ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

কবির মুকুল প্রদীপ

জাদুবাস্তববাদের বিভ্রান্তিসমূহ

প্রকাশিত: ০০:২২, ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২১

জাদুবাস্তববাদের বিভ্রান্তিসমূহ

‘ফ্লোরেন্সের একজন নাবিক, আন্তোনিও পিপাফেত্তা, মাগেলানের প্রথম বিশ্বভ্রমণে তিনি ছিলেন তাঁর সহযোগী। আমাদের মধ্যরেখাসংলগ্ন আমেরিকা মহাদেশ দিয়ে যাবার সময়, এক প্রখর যথাযথ কালপঞ্জি, যেটা মনে হয় তাঁর [যথাযথ হবার দাবি সত্ত্বেও], কল্পনার এক লাগামছেঁড়া তুলকালাম অভিযান। তিনি বর্ণনা করেছেন তিনি নাকি এমন শুয়োর দেখেছেন যাদের নাভিকুণ্ডলি ছিল তাদের পিঠে [পেটে নয়] নাকি দেখেছেন এমন অনেক পাখির প্রজাতি যাদের পা নেই, মেয়েগুলো ডিম পেড়ে তা দিচ্ছে তাদের পুরুষগুলোর পিঠে, আর এমন কোন-কোন পাখি যাদের দেখতে এ্যালবার্টসের মতো, দেখেছেন এমন পাখি যাদের জিভ নেই, যাদের চঞ্জুগুলো একেকটা শান-দেয়া ছুরির ফলা; পিপাফেত্তা বলেছেন তিনি দেখেছেন স্থগিতবৃদ্ধি সব প্রাণী-যাদের মুণ্ডু আর কানগুলো খচ্চরের মতো, শরীরটা উটের, পাগুলো হরিণীর, আর মৃদু হ্লেষাধ্বনিগুলো ঘোড়ার, তিনি বলেছেন পাতাগোনিয়ার প্রথম যে বাসিন্দার সঙ্গে তাঁদের দেখা হয়েছিল তাকে তাঁরা একটি আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলেন, আর তার নিজের প্রতিরূপ দেখে নাকি আতঙ্কে উত্তেজিত সেই মানুষটির বুদ্ধিসুদ্ধি অমনিই লোপ পেয়ে গিয়েছিল।’ [গ্রাবিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের নোবেল-ভাষণের অংশবিশেষ] সত্যি বলছি এবিষয়ে নতুন করে আর কিছু লেখার ইচ্ছা আমার অনুভূত হচ্ছিল না, কিন্তু বাংলাদেশের সমকালীন জাদুবাস্তব গল্প পাঠের পর মনে হলো- এই গল্প লেখকদের অধিকাংশই জাদুবাস্তববাদ ব্যাপারটা স্পষ্ট বোঝেননি [সকলেই নয়] তাই আবার লিখতে উদ্যত হয়েছি। হ্যাঁ কল্পনা, জাদুবাস্তববাদ জটিল কিছু নয়; তুখোর কল্পনা, মার্কেজ যেটা বলেছেন তাঁর নোবেল-ভাষণে। কল্পনাই কেবল নয়, তার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে মিশে থাকে বাস্তব। জটিল মনে হচ্ছে? এত জটিল করে ভাববার কোন কারণ নেই। কল্পনা কী! এটা নিয়ে চিন্তায় আছেন? নাহ্ চিন্তার কোন কারণ নেই। কল্পনা হচ্ছে সেই; ঘটনাটা মনে আছে? আরে, ওই যে এক ভদ্রমহিলাকে ছেলেধরা ভেবে পিটিয়ে মারল-পরে জানতে পারলাম ওই ভদ্রমহিলা আসলে তার বাচ্চাকে স্কুল থেকে আনতে গিয়েছিল। মনে পড়েছে? ওই যারা পিটিয়ে মারল, তারা কি ভেবে পিটিয়ে মারল মহিলাকে? ছেলেধরা? কিন্তু মহিলা তো তা নয়! ওরা ভেবে নিয়েছিল, ওদের মনে হয়েছিল। এটাই কল্পনা। বিষয়টা এমন যে, লাতিন আমেরিকায় যে জাদুবাস্তববাদের উদ্ভব হয়েছিল তা মূলত এমন কিছু বিস্মৃত মানুষের কল্পনা যারা মূর্খ, দাস। দূরে