিই ছিলেন প্রথম পাকিস্তানের কারাগারে আটক। শুধু তাই নয়, ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি তিনি ফরিদপুরের জেল থেকে জানতে পারেন ঢাকার রাজপথ ভাষার দাবিতে রক্তের বন্যা বইয়ে যাচ্ছে। পাকিস্তানী সামরিক জান্তার অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে তিনি তখন অনশন ব্রতে। যে ভাষার জন্য ভাষা সংগ্রামীরা অকাতরে জীবন বিসর্জন দিল সেই বাংলা ভাষার মর্যাদা আজ কোথায় সেটা ভেবে দেখার দিন আসাই শুধু নয়, শেষও হয়ে যাচ্ছে। রাষ্ট্রভাষার দাবিতে বাংলাকে প্রতিষ্ঠিত করতে যে বৈপ্লবিক স্রোত সারা বাংলাকে উন্মত্ত আর উত্তাল করে সেই সমৃদ্ধ বাংলা কি আজ সবখানে আপন মর্যাদায় সমাসীন? এমন প্রশ্ন স্বাভাবিক এবং বাঞ্ছনীয়। আমরা যদি শুধু শিক্ষার ক্ষেত্রকে বিবেচনায় আনি সেখানেও দৃশ্যমান হবে বাংলা ভাষাকে সেভাবে তার মর্যাদায় অভিষিক্ত করা হয়নি। শুধু তাই নয়, কখনও কখনও আধুনিক বিভিন্ন বাংলা চ্যানেলে যেভাবে সমৃদ্ধ এই ভাষা করা হয় তা যৌক্তিক নয়Ñ এমনকি অপরিহার্যও নয়। তার ওপর ইংরেজী মাধ্যম স্কুলের সংখ্যা এত বেশি বাড় বাড়ন্ত তাও মাতৃভাষার আধুনিক বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করছে। সময় এবং আধুনিকতার নির্মল স্রোতে ভাষার পরিবর্ধন, পরিমার্জন এবং পরিশীলিত হওয়াও যুগের অনিবার্য দাবি। উচ্চশিক্ষা ও গবেষণায়ও বাংলা ভাষার যথার্থ চর্চা যেভাবে দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না। আর রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে আধুনিক ও প্রযুক্তির বাংলাদেশ কিভাবে স্বমহিমায় মাতৃভাষাকে উদ্ভাসিত করছে তাও ভেবে দেখার বিষয়। জাতির মেরুদণ্ড শিক্ষাব্যবস্থায় মাতৃভাষা চর্চা এক আবশ্যকীয় বিষয়। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় শিক্ষায় মাতৃভাষাই মাতৃদুগ্ধ। এর ব্যতিরেকে শিশুরা সমৃদ্ধ হয় না পরিপুষ্টিও অর্জন করতে অপারগ হয়। শিক্ষা শুধু সার্বজনীনই নয়, সব মানুষের মৌলিক অধিকারও। আর তার বাহন হবে অতি প্রাসঙ্গিকভাবে জনগোষ্ঠীর মুখের ভাষা। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর দিকে তাকালে আমাদের বুঝতে কষ্ট হয় না তারা মাতৃভাষা চর্চা করেই দেশ ও দশের কল্যাণ সাধন করেছে। প্রতিদিনের জীবন ও কর্ম প্রবাহেও মাতৃভাষার গুরুত্ব অপরিসীম। নব নব উদ্ভাবন আর বৈজ্ঞানিক জয়যাত্রাকে প্রাত্যহিক জীবনের অনুষঙ্গ করতে ব্যর্থ হলে দেশের সার্বিক কল্যাণ নিশ্চিত হয় না। আর সেটা করতে হবে মাতৃভাষায় বিজ্ঞানচর্চা এবং নিত্যনতুন গবেষণা কার্যক্রমকে অনুবর্তী করা। প্রযুক্তি বিদ্যার সার্বিক সুফল সব মানুষের দ্বারে পৌঁছে দিতে গেলে মাতৃভাষার বিকল্প অন্য কিছু নয় বলে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন রবীন্দ্রনাথ। শুধু রাষ্ট্রীয় পর্যায়ই নয়, গ্রাম বাংলার অসহায় দরিদ্র মানুষের প্রাত্যহিক জীবনের কার্যক্রমে মাতৃভাষার মাধ্যমে আধুনিক প্রযুক্তিকে পৌঁছে দিতে হবে উন্নত বাংলাদেশ গঠন প্রক্রিয়ায়। মাতৃভাষা যে কোন জনগোষ্ঠীর অহঙ্কার, অলঙ্কার। যা মানুষের নিত্য জীবন যাপনেরও অংশীদার। ভাষা আন্দোলনের ঊনসত্তর বছর পদার্পণ এবং স্বাধীনতা দিবসের সুবর্ণজয়ন্তীর দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে মাতৃভাষা চর্চায় অনমনীয় বোধই শুধু নয়, তা মানুষের সন্নিকটে পৌঁছে দেয়াও একান্ত দায়বদ্ধতা। ভাষার জন্য রক্তস্নাত পথ পাড়ি দেয়ার গর্বিত জাতি আমরা। সেটা শুধু কাগজে, কলমে, আলোচনায় কিংবা সম্মেলনে নয়, বাস্তব প্রেক্ষাপটে তার যথাযথ প্রয়োগ ও প্রচলনও একান্ত জরুরী। আন্তর্জাতিক উন্নতমানের ভাষা আয়ত্ত করা যেমন প্রাসঙ্গিক তার চেয়েও বেশি দরকার মাতৃভাষাকে তার যথাস্থানে পৌঁছে দিয়ে সর্বাঙ্গীণ এবং সার্বজনীন করা। একুশের মহান ভাষা দিবস হোক সেই প্রত্যয়ের দীপ্ত অঙ্গীকার। লেখক : সাংবাদিক
×