ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ভাষা সংগ্রামী সুসংবাদ দুঃসংবাদ

প্রকাশিত: ২০:৩০, ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২১

ভাষা সংগ্রামী সুসংবাদ দুঃসংবাদ

ভাষা আন্দোলন, ভাষা-শহীদ, ভাষা সংগ্রামীদের তত্ত্ব-তালাশ যতটুকুই করা হোক না কেন বিধাতা যেন সারা বছরের ৩৬৫ দিনের মধ্যে ফেব্রুয়ারির ২৮/২৯ দিনকেই নির্দিষ্ট করে রেখেছেন। অন্তত আমাদের আচরণে তেমন ধারণাই জন্মে। কমতি অবশ্যই আছে ভাষা-শহীদ ও ভাষাসৈনিকদের তত্ত্ব-তালাশ নেয়ার, ভাষা আন্দোলনের অবিকৃত ইতিহাস আলোচনার-পর্যালোচনার, ভাষা সংগ্রামীদের অবদানের ঐতিহাসিক কাহিনীগুলো প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে ছড়িয়ে দেয়া এবং তাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যগুলো বাস্তবায়নের মাধ্যমে প্রকৃত অর্থে ভাষা সংগ্রামীদের সম্মানিত করার ক্ষেত্রে। এ রোগ ও পীড়া থেকে কতদিনে মুক্তি পাওয়া যাবে তা বুঝে ওঠা কঠিন। যে ঘাটতিগুলোর কথা বললাম সে ঘাটতি যেহেতু দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে সেহেতু তা আমাদের অনেকটা যেন গা-সহা হয়ে গেছে। তাই এগুলো নিয়ে আমাদের কারও তেমন একটা মাথাব্যথা নেই। রাষ্ট্রের তো নেই-ই। তবে রোষ্ট্রের কর্ণধাররা তাঁদের বক্তব্যে-ভাষণে ভাষা সংগ্রামীদের ও শহীদদের শ্রদ্ধা নিবেদন, ভাষার উন্নয়ন এবং আন্দোলনের ইতিহাস নিয়ে তাঁদের মতো করে আলোচনা করে থাকেন। সেই আলোচনায় ভাষা আন্দোলনের গুরুত্ব, তার তাৎপর্য, তার লক্ষ্য ও আর্দশ তেমন একটা স্থান পায় না। ইতিহাসের বাস্তবতাও খুব একটা উঠে আসে না। ভাষা আন্দোলনকেই মুক্তিযুদ্ধের মূল প্রেরণা, ভাষা আন্দোলন না হলে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ সম্ভব হতো না-এমনতরো কথাবার্তা অবশ্য ফেব্রুয়ারি মাসজুড়ে আমরা সবাই বলে থাকি। কিন্তু তেমন একটি গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলনের যাঁরা নির্মাতা, যাঁরা সংগঠক, যাঁরা অংশগ্রহণকারী তাঁদের খোঁজ-খবর রাখার উদ্যোগ তেমন একটা চোখেই পড়ে না। মাত্র দিন কয়েক আগে একটি টেলিভিশন চ্যানেলে দেখছিলাম ভাষা শহীদদের সম্পর্কে একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণী। এঁরা তো শহীদ হয়েছিলেন বাহান্ন সালের একুশে ফেব্রুয়ারি বিকেলে বা রাতে। কিন্তু তাদের পরিবারবর্গকে আর্থিক সাহায্য দিলেন বঙ্গবন্ধু ক্ষমতায় এসে ১৯৭৩ সালে মুক্তিযুদ্ধের পর। সেই আর্থিক সাহায্যের পরিমাণ ছিল, ঐ তথ্যমতে, পরিবার প্রতি ২,০০০/- টাকা করে। আজ হয়ত ঐ দুই হাজারের দাম ২০,০০০ টাকার সমতুল্য। কিন্তু আর কি দেয়া হয়েছে পরবর্তীকালে এই ৪৭ বছরে? হয়ে থাকলে খুব ভাল, নতুবা নিন্দা করার ভাষা নেই। শহীদ ধীরেন দত্ত ইতিহাস বলে, শহীদ ধীরেন দত্তই প্রথম পাকিস্তানের গণপরিষদের সদস্য হিসেবে ১৯৪৮ সালের ফেরুয়ারিতে করাচী অধিবেশনে যোগ দিয়ে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতিদানের দাবি আনুষ্ঠানিকভাবে তুলে ধরেন। অধিবেশনটি বসেছিল ২৩ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৮। কিন্তু ধীরেন দত্ত ঐ প্রস্তাব উত্থাপনের সঙ্গে সঙ্গে সংসদে হৈ চৈ শুরু হয়। সরকারী প্রস্তাব ছিল পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে ঊর্দু। কিন্তু তার পাশাপাশি পাকিস্তানের জনসংখ্যার ৫৬ ভাগ যেহেতু বাঙালী এবং তাদের মাতৃভাষা বাংলা হওয়া সত্ত্বেও বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি জানাতে শুধু অস্বীকৃতিই জানান হয়নি, প্রস্তাবক ধীরেন দত্তকে ‘ভারতের দালাল,’ ‘পাকিস্তানের দুশমন’ প্রভৃতি আখ্যায় আখ্যায়িত করেন পাকিস্তানের তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানসহ মুসলিম লীগের অপর বাঙালী-অবাঙালী নেতৃবৃন্দ। ঐ অধিবেশনেই ২৯ মার্চ তারিখে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি দিয়ে আনীত বিল পাস করা হয়। প্রতিবাদ করেন শহীদ ধীরেন দত্ত একক কণ্ঠে। অতঃপর দ্রুত তিনি ফিরে আসেন পূর্ব-বাংলায়। ঢাকা বিমানবন্দরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রগতিশীল ছাত্ররা তাঁকে মাল্যভূষিত করেন, সশ্রদ্ধ সংবর্ধনা জানান। ভাষা আন্দোলন অতঃপর জনতার পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেন ছাত্রসমাজ, যার শুরু ১৯৪৮-এ। অবশ্যই এই বিশাল তাৎপর্যময় আন্দোলনের সূচনা করেন ধীরেন দত্ত। ফলে তাঁকেই ভাষা আন্দোলনের প্রধান নেতা হিসেবে রাষ্ট্রীয় ও সামাজিকভাবে স্বীকৃতি দেয়া আমাদের ঐতিহাসিক দায়িত্ব। কিন্তু এক্ষেত্রে যদি দলবাজি নেতাবাজি-ব্যক্তিবাদ প্রভৃতি এনে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করা হয় তবে নিশ্চিতভাবেই এই বীরের অবমূল্যায়ন করা হবে। বঙ্গবন্ধু ধীরেন দত্তকে মর্যাদা দিয়েছেন অকুণ্ঠচিত্তে। তিনি বলেছেন, পাকিস্তান গণপরিষদে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতিদানের দাবি জোরেশোরে উত্থাপন করে ভাষা আন্দোলনের সূচনা করেন ধীরেন দত্ত। সেই ধীরেন দত্ত কুমিল্লার সন্তান এবং কংগ্রেস নেতা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালেও দেশত্যাগ তো দূরের কথা, নিজের বাড়ি ছেড়ে অন্য কোথাও যাননি। বলতেন, ‘জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরীয়সী’। অর্থাৎ জননী ও জন্মভূমি স্বর্গাপেক্ষা গৌরবের। তাই পাকবাহিনীর হাতে তাঁকে জীবন দিতে হয়েছে। তিনি শহীদ হলেন দেশ মাতৃকাকে ভালবেসে। সেই ধীরেন দত্তের কুমিল্লার গ্রামের বাড়িটি দেখাশোনার আজ আর কেউ নেই। বাড়িটি কার্যত একটি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। ঐ বাড়ির জরাজীর্ণ ছবিটি দিনকয়েক আগে ফেসবুকে ভাইরাল হতে দেখেছি। সরকার সেখানে ‘ভাষা আন্দোলন ও বাঙালী সংস্কৃতি গবেষণা কেন্দ্র’ হিসেবে ঐ বাড়িটিকে গড়ে তুলে ধীরেন দত্তের প্রতি শ্রদ্ধা এবং সম্মান দেখাতে ও তাঁকে স্মরণীয় করে রাখতে পারে। হারিয়ে যাওয়া নেতারা ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস থেকে ধীরে ধীরে সবার অলক্ষ্যেই অনেক নেতা হারিয়ে যাচ্ছেন। স্মৃতি হাতড়ে যাঁদের নাম পাচ্ছি তাঁরা হলেন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, মাওলানা আবদুর রশিদ তর্কবাগীশ, অলি আহাদ, গাজীউল হক, আবদুল মতিন, ইমাদুল্লাহ, হাসান হাফিজুর রহমান, মোহাম্মদ সুলতান, খোন্দকার মোঃ ইলিয়াস, কেজি মোস্তফা প্রমুখ। হারিয়ে গেছে বাহান্নর ভাষা আন্দোলনের পর তেপ্পান্ন সালে প্রধানত আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারীদের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস, প্রবন্ধ, ছোটগল্প ও একগুচ্ছ কবিতা নিয়ে ‘একুশে ফেব্রুয়ারী’ নামে যে সংকলন প্রকাশিত হয় সেটিও, ঐ সময় মেডিক্যাল কলেজ হোস্টেলের বিপরীতে অবস্থিত ‘পুঁথিপত্র’ নামক প্রকাশনা কেন্দ্র থেকে বইটি প্রকাশিত