ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

দুর্নীতি দমনকে আন্দোলন হিসেবে গড়ে তোলার অঙ্গীকার করতে হবে

প্রকাশিত: ২৩:০৪, ২৮ জানুয়ারি ২০২১

দুর্নীতি দমনকে আন্দোলন হিসেবে গড়ে তোলার অঙ্গীকার করতে হবে

সংসদ রিপোর্টার ॥ প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা শেখ হাসিনা সকল স্তরে দুর্নীতি প্রতিরোধ ও দমনে সরকারের ‘জিরো টলারেন্স’ নীতিতে অটল থাকার কথা উল্লেখ করে বলেছেন, দুর্নীতির বিষবৃক্ষ সম্পূর্ণ উপড়ে ফেলে দেশের প্রকৃত আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্য একটি স্থায়ী সুশাসনভিত্তিক প্রশাসনিক কাঠামো তৈরি করতে সরকার নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। তবে দুর্নীতি প্রতিরোধে ব্যক্তি-পর্যায়ে কর্তব্যনিষ্ঠা ও সততা, তথা চরিত্রনিষ্ঠা খুব দরকার। এজন্য বিদ্যমান আইনকানুন, নিয়মনীতির সঙ্গে দুর্নীতি দমনকে একটি আন্দোলন হিসেবে গড়ে তোলার অঙ্গীকার করতে হবে। স্পীকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে বুধবার জাতীয় সংসদ অধিবেশনে টেবিলে উত্থাপিত প্রশ্নোত্তর পর্বে সংসদ সদস্য পনির উদ্দিন আহমেদের প্রশ্নের লিখিত প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, সকল স্তরে দুর্নীতি প্রতিরোধ ও দমনে সরকার জিরো টলারেন্স নীতিতে অটল ও বহুমাত্রিক কাজ করছে। ফলে এক দশক আগের তুলনায় দুর্নীতি অনেকাংশে কমে এসেছে। প্রধানমন্ত্রী এ সময় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর একটি বক্তব্য’র উদ্বৃতি দিয়ে বলেন, বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘নেশন মাস্ট বি ইউনাইটেড এ্যাগেইনস্ট করাপশন। পাবলিক ওপিনিয়ন মবিলাইজ না করলে শুধু আইন দিয়ে করাপশন বন্ধ কর যাবে না।’ বর্তমান সরকার এ লক্ষ্যে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। তবে কেবল আইন প্রয়োগ ও শাস্তি প্রদানের মাধ্যমে দুর্নীতি নির্মূল করা সম্ভব নয়, তার জন্য প্রয়োজন রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক ক্ষেত্রে একটি আন্দোলন গড়ে তোলা, যতে নাগরিকগণ চরিত্রনিষ্ঠ হয়, রাষ্ট্রীয় ও ব্যক্তিমালিকানাধীন ও সুশীল সমাজের প্রতিষ্ঠাসমূহে শুদ্ধাচার প্রতিষ্ঠা পায়। দুর্নীতি প্রতিরোধে মানুষকে নৈতিক জীবন-যাপনে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। এ প্রসঙ্গে সংসদ নেতা আরও বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দীর্ঘ সংগ্রামের চালিকাশক্তি ছিল একটি সুখী, সমৃদ্ধ ও শান্তিপূর্ণ সমাজের স্বপ্ন। কিন্তু রাষ্ট্রের ৫০ বছরের ইতিহাসে সেই স্বপ্ন বারবার বাধাগ্রস্ত হয়েছে, পথভ্রষ্ট হয়েছে এবং মুখ থুবড়ে পড়েছে। তিনি বলেন, জাতির পিতার নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে নেমে আসে অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি এবং শুদ্ধাচারের অভাব। তিনি বলেন, ২০০৯ সালে দায়িত্ব গ্রহণের পর আওয়ামী লীগ সরকার এই অব্যবস্থা ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিল। এই যুদ্ধকে আমি চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করেছিলাম। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও তার শাসনামলে একই ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছিলেন। ১৯৭৪ সালের ২৫ ডিসেম্বর জাতির উদ্দেশে প্রদত্ত ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন- ’... সুখী ও সমৃদ্ধশালী দেশ গড়তে হলে দেশবাসীকে কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে উৎপাদন বাড়াতে হবে। কিন্তু একটি কথা ভুলে গেলে চলবে না- চরিত্রের পরিবর্তন না হলে এই অভাগা দেশের ভাগ্য ফেরানো যাবে কিনা সন্দেহ। স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতি ও আত্মপ্রবঞ্চার উর্ধে থেকে আমাদের সকলকে আত্মসমালোচনা, আত্মসংযম ও আত্মশুদ্ধি করতে হবে।’