ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মার্জিয়া লিপি

ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার

প্রকাশিত: ০০:৩০, ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২১

ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার

‘আনিসুজ্জামানের জীবন- এ ভূখণ্ডের ইতিহাস’। ব্রিটিশ, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের এক দীর্ঘ কালযাত্রার সাক্ষী। আনিসুজ্জামানের জীবন পরিক্রমা- ত্রিশের দশকে জন্ম নিয়ে পরবর্তী আটটি দশক (১৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৩৭- ১৪ মে ২০২০ )। জীবনকালে এদেশের জাতিসত্তার উন্মেষে কখনও প্রত্যক্ষ, কখনও পরোক্ষভাবে ভূমিকা রেখেছেন। তিনি দেখেছেন, চল্লিশের দশকে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও দেশ বিভাগ। পঞ্চাশের দশকে জড়িয়েছিলেন মাতৃভাষা রক্ষার আন্দোলনে। ষাটের দশকে ভূমিকা রেখেছেন বাঙালীর সংস্কৃতির আন্দোলন ও গণঅভ্যুত্থানে। সত্তর দশকে যুক্ত হন মুক্তিযুদ্ধে। তিনি স্বাধীন দেশের সংবিধানের বাংলা ভাষান্তর করেন। আশির দশকে নিবেদিত ছিলেন স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে। নব্বইয়ের দশকে সক্রিয় ছিলেন যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে গণআদালত গঠনে। ভূমিকা রাখেন মুক্তিযুদ্ধেরপক্ষের শক্তির বিকাশে। নতুন শতাব্দীর শুরুতে এসে সংখ্যালঘুদের স্বার্থ, গণতন্ত্র রক্ষা ও পুনরুদ্ধারে নিজেকে সক্রিয় রাখেন। জীবনের শেষ দশকে যুক্ত হন যুদ্ধাপরাধের বিচারে। অবস্থান নেন মানবাধিকার সংরক্ষণ ও ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে। বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী ছিলেন আনিসুজ্জামান। নানামাত্রিক পরিচয়- ব্যক্তি আনিসুজ্জামান, অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। যার বিস্তৃতি ছড়িয়ে রয়েছে এদেশের সীমানা পেরিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেÑ মানুষের মনে এবং মননে। বাঙালী জাতির বাতিঘর- সর্বজনশ্রদ্ধেয় এ কীর্তিমান ব্যক্তি সত্যিকার অর্থে একজন মুক্ত মনের মানুষ। জীবন এবং সময়কে নিয়ে লেখা ‘কালনিরবধি’তে- নিজের উৎস বা শিকড় সম্পর্কে তিনি লিখেছেন- ‘আমাদের পরিবার যেমন দেশজ, আমার মায়ের পরিবার তেমনি বহিরাগত। তাঁদের একটি প্রাচীন কুরসিনামা আছে বলে শুনেছি, যদিও আমি কখনও তা দেখিনি। তবে তার থেকে ইংরেজী ও বাংলায় তৈরি করা বংশলতিকার একাধিক খণ্ডাংশ আমার গোচরে এসেছে। এর থেকে জানা যায় যে, তাঁদের পূর্বপুরুষ সৈয়দ মোহাম্মদ মিন্হা বাগদাদ থেকে বাংলায় আসেন সুলতান হোসেন শাহ্র রাজত্বকালে (১৪৯৩-১৫১৯) এবং বসিরহাটে বসতি স্থাপন করেন।’ আনিসুজ্জামান- আবু তৈয়ব মোহাম্মদ (সংক্ষেপে এটিএম) আনিসুজ্জামান। নিজের নামকরণ প্রসঙ্গে বলেন, ‘আব্বা আমাদের চাচাতো-মামাতো ভাইদেরÑ নাম রেখেছিলেন নিজের নামের মতো দীর্ঘ করে। আমার অগ্রজের নাম আবুল কালাম মোহাম্মদ কামরুজ্জামান। ততদিনে আব্বার নামও ইংরেজী মতে সংক্ষিপ্ত হয়ে ডাঃ এটিএম মোয়াজ্জেমে পরিণত হয়েছে। তখন থেকে আমাদের সবার নামেই যেন এটিএম থাকে, এটাই হয় তাঁর লক্ষ্য। অতএব আমার নাম রাখা হয় আবু তৈয়ব মোহাম্মদ (এটিএম) আনিসুজ্জামান। আমার ছোটো ভাইয়ের আবু তালেব মোহাম্মদ আখতারুজ্জামান। আমার প্রথম গল্প বেরিয়েছিল এটিএম আনিসুজ্জামান স্বাক্ষরে। তারপর এটিএম বর্জন করি। পত্রিকার পাতায় তা দেখে আব্বা জিজ্ঞেস করলেন, ‘এটিএম লেখনি কেন? বললাম, ওটা বাদ দিয়েছি।’ আব্বা একটু চুপ করে থেকে বললেন, ‘আমার ছেলে বলে চেনা যাবে না।’ অধ্যাপক আনিসুজ্জামান জীবনের শুরুতেই অনেক আলোকিত মানুষের সংস্পর্শে এসেছিলেনÑ বেনাজীর আহমদ, ছবি বিশ^াস, আনিস চৌধুরী, সুফিয়া কামাল, জয়নুল আবেদিন, ফজলে লোহানী, কাজী মোতাহার হোসেন, রোকনুজ্জামান খান, আহসান হাবীব, কামরুল হাসান, প্রকৌশলী এফ আর খান, শহীদ কাদরী, মোহাম্মদ নাসিরুদ্দীন, আবু জাফর শামসুদ্দীন, আব্বাস উদ্দীন, জসীম উদদীন, ইবরাহীম খাঁ, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক –এ রকম আরও অনেক মনীষী। বরেণ্য এ মনীষীর সঙ্গে আমার পরিচয় কাজের সূত্রে পরিচয়। গত এক দশক তিনি ছিলেন আমার যে কোন সৃষ্টিশীল কাজের পরামর্শক। চারপাশে যেন, স্মৃতির জোনাকিরা ভিড় করছে। তারিখটি ছিল ২০১৫ সালের নবেম্বরের ১০ তারিখ। সরদার ‘ফজলুল করিম জীবনীগ্রন্থ’ ভূমিকা লিখে দেয়ার সময় -২০১৫ সালে । খুব ভয় ভয় মনে সাহস সঞ্চয় করে সেদিন স্যারকে আমার ইচ্ছের কথা জানালাম। বললাম, ‘স্যার, আপনাকে নিয়ে আমি একটি কাজ করতে চাই- ‘আনিসুজ্জামান : জীবন ও সাহিত্য’ এ নামে।’ তিনি বললেন, ‘সরদার ভাই এর কাজটি আগে ভালভাবে শেষ কর, তারপর আমার কাজটি শুরু কর।’ এরপর থেকে সেই শুরু। যে কোন উপলক্ষে যখন-তখন ছুটে গিয়েছি- সহজাত বৈশিষ্ট্যের কারণেই তাঁর কাছে পেয়েছি অবারিত দ্বার, আশাতীত অনুপ্রেরণা, মমতা, সাহস আর ভরসা। তাঁর জীবনীগ্রন্থের সর্বশেষ পর্ব ‘বিপুলা পৃথিবী’ আমাকে উপহার দিয়েছিলেন শুভেচ্ছা বাণীসহ। বলেছিলেন, ‘কাল নিরবধি’, ‘আমার একাত্তর’ আর ‘বিপুলা পৃথিবী’ তে তুমি আমাকে আর আমার সময়কে খুঁজে পাবে।’ তাঁর রচিত ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা শতাধিক। প্রবন্ধ-গবেষণা গ্রন্থের মধ্যে- ‘মুসলিম মানস ও বাংলা সাহিত্য’, ‘মুসলিম বাংলার সাময়িকপত্র’, ‘মুনীর চৌধুরী’, ‘স্বরূপের সন্ধানে’, ‘ঝড়পরধষ অংঢ়বপঃং ড়ভ ঊহফড়মবহড়ঁং ওহঃবষষবপঃঁধষ ঈৎবধঃরারঃু’ (১৯৭৯) ‘ঋধপঃড়ৎু ঈড়ৎৎবংঢ়ড়হফবহপব ধহফ ড়ঃযবৎ ইবহমধষর উড়পঁসবহঃং রহ ঃযব ওহফরধ ঙভভরপরধষ খরনৎধৎু ধহফ জবপড়ৎফং’, ‘আঠারো শতকের বাংলা চিঠি’, ‘মুহম্মদ শহীদুল্লাহ’, ‘পুরনো