হয়। প্রকাশের পরপরই মুসলিম লীগ সরকার বইটিকে বেআইনী ঘোষণা করে। অতঃপর ১৯৫৬ সালে আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ কোয়ালিশন সরকার বেআইনী ঘোষণার আদেশটি প্রত্যাহার করে। অতঃপর জনপ্রিয় ঐ বইটির দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয়। কিন্তু দেশে ১৯৫৮ সালে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটার পর সামরিক আইন জারি হলে বইটি আবারও নিষিদ্ধ ঘোষিত হয় এবং তারপর থেকে বইটি বাজারে পাওয়া যায় না। ‘একুশে ফেব্রুয়ারী’ নামক সংকলন গ্রন্থটির ঐতিহাসিক মূল্য থাকায় বাংলা একাডেমির উচিত নতুন একটি সংস্কারণ প্রকাশ করা। স্মৃতিরক্ষায় অবহেলা কাম্য নয় ভাষা আন্দোলনকে নিয়ে বাঙালী জাতি অত্যন্ত গর্বিত, গর্বিত দলমত-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে। নারী-পুরুষ, শিশু-কিশোর, যুব-বৃদ্ধ নির্বিশেষে। তাই তো বাহান্নর পরে আজ দীর্ঘ ৬৯ বছর অতিক্রান্ত হলেও গ্রাম থেকে শহর-বন্দর-নগর পর্যন্ত একুশে ফেব্রুয়ারির প্রথম প্রহর থেকে অন্তত সকাল ১১টা পর্যন্ত শহীদ মিনারগুলোতে মানুষের ঢল নামে, নামে স্বতঃস্ফূর্তভাবে। এ এক কল্পনাতীত ব্যাপার, সন্দেহ নেই। কিন্তু ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিরক্ষায় একমাত্র বাংলা একাডেমি ব্যতিরেকে তার গবেষণা কেন্দ্র, ইতিহাস সংরক্ষণ কেন্দ্র, ভাষা সংগ্রামীদের বাড়িঘর সংরক্ষণ, তাঁদের পরিবার-পরিজনদের (অনেক ভাষা সংগ্রামী যেহেতু আজ লোকান্তরে) খোঁজ-খবর রাখা, ভাষা সংগ্রামীদের ছবি জেলায় জেলায় সংরক্ষণ, তাঁদের তালিকা উপজেলাওয়ারি প্রণয়ন ও যত দ্রুত সম্ভব তাঁদের নামের তালিকা সরকারীভাবে গেজেট আকারে প্রকাশ এবং মর্যাদাপূর্ণ ভাতাদি প্রদান রাষ্ট্রের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। আজ ইউএনওদের চলাফেরার জন্য কোটি টাকা মূল্যের গাড়ি বরাদ্দ হচ্ছে বিস্ময়করভাবে, কিন্তু ভাষা সংগ্রামীরা- যাঁরা বাঙালী জাতিসত্তা ও সংস্কৃতির নব উন্মেষ ঘটালেন, মহান মুক্তিযুদ্ধের পরিবেশ রচনা করলেন, দেশ ও জাতির জন্য উচ্চশিক্ষার সুযোগ তৈরি করলেন, তাঁদের প্রতি যে অবহেলা তা ভাবতেও কষ্ট হয়। এর অবসান হওয়া জরুরী। ভাষাসৈনিকদের প্রতি সম্মান জানাতে তাঁদের নামে স্টেডিয়াম, রাস্তা, পাঠাগার, সাংস্কৃতিক ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা বা নামান্তর করা জরুরী। ভাষা আন্দোলন ও ভাষাসৈনিকদের শ্রদ্ধা জানানোর ক্ষেত্রে অবহেলার তালিকা আর দীর্ঘ না করে ঢাকা থেকে প্রকাশিত দৈনিক সময়ের আলো নামক স্বল্প পরিচিত পত্রিকায় প্রকাশিত একটি সুসংবাদও প্রিয় পাঠক-পাঠিকাদের কাছে পরিবেশন করছি- ভাষাসৈনিক ‘আবদুল মতিনের গ্রামে প্রথম শহীদ মিনার- খুশি এলাকাবাসী’ শিরোনামে প্রকাশিত খবরটিতে বলা হয়- প্রতীক্ষার ৬৮ বছর পর ভাষাসৈনিক আবদুল মতিনের নিজ গ্রাম গুধিবাড়ী সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নবনির্মিত শহীদ মিনারে ব্যাপক আয়োজনে পালিত হয়েছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ও শহীদ দিবস। সিরাজগঞ্জ জেলা পরিষদের অর্থায়নে দিবসটি পালন করা হয়। এর ফলে আশা মিটেছে আবদুল মতিনের জন্মভূমির সর্বস্তরের মানুষের। সারাদেশে জেলা ও উপজেলা পরিষদ, পৌরসভা এবং সিটি কর্পোরেশনগুলো এ থেকে শিক্ষা নিলে তবেই ভাষা সৈনিকদের স্মরণে বড়কিছু হতে পারে। লেখক : সাংবাদিকতায় একুশে পদকপ্রাপ্ত [email protected]
×