ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

জয়শ্রী দাস

বর্তমান সমাজে অভিভাবকদের দায়দায়িত্ব

প্রকাশিত: ২০:৩২, ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২১

বর্তমান সমাজে অভিভাবকদের দায়দায়িত্ব

প্রতিনিয়ত কত শত ঘটনা ঘটছে। গত ৭ জানুয়ারি রাজধানীর কলাবাগানের একটি বাসায় হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটেছে। ইংরেজী মাধ্যমে পড়ুয়া এক স্কুলছাত্রীকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে। এ ঘটনায় অভিভাবকরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। গণমাধ্যমসহ সর্বত্র মানুষের ক্ষোভ ও উদ্বেগ লক্ষ্য করা যায়। ওই ঘটনার পর আমার এক আত্মীয় ফোন করে বললেন, সারারাত ঘুমাতে পারিনি। কেন? টিভিতে এক কিশোরীর অস্বাভাবিক মৃত্যু দেখাচ্ছিল। আমারও তো ১৭ বছরের একটা মেয়ে আছে, আমি কি করে সেই কিশোরীর মায়ের কান্না সহ্য করি, বল? বুঝতে পারলাম কলাবাগানের ওই ঘটনার কথাই বলছেন তিনি। কোন উত্তর না দিয়ে মনে মনে ভাবলাম আমিও তো একজন অভিভাবক। উদ্বেগ আর আতঙ্কের মধ্যে আমিও আছি। কলাবাগানের ওই ঘটনার পর হয়ত অনেক অভিভাবক সতর্কতার সঙ্গে মেয়েদের কড়া শাসনে রেখেছে। সেইসঙ্গে উদ্বেগ আর আতঙ্ক তো আছেই সবার। তবে এখন অনেক অভিভাবক তাদের সন্তানের জন্য গোল্ডেন ফাইভ ও জিপিএ ফাইভ পাওয়ার জন্য যতটা ব্যস্ত থাকেন ঠিক ততটা ব্যস্ত থাকেন না সন্তানকে নীতি-নৈতিকতা এবং মানবিক মূল্যবোধের আদর্শ শিক্ষা-দীক্ষা দিয়ে একজন মানবিক মানুষ গড়ে তোলায়। আমরা আসলে অনেকেই সন্তানের ভাল রেজাল্টের দিকে ছুটছি। কিন্তু ভাল মানুষ গড়ে তোলার পেছনে ছুটছি না। সন্তান প্রথম শিক্ষা পায় তার পরিবার থেকে। পরিবার থেকেই তাকে মানবিক শিক্ষাটা দেয়া খুবই জরুরী বলে মনে করি। পরিবার হলো শিশুর প্রাথমিক ও সর্বশ্রেষ্ঠ শিক্ষাঙ্গন। পরিবার থেকে শিশুর শিক্ষার ভিত্তিটা তৈরি হয়। সচেতন বাবা-মায়ের কাছ থেকেই শিশুর নৈতিকতা ও মূল্যবোধ এবং জীবনবোধ তৈরিতে সহায়তা করে। এছাড়াও শিশুর সুস্থ মানসিক ও শারীরিক বিকাশে পরিবারের সবার ভূমিকাই ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এখন প্রযুক্তির যুগে অনেক অভিভাবক তাদের সন্তানদের সঙ্গে পেরে উঠছে না। নানারকমের দাবি আর হুমকির মধ্য দিয়ে সন্তান তার ইচ্ছা পূরণ করে নিচ্ছে অভিভাবকের কাছে থেকে। সন্তানের অপইচ্ছা পূরণ করতে অনেক অভিভাবক মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছে। বিশেষ করে মোবাইল ফোনের ব্যবহার নিয়েই এখন প্রতিটি পরিবারের ঝগড়া হয়। গত কয়েকদিন আগে পাশের বাসার ভাবিকে জিজ্ঞেস করলাম, কাল রাতে আপনার বাসায় খুব জোরে চিৎকার শুনলাম। আসলে কি