ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

ড. আনু মাহ্মুদ

মধ্যভোগীদের দৌরাত্ম্য থামাতে হবে

প্রকাশিত: ০০:৫৮, ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২১

মধ্যভোগীদের দৌরাত্ম্য থামাতে হবে

কৃষক দেশের মানুষের খাদ্য জোগায়। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে তারা ফসল ফলায়। কিন্তু ফসলের ন্যায্যমূল্য পাওয়া তাদের জন্য ক্রমেই কষ্টসাধ্য হয়ে উঠছে। ক্ষুদ্র আয়তনের বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৭ কোটি। গত পাঁচ দশকে জনসংখ্যা বেড়ে ৭ কোটি থেকে ১৭ কোটি হয়েছে। বাড়তি জনসংখ্যার বসবাসের জন্য এবং রাস্তাঘাট, বাজার, শিল্পকারখানা স্থাপনে চাষযোগ্য জমির একটা বড় অংশ নষ্ট হয়েছে। তারপরও দেশের কৃষকের কঠোর পরিশ্রমের কারণে গত পাঁচ দশকে খাদ্য উৎপাদন তিন গুণের বেশি বেড়েছে। স্বাধীনতার আগে যে দেশের সিংহভাগ মানুষ অনাহার অর্ধাহারে কাটাত তারা এখন তিন বেলা পেট ভরে খেতে পারছে। এটি সম্ভব হয়েছে কৃষকের কঠোর পরিশ্রমের কারণে। কিন্তু কৃষক তাদের ফসলের ন্যায্যমূল্য না পাওয়ায় কতদিন দেশের মানুষের জন্য খাদ্য জোগাবে তা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কৃষকের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে সরকার কৃষিপণ্যের মূল্য বেঁধে দেয়ার পরিকল্পনা নিয়েছে। উদ্যোগটি ভাল। তবে এর সুফল যাতে কৃষক পায় তাও নিশ্চিত করতে হবে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, কৃষক কঠোর পরিশ্রম করে উৎপাদন বাড়ালে বাজারদর পড়ে যাওয়ায় অনেক সময় তারা পণ্য উৎপাদনের খরচ ওঠাতেও ব্যর্থ হয়। অথচ কোন বছর জলোচ্ছ্বাসে খাদ্যপণ্যের উৎপাদন হ্রাস পেলে বিদেশ থেকে খাদ্য আমদানি করতে গিয়ে সরকারের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে টান পড়ে। সাধারণ ভোক্তাদের জীবনযাত্রার খরচ বেড়ে যায়। এ সমস্যার সমাধানে শুধু পণ্যের মূল্য বেঁধে দেয়া নয়, কৃষিপণ্য পরিবহন সহজতর করার উদ্যোগ নিতে হবে। পণ্যবাহী ট্রাক যাতে চাঁদাবাজির শিকার না হয় তা নিশ্চিত করা জরুরী। কৃষিপণ্য সংরক্ষণের জন্য পর্যাপ্ত কোল্ড স্টোরেজ নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া দরকার। কৃষিপণ্যে সরকারের ভর্তুকি দেয়ার কথাও ভাবা যেতে পারে। কৃষকের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে কৃষিপণ্য বিপণনে মধ্যভোগীদের দৌরাত্ম্যের অবসান ঘটাতে হবে। ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতকরণ কৃষিতে বাংলাদেশের সাফল্য ঈর্ষণীয়। ধান, গম ও ভুট্টা বিশে^র গড় উৎপাদনকে পেছনে ফেলে ক্রমেই এগিয়ে চলেছে বাংলাদেশ। সবজি উৎপাদনে তৃতীয় আর চাল ও মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশে^ চতুর্থ অবস্থানে। গত এক যুগে দেশে রীতিমতো সবজি বিপ্লব ঘটে গেছে। এখন দেশের প্রায় সব এলাকায় সারা বছরই সবজির চাষ হচ্ছে। দেশের বিভিন্ন এলাকায় মূলা, বেগুন, ফুলকপি, বাঁধাকপি, লাউ, শিম, শসাসহ রকমারি শীতকালীন সবজিতে মাঠ ভরে গেছে। সাধারণত সরবরাহ চাহিদার তুলনায় কম হলে পণ্যমূল্যে তার প্রভাব পড়ে। বাজার ভেদে দাম বেশি হওয়াও অস্বাভাবিক নয়। অথচ খোঁজ নিলে দেখা যাবে, মফস্বলের পাইকারি বাজারে দাম তেমন বাড়েনি। প্রান্তিক পর্যায়ে চাষী এই বাড়তি দাম থেকে লাভবান হচ্ছে না। কিন্তু শহরের বাজারে সবজির দাম কমছে না। কৃষক উৎপাদনে যে খরচ করেন সবজির ভরা মৌসুমে ব্যাপক প্রতিযোগিতায় সে খরচটুকুও অনেক সময় অনেক পণ্যে পান না। এখানে সিন্ডিকেটের আড়ালে একটি সাপ্লাই চেইন থাকে। তারা যে মূল্য নির্ধারণ করবে সে দামেই কৃষককে বিক্রি করতে হয়। আর ব্যাপারী ও আড়তদার মিলে যে দাম ঠিক করবেন, সেই দামেই কিনতে হবে খুচরা বিক্রেতাদের। সাপ্লাই চেইনে আড়তদার ও ব্যাপারীর সিন্ডিকেটের শক্তিটাই সবচেয়ে বেশি। ফলে কৃষক যে দামে সবজি বিক্রি করেন ভোক্তাকে কিনতে হয় তার কয়েকগুণ বেশি দামে। এই নৈরাজ্য ঠেকাতে কৃষিজাত পণ্যের মূল্য বেঁধে দেয়ার পরিকল্পনা করছে সরকার। কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা, বাজার স্থিতিশীল রাখার পাশাপাশি এমন ব্যবস্থা নিতে হবে, যাতে কৃষক ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত না হন। কৃষক যেন লাভবান হয় দেশের বিভিন্ন স্থানে কৃষকরা সরকারের কাছে ধান-চাল বিক্রিতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন। এক প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, ঘুষ বিড়ম্বনা, বাজার মূল্যের চেয়ে সরকারের সংগ্রহ মূল্য কম এবং এ্যাপসের জটিল প্রক্রিয়ার কারণে এ সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। সরকারের কাছে ধান-চাল বিক্রিতে কৃষকদের অনাগ্রহের খবরটি হতাশাজনক। খোলাবাজারে ধানের ভাল দাম পাওয়ায় কৃষকরা সরকারী খাদ্য গুদামে ধান দিচ্ছেন না। অভিযোগ আছে, খাদ্য গুদামে ধান দিতে গেলে বিভিন্নভাবে হয়রানির শিকার হতে হয় প্রান্তিক চাষীদের। ধানের আর্দ্রতা আর গুণাগুণ পরীক্ষা করে নিয়ম অনুযায়ী না মিললে তা ফেরত পাঠানো হয়। অথচ ফড়িয়ার সঙ্গে গোপন আঁতাতে তাদের দেয়া ধানের আর্দ্র্রতা বা গুণাগুণ নির্ণয় করা হয় না। এছাড়া সরকারের কাছে ধান-চাল বিক্রি করত হলে সরকার নির্ধারিত এ্যাপসে আবেদন করতে হয়। এ জটিল প্রক্রিয়া সম্পন্ন করাও অনেক কৃষকের পক্ষে সম্ভব নয়। করোনার দুঃসময়ে অভ্যন্তরীণ উৎপাদন থেকে ধান-চাল সংগ্রহ জোরদার করে সরকারের খাদ্য