ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির ইতিহাস না জানলে বিশ্বে মর্যাদার আসন স্থায়ী হবে না

প্রকাশিত: ১৮:২২, ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২১

বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির ইতিহাস না জানলে বিশ্বে মর্যাদার আসন স্থায়ী হবে না

স্টাফ রিপোর্টার ॥ বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির ধর্মনিরপেক্ষ মানবিক ইতিহাস না জানলে এবং একে আরও সমৃদ্ধ করার উদ্যোগ গ্রহণ না করলে আমরা কখনও বিশ্বসভায় নিজেদের মর্যাদার আসন স্থায়ী করতে পারব না বলে মনে করেন বিশিষ্টজনরা। তারা বলেন, প্রাথমিক পর্যায় থেকে আরম্ভ করে স্নাতকোত্তর পর্যায় পর্যন্ত বাংলা ভাষা ও সাহিত্য এবং বাঙালি জাতির ইতিহাস পাঠ বাধ্যতামূলক করতে হবে। বাংলার ওপর বিশাল তথ্যভান্ডার তৈরি করে তা বাংলা ভাষার প্রসারের জন্য সর্বক্ষেত্রে ব্যবহার করারও পরামর্শ দেন তারা। মানসম্মত অনুবাদের মাধ্যমে আমাদের সাহিত্য বহির্বিশ্বে তুলে ধরতে পারেলে তা নিজস্ব সাহিত্যের সমৃদ্ধি ঘটাবে বলেও মত দেন অনেকে। সোমবার একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে ‘বাংলা ভাষার আন্তর্জাতিক মর্যাদা অর্জনে বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনার অবদান এবং আমাদের করণীয়’ শীর্ষক এক অনলাইন ওয়েবিনারে অংশ নিয়ে বক্তারা এমন মতামত তুলে ধরেন। সংগঠনের সভাপতি লেখক সাংবাদিক শাহরিয়ার কবিরের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই ওয়েবিনারে প্রধান অতিথি ছিলেন ডাক, টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার। আলোচনায় অংশ নেন, মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী দক্ষিণ এশীয় গণসম্মিলনের সভাপতি বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সহ-সভাপতি শহীদজায়া শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী, বরেণ্য কথাশিল্পী সেলিনা হোসেন, ১৯৭১: গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘর ট্রাস্টের সভাপতি অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন, মুক্তিযুদ্ধে শহীদ ভাষাসংগ্রামী ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের পৌত্রী সমাজকর্মী আরমা দত্ত এমপি, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য কথাশিল্পী অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল, টুয়েন্টি ফার্স্ট সেঞ্চুরি ফোরাম ফর হিউম্যানিজম তুরস্ক-এর সাধারণ সম্পাদক, লেখক চিত্রনির্মাতা শাকিল রেজা ইফতি এবং একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সাধারণ সম্পাদক কাজী মুকুল। সভাপতির বক্তব্যে শাহরিয়ার কবির বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৫২ সালে চীনের রাজধানী বেইজিং-এ অনুষ্ঠিত বিশ্ব শান্তি সম্মেলন থেকে শুরু করে ১৯৭৪ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে প্রথম বারের মতো বাংলায় ভাষণ দিয়ে বাংলা ভাষাকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যেভাবে তুলে ধরেছেন তার দ্বিতীয় কোনও নজির নেই। ১৯১৩ সালে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা সাহিত্যের জন্য নোবেল পুরস্কার অর্জন করে বাংলা ভাষার সমৃদ্ধতা যেভাবে বিশ্বসভায় প্রতিষ্ঠিত করেছেন তার যোগ্য উত্তরসুরী ছিলেন স্বাধীন বাঙালি জাতিরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৯৯ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাদের