ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

অজয় দাশগুপ্ত

সিডনির মেলব্যাগ ॥ অতিক্রান্ত একুশের প্রত্যাশা

প্রকাশিত: ২১:০১, ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২১

সিডনির মেলব্যাগ ॥ অতিক্রান্ত একুশের প্রত্যাশা

আমাদের দেশটি ভাষাভিত্তিক রাষ্ট্র। ভৌগোলিক সংলগ্নতা আর ঐতিহ্য এক হলে ভারত ভাঙতে হতো না। আর ধর্ম মুখ্য হলে পাকিস্তানও থাকত এক। বাংলাদেশের জন্মের বীজ বপন হয়ে গিয়েছিল বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে। সেই ভাষা আমাদের রক্তের অধিকার। মুক্তিযুদ্ধ ব্যতীত আর কোন ইতিহাস নেই, যা একুশের মতো মহান। সেই প্রথম রক্তপাত ইতিহাসকে শুদ্ধ করে দিয়েছিল। সে শুদ্ধতার একুশে আজ কি শুধুই প্রথা, শুধুই বইমেলা-আলোচনা আর কিছু আবেগ? এখন এসব প্রশ্নের জবাব চাওয়া জরুরী। বাস্তবে বাংলাদেশ এমন এক জায়গায় দাঁড়িয়ে যেখানে তার অতীত তাকে গৌরবমণ্ডিত করে রাখলেও বর্তমানে লড়তে হচ্ছে বাংলাবিরোধী অপশক্তির সঙ্গে। আজকের তারুণ্য, শিশু-কিশোর বা নারীরা কি আসলেই একুশের চেতনার ধারে-কাছে আছে? সমাজে এখন ধর্মের নামে যে অন্ধত্ব তার আগুন, তার উত্তাপে সমাজের আদল বিকৃত হওয়ার পথে। অন্যদিকে আছে ইংরেজী-হিন্দীর আধিপত্য। আমাদের ছেলে-মেয়েরা জেনে বড় হচ্ছে আগে সম্প্রদায়গত পরিচয়, তারপর জাতিসত্তা। এটা না ছিল একুশের চেতনা, না মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ। একসময় আমাদের অগ্রজেরা বাংলা বর্ণমালার একেকটি কণাকে মা বলে সংবোধন করতেন, বাংলা বাঙালীর প্রাণ মনে করতেন। আজ সে সম্মানের বিন্দুমাত্রও আর অবশিষ্ট নেই। বরং সুকৌশলে শব্দ ও ভাষার ভেতর ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে শব্দগত বিদ্বেষ। ভাষা সাম্প্রদায়িকতা এক ভয়াবহ রোগ। সে যখন আক্রমণ করে বা বিস্তার লাভ করে তখন সমাজের আসল পরিচয় ঘুচে সে হয়ে ওঠে ক্লীব। তারুণ্যকে কেমন আছো-এমন প্রশ্ন করলে জবাব আসে, বিন্দাস আছি। কি এই বিন্দাস? সে মহারাষ্ট্রের হোক আর কাবুলের হোক, আসলে তার এই ঢুকে পড়ার ভেতর আছে সর্বনাশের ইঙ্গিত। এমন এক পরিবেশ ঈশ্বরের নামও পরিবর্তন করে দিয়েছি আমরা। বলতে বলতে অভ্যস্ত খোদা হাফেজ এখন আর তেমন চলে না। চলে না- তার উত্তর আমাদের অজানা নয়। এসব পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে যাওয়া ফেব্রুয়ারি কি আসলেই প্রেরণার উৎস এখন? তাই যদি হবে বইমেলার প্রাঙ্গণে বা বইমেলাকে ঘিরে রক্তের দাগ আসে কোন্ সাহসে? ঢাকার এই বইমেলা বাংলা বইয়ের সবচেয়ে বড় মেলা। কলকাতার তুলনায় নানাদিক থেকে এগিয়ে থাকা মেলাটিকে ঘিরে কারা এই মাতম করে? কি তাদের আসল উদ্দেশ্য? রাজনীতির মারপ্যাঁচ বোঝা বড় কঠিন। তারা দলভিত্তিক ঝগড়া করে বটে, চড়াও হয় মেধার ওপর। বাংলাদেশের ইতিহাস বলে মেধা ও প্রজ্ঞাই এদেশের বড় কাজগুলো করার সাহস জুগিয়েছিল। কী আশ্চর্য সময়কাল! পদ্মাপাড়ের ভীতু ও দুর্বল নামে পরিচিত ছোটখাটো মানুষগুলোই রক্ত দিয়ে একের পর এক মৌলবাদী আগ্রাসন ঠেকিয়েছিল। আজ সেই সাহস, সেই শৌর্য প্রায় অস্তমিত। শুধু তাই নয়, কিভাবে যেন ভয় প্রলোভন আর চাতুর্যে সুশীল থেকে প্রতিবাদী সবাইকে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছে নষ্ট সময়। এই শীতল সময়কে আমি শান্ত বলতে নারাজ। এটি আসলে কোন এক কঠিন ঝড়ের পূর্বাভাস অথবা বিনষ্টের আগে ঘুমিয়ে থাকা মাটির জেগে ওঠার সহ্যকাল। একুশের একটা আন্তর্জাতিক দিকও আছে। সেটি ভুলে গেছে দানবেরা। যেসব বাংলাদেশী দেশের বাইরে দুনিয়ার নানা দেশে বসবাস করেন তাদের সংখ্যা এখন হেলেফেলার নয়। বরং এরা নিরাপদ সমাজে বড় হয়ে ওঠা এক শক্তিবলয়। তারা বাংলা ভাষা ও দেশ থেকে দূরে থাকেন বলে তাদের এই দুয়ের প্রতি টান অকৃত্রিম। এই বিপুল জনগোষ্ঠী যে ভাষা, যে সমাজেই থাকুন না কেন, তাদের কাছে বাংলার মর্যাদা মায়ের মর্যাদার মতো। তারা কোনভাবেই মাকে অপমানিত হতে দেবেন না। দেবেন না বলেই বিলেতের শহীদ মিনারের বয়সে এখন প্রৌঢ়। আমাদের সিডনিতেও নয় নয় করে অনেক বছর হয় মাতৃভাষা স্মৃতিসৌধ মাথা তুলেছে প্রশান্তপাড়ে। তার বইমেলা, তার একুশে যত ছোটই হোক এর প্রাণশক্তি অনেক বেশি। এ কথা নিশ্চিতভাবে বলতে পারি, বাংলাদেশের বিনষ্ট রাজনীতি বা পরিবর্তনের নামে অপশক্তির জোয়ারে তারা সবকিছু ভেসে যেতে দেবে না। এই একুশে আমাদের দেশের মানুষ একদিনের জন্য বাঙালী হলেও তাদের জীবনে আজ অনেক প্রশ্ন আর সমস্যা। সেগুলো রাজনীতি সমাধান করবে কি করবে না সেজন্য বসে থাকলে চলবে না। দেশ ও মানুষ এক অখণ্ড অভয় শক্তির নাম। তাদের সঙ্গে আছে বিদেশের বাংলাদেশীরা। এই শক্তিকে জাগানোর জন্য সংস্কৃতি ও মেধার উদ্বোধন চাই। কিছু উঠতি যুবক-যুবতী বা বয়সী মানুষের পুস্তক প্রকাশনা নিতান্ত আনন্দের, উৎসাহেরও বটে। কিন্তু চিকিৎসা, আইন, বিজ্ঞান মহাকাশের কোন ভাল বই আজও নেই বাংলা ভাষায়। আজও আমাদের লেখাপড়ার জগতে বিদেশী ভাষার প্রবল চাপ। এসব থেকে মুক্ত হয়ে আন্তর্জাতিক ভাষার সঙ্গে নিবিড় আত্মীয়তা ও ঐক্যে গড়তে হবে নতুন বাংলাদেশ। মনে রাখতে হবে এখনও পার্বত্য পাহাড়ী ছোট ছোট নৃগোষ্ঠীর জীবন ও ভাষা অনিরাপদ। অনিরাপদ নারী ও শিশু। একুশের চেতনা বা ভাষার লড়াই সেদিন শেষ হবে যেদিন সবাই মিলে ভাবতে শিখবে এদেশ আমাদের। তারপরও এই আমাদের গর্বের আনন্দের প্রেরণার উৎসভূমি। আমাদের জাতীয় ও আন্তর্জাতিকতার ঐক্যও এখানেই। [email protected]
×