মজুদ পরিস্থিতি সন্তোষজনক পর্যায়ে নিতে হবে। যেভাবেই হোক, খাদ্য গুদাম কর্মকর্তাদের ঘুষ-দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে। ধান-চাল সংগ্রহের প্রক্রিয়ায় কৃষক হয়রানি বন্ধ করতে হবে। খাদ্য গুদামে যারা অনিয়মের সঙ্গে জড়িত তদন্ত সাপেক্ষে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রতি বছর সরকার কৃষককে সুবিধা দিতেই সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে ধান কিনে। এবার সরকারকে নিজের প্রয়োজনেই কৃষকের দ্বারে দ্বারে গিয়ে ধান কিনতে হবে। ধান-চাল সংগ্রহে সরকারকে যেমন সফল হতে হবে, তেমনি কৃষককেও লাভবান হতে হবে। ধান-চালের সংগ্রহ মূল্য যদি বাড়ানো হয় তবে সেটা যেন মধ্যস্বত্বভোগীদের পকেটে না যায় সেদিকে নজর দিতে হবে। আধুনিক ও সমন্বিত বাজার ব্যবস্থা গড়া বর্তমানে কৃষি বিপণন অধিদফতর অন্তত ৩৬টি পণ্যের পাইকারিসহ খুচরা যৌক্তিক দাম বেঁধে দেবে। তাতে সমস্যার সমাধান হবে কিনা, কৃষক ও ভোক্তা স্বার্থ রক্ষিত হবে কিনা সর্বোপরি মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য কমবে কিনা সময়ই তা বলে দেবে। অনেকে আবার কৃষিপণ্য মূল্য কমিশন গঠনের প্রস্তাব করেছেন। কাজটি কঠিন এবং সময়সাপেক্ষ হলেও এটি যে কৃষক ও ভোক্তাসহ সবার দাবি তাতে সন্দেহ নেই। বিশে^ চাল উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ। সরকারের অন্যতম অগ্রাধিকার হলো সব মানুষের জন্য খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীদেরও উচিত হবে জনসাধারণ ও সরকারকে জিম্মি কিংবা কারসাজি করে নয়, বরং আস্থায় নিয়েই ব্যবসা করা। তদুপরি দেশে ধান-চাল-পাটসহ কৃষিজাত পণ্যের ন্যায্য দাম নিশ্চিত করার জন্য তৃণমূল থেকে রাজধানী পর্যন্ত একটি আধুনিক ও সমন্বিত বাজার ব্যবস্থা গড়ে তোলা জরুরী ও অপরিহার্য। টেকসই কৃষি ও খাদ্য নিরাপত্তা উচ্চফলনশীল জাতের উদ্ভাবন ও সম্প্রসারণ, সেচ ব্যবস্থা উন্নয়ন, সার ও যান্ত্রিকীকরণে ভর্তুকি প্রদান, সহজ শর্তে কৃষিঋণ বিতরণ ইত্যাদির জন্য দেশের শস্য নিবিড়তা অনেক বেড়েছে। বিবিএসের তথ্যমতে, ২০০১-০২ থেকে ২০১৬-১৭ সাল পর্যন্ত দেশের প্রধান খাদ্যশস্যগুলোর উৎপাদন প্রায় ৭৬ শতাংশ বেড়েছে গত ৫০ বছরে দেশে চাল উৎপাদন দ্বিগুণের বেশি হয়েছে। সবজি, ফল প্রভৃতির উৎপাদন বেড়েছে। সাফল্যের পেছনে বিপরীত চিত্রও রয়েছে। স্বল্প জমিতে অধিক উৎপাদন করতে গিয়ে মাটির ওপর ক্রমাগত চাপ বাড়ছে। বিভিন্ন ফসলের উচ্চফলনশীল ও হাইব্রিড জাত আবাদের ফলে সারের চাহিদা ব্যাপক হারে বেড়েছে। ফসলের অধিক ফলনের আশায় কৃষক ও প্রতিনিয়ত অনিয়ন্ত্রিতভাবে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক প্রয়োগ করছেন। ফলে জমি হারাচ্ছে তার উর্বরা শক্তি। মাটির উর্বরা শক্তি ও জৈব পদার্থের উপস্থিতি নিয়ে মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট (এসআরডআই) পরিচালিত ‘লান্ড ডিগ্রেডেশন ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক এ সমীক্ষায় বলা হয়েছে, মাটিতে জৈব পদার্থের পরিমাণ ৫ শতাংশ হলে সে মাটিকে সবচেয়ে ভাল বলা হয়। ন্যূনতম ২ শতাংশ থাকলে সেটিকে ধরা হয় মোটামুটি মানের। কিন্তু দেশের মাটিতে জৈব পদার্থের পরিমাণ এখন গড়ে ২ শতাংশেরও নিচে নেমে এসেছে। এছাড়া দেশের মোট জমির প্রায় ৭৯ শতাংশ জৈব পদার্থের ঘাটতি রয়েছে। চাল প্রধান খাদ্য হওয়ায় বাংলাদেশের ৮০ শতাংশ জমিতেই ধান আবাদ হচ্ছে। একই জমিতে দীর্ঘ সময় ধরে শুধু ধানই আবাদ হচ্ছে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এটা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু এর ফলে জমির উর্বরা শক্তি বিনষ্ট হওয়ার বিষয়টি উদ্বেগজনক। মাটির উর্বরা শক্তি হ্রাসের জন্য অতিরিক্ত কীটনাশক-রাসায়নিক সারের ব্যবহার এবং একই ফসল টানা উৎপাদনকে দায়ী করা হচ্ছে। বড় কৃষকরা আর্থিক সচ্ছলতাকে কাজে লাগিয়ে অধিক সার প্রয়োগ করছেন, আবার ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকরা অনেক ক্ষেত্রে পরিমাণ মতো সব সুপারিশকৃত সার প্রয়োগ করতে পারছেন না। সুতরাং সঠিক মাত্রায় সার প্রয়োগ বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে একটি বড় চ্যালেঞ্জ, যেটি মাটির উর্বরা শক্তি হ্রাস করছে। মাটির উর্বরা শক্তি ধরে রাখার জন্য নির্দিষ্ট সময় অন্তর ফসলের ধরন পরিবর্তন করা প্রয়োজন। জমিতে নির্দিষ্ট সময় অন্তর ফসলের ধরন পরিবর্তনের নানামুখী উপকারিতা রয়েছে। এটি জমির আগাছা দমনে সহায়ক, পোকামাকড়ের আক্রমণ কমায়, ফসলের রোগবালাই কম হয়, সর্বোপরি ফসলের ফলন বৃদ্ধি পায়। একইভাবে লিগিউম ফসল আবাদ করলে এটি বায়ুমণ্ডলের নাইট্রোজেন মাটিতে আবদ্ধ করে, মাটির জৈব উপাদানের পরিমাণ ও পানি ধারণক্ষমতা বাড়ায় এবং মাটির অভ্যন্তরীণ পুষ্টিপ্রবাহ বৃদ্ধি করে। ফলে মাটির উর্বরা শক্তি বৃদ্ধি পায়। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রতিক্রিয়া এবং সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার ঘাটতির জন্য শস্যবৈচিত্র্য সব জায়গায় এখনো সমানভাবে হয়নি। কৃষিজমি ব্যবহার ও মৃত্তিকা ব্যবস্থাপনায় দক্ষ ও কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ এবং বাস্তবায়ন না করলে চরম সঙ্কটে পড়তে পারে আমাদের খাদ্যনিরাপত্তা, অর্থনীতি ও পরিবেশ। এসডিজির ১, ২, ৩, ৬, ১২, ১৪ ও ১৫ নং লক্ষ্য অর্জন লাগসই মৃত্তিকা ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত।
×