ভাষা শহীদ দিবস ২১শে ফেব্রুয়ারিকে জাতিসংঘের মাধ্যমে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে বিশ্বব্যাপী পালনের স্বীকৃতি অর্জন করেছেন। তিনি বলেন, এখন আমাদের এবং বাংলা একাডেমি সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়কে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন ভাষায় পরিচিত করার জন্য বহুমাত্রিক উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। বিশ্বের বিভিন্ন ভাষার সেরা সাহিত্য সম্ভার এবং বিজ্ঞান ও গবেষণামূলক গ্রন্থ বাংলায় অনুবাদের পাশাপাশি বাংলা ভাষার সেরা নিদর্শনসমূহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ভাষায় অনুবাদে অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করতে হবে বাংলা একাডেমীকে। তিনি বলেন, প্রাথমিক পর্যায় থেকে আরম্ভ করে স্নাতকোত্তর পর্যায় পর্যন্ত বাংলা ভাষা ও সাহিত্য এবং বাঙালি জাতির ইতিহাস পাঠ বাধ্যতামূলক করতে হবে। বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির ধর্মনিরপেক্ষ মানবিক ইতিহাস না জানলে এবং একে আরও সমৃদ্ধ করার উদ্যোগ গ্রহণ না করলে আমরা কখনও বিশ্বসভায় নিজেদের মর্যাদার আসন স্থায়ী করতে পারব না।’ প্রধান অতিথির বক্তব্যে মোস্তাফা জব্বার বলেন, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষ্যে আয়োজিত এই আলোচনা আমাদেরকে কেবল পাকিস্তান রাষ্ট্র কাঠামোতে বাঙালীদের মাতৃভাষার দাবি প্রতিষ্ঠাকে স্মরণ করিয়ে দেয়না, বিশ্বের নানা স্থানে অনুষ্ঠিত ও চলমান মাতৃভাষার দাবিকেও স্মরণ করিয়ে দেয়। এমনকি আসামের শিলচরে বাংলা ভাষার জন্য রক্তদানও সারা বিশ্বের মাতৃভাষার দাবিকে মহিমান্বত করে। মাতৃভাষার আন্দোলন এখনও পাকিস্তান, ভারত, লাটভিয়া, আমেরিকা, নেপাল ও দক্ষিণ আমেরিকায় চলমান। আমরা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য রক্ত দিয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর পিতৃত্বে একটি বাংলা ভাষাভিত্তিক জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছি। এই অর্জনের পাশাপাশি আমাদের শহীদ দিবস সারা বিশ্বের মাতৃভাষা দিবস হওয়াটাও আমাদের বিশাল অর্জন। আমাদের ভাষা আন্দোলন এখনও চলমান উল্লেখ করে মন্ত্রী আরও বলেন, আমরা এই প্রযুক্তির যুগে বাংলা ভাষাকে ডিজিটাল পদ্ধতিতে ব্যবহার করার জন্য ইউনিকোড ও আইকানের সাথে আলাপ আলোচনা করে এর সকল সমস্যার সমাধান করেছি। আমাদের রয়েছে ডট বাংলা ডমেইন। এরই মধ্যে আমরা যে কোন ডিজিটাল যন্ত্রে বাংলা লেখার পদ্ধতি আবিষ্কার করেছি বলে একদিকে আমাদের মুদ্রণ ও প্রকাশনায় বিপ্লব সাধিত হয়েছে অন্যদিকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ সর্বত্র বাংলা ভাষার ব্যবহার প্রতিদিনই বাড়ছে। তবে এখনও আমরা বাংলাকে জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা করতে পারিনি একথা উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, আমরা পারিনি উচ্চ শিক্ষা বা উচ্চ আদালতের ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে। অন্যদিকে রোমান হরফে বাংলা লেখা বা রোমান হরফকে বাংলায় রূপান্তর করার এক জঘণ্য প্রবণতা আমাদের তরুণ সমাজকে বিভ্রান্ত করছে। আমাদের প্রযুক্তিগত উন্নয়ন-যেমন বানান পরীক্ষক, ওসিআর, স্পীচ টু টেক্সট-টেক্সট টু স্পীচ ইত্যাদি তৈরি হয়নি। আশার কথা যে সরকার ১৭ সাল থেকে ভাষার জন্য ১৬টি টুলস ব্যবহার করার জন্য ১৫৯ কোটি