ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মোহাম্মদ ফায়েক উজ্জামান

উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়নে অতীতে কেউ ভাবেনি

প্রকাশিত: ২১:০৬, ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২১

উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়নে অতীতে কেউ ভাবেনি

বাংলাদেশের সাধারণ শিক্ষা চার ভাগে বিভক্ত–প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা। প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের জন্য ‘পিটিআই’ (প্রাইমারী ট্রেনিং ইনস্টিটিউট), মাধ্যমিক স্তরে ‘বিএড’ (ব্যাচেলর অব এডুকেশন), সরকারী কলেজের শিক্ষকদের জন্য ‘নায়েম’ (ন্যাশনাল একাডেমি ফর এডুকেশনাল ম্যানেজমেন্ট) রয়েছে। বেসরকারী কলেজের শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের জন্য আছে ‘এইচএসটিটিয়াই’ (হায়ার সেকেন্ডারি টিচার্স ট্রেনিং ইনস্টিটিউট)। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্য কোন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেই। ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে জিটিআই (গ্রাজুয়েট ট্রেনিং ইনস্টিটিউট) নামে একটি প্রতিষ্ঠান আছে। কিন্তু সেখানে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের জন্য ট্রেনিং বাধ্যতামূলক নয়। আমরা যারা বিশ্যবিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়েছি, আমরা অনুসরণ করেছি আমাদের শিক্ষকদের। তাদের পড়ানোর স্টাইল ও অন্যান্য বিষয় আমরা রপ্ত করতে চেষ্টা করতাম। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে আমাদের কোন প্রশিক্ষণ ছিল না। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ ছাড়াও আর্থিক দৈন্যের কারণে রাসায়নিক দ্রব্য, গবেষণার যন্ত্রপাতিও ছিল অপ্রতুল। কিছু শিক্ষক বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে অল্প-স্বল্প যন্ত্রপাতি ক্রয় করলেও রাজস্ব খাতের আওতায় যন্ত্রপাতি খুব একটা কেনা হয়নি। গ্রন্থাগারসমূহে বইপত্রের পর্যাপ্ততা ছিল না। কিন্তু উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রে সাম্প্রতিক বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটে গেছে, যা বাইরে থেকে অনুধাবন করা সহজ নয়। গত ১২-১৩ বছরে বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রে যেসব উদ্যোগ গৃহীত হয়েছে তার একটা পটভূমি আছে। শেখ হাসিনা যখন বলেন যে, বর্তমান সরকার বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়নে কাজ করছে তখন সমালোচকরা এই ‘স্বপ্ন’ নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রƒপ করেন। এজন্য বঙ্গবন্ধুর প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার দিকে নজর দেয়া প্রয়োজন। সেখানে শিক্ষাক্ষেত্রে তাঁর সরকারের ভাবনা ও উদ্যোগগুলো বর্ণিত আছে। বর্তমান শিক্ষামন্ত্রী ডাঃ দীপু মনি প্রায়ই বলছেন যে, হাতে-কলমে শেখা যায় এমন শিক্ষা গ্রহণ জরুরী। বিশেষ করে বিদেশে চাকরিপ্রার্থীদের কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার জন্য তিনি জোর দিয়েছেন। প্রাইমারী থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত প্রতিটি পর্যায়কে বঙ্গবন্ধু পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার মধ্যে নিয়ে আসেন এবং আধুনিক ও বিজ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠনের জন্য তিনি প্রযুক্তিগত শিক্ষার ওপর জোর দেন। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়নের জন্য তিনি প্ল্যানিং কমিশনের অধিকাংশ সদস্য হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের খ্যাতনামা অধ্যাপকদের। বাংলাদেশের প্রথম সরকারের (মুজিবনগর সরকার) সময়কালেই প্ল্যানিং সেল গঠিত হয়। এর চেয়ারম্যান ছিলেন অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ চৌধুরী, সদস্য ছিলেন খান সারোয়ার মুরশেদ, ড. আনিসুজ্জামান ও মোশাররফ হোসেন। বঙ্গবন্ধু একে প্ল্যানিং কমিশনে রূপান্তর করেন। সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর তত্ত্বাবধানে এর ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন ড. নূরুল ইসলাম এবং সদস্য ছিলেন রেহমান সোবহান, আনিসুর রহমান ও মোশাররফ হোসেন। লক্ষ্য করি, পাকিস্তান সামরিক সরকারের বিপরীতে একটি সিভিল সরকার গঠনে বঙ্গবন্ধুর দূরদৃষ্টি কত প্রখর ছিল। শেখ হাসিনা প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী হয়ে সম্ভবত ওই পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাকে সামনে মেলে ধরেছেন এবং বর্তমান সময়ের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে দেশের জন্য যা প্রয়োজন সেভাবে নতুন পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করছেন। তারই অংশ হিসেবে উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়নের জন্যও প্রচুর উদ্যোগ গৃহীত ও বাস্তবায়ন হচ্ছে। ২০০৮ সালে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়ন প্রকল্প হাতে নেয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর আনুষ্ঠানিকভাবে এর যাত্রা শুরু হয়। প্রকল্পের নাম দেয়া হয় ঐঊছঊচ (ঐরমযবৎ ঊফঁপধঃরড়হ ছঁধষরঃু ঊহযধহপবসবহঃ চৎড়লবপঃ)। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের প্রশিক্ষণ, আন্তর্জাতিকমানের গবেষণাগার তৈরি, উন্নতমানের ক্লাসরুম, আধুনিক আসবাবপত্র, প্রযুক্তিগত দক্ষতা বৃদ্ধি, উন্নত বিশ্বের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ কারিকুলাম প্রণয়ন, শিক্ষকবৃন্দের অভ্যন্তরীণ মূল্যায়নকে এই প্রকল্পের আওতায় আনা হয়। এই প্রকল্পে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান তদারকির জন্য ওছঅঈ (ওহঃবৎহধঃরড়হধষ ছঁধষরঃু অংংঁৎধহপব ঈবষষ ) প্রতিষ্ঠা করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের পাঠ্যসূচী কতটুকু সময়োপযোগী, শিক্ষার্থীরা এই পাঠ্যসূচীতে কতটুকু সংযুক্ত, বৈশ্বিক প্রতিযোগিতার জন্য আমাদের শিক্ষার্থীরা কতটুকু প্রস্তুত, শিক্ষার্থীদের প্রয়োজন ও চাহিদা, শিক্ষকদের শিক্ষাদান সংক্রান্ত সুযোগ-সুবিধা প্রভৃতি বিষয় খতিয়ে দেখার জন্য দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় ও বিদেশের কমপক্ষে একজন বিশেষজ্ঞকে দিয়ে মূল্যায়ন কমিটি গঠন করা হয়। এই মূল্যায়নের ভিত্তিতে বিভাগসমূহ প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। বিদেশী বিশেষজ্ঞগণ প্রতিটি বিভাগের সার্বিক পরিবেশও পর্যবেক্ষণ করেন। এমনকি অফিস সহকারী বা সহায়কবৃন্দের দক্ষতা, সুযোগ-সুবিধা বা প্রয়োজনগুলোকে এই মূল্যায়ন কমিটি বিবেচনায় আনে। মানসম্মত শিক্ষার পাশাপাশি শিক্ষক-শিক্ষার্থীর টয়লেট কতটুকু স্বাস্থ্যকর, পুরো ক্যাম্পাসের পরিবেশ কেমন এ বিষয়গুলোও মূল্যায়নের আওতাভুক্ত। অর্থাৎ গতানুগতিক পাঠচর্চা, পাঠদান ও পাঠ গ্রহণের বিষয়টি ধীরে ধীরে পাল্টে যাচ্ছে। প্রশ্নপত্র প্রণয়ন, উত্তরপত্র মূল্যায়নের জন্যও পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক জ্যেষ্ঠ শিক্ষক দিনব্যাপী প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। কর্মকর্তা-কর্মচারীবৃন্দকেও নতুন নতুন প্রশিক্ষণের আওতায় আনা হয়েছে। উচ্চশিক্ষার সঙ্গে যুক্ত শিক্ষকবৃন্দের রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় প্রচুর বৃত্তি প্রদান করা হচ্ছে, যদিও সামগ্রিক বৃত্তির খুব কম অংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে যায়। প্রধানমন্ত্রী ফেলোশিপ, বঙ্গবন্ধু ফেলোশিপ এক্ষেত্রে যুগান্তকারী পদক্ষেপ। একজন শিক্ষক যে কোন উন্নত দেশে স্নাতকোত্তর বা পিএইচডি ডিগ্রী নির্দিষ্ট সময়ে সম্পন্ন করার জন্য যে পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন তার পুরোটাই এই ফেলোশিপের মাধ্যমে স্বাচ্ছন্দ্যে পাওয়া সম্ভব। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের পিএইচডি ও পোস্টডক্টরাল ফেলোশিপের পরিমাণও অনেক। এছাড়া উঁচু মানের গবেষণার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন সম্মানজনক পুরস্কারের ব্যবস্থা নিয়েছে। শিক্ষা এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় থেকে উচ্চতর ডিগ্রী এবং বিভিন্ন প্রকল্পের জন্য মোটা অঙ্কের অর্থ বরাদ্দ করা হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবকাঠামোগত উন্নয়ন- ভবন ও রাস্তাঘাট নির্মাণ, কম্পিউটার ল্যাব, ইন্টারনেট সংযোগ প্রভৃতি ক্ষেত্রে সরকারের উদ্যোগ চোখে পড়ার মতো। বিডিরেন (ইউজঊঘ-ইধহমষধফবংয জবংবধৎপয ধহফ ঊফঁপধঃরড়হ ঘবঃড়িৎশ)-এর মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে ইন্টারনেট সংযোগ ও স্মার্ট ক্লাসরুমের ব্যবস্থা করা হয়েছে। শিক্ষক একটি নির্দিষ্ট জায়গায় দাঁড়িয়ে পাঠদান করেন। শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন শ্রেণীকক্ষে বসে ওই ক্লাসে অংশগ্রহণ করতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয় ব্যতিরেকে বাংলাদেশের মহাবিদ্যালয় ও স্কুলসমূহকেও মানোন্নয়নের আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে। এর পেছনে বড় কারণ হলো বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা যেন পিছিয়ে না পড়ে। সর্বোপরি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের জন্য আন্তর্জাতিকমানের একটি ইনস্টিটিউট গঠনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এটি বাস্তবায়ন হলে উচ্চশিক্ষার মান আরও বৃদ্ধি পাবে বলে মনে করি। গবেষণা ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক যোগাযোগ ও বিদেশী শিক্ষার্থীদের আকৃষ্ট করার জন্য ইতোমধ্যে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ইন্টারন্যাশনাল অফিস স্থাপন করা হয়েছে এবং এর সুফলও পাওয়া যাচ্ছে। আমরা যারা রাষ্ট্রের বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করি তারা তাদের মেয়াদকাল কোনমতে পূরণ করতেই সচেষ্ট থাকি। শুধু রুটিন দায়িত্বের মধ্যে নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখি, কোন ধরনের চ্যালেঞ্জ নিতে চাই না। কিন্তু শেখ হাসিনা ও তার সরকার প্রতিটি ক্ষেত্রে নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করছেন। শিক্ষাক্ষেত্রে যে উদ্যোগগুলো নেয়া হয়েছে তা যদি যথাযথভাবে বাস্তবায়ন হয় তাহলে এর সুফল পাওয়া যাবে আরও কিছুদিন পর। সেজন্য শিক্ষাক্ষেত্রে গৃহীত উদ্যোগসমূহ বাস্তবায়নের সঙ্গে যুক্ত সবার অনেক বেশি আন্তরিক ও তৎপর হওয়া প্রয়োজন। লেখক : অধ্যাপক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
×