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, বর্তমান সরকারও রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় সকল কাজে আত্মশুদ্ধি ও চরিত্রনিষ্ঠার ওপর সবিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছে। বর্তমান সরকার ২০০৯ সালে দায়িত্ব গ্রহণের পর হতে এ পর্যন্ত দেশ থেকে দুর্নীতিমুক্ত করার লক্ষ্যে এবং সকল স্তরে দুর্নীতি রোধকল্পে বেশকিছু আইন প্রণয়ন করেছে। দুর্নীতি ও অনিয়মের উৎসমুখগুলোর বন্ধ করার লক্ষ্যে অনলাইনে টেন্ডারসহ বিভিন্ন সেবা খাতে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। তিনি বলেন, দুর্নীতি হ্রাসে সরকার সচেষ্ট থাকার কারণে বর্তমান সরকারের আমলে অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তি ও গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন প্রভাবমুক্ত হয়ে সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে অনুসন্ধান ও তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনা করছে। সরকারের দুর্নীতিবিরোধী কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণের ফলে বিগত ১০ বছরে দুর্নীতি দমন কমিশন কর্তৃক ১৩ হাজার ২টি অভিযোগের অনুসন্ধান, ৩ হাজার ৫০৯টি মামলা রুজু এবং ৪ হাজার ৪০৭টি চার্জশীট দাখিল করা হয়েছে। তিন কোটির বেশি ভ্যাকসিন ক্রয়ের ব্যবস্থা সম্পন্ন ॥ সরকার দলীয় সংসদ সদস্য আহসানুল ইসলাম টিটুর প্রশ্নের লিখিত জবাবে প্রধানমন্ত্রী জানান, যথাসময়ে করোনাভাইরাসের টিকা প্রাপ্তির বিষয়ে সরকার শুরু থেকেই উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। সরকার ইতোমধ্যে ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট ও বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যাল লিমিটেডের মধ্যে একটি ত্রিপক্ষীয় চুক্তির মাধ্যমে অক্সফোর্ড/এ্যাস্ট্রেজেনকা উদ্ভাবিত কোভিড-১৯ ভ্যাকসিনের ৩ কোটি বা তার অধিক ডোজ ভ্যাকসিন ক্রয় করার ব্যবস্থা সম্পন্ন করেছে। এই ভ্যাকসিন চলতি জানুয়ারি মাসের শেষ সপ্তাহেই বাংলাদেশে আসবে বলে আশা করা যায়। তিনি জানান, বাংলাদেশ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডঐঙ), কোভ্যাক্স ফ্যাসিলিটি হতে বিশ্বের ৯২টি দেশের মতো দেশের মোট জনসংখ্যার শতকরা ২০ ভাগ জনগোষ্ঠী তথা ৩ কোটি ৪০ লাখ মানুষের জন্য ৬ কোটি ৮০ লাখ ডোজ ভ্যাকসিন পাবে। ভ্যাকসিন বিভাগের ১ম পর্যায়ে দেশের জনসংখ্যার মোট দেড় কোটি (৮ দশমিক ৬৮ ভাগ) লোককে দুই সপ্তাহের ব্যবধানে মোট ২ ডোজ করে ভ্যাকসিন দেয়া হবে। দেশের ৬৪ জেলা ইপিআই স্টোর এবং ৪৮৩টি উপজেলা ইপিআই স্টোরে এই ভ্যাকসিন সংরক্ষণ করা হবে। সংসদ নেতা জানান, ইতোমধ্যে ভারতের উপহার হিসেবে ২০ লাখ টিকা পেয়েছে বাংলাদেশ। ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে ক্রয়কৃত ৫০ লাখ করোনার টিকা ঢাকা পৌঁছেছে। এই ৭০ লাখ টিকা সংরক্ষণ ও বিতরণের প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। সেরামের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী আগামী ৬ মাসে সকল টিকার সরবরাহ পাওয়া যাবে। এর বাইরে প্রয়োজন মোতাবেক আরও টিকা ক্রয়ের পরিকল্পনা সরকারের রয়েছে। কারা টিকা পাবেন অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ॥ প্রশ্নের লিখিত জবাবে প্রধানমন্ত্রীর উপস্থাপিত তথ্য অনুযায়ী যারা করোনা টিকা পাবেন তারা হচ্ছেন- কোভিড-১৯ স্বাস্থ্য সেবায় নিয়োজিত চার লাখ ৫২ হাজার ২৭ জন স্বাস্থ্যকর্মী, অনুমোদিত ছয় লাখ বেসরকারী ও প্রাইভেট স্বাস্থ্যকর্মী, দুই লাখ ১০ হাজার মুক্তিযোদ্ধা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাঁচ লাখ ৪৬ হাজার ৬২০ জন সদস্য, সামরিক ও বেসামরিক প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদস্য তিন লাখ ৬০ হাজার ৯১৩ জন, রাষ্ট্র পরিচালনায় অপরিহার্য ৫০ হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী, ৫০ হাজার গণমাধ্যম কর্মী, এক লাখ ৭৮ হাজার ২৯৮ জন জনপ্রতিনিধি, সিটি কর্পোরেশন ও পৌরসভার দেড় লাখ কর্মচারী, পাঁচ লাখ ৪১ হাজার ধর্মীয় প্রতিনিধি, মৃতদেহ সৎকারে নিয়োজিত ৭৫ হাজার ব্যক্তি, জরুরী সেবার (পানি, গ্যাস, পয়ঃনিষ্কাশন, বিদ্যুত, ফায়ার সার্ভিস, পরিবহন কর্মী) চার লাখ কর্মী, স্থল, নৌ ও বিমান বন্দরের দেড় লাখ কর্মী, এক লাখ ২০ হাজার প্রবাসী অদক্ষ শ্রমিক, জেলা-উপজেলায় কর্মরত চার লাখ জরুরী সেবায় নিয়োজিত সরকারী কর্মচারী, এক লাখ ৯৭ হাজার ৬২১ জন ব্যাংক কর্মকর্তা-কর্মচারী, স্বল্প রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার (যক্ষ্মা, এইডস, ক্যান্সার) ছয় লাখ ২৫ হাজার জনগোষ্ঠী, ৬৪ থেকে ৭৯ বছর বয়সী এক কোটি তিন লাখ ২৬ হাজার ৬৫৮ জন্য ব্যক্তি, ৮০ বছর ও তদুর্ধ ১৩ লাখ ১২ হাজার ৯৭৩ জন জনগোষ্ঠী, জাতীয় দলের খেলোয়াড় ২১ হাজার এবং বাফার,ইমারজেন্সি, আউটব্রেক এক লাখ ৭ হাজার জন। বঙ্গবন্ধু-বাপু ডিজিটাল প্রদর্শনী ॥ সরকারী দলের সংসদ সদস্য এ কে এম রহমতুল্লাহ’র প্রশ্নের লিখিত জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, গতবছরের ১৭ ডিসেম্বর বাংলাদেশ-ভারত প্রধানমন্ত্রী পর্যায়ে ভার্চুয়াল বৈঠকে ভারত সরকারের উদ্যোগে দুই প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু-বাপু ডিজিটাল প্রদর্শনীর উদ্বোধন করা হয়। এই প্রদর্শনী মূলত একটি বছরব্যাপী আয়োজন। বাংলাদেশ ও ভারতের বিভিন্ন স্থানে ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরে এ প্রদর্শনী আয়োজনের পরিকল্পনা গৃহীত হয়েছে। তিনি জানান, বাংলাদেশের ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, সিলেট ও ভারতের কলকাতায় এই ডিজিটাল প্রদর্শনী প্রদর্শিত হবে। দিল্লীতে ইতোমধ্যেই গত ১৭ ডিসেম্বর উদ্বোধনী প্রচারণা অনুষ্ঠিত হয়েছে। মূলত বাংলাদেশ-ভারত যৌথভাবে মুজিববর্ষ উদ্যাপনের অংশ হিসেবে ভারত পক্ষ এ প্রদর্শনীর আয়োজন করে। বিশ্ব থেকে অর্থনৈতিক সহযেগিতা প্রাপ্তি ॥ বিরোধী দলের চীফ হুইপ মশিউর রহমান রাঙার প্রশ্নের লিখিত জবাবে প্রধানমন্ত্রী জানান, সরকারের সময়োপযোগী উদ্যোগ গ্রহণের ফলে কোভিড-১৯-এর কারণে সৃষ্ট বর্তমান সঙ্কট মোকাবেলায় অর্থনৈতিক সহযোগিতা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে বিভিন্ন দেশ, বহুপাক্ষিক উন্নয়ন ব্যাংক (এমডিবি), জাতিসংঘের বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থা হতে যথেষ্ট সাড়া পাওয়া গেছে। তিনি জানান, অদ্যাবধি অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের মাধ্যমে বিভিন্ন দেশ, এমডিবি ও জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা হতে কোভিড-১৯ মোকাবেলায় মোট এক হাজার ৮১৭ দশমিক ৩৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে, যার মধ্যে ঋণ সহায়তার পরিমাণ এক হাজার ৬৪০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ও অনুদান সহায়তার পরিমাণ ১৭৭ দশমিক ৩৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য ফখরুল ইমামের প্রশ্নের লিখিত জবাবে প্রধানমন্ত্রী জানান, করোনাভাইরাসের বিস্তার পর্যবেক্ষণ করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার বিষয়টি সরকারের বিবেচনায় রয়েছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার পর কীভাবে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে শিক্ষার্থীরা স্বাস্থ্যবিধি মেনে শ্রেণী কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করবে তার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে।
×