ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

সম্মুখসারির করোনা যোদ্ধাদের কথা

প্রকাশিত: ২২:৫৬, ২৮ জানুয়ারি ২০২১

সম্মুখসারির করোনা যোদ্ধাদের কথা

ওয়াজেদ হীরা ॥ ছয় বছরের মালিহার শরীরটা বেশ দুর্বল কিছুই খেতে চায় না। বাবা-মা উদাস মনে ডাক্তারের কাছে নিয়ে আসে সমাধানের জন্য। পরীক্ষার পর জানতে পারেন করোনা পজিটিভ। মা সুফিয়া আক্তার আরও বেশি দুশ্চিন্তায় ডুবে যান তবে সাবধানতা অবলম্বন আর যত্নের ফলে এখন তাদের সন্তান সুস্থ। আগের মতোই বাসায় ছোটাছুটি করে আনন্দে মেতে উঠে। অনেক শিশু করোনায় আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি। আর অনেক শিশু করোনা হলেও বুঝা যাচ্ছে না। ডাক্তারদের মতে, শিশুদের ক্ষেত্রে করোনার লক্ষণগুলো মৃদু আকারে প্রকাশ পায়। তবে শিশুদের সবসময়ই যত্নে রাখতে হয় আর এক্ষেত্রেও অধিক নজর দেয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন শিশু ডাক্তাররা। এদিকে শিশুদের চিকিৎসা দিতে গিয়ে নানা অভিজ্ঞতা হচ্ছে ডাক্তারদেরও। মৃত্যুকে ভয় না পেয়ে করোনার চিকিৎসা দিচ্ছেন শিশু ডাক্তাররাও। সম্মুখসারির যোদ্ধা হিসেবে হয়ে আদরের সন্তাদের সুস্থ করে তোলায় ভূমিকা রাখার জন্য অনেক বাবা-মায়ের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছেন শিশু ডাক্তার। আক্রান্ত শিশুদের পরম যত্নে হাসিমুখে সেবা দিচ্ছেন। এরাই সত্যিকারের ‘জাতীয় বীর’ হিসেবে পরিচিতি পাচ্ছেন। করোনার শুরু থেকে বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে জনকণ্ঠের সঙ্ঘে আলাপচারিতায় শিশুদের নানা বিষয় তুলে ধরেন করোনাযোদ্ধা শিশু ডাক্তার ঢাকা মেডিক্যালের অধ্যাপক ডাঃ সাকিল আহমদ। শতাধিক করোনা আক্রান্ত শিশুর চিকিৎসা করতে গিয়ে নিজেও আক্রান্ত হয়েছেন করোনায়। শিশুদের করোনায় আক্রান্ত হওয়া এবং রোগীর ওপর পরবর্তী প্রভাব নিয়ে গবেষণা চালাচ্ছেন তিনি। ডাঃ সাকিল আহমদ বলেন, শুরু থেকেই শিশুদের করোনা হচ্ছে। শিশুদের ক্ষেত্রেও এটির আলাদা কোন চিকিৎসা নয়। যদি অক্সিজেন কমে যায় অক্সিজেন দিতে হবে। খেতে না পরলে স্যালাইন দিতে হবে। জ্বর হলে ওষুধ দিতে হবে। কখনও কখনও এন্টিবায়োটিক দিতে হয়। এছাড়াও ‘মাল্টি সিস্টেম ইনফ্লামেটরি ডিসঅডার’ হয়। এর কারণে হার্টে সমস্যা হতে পারে, স্কিনে সমস্যা হতে পারে, লিভারে হতে পারে। মাল্টি সিস্টেম মানেই অনেকগুলো সিস্টেম বা অনেক ধরনের সমস্যাই দেখা যেতে পারে। করোনা শিশু রোগী দেখার অভিজ্ঞতায় বলেন, আমি সদ্য ভূমিষ্ঠ শিশু পাইনি তবে এক-দুই বছর বয়সী শিশু করোনা রোগী দেখেছি। চিকিৎসা দিতে গিয়ে আমি আক্রান্ত হয়েছি আমারও স্ত্রী ডাক্তার সেও আক্রান্ত হয়েছিল। বাচ্চাদের লক্ষণ শিশু বিশেষজ্ঞ এই ডাক্তার বলেন, বাচ্চাদের লক্ষণগুলো খুবই মৃদু হয়। বাচ্চাদের করোনা হলে বাড়ির বয়স্কদের যত্নটা নিতে হবে। যাতে বাচ্চাদের থেকে বয়স্কদের রোগটা না ছড়ায়। এটাই হচ্ছে মূল বিষয়। কোন বাসায় শিশু করোনায় আক্রান্ত হয় জোর দিয়ে বলব যারা বয়স্ক মানুষ আছেন বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত আছেন তাদের শিশুদের কাছ থেকে আলাদা রাখা। কেননা বাচ্চাদেও তো মাস্ক পরিয়ে রাখা যাবে না। বাচ্চারা হাত মুখে দিবে, চোখ কান চুলকাবেই, আটকানো যাবে না। বাচ্চারা কারো কোলে এসে বসবে আপনি ফেরাতে পারবেন না এক্ষেত্রে রোগ যাবে। আর বয়স্কদের ক্ষেত্রে রোগ হলে রোগটা মারাত্মক আকার ধারণ করে। বাচ্চাদের রোগটা মৃদু আকারের হয়ে থাকে সাধারণ একদিন জ্বর, পরের দিন কাশি থেকে ভাল হয়ে যায়। তবে বাচ্চাদের থেকে অন্যদের যাওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়। আমি হাসপাতালে ভর্তি রোগীর চিকিৎসাই করছি এক্ষেত্রে দেখেছি মৃত্যুর হার খুবই কম। করোনা আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা হচ্ছে আরেকটি করোনা রোগীর সংস্পর্শে আসা। রোগ হওয়ার ক্ষেত্রে আর দশটা বড় রোগীদের ক্ষেত্রে যা প্রযোজ্য শিশুদের ক্ষেত্রে তাই প্রযোজ্য। হাত ধোয়ার ক্ষেত্রে বাবা-মার অবশ্যই বারবার জোর দিতে হবে। পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। আবহাওয়া পরিবর্তনের ক্ষেত্রে অনেকেই জ্বর ঠাণ্ডা কাশিতে ভুগে থাকেন। শিশুরাও তাই তবে। লক্ষণ বুঝে চিকিৎসা দেয়া হবে। করোনায় জ্বর হলে জ্বরের ওষুধ, একটু বেশি করে পানি খেতে দিব। শ্বাসকষ্ট হচ্ছে কিনা খেয়াল রাখতে হবে হলে হাসপাতালে ডাক্তারদের পরামর্শ নