ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সড়ক দুর্ঘটনায় বছরে আর্থিক ক্ষতি দেড় হাজার কোটি টাকা

প্রকাশিত: ২৩:০৫, ২৮ জানুয়ারি ২০২১

সড়ক দুর্ঘটনায় বছরে আর্থিক ক্ষতি দেড় হাজার কোটি টাকা

রাজন ভট্টাচার্য ॥ দেশে সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম কারণের একটি সড়ক-মহাসড়কে অপরিকল্পিত স্পিড ব্রেকার। সড়ক নিরাপত্তার স্বার্থে এসব স্পিড ব্রেকার তুলে নেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছিল কয়েক বছর আগে। কিন্তু তা বাস্তবায়ন করতে পারেনি সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ের সড়ক-মহাসড়ক বিভাগ। মন্ত্রণালয় বলছে, সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয় দেশের মহাসড়কগুলো থেকে ‘অপ্রয়োজনীয়’ গতিরোধক অপসারণ করা শুরু করলেও এখনও প্রায় ১২শ’ ‘স্পিড ব্রেকার’ রয়েছে বিভিন্ন স্থানে। সম্প্রতি সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির বৈঠকে এ বিষয়ে একটি প্রতিবেদেন দিয়েছে মন্ত্রণালয়। এই প্রেক্ষাপটে বাদবাকি গতিরোধক অপসারণের চিন্তা করছে মন্ত্রণালয়। অন্যদিকে দূরপাল্লার বাস ও ট্রাকের নির্ধারিত গতিবেগ সর্বোচ্চ ৮০ কিলোমিটার ও ৬০ কিলোমিটার নির্ধারণ করা হলেও তা মানছেন না চালকরা। এতেও বাড়ছে সড়ক দুর্ঘটনা। বুয়েটের এক্সিডেন্ট রিচার্স ইনস্টিটিউটের গবেষণায় বলা হয়েছে, সড়ক দুর্ঘটনার ৯০ ভাগই হয়ে থাকে যানবাহনের অতিরিক্ত গতি ও চালকদের বেপরোয়া মনোভাবের কারণে। সড়ক দুর্ঘটনায় বছরে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ দেড় হাজার কোটি টাকার বেশি। সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, সড়ক বিভাগের ১০টি জোন থেকে ৭৫৫টি গতিরোধক ইতোমধ্যে অপসারণ করা হয়েছে। বিভিন্ন স্থানে এখন এক হাজার ১৮৮টি স্পিড ব্রেকার রয়েছে। এর আগে অক্টোবর মাসে সংসদীয় কমিটির বৈঠকে মহাসড়ক থেকে অপ্রয়োজনীয় গতিরোধক তুলে দেয়ার সুপারিশ করা হয়েছিল। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সড়ক মহাসড়ক থেকে নির্মাণ করা গতিরোধকের উভর পাশে রং দিয়ে মার্কিং করা হয়ে থাকে। ফলে চালকরা রাতের আলোতে দূর থেকে তা দেখতে পেরে যানবাহনের গতি কমাতে পারেন। কিন্তু ব্যক্তিগত পর্যায়ে নির্মাণ করা গতিরোধকগুলোতের উভয়পাশে কোন সতর্ক সংকেত বা চিহ্ন থাকে না। এতেই বাধে বিপত্তি। তাছাড়া সড়ক বিভাগের অনেক গতি রোধকের মার্কিং সাইন উঠে গেছে। সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ের উপসচিব ও সংসদীয় কমিটির কাউন্সিল অফিসার আব্দুল মোক্তাদের বলেন, নিয়ম অনুযায়ী মহাসড়কে কোন স্পিড ব্রেকার থাকার কথা না। কিন্তু বাস্তবতার প্রয়োজনে অনেক স্থানে স্পিড ব্রেকার দেয়া হয়েছে। নৌ সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক আশীষ কুমার দে বলেন, মহাসড়কগুলোতে তদারকির অভাবে স্থানীয় লোকজন ইচ্ছামতো গতিরোধক নির্মাণ করছেন। এর কারণে হিসেবে তিনি বলেন, বিশেষ করে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, বাজার ও স্কুলকে কেন্দ্র করেই এসব গতিরোধক নির্মাণ করা হচ্ছে। অপরিকল্পিত এই নির্মাণের কারণে সড়কে প্রাণ ঝরে যাওয়ার ঘটনা বাড়ছে। উন্নত বিশে^র দেশগুলোর মহাসড়কে কিন্তু এ ধরনের গতিরোধক নেই। বুয়েটের এআরআই দুর্ঘটনার কারণ সংক্রান্ত পুলিশের দেয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে থাকে। ১৯৯৮ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ঘটে যাওয়া সড়ক দুর্ঘটনা বিশ্লেষণ করে এআরআই বলছে, দেশে ৫৩ শতাংশ সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে অতিরিক্ত গতিতে গাড়ি চালানোর কারণে। আর চালকদের বেপরোয়া মনোভাবের কারণে দুর্ঘটনা ঘটে ৩৭ শতাংশ। অর্থাৎ চালকের বেপরোয়া মনোভাব ও গতির কারণে ৯০ শতাংশ দুর্ঘটনা ঘটছে। আর পরিবেশ-পরিস্থিতিসহ অন্যান্য কারণে দুর্ঘটনা ১০ শতাংশ। এআরআইয়ের গবেষক ও বুয়েটের সহকারী অধ্যাপক কাজী সাইফুন নেওয়াজ বলেন, প্রকৌশলগত ত্রুটি ও সচেতনতার অভাবে পথচারীরা মারা যাচ্ছেন। সব স্থানে জেব্রা ক্রসিং না থাকা, ফুটপাথ না থাকা কিংবা অবৈধ দখলে চলে যাওয়া, স্বয়ংক্রিয় সংকেতব্যবস্থার অনুপস্থিতি, পথচারী পারাপারে অব্যবস্থাপনা অন্যতম প্রকৌশলগত ত্রুটি। তিনি বলেন, যেখানে যেখানে গতিরোধক করা মানেই যান চলাচলে বাধা সৃষ্টি হয়। এতে দুর্ঘটনা ঘটে থাকে। গবেষণা বলছে, সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহত ব্যক্তিদের বেশির ভাগই তরুণ ও কর্মক্ষম ব্যক্তি। এআরআইয়ের গবেষণা অনুসারে, দেশের সড়ক-মহাসড়কে দুর্ঘটনায় মারা যাওয়া লোকজনের ৫৪ শতাংশের বয়স ১৬ থেকে ৪০ বছরের মধ্যে। আর দুর্ঘটনায় নিহত লোকদের সাড়ে ১৮ শতাংশ শিশু, এদের বয়স ১৫ বছরের নিচে। এআরআইয়ের সাম্প্রতিক এক গবেষণায় বলা হয়, দেশে সড়ক দুর্ঘটনা এবং এর প্রভাবে সৃষ্ট ক্ষয়ক্ষতির আর্থিক পরিমাণ বছরে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা। এসব দুর্ঘটনার কারণে বছরে মোট জাতীয় উৎপাদনের (জিডিপি) ২ থেকে ৩ শতাংশ হারাচ্ছে বাংলাদেশ। দুর্ঘটনায় জানমালের ক্ষতি ও দুর্ঘটনা থেকে সৃষ্ট যানজট অর্থনীতিকে বাধাগ্রস্ত করছে। এদিকে অন্য সংস্থাগুলোর হিসাব অনুযায়ী সারা বছরের সড়ক দুর্ঘটনায় শিকার মানুষের বা তাদের পরিবারে বার্ষিক ক্ষতির পরিমাণ দেড় হাজার কোটি টাকার বেশি। বিশ্বের নামকরা চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকেরা সড়ক দুর্ঘটনায় আর্থিক ক্ষতির এই হিসাব দিয়েছেন। ১৬৬টি দেশের দুর্ঘটনাজনিত ব্যয়ের বিশ্লেষণের ভিত্তিতে তারা এই হিসাব বের করা হয়েছে। ২০১০ সালকে ভিত্তি ধরে তারা হিসাবটি কষেছেন। তাঁরা ২০১৫ থেকে ২০৩০ সালের প্রাক্কলন দিয়ে বলেছেন, এই সময়ে সড়ক দুর্ঘটনাজনিত কারণে বাংলাদেশে ২২ হাজার কোটি টাকা খরচ হবে। প্রতিষ্ঠান চারটি হচ্ছে জার্মানির হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের হাইডেলবার্গ ইনস্টিটিউট অব পাবলিক হেলথ, মোহেনহেইম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব ইকোনমিকস, অস্ট্রিয়ার ভিয়েন ইনস্টিটিউট অব ডেমোগ্রাফি এবং যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড টি এইচ চ্যান স্কুল অব পাবলিক হেলথের গ্লোবাল হেলথ এ্যান্ড পপুলেশন বিভাগ। গবেষকেরা বলছেন, প্রতিবছর সারা বিশ্বে সড়ক দুর্ঘটনাজনিত ক্ষতি বৈশ্বিক জিডিপির দশমিক ১২ শতাংশ। নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশগুলোয় স্বাস্থ্য খাতের সবচেয়ে বড় বোঝা সড়ক দুর্ঘটনা। গবেষণা ফলাফল সম্প্রতি জনস্বাস্থ্য সাময়িকী ল্যানসেট-এ ছাপা হয়েছে। সড়ক ও জনপথ অধিদফতরের আওতায় তিন হাজার ৯৪৩ দশমিক ৬৯ কিলোমিটার জাতীয় মহাসড়ক, চার হাজার ৮৮২ দশমিক ৯৪ কিলোমিটার আঞ্চলিক মহাসড়ক এবং ১৩ হাজার ৫৫৬ দশমিক ২০ কিমি জেলা মহাসড়ক রয়েছে। সব মিলিয়ে ২১ হাজার কিলোমিটারের বেশি সড়ক মহাসড়কের সবখানেই কমবেশি রয়েছে গতিরোধক।
×