ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

স্বর্ণশ্যাম সময়ের কুহক

প্রকাশিত: ০০:২৩, ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২১

স্বর্ণশ্যাম সময়ের কুহক

রবীন্দ্র পরবর্তী সময়ে আধুনিক বাংলা কবিতার সবচেয়ে পাঠকনন্দিত কবি জীবনানন্দ দাশ। উত্তরকালের কবিতায়চর্চায় সবচেয়ে বেশি অনুসৃত কবিও জীবনানন্দ দাশ। বাংলার ষড়ঋতুর মধ্যে হেমন্তকে সর্বাধিক ভালোবাসতেন বসন্তে আবির্ভূত এই কবি। আবার হেমন্তেই অগ্যস্তযাত্রায় শামিল হন। হেমন্ত ঋতু ‘এক অর্থে জটিল অন্য অর্থে অনায়াস অক্লেশ সময়ের যাত্রা। জটিল এই কারণে যে, বাংলার নিসর্গ-সঙ্গীতে এই ঋতু এমন এক সোমে এসে চলা শুরু করে বা থামে; যা আমাদের সাধারণ চোখে দৃশ্যমান হয়ে ওঠে না। এ ঋতুর জন্ম শরতের গর্ভে আর বিদায়যাত্রা ভর করে থাকে শীতের কাঁধে। প্রকৃতি বা আবহাওয়া বিচারে এই ঋতুর প্রকাশ যৌগ, ঠিক ভোর বা গোধূলির মতো তারও রয়েছে ভিন্ন মাত্রিকতা।’ ফলে হেমন্তকে ‘স্বর্ণশ্যাম সময়ের কুহক’ হিসেবে আখ্যা দেওয়া যেতে পারে। জীবনানন্দ দাশ এই কুহকের আশ্চর্য নির্মাতা হয়ে অন্তর্হিত হলেও তার কবিতা পাঠে নাতিদীর্ঘ বিষণ্নতা, স্বপ্নময়তা, আশ্চর্য রূপশ্রী, ক্লান্তি, হতাশা ও বিষাদ; আবার আশাবাদও সোনার টুকরোর মতো উজ্জ্বলতা মেলে ধরে পাঠকের অন্তর্লোকে। ব্যক্তিগত জীবনে সমসাময়িক আধুনিক কবিদের মধ্যে জীবনানন্দ দাশ সবচেয়ে ব্যর্থ কবি-বিশ্লেষকরা এমনটি দাবি করেন। কবির যাপনের দিকে চোখ ফেরালে এমন ভাবনার যুক্তি মেলে বৈকি। তবে, ব্যক্তিজীবনে ব্যর্থ হলেও আধুনিক কবিতা রচনায় তিনি যে সবার ওপরে তা হলফ করে বলা যায়। প্রকৃতি ও জীবনের এমন কোন্ প্রপঞ্চ নেই যা জীবনানন্দের কবিতায় অনুপস্থিত। জীবনের নানান অনুষঙ্গ তিনি নিসর্গের মোড়কে কবিতায় স্ফূর্তি দিতে সক্ষম হয়েছেন। প্রেম, নারী, রোমান্টিকতা, ভালোবাসা এবং দেশাত্মবোধেও উজ্জ্বল তার কবিতা। তিনি বাংলার রূপে এতটাই মোহিত ছিলেন যে, বারবার বাংলায় ফিরে আসার তুমুল আকুতি ব্যক্ত করেছেন। ফিরে আসতে চেয়েছেন জন্মভূমির প্রিয় ধানসিঁড়ি নদীর তীরে। বাংলার প্রকৃতিই ছিল কবির সবচেয়ে প্রিয়। আর এসবের ভেতর দিয়ে জীবদ্দশায় কবির অতৃপ্তির বিষয়টিও পাঠকের চেতনায় মৃদু টোকা দেয়। সার্বিকভাবে জীবনানন্দ দাশকে পাঠক আবিষ্কার করেন ‘অলীক এক ভুবনের বাসিন্দা’ হিসেবে। তিনি অধরা এবং তার বিচরণ যেন স্বপ্নালোকে। তার কবিতা চির রহস্যময়তা নিয়ে ঝুলে থাকে অদ্ভুত এক আঁধারে। তাই কবিকে ঠিক বুঝতে পারা যায় না। কবিকে নিয়ে পাঠকের কৌতূহলও নিবৃত্ত হয় না। তার কবিতা অস্পষ্টতার কুণ্ডলী থেকে ধোঁয়া হয়ে মরীচিকার মতো শূন্যে মিলিয়ে যায়। কিন্তু বার বার পাঠের আগ্রহ মরে না। জীবনানন্দের কবিতার শব্দগুলোর মর্ম ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে করে পাঠকের। ‘জীবনানন্দ দাশ কবিতায় যে অলৌকিক জগৎ নির্মাণ করেছেন, সেখানে সহজে ঢুকতে পারা যায় না। তিনি শব্দে শব্দে যে চিত্র আঁকেন, তার সঠিক ব্যাখ্যাও কারও পক্ষে ফুটিয়ে তোলাও সম্ভব হয় না। তিনি রূপের যে বর্ণনা দিয়েছেন, তার মাধুর্য আর কোথাও পাওয়া যায় না। তিনি যে গন্ধ পেয়েছেন, তা আর কেউ সেভাবে অনুভব করতে পারেননি।’ গবেষকের এমন বক্তব্য আত্মস্থ করে বলা যায়, কবির অনুভব, অনুভূতি, অনুধাবন পাঠকের কাছে চির প্রহেলিকা হয়েই ধরা দেয়। যে কারণে কী আছে তার কবিতায় কিংবা কেন তিনি প্রতি পাঠে নতুন রূপে ধরা দেন-এমন প্রশ্নের মীমাংসা হয় না। তবে জীবনের নানান হতাশা, চড়াই-উৎরাই প্রত্যক্ষণ সত্ত্বেও জীবনানন্দ দাশ প্রচণ্ড আশাবাদ ব্যক্ত করেন। এ প্রসঙ্গে কবির ‘নাবিক’ কবিতা থেকে কিছু অংশ তুলে ধরা যেতে পারে, ‘সেই দুরাশার মোহে ভুলে গেছ পিছুডাকা স্বর ভুলেছ নোঙর! কোন্ দূর কুহকের কূল লক্ষ করি ছুটিতেছে নাবিকের হৃদয়-মাস্তুল কে বা তাহা জানে! অচিন আকাশ তাকে কোন্ কথা কয় কানে কানে!’ জীবনানন্দ দাশ কবিতায় অপার্থিব এক জগত নির্মাণ করেছেন, যাতে এক ধরনের হেঁয়ালি আছে, আছে অধরা মাধুরী। তিনি জীবনকে ‘নিভৃত কুহক’-এর অন্তরালে দাঁড় করিয়ে আশাবাদের কথা শুনিয়েছেন। নিজস্ব বেদনাক্ষতে এক ধরনের বোধের নিরাময়-প্রলেপ দানে সচেষ্ট থেকেছেন। যে কারণে জীবনানন্দ দাশের কবিতার গভীর পাঠে সুস্পষ্ট বক্তব্য ও দর্শন পাওয়া যায়। ‘বৌদ্ধদর্শন এবং দ্বৈতবাদের আলোকে ভারতীয় ব্যক্তি-সমাজ-সভ্যতাকে দেখে নিতে কবিকে কিভাবে, কতটা তাড়িত করেছিল সেসব দিক পরিষ্কারভাবে’ উঠে আসে কবির কবিতায়। সমাজ-সংস্কার, প্রেম-যৌনতা, প্রতীক-বিশ্বাস ইত্যাদি বিষয়ও তার কবিতার মর্মস্থলে স্পন্দন তোলে। জীবনানন্দের কবিতায় নানান নামে উঠে আসা নারীরা পর্যায়ক্রমে একক নারী থেকেও যেন হয়ে ওঠে সমাজের সকল নারীর প্রতিভূ। গবেষক ফয়জুল লতিফ চৌধুরীর মতে, ‘এক বিবেচনায়, বিংশ শতাব্দীর নাগরিক মানুষের কাছে জীবনানন্দ দাশ রবীন্দ্রনাথেরই পরিপূরক। তাঁরা দুজনই আমাদের শূন্যতাদীর্ণ নগর-যান্ত্রিক মানসের শরণবেদী। আপাত অসবর্ণ দুই কবি বিংশ শতাব্দীর বিভক্ত মানবসত্তার দুই খণ্ডর কাছে ভিন্ন আঙ্গিকে পূর্ণমাত্রায় আবেদন নিয়ে উপস্থিত-সক্ষম। একজনের আবেদন ঈশ্বরে সমর্পিত রূপকাতর চেতনার কাছে, অন্যজনের করাঘাত আধুনিক নাগরিক মানুষের নিরাবলম্ব ও সন্ত্রস্ত অথচ ইন্দ্রিয়লিপ্ত অবচেতনার কাছে। জীবনানন্দের কবিতার অস্পষ্ট নায়কেরা তাই অভূতপূর্ব প্রতিবিম্ব নিয়ে উপস্থিত হয় পাঠকের কাছে’- কখনও কখনও। আরও গাঢ় বিতর্কের পাতা নেড়ে-চেড়ে জানি না সে পেল কোন্ প্রীত সমাধান বহু দিন আমাদের চক্ষু থেকে অন্তর্হিত হয়ে সে যেন প্রবাদ হয়েছিল কোনও অন্ধকার নিমজ্জিত ভিড়ে মাঝে-মাঝে যেন কোনও মধ্যযুগ থেকে এক অর্ধমৃত সমুদ্রের বাতাসের মত আমাদের নিশীথ’কে মুহূর্তের কোলাহলে ব্যস্ত ক’রে চ’লে যেত তবু আমরাই মৃত্যুর ভিতরে পড়ে আছি। [আরও গাঢ় বিতর্কের] জীবনানন্দ দাশের অস্তিত্বের মধ্যে, চৈতন্যের মধ্যে, রক্তের মধ্যে যা কিছু ক্রিয়াশীল কিংবা আন্দোলিত, তা তিনি শব্দ ও বাক্যের ব্যঞ্জনে দক্ষতার সঙ্গে প্রক্রিয়াজাত করেছেন। তিনি কবিতা নিয়ে এক ধরনের এক্সপেরিমেন্টও করেছেন বলা যেতে পারে। কেননা, ‘কবিতার কথা’ প্রবন্ধে তিনি বলেছেন, ‘আমি বলতে চাই না যে কবিতা সমাজ বা জাতি বা মানুষের সমস্যাখচিত, অভিব্যক্ত সৌন্দর্য হবে না। তা হতে বাধা নেই। সে সমস্ত চিন্তা, ধারণা, মতবাদ, মীমাংসা কবির মনে প্রাক্কলিত হয়ে কবিতার কঙ্কালকে যদি দেহ দিতে যায় কিংবা সেই দেহকে দিতে যায় আভা তাহলে কবিতা সৃষ্টি হয় না, পদ্য লিখিত হয় মাত্র।’ সুতরাং এটা বলা অসঙ্গত হয় না যে, জীবনানন্দ দাশ পদ্য নয়, কবিতা লিখতেই জীবন পার করেছেন। এছাড়া সার্বিক বিবেচনায় বলতে গেলে, শুধু মৃত্যু নিয়ে তিনি কবিতার এক মায়াভুবন গড়ে তুলেছেন। যে কারণে তার কবিতা হয়ে উঠেছে অনধিগম্য, অপ্রাকৃত ও স্পর্শাতীত। বিশ্লেষকদের মতে, আধুনিক কবিতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো মৃত্যুদর্শন। তার কবিতা থেকেই পাঠ নেওয়া যাক, ‘মনে হয় প্রাণ এক দূর স্বচ্ছ সাগরের কূলে জন্ম নিয়েছিলো কবে; পিছে মৃত্যুহীন জন্মহীন চিহ্নহীন কুয়াশার যে-ইঙ্গিত ছিলো- সেই সব ধীরে-ধীরে ভুলে গিয়ে অন্য এক মানে পেয়েছিলো এখানে ভূমিষ্ঠ হ’য়ে- আলো জল আকাশের টানে; কেন যেন কাকে ভালোবেসে। মৃত্যু আর জীবনের কালো আর শাদা হৃদয়ে জড়িয়ে নিয়ে যাত্রী মানুষ এসেছে এ-পৃথিবীর দেশে;’ [যাত্রী] জীবনানন্দে মৃত্যুচিন্তা এতটাই প্রগাঢ় যে, তিরিশের আর কোনো কবির ক্ষেত্রে তা চোখে পড়ে না। বিশ্লেষকের মতে, ‘তাঁর এই মৃত্যুচিন্তার অন্যতম কারণ বোধহয় তাঁর ব্যক্তিজীবনের নানাবিধ হতাশা-কষ্ট-বেদনা এবং সর্বোপরি অমানবিক দুনিয়ার বিষবাষ্পের ক্ষত ‘জীবন-জ্বর প্রসূত পরিণতি পলায়ন ও মৃত্যুচেতনা।’ তবে জীবনানন্দের, মৃত্যুচেতনা তার জীবনচেতনারই অংশ বলা যায়। অন্ধকারের প্রতি ছিল কবির দুর্মর আকর্ষণ। তিনি চেয়েছিলেন, ‘জীবনের চেয়ে সুস্থ মানুষের নিভৃত মরণ।’ কবির জীবনবাদী চেতনারও প্রকাশ ঘটেছে মৃত্যুচেতনার বিকল্প অব্যয় হিসেবে। লক্ষণীয় যে, ‘নিসর্গ, সমসাময়িক প্রতিবেশ, ইতিহাস আর পুরাণ থেকে গৃহীত চিত্রাবলি জীবনানন্দের সূক্ষ্ম উপলব্ধির ঐক্যসূত্রে গাঁথা পড়ল। মূলত জীবনানন্দের কবিসত্তা তাঁর অতলস্পর্শী বোধশক্তির কাছে ঋণী, কেননা এই বোধশক্তির জোরেই জীবনানন্দ সকল মেকি অনুভবের আবরণ ঠেলে মহাকাল ও ইতিহাসের নিরিখে বিংশ শতকী আধুনিক মানুষের মৃত্তিকালগ্ন, ইতিহাস-সমর্থিত মূল চেতনাটি আবিষ্কার করতে পেরেছিলেন।’ কবির আশ্চর্য শোভাময় কবিতা পাঠে এ সত্যই যেন পাঠক অনুভব করেন। ভোর কিংবা সন্ধ্যা যেমন সন্ধি-সময়ে রূপের সুষমা খোলে তেমনি জীবনানন্দ দাশের কবিতাও মহাকালের এক সন্ধি-লগ্ন, কুহকে আবৃত জীবনের অনুভূতিমালা, যা অন্তর্লোকের চোখ দিয়ে দেখার দাবি রাখে।
×