পরে যাচ্ছি, আগে বাংলার সংস্কৃতি ও পুরাণ কল্পনার দিকে তাকানো যাক। রামায়ণ, মহাভারত, মনসামঙ্গল, আরব্যরজনী কোথায় নেই এই কল্পনা? ব্যক্তিগতভাবে আমি ছোট থেকেই একটা ঘটনা জেনে বড় হয়েছি যে, রবিঠাকুর নজরুলের কবিতা চুরি করে নোবেল পেয়েছেন; অনেক পরে যখন সাহিত্য নিয়ে একটুআধটু ঘাটাঘাটি করছি তখন জানতে পারলাম-নজরুলের যখন ১৩ বছর বয়স তখন কবিগুরু নোবেল পেয়েছেন! এটা কি জাদুবাস্তববাদ নয়? হ্যাঁ, এমন বহু উদাহরণ আপনি আপনার আশপাশে চোখখুলে তাকালেই দেখতে পাবেন, যা বাস্তব নয়, কল্পনা, অথচ এমনভাবে বাস্তবের সঙ্গে মিশে আছে যে বাস্তব থেকে তাকে আর আলাদা করা সম্ভব নয়। একেই বলে জাদুবাস্তববাদ। কোন এক দুদে-সমালোচক একটি ত্রৈমাসিক পত্রিকায় এক প্রবন্ধে লিখেছেন, জাদুবাস্তববাদ বলে পৃথিবীতে কিছুই নেই; অনেক যুক্তিটুক্তি দেখিয়ে সেই মত প্রতিষ্ঠা করতেও চেয়েছেন। আমি বলি, তবে আছে কী? কি এমন ঈশী গ্রন্থ আপনি পড়লেন যার বক্তব্য নির্ভুল! আমাদেরও দিয়েন পড়ব এবং নির্ভুল বাণী আওড়াব। কোন বাস্তববাদী তাত্ত্বিক আজও পর্যন্ত বাস্তবের কোন সংজ্ঞা দাঁড় করতে পাড়ল না, সেখানে আপনি তো বিস্ময়, বাংলা সাহিত্যের! বলে রাখা ভাল, লেখকদের তার অতীত জানতে হয়, জানতে হয় তার বাপ-দাদা থেকে শুরু করে চোদ্দপুরুষের সংস্কৃতি এবং ক্ষমতা থাকতে হয় সেগুলোকে যাচাই-বাছাই করে গ্রহণ-বর্জন করার। বাস্তবের কোন সংজ্ঞা না জেনেই বাস্তবের সংজ্ঞা নির্ধারণ; তাই তো ঘটে বসে এমন বিপর্যয়। বাস্তব তবে কী? খুব সহজ এই প্রশ্ন, আমরা যাকে বাস্তব মনে করি। মনে করুন পৃথিবীর ইতিহাস ষাট লাখ বছরের, কিন্তু মানুষের সভ্যতা? ইহুদি মাইথলজি অনুযায়ী দুহাজার বছর, বাইবেল পনের শ বছর, কোরআন বার শ বছর, গীতা-মহাভারত-রামায়ণ এরই আশপাশের সময়ের। এই তো? আমি এই টেক্সট লিখছি ওয়ার্ড ফাইলে, আমার বাপ লিখেছে তাল পাতায়; আমার বাবার বাস্তবতা তাল পাতা, আমার কম্পিউটার। তাল পাতার বাস্তবতা এখন কেবল স্মৃতি, আগামীতে কম্পিউটার স্মৃতি হয়ে যাবে। বাস্তবতা তাৎক্ষণিক, বাস্তবতা স্মৃতি, বাস্তবতা কল্পনা কারণ মানুষ স্মৃতি কল্পনা করে; এই বাস্তবতা কোন গড-ঈশ্বর-আল্লাহ এভাবে সাজিয়ে রাখেননি, গড়েছে মানুষ। যার কোন নিশ্চয়তা নেই, আপেক্ষিক। পৃথিবীতে মানৃষের বাস্তবতা সবটাই বানোয়াট, আপেক্ষিক। এটা কি জাদুবাস্তববাদ নয়? কিছুটা অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেল বোধহয়, নাকি একেবারে তা নয়! আলেহ কার্পেন্তিয়র, একজন কুবান লেখক মার্কেস যাঁকে গুরু মানতেন-কারণ লাতিন আমেরিকার জাদুবাস্তববাদ তাঁর হাতেই সূচনা হয়। কুবার ইতিহাস আপনারা কমবেশি সকলেই জানেন, বিভিন্ন উপনিবেশের কারণে যার বাস্তবতা একেবারে ঝাপসা হয়ে গিয়েছিল, স্পেইন, ফ্রান্স, পর্তুগিস, ইংল্যান্ড, ইন্ডিয়ান