টাকার একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। এই দিনে আমরা এই প্রকল্পের সম্পূর্ণ সফলতা কামনা করি। আমাদের এটিও প্রত্যাশা যে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইন্সটিটিউটের মাধ্যমে আমরা আমাদের দেশের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীসমূহের ভাষাসহ সকল মাতৃভাষার জন্য কাজ করতে পারবো। তিনি বলেন, আমাদের ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার পাশাপাশি বিশ্বের সকল মাতৃভাষার ডিজিটাল রূপান্তর কেবল গবেষণা ও উদ্ভাবনের মধ্যেই হতে পারে। বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক বলেন, ‘বাংলার রায় লেখা হচ্ছেÑ যা আমাদের আনন্দিত করেছে। সমস্যা হচ্ছে মৌলিক আইনগুলো ইংরেজি ভাষায় লেখা। সেগুলো বাংলায় ভাষান্তর করা আবশ্যক হয়ে পড়েছে। সরকারী কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে সমন্বয় করে আইনগুলো বাংলায় ভাষান্তর করতে হবে। বাংলায় রায় হলে বিচারপ্রার্থী নিজেরাই রায় বুঝতে পারবে। সব দেশেই আদালতের ভাষা তাদের নিজস্ব ভাষা। কথাশিল্পী সেলিনা হোসেন বলেন, ‘আমাদের সাহিত্য বহির্বিশ্বে তুলে ধরার উদ্যোগ খুবই কম। মানসম্মত অনুবাদের মাধ্যমে আমাদের সাহিত্য বহির্বিশ্বে তুলে ধরতে পারেলে তা আমাদের সাহিত্যের সমৃদ্ধি ঘটাবে। অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন বলেন, ‘উন্নয়নের ইতিহাসের সঙ্গে ভাষার ইতিহাস জড়িত। জাপানের উন্নয়নের মূল কারণ মাতৃভাষাকে গুরুত্বারোপ। বাংলাদেশ এর ব্যতিক্রম। আমাদের নিজস্ব ভাষানীতি নেই। অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলার চেয়ে ইংরেজিকে বেশি গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি বাংলা ভাষায় শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার কারণে আমাকে যথাযথ পদোন্নতি দেয়া হয়নি। যারা বর্তমানে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে পাশ করে বের হচ্ছেন, তারা শুধু ইংরেজি ভাষা নয়, বাংলাতেও ভালোভাবে লিখতে পারেন না। তিনি আরও বলেন, বাংলা শিক্ষার ক্ষেত্রে হীনমন্যতাবোধ দূর করতে হবে। ভাষা ইন্সটিটিউটের কাজ দৃশ্যমান নয়। ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের বাড়িতে ইন্সটিটিউট করে ভাষার জন্য অগ্রসর হতে পারি কিনা দেখতে হবে। আরমা দত্ত এমপি বলেন, বাংলা ভাষা চর্চার জন্য রাজনৈতিক নীতি ঠিক করতে হবে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলা ভাষার ব্যবহার ও মান বজায় রাখার জন্য সরকারের নিকট বড় বরাদ্দের প্রস্তাব করা দরকার। এজন্য প্রধানমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্ট সকলের কাছে আমাদের প্রস্তাব তুলে ধরতে হবে। একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য কথাশিল্পী অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল বলেন, ‘পৃথিবীর ভাষাসংখ্যা ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে। এরকম বাংলাদেশেও ভাষার সংখ্যা কমছে। মাতৃভাষায় জ্ঞানচর্চার উদ্যোগ খুবই কম। সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেক ভুল বাংলা লেখা হচ্ছে। আমরা যদি সঠিকভাবে এই বিষয়টা সমাধান না করি, তবে ভবিষ্যতে আমাদের যথেষ্ট দুর্গতি আছে। বাংলাদেশে বাংলার উপর বেশ কিছু সফটওয়্যার তৈরি হচ্ছে। আমাদের দেশে বাংলার ওপর বিশাল তথ্যভান্ডার তৈরি করে তা বাংলা ভাষার প্রসারের জন্য সর্বক্ষেত্রে ব্যবহার করতে হবে।
×