হয়েছিল? আর বলবেন না বউদি, আমার ছেলে সারাদিন মোবাইলে গেম খেলে। আমি মোবাইলটা কেড়ে নিতে আমার ১২ বছরের ছেলের এমন আর্তচিৎকার যেন আমি তার শরীরের একটা অংশ কেটে নিয়েছি। কোনভাবেই তার কাছ থেকে মোবাইলটা নিয়ে রাখতে পারলাম না। মোবাইল ফোনের অতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে ও পড়ালেখা করছে না ঠিকমতো। পড়ার কথা বললে বলে স্কুল বন্ধ। তুমি চুপ থাক। আমাকে খেলতে দাও। কড়া শাসন করলে বাড়ি থেকে বের হয়ে যাওয়ার ভয় দেখায়। নানারকমের হুমকি দেয়। সন্তানের এমন আচারণে খুব কষ্ট পেয়ে কেঁদেছি। ভাবির কথাগুলোতে আমার খুব খারাপ হয়ে গেল। পরিবার থেকে কি আমরা শিশুদের সঠিক আচার-ব্যবহারের শিক্ষা দিতে পারছি? নাকি দিতে গিয়েও পারছি না? আমরা কি ভাল-মন্দ বোঝাতে ব্যর্থ হচ্ছি? সন্তানরা অনেক সময় পড়াশোনার জন্য গ্রুপ স্টাডির কথা বলে চলে যায় গার্লফ্রেন্ডের অথবা বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে নিভৃতে একান্তে দেখা করার জন্য। এটি অবশ্য সবার জন্য প্রযোজ্য নয়। অনেকেই এমনটা করে থাকে। ইন্টারনেটে আধুনিক মোবাইলের বিভিন্ন অপব্যবহারে আসক্ত হয়ে যাচ্ছে অনেক কিশোর-কিশোরী। ইন্টারনেট ব্যবহারে তাদের সতর্ক করে দিতে হবে। এ কারণেই একটু চোখে চোখে রাখতে হবে সন্তানদের। খোলামেলা গল্পের মাধ্যমে বের করে আনতে হবে সন্তানের মনের কথা। মনের ভেতর খারাপ মনমানসিকতা লালন করে থাকলে তা হলে সেটা যাচাই করে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনতে হবে। কিশোর বয়সটা আমরা পার করে এসেছি। সুতরাং তাদের মনের ভাব বোঝা অতটা জটিল নয় অভিভাবকদের কাছে। সারাদিনের নানারকেমর কর্মব্যস্ততার পর বাড়িতে ফিরে শিশুকে বুকে জড়িয়ে তার পছন্দের একটা গান বা কবিতা বা স্নেহমাখা আদুরে স্পর্শে সম্পর্ককে গড়ি তুলি আরও গভীর, উষ্ণ ও প্রাণবন্ত করে। প্রযুক্তির যুগে সন্তানদের চাহিদা বাড়ছে। এক শ্রেণীর অভিভাবক সন্তান যা চাচ্ছে তাই পূরণ করছে। আর এক শ্রেণীর অভিভাবক তা পূরণ করতে পারছে না এবং এক শ্রেণীর অভিভাবক সন্তানের প্রয়োজনীয় বেশি কিছু দিতে চাচ্ছে না। অভিভাবক হিসেবে সন্তানের চাহিদার ব্যাপারে সকর্ত থাকতে হবে সবাইকে। চাহিদার অতিরিক্ত পূরণ করা যাবে না। অভিভাবক হিসেবে যেমন সন্তানের সাফল্যের গর্বিত অংশীদার, তেমনি সন্তানের দুর্নামও অভিভাবকদের ওপরই বর্তাবে। তাই আসুন আমরা অভিভাবক হিসেবে সন্তানের সাফল্যের জন্য সঠিক দিকনির্দেশনা দেই আর দুর্নাম ঘটে এমন কাজ থেকে সচেতন করি। অভিভাবক হিসেবে সন্তানের প্রতি যে দায়-দায়িত্ব আছে তা সঠিকভাবে পালন করে সন্তানকে মানবিক গুণের মানুষ হিসেবে গড়ে তোলায় ব্যস্ত থাকি। লেখক : কথাসাহিত্যিক ও গবেষক
×