ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ড. মিহির কুমার রায়

এডিপি বাস্তবায়নের ধীরগতি উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করবে

প্রকাশিত: ০০:৫৯, ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২১

এডিপি বাস্তবায়নের ধীরগতি উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করবে

স্বাধীনতার ৫০ বছর পার করে বাংলাদেশ আগামী ২৬ মার্চ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালন করতে যাচ্ছে ্এমন একটি সময়ে যখন কোভিড-১৯ মহামারীর আক্রমণে বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত প্রায় আট হাজারের মতো মানুষ প্রাণ হারিয়েছে এবং ১ কোটি ৫০ হাজার মানুষ দারিদ্র্যের মধ্যে পড়েছে যাদেরকে পুনর্বাসন করা এখন সময়ের দাবি। সরকার এরই মধ্যে ১ লাখ ২৪ হাজার ৫৩ কোটি টাকা প্রণোদনা হিসাবে বরাদ্দ দিয়েছে যা জিডিপির ৪ দশমিক ৪৪ শতাংশ। সে যাই হোক না কেন বর্তমান (২০২০-২১) বছরে ঘোষিত বাজেটকে বলা হয় করোনা কালের বাজেট যেখানে সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা ও খেলাপী ঋণের সঙ্কট, কোভিড-১৯ মোকাবেলায় জীবন-জীবিকা সুরক্ষা, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, বিনিয়োগকারীর আস্থা এবং বিদেশের বাজারে তেলসহ পণ্যের কেনাবেচা ইত্যাদি অর্থনীতির চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে পারে। এ বিষয়গুলো বিবেচনায় রেখে বর্তমান বছরের পাঁচ মাসে উন্নয়ন খাতের বাজেট ব্যয়ের গতি প্রকৃতির নিরপেক্ষ বিশ্লেষণ করাই এই প্রবন্ধের মূল লক্ষ্য। সরকারের বাজেট কাঠামোতে উন্নয়ন বাজেট তথা বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচী (এডিপি) একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এবং বর্তমান অর্থ বছরের বাস্তবায়িত বাজেটে উন্নয়ন বরাদ্দ ব্যয় ধরা হয়েছে ২ লাখ ৫ হাজার ১৪৫ কোটি টাকা যা জিডিপির প্রায় ৬ শতাংশের কাছাকাছি। ১ হাজার ৫৮৪টি প্রকল্পে এ অর্থ ব্যয় হবে। বরাদ্দকৃত অর্থের মধ্যে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ১ লাখ ৩৪ হাজার ৬৪৩ কোটি ও বৈদেশিক উৎস থেকে ৭০ হাজার ৫০২ কোটি টাকার সংস্থান করা হবে। ২০২০-২১ অর্থবছরে এডিপির আওতায় বিনিয়োগ প্রকল্প ১ হাজার ৪৫৬টি, কারিগরি সহায়তা প্রকল্প ১২৭টি ও জেডিসিএফ অর্থায়িত প্রকল্প একটি। এছাড়া স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা বা কর্পোরেশনের ৮৯টি প্রকল্পে প্রায় ৯ হাজার ৪৬৬ কোটি টাকার এডিপি বরাদ্দ রয়েছে। এ অর্থের মধ্যে অভ্যন্তরীণ উৎস ৫ হাজার ৫৭৮ কোটি ও বৈদেশিক উৎস ৩ হাজার ৮৮৮ কোটি টাকা। ফলে স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা বা কর্পোরেশনের ব্যয় ও প্রকল্প যুক্ত করলেও মোট প্রকল্প দাঁড়াবে ১ হাজার ৬৭৩টি এবং এডিপির আকার দাঁড়ায় ২ লাখ ১৪ হাজার ৬১১ কোটি টাকা। অর্থমন্ত্রী তার বাজেট বক্তৃতায় ৪টি কৌশলের কথা বলেছিলেন যেমন : সকল ব্যয়ে কর্মসৃজনকে অগ্রাধিকার ও বিলাশী খরচ কমানো, ব্যাংকের মাধ্যমে স্বল্প সুদে কতিপয় সুবিধা, সামাজিক সুরক্ষার আওতা বৃদ্ধি ও বাজারে মুদ্রা সরবরাহ বৃদ্ধি। মুজিব বর্ষে সরকারের বিশেষ উপহার পাঁচ বছর পর করমুক্ত আয়সীমা যেমন বাড়িয়েছে তেমনি আয় করের হারও কমিয়েছে। সার্বিক মূল্যায়নে দেখা যায় যে বর্তমান অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচী (এডিপি) বাস্তবায়ন পাঁচ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন যেখানে নবেম্বর পর্যন্ত পাঁচ মাসে এডিপি বাস্তবায়ন হয়েছে ১৭ দশমিক ৯৩ শতাংশ, যা গত অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ১৯ দশমিক ২৪ শতাংশ। টাকার অংকে বাস্তবায়নের পরিমাণও কমেছে প্রায় ২ হাজার ৯১৪ কোটি টাকা (উৎস:। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ)। এই বিভাগের তথ্যে জানা গেছে, চলতি অর্থবছরে মোট ব্যয় হয়েছে ৩৮ হাজার ৪৭৩ কোটি ৭৭ লাখ টাকা, যা গত অর্থবছরে ছিল ৪১ হাজার ৩৮৭ কোটি ৫৫ লাখ টাকা, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ছিল ৩৬ হাজার ৪৩৮ কোটি টাকা, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ছিল ৩২ হাজার ৯৯৭ কোটি ও ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ২৩ হাজার ৫৯৩ কোটি টাকা। স্বাধীনতার এত বছর পরও এ কথা কোনভাবেই বলা যাবে না যে কেবল মাত্র নির্বাচনী বছর ছাড়া এডিপি এর বাস্তবায়ন ৯০ শতাংশের উপরে পৌঁছেছে যার প্রমাণ অর্থমন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রকাশিত বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা (২০২০) অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসের হিসাবে ২০১৯-২০ অর্থবছরে বাস্তবায়নের হার ছিল ১৯ দশমিক ২৪ শতাংশ, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ২০ দশমিক ১৫ শতাংশ, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ২০ দশমিক ১১ ও ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ১৯ দশমিক ১৩ শতাংশ যার ফলে গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ১ দশমিক ৩১ শতাংশ কমেছে। আলোচিত বছরে করোনাকালীন বাজেট বাস্তবায়নের অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে যেমন কেন্দ্রিক রাজস্ব আহরণ, অবকাঠামোগত ঘাটতি, অগ্রধিকারভিত্তিক সরকারী ব্যয় নির্ধারণ, ঘাটতি বাজেটের আর্থিক ব্যবস্থাপনা, বৈদেশিক ঋণ প্রাপ্তির অনিশ্চয়তা, ব্যক্তি ঋণের প্রতিবন্ধকতা, রফতানি আমদানি বাণিজ্যে সমতা আনয়ন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, সঞ্চয় বিনিয়োগের ভারসাম্য রক্ষা ইত্যাদি যা একেবারেই দৃশ্যমান। তাই এডিপি বাস্তবায়নের সক্ষমতা রোড ম্যাপ তৈরি, রাজস্ব আদায়ে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা, প্রকল্পের গুণগত বাস্তবায়ন ইত্যাদি বিষয় বিবেচনা করলে অনেক চ্যালেঞ্জই মোকাবেলা করা সম্ভব হবে। এখন প্রশ্নটি হলো তা কিভাবে সম্ভব। প্রধানমন্ত্রী তাঁর বাজেট সমাপনী বক্তৃতায় মহান জাতীয় সংসদে বলেছেন করোনা মোকাবেলা করে বাজেট বাস্তবায়ন সম্ভব হবে এবং অর্থমন্ত্রী বলেছেন অর্থের কোন রকম অভাব হবে না। এ ব্যাপারে বেশ কিছু বিষয়ে নজর দেয়া প্রয়োজন : প্রথমত : চলতি বছরের এডিপিতে তালিকাভুক্ত সম্ভাব্য কোন প্রকল্প আগামী অর্থ বছরের এডিপির জন্য প্রস্তাব করা যাবে না; দ্বিতীয়ত: ২০১৯-২০ অর্থবছরের জুন মেয়াদে উত্তীর্ণ কোন প্রকল্প মেয়াদ বৃদ্ধি ছাড়া নতুন এডিপিতে যুক্ত করা যাবে না; তৃতীয়ত: সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার ও কাক্সিক্ষত সুফল পেতে নতুন প্রকল্প গ্রহণ নিরুৎসাহিত করা হয়েছে চলমান এডিপিতে এবং প্রকল্প যথাসময়ে সমাপ্ত করতে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে; চতুর্থত: চলতি অর্থবছরের এডিপিতে অন্তর্ভুক্ত বরাদ্দবিহীন অননুমোদিত নতুন প্রকল্প বর্তমান অর্থবছরের এডিপিতে স্বয়ংক্রিয়ভাবে অন্তর্ভুক্ত হবে না; পঞ্চমত: জলবায়ু পরিবর্তন প্রতিরোধ সংক্রান্ত নদী ভাঙ্গন, নদী ড্রেজিং ও তথ্যপ্রযুক্তি খাতের প্রকল্প অর্থ বরাদ্দের ক্ষেত্রে প্রাধান্য পাবে; সর্বশেষ: জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বৈদেশিক সাহায্যপূর্ণ বর্তমান অর্থবছরের সমাপ্তির জন্য নির্ধারিত এবং দ্রুত অগ্রগতি সম্পন্ন প্রকল্পে অর্থ বরাদ্দ নিশ্চিত করতে চলতি প্রকল্পগুলোর সর্বশেষ অনুমোদিত প্রাক্কালিত ব্যয় এবং ক্রমপুজিগত অগ্রগতি ব্যয়ের ভিত্তিতে সম্ভাব্য যৌক্তিক ব্যয় বিবেচনায় আগামী বছরে এডিপিতে বরাদ্দ প্রস্তাব করতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে বলা হয়েছে প্রকল্প ব্যবস্থাপনার দক্ষতা ও তদারকি বাড়ানোর, প্রকল্প গ্রহণে দৈ¦ততা পরিহারসহ আরও কয়েকটি বিষয়ে এ ধরনের তদারকি উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে।
×