ও আফ্রিকান কালো মানুষের সংস্কৃতি যেখানে মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল। কোনটা তবে কুবান সংস্কৃতি? এমন প্রশ্নে কার্পেন্তিয়র মনে করতেন, নিগ্রো ও ইন্ডিয়ানদের বাদ দিয়ে সেটা অবশ্যই সম্ভব নয়। তাই তিনি তারই সন্ধান করলেন তাঁর উপন্যাস ‘এই মর্তের রাজত্বে’, তিনি সেটা করলেন একজন নিগ্রো ক্রীতদাসের বয়ানে, যার নাম তি-নোয়েল; আফ্রিকা থেকে যাকে কিনে আনা হয়েছে। সে মূর্খ কিন্তু তার আছে কল্পনাশক্তি, আছে আফ্রিকা থেকে নিয়ে আসা সংস্কৃতি যা স্মৃতিতে বিস্মৃতপ্রায়। উল্লেখ্যহুয়ান রুলফো, তিনিও একজন লাতিন আমেরিকান লেখক, এই লেখককেও মার্কেজ গুরু মানতেন; তাঁর একটি ছোটগল্পে এমনই এক বিস্মৃতপ্রায় ঘটানার বর্ণনা করেছিলেন। বুড়ো এস্তেবান যাকে তার মনিবকে খুন করার অপরাধে গ্রেফতার করা হয় কিন্তু যখন তার আত্মপক্ষ সমর্থনের সময় আসে তখন তিনি মনে করতে পারেন না, আসলেই তিনি খুনটা করেছেন কিনা অথবা করলেও করতে পারেন কিংবা না করলেও তার সেটা করা উচিত ছিল। প্রবন্ধ কী লাতিন আমেরিকার জাদুবাস্তববাদের মতোই ঝাপসা হয়ে গেল? ঘাবড়াবেন না, তেমনটা হওয়ার আশংকা এখানে একেবারেই ক্ষীণ। কারণ কার্পেন্তিয়র তাঁর ‘এই মর্তের রাজত্বে’ তি-নোয়েলকে দিয়ে যা বর্ণনা করান, সেখানে আমরা দেখতে পাই একজন নিগ্রো ক্রীতদাস যার একহাত কেটে নিয়েছে তার সাদা প্রভুরা, যার নাম মাকান্দাল। দাস হিসেবে যখন তার আর কোন মূল্য নেই তখন সে পালিয়ে চলে যায় জঙ্গলে। এখান থেকেই শুরু হয় তুলকালাম কল্পনার বিস্তার, নিগ্রো-রা ভাবতে থাকে মাকান্দালই তাদের রক্ষাকর্তা কারণ তার ওপর এখন ভর করেছে দেবতা, সে নানা রূপ ধরতে পারে—নিশিপোকা, সবুজ গিরগিটি, খুরওয়ালা কোন জত্রু যার মাথায় দাউদাউ করে শিং; গলে যেতে পারে কোন চাবকি ফোঁকর দিয়ে ইত্যাদি। হ্যাঁ এমটাই তারা কল্পনা করে, কেননা তারা দাস, মূর্খ-দিনভর প্রভুর বাড়িতে খেটে অবসরে স্মৃতি ঘেটে ঘেটে আষাঢ়ে গল্প ফাঁদাই তাদের জীবন। তারা বিশ্বাস করে দাস জীবন থেকে তাদের উদ্ধার করতে পারে একমাত্র কোন অলৌকিক শক্তিই। এভাবেই বাস্তবের সঙ্গে কল্পনা মিশে গিয়ে জন্ম নেয় অন্য এক বাস্তবের, জাদুবাস্তববাদের। যেমটা ঘটেছে রুলফোর গল্পে, যে বুড়ো এস্তেবান দিনরাত কল্পনা করে তার প্রভুকে হত্যা করার, স্বপ্নে সেটা সে করেছেও বহুবার; এখন যখন তার আর কাউকেই হত্যা করার ক্ষমতা নেই-তখন কিনা তাকে তার মনিবকে হত্যার দায়ে গ্রেফতার করা হলো! তাহলে সে বুঝতে পারবে কিকরে যে সে হত্যা করেছে কি-না? বাস্তব আর কল্পনা দুই তো তার জীবনে মিলেমিশে এক হয়ে গেছে! পরিষ্কার হলো না? না হোক সমস্যা নেই। মনে করুন আপনি হ্যাঁ আপনিই, মৃত্যুশয্যারত আপনার মাকে কথা দিয়েছেন যে; আপনার বাবা, যিনি আপনার মায়ের সকল