বাংলা গদ্য’, ‘মোতাহার হোসেন চৌধুরী’, ‘ঈৎবধঃরারঃু, জবধষরঃু ধহফ ওফবহঃরঃু’, ‘ঈঁষঃঁৎধষ চষঁৎধষরংস’,’ ওফবহঃরঃু, জবষরমরড়হ ধহফ জবপবহঃ ঐরংঃড়ৎু’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। একটা নদী যেমন চলার পথে স্থান ও কালের রেখা রেখে বয়ে চলে, হাজারো মানুষের স্মৃতি সঙ্গী করে সমুদ্রে মেশে, আনিসুজ্জামান ঠিক তেমনি কীর্তিমান। তিনি ছিলেন বহুমাত্রিক সত্তার। শুধুমাত্র লেখক, শিক্ষক বা গবেষক নয়; তিনি ছিলেন আরও অনেক কিছু। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা ব্যতিরেকেও অধ্যাপক আনিসুজ্জামান ছিলেন প্রবাসী সরকারের পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য। তিনি ছিলেন আফ্রো-এশীয় লেখক সংঘের সক্রিয় সদস্য। উপনিবেশমুক্ত দেশগুলোর শিক্ষা, সংস্কৃতি ও রাজনীতিকে ঔপনিবেশিক প্রভাব থেকে মুক্ত হতে এ সংস্থা কাজ করেছে। কমনওয়েলথ একাডেমি স্টাফ ফেলো হিসেবে তিনি লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব ওরিয়েন্টাল এ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজে গবেষণা করেন। জাতিসংঘ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা-প্রকল্পে অংশ নেন। বঙ্গবন্ধু আনিসুজ্জামানকে সরকারের শিক্ষাসচিব হওয়ার প্রস্তাব দেন। কিন্তু আমরা পরম বিস্ময়ে দেখি, তিনি তা গ্রহণ করেননি। তাঁর সৌভাগ্য- তিনি পেয়েছেন অনেক। সবচেয়ে বেশি পেয়েছেন- মানুষের ভালবাসা। তাঁর বিচরণ ছিল সমাজের সব পর্যায়ে- রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদ থেকে তৃণমূলে। রাষ্ট্রীয়সম্মানপেয়েছিলেন, সঙ্গে ছিল আন্তর্জাতিক প্রাপ্তি। ২০১৮ সালে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কার ‘স্বাধীনতা পদক’ এবং ভারত সরকারের তৃতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা ‘পদ্মভূষণ’ পদক (২০১৪) লাভ করেন। আনিসুজ্জামান মানবিক মানুষ ছিলেন। মানবিকতা ছাড়াও লক্ষণীয় ছিলেন- পরিশীলিত জীবনাচরণ, সৌজন্যপরায়ণতা, তীক্ষè রসবোধ, কঠোর সময়ানুবর্তিতা, পরমতসহিষ্ণুতা। লক্ষণীয় ছিলেন তাঁর উদারতা, অনাড়ম্বর জীবন-যাপন, সত্যবাদিতা, দায়িত্ববোধ, দেশপ্রেম; কখনও কখনও দেশপ্রেমের উর্ধে আন্তর্জাতিকতায়। সরাসরি রাজনীতিতে যুক্ত হননি তিনি, তবে তাঁর একটা রাজনৈতিক দর্শন ছিল। রাজনৈতিক অঙ্গীকার নিয়ে রাজপথে ছিলেন সবসময়। মানুষ ও দেশ নিয়ে নীতি-নৈতিকতা ও আদর্শের প্রশ্নে সক্রিয় ছিলেন সারা জীবন । নানা প্রাসঙ্গিকতায় যথার্থই বলা হয়, ‘আনিসুজ্জামান বাংলার উত্তাল ইতিহাসের নানা সন্ধিক্ষণে যথোচিত ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে ক্রমিক উত্থানের মধ্য দিয়ে নিঃসন্দেহে পরিণত করেছেন নিজেকে জাতির বিবেকে।’ তিনি বিশ্বাস করতেন -সমষ্টিতে, ভাবতেন- বহুত্ব নিয়ে, আকৃষ্ট হতেন বিশালত্বে।
×