সম্পত্তি আত্মসাৎ করে তাঁকে তাড়িয়ে দিয়েছে- তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর হারানো ঐশর্য উদ্ধার করবেন এবং তৎক্ষণাৎ আপনার মা মারা গেলেন। অতঃপর মায়ের কথা রাখতে একদিন পিতার উদ্দেশে রওনা হলেন, বাবার গ্রামের দিকে; যে গ্রাম আপনি চেনেন না, কোন দিন সেখানে আপনি যাননি। পথে আপনি দেখতে পেলেন ধু ধু মরুভূমি আর ভগ্নস্তূপ; যাদের সঙ্গে আপনার পথে দেখা হচ্ছে তাদের কথা অস্পষ্ট ভাসাভাসা। এভাবে যখন আপনি আপনার বাবার গ্রামে গিয়ে পৌঁছলেন, দেখলেন সেখানে কোন গ্রাম নেই, আছে কেবল পুরোজমি আর ভগ্নস্তূপ; মানুষ সকলেই মৃত। রাত হলেই সব জেগে ওঠে, বাতাসে ফিসফাস কথা শোনা যায়, খুরে শব্দ তুলে ছুটে যায় ঘোড়া। যে বৃদ্ধার ভাঙাচোরা ঘরে আপনি গিয়ে উঠেছেন, তিনি আপনার আসার কথা আগে থেকেই জানে; তার কাছে জল চাইলে একটি ভাঙা মাটির পাত্র আপনাকে দেয়া হয় যার ভেতর জলের কোন অস্তিত্ব নেই। পরক্ষণেই জানতে পারছেন বৃদ্ধাও মরে ভূত হয়ে গেছে বহু আগেই। পর্যায়ক্রমে জানতে পারছেন আপনার পিতাও তারই অন্য আর এক সন্তানের হাতে খুন হয়েছেন, যখন কিনা তিনি গ্রামের সকলকে না খাইয়ে মারার পরিকল্পনা করছিল। মোটাদাগে আপনি একটি ভূতের গ্রামে এসে আটকে পড়েছেন, যেখান থেকে বেরনোর কোন পথ আপনার জানা নেই, আর অতীতের কোন গলিঘুপচির ভেতর হাতরে ফিরছেন অস্তিত্ব আর আমরা জানতে পারছি আপনিও কবেই মরে ভূত হয়ে গেছেন। হুয়ান রুলফো তাঁর একমাত্র উপন্যাস পেদ্রো পারামোতে এমনই এক গল্প ফেঁদেছিলেন। আসলে তিনি খুলে দেখিয়েছিলেন মেহিকোর অতীত ও বর্তমানের এমন এক জটিল অবস্থা যার ভেতর মানুষ যেন কেউ বেঁচে নেই, দীর্ঘ উপনিবেশ ও স্বৈরাচারী শাসকদের শোষণের কারণে যাদের অস্তিত্ব ঝাপসা ও অস্পষ্ট হয়ে গেছে। গ্রাবিয়েল গার্সিয়া মার্কেস তাঁর নোবেলজয়ী উপন্যাস নিঃসংগতার এক শ’ বছর-এও অতীত-বর্তমান ঘুলিয়ে দিয়েছেন। বাংলাদেশী ঔপন্যাসিক মোজাফ্ফর হোসেনের উপন্যাস তিমিরযাত্রাতেও অতীত অনুসন্ধানের প্রয়াস পেয়েছে। এর পরেও যদি বুঝতে অসুবিধা হয়, তবে মনে করুন আপনিই আপনার অস্তিত্ব অনুসন্ধানে বেড়িয়েছেন; কোথায় যাবেন? অতীতে? সেখানে তো কেউ বেঁচে নেই, মরে ভূত হয়ে গেছে। ভূতে আপনার বিশ্বাস নেই? আমিও বিশ্বাস করি না, এগুলো মানুষের কল্পনাপ্রসূত। যেমন স্বর্গ-নরক ইত্যাদি, কিন্তু আপনার আমার বিশ্বাসকে তো সবাই পরোয়া করে না! বাংলাদেশের নিরানব্বই শতাংশ মানুষ এমন কল্পনার ভেতর জীবনযাপন করে-এটা কি জাদুবাস্তববাদ নয়? নাকি সেই মানুষগুলো বাস্তবের অংশ নয়? মোটাদাগে এই বিশ্বে কল্পনা আর বাস্তব এমনভাবে মিশে আছে যাকে আর আলাদা করা সম্ভব নয়- এবং সেটাই হচ্ছে বাস্তব পক্ষান্তরে জাদুবাস্তব; বাস্তব বলে কিছু নেই কিংবা আছে যার কোনো বাস্তবসম্মত সংজ্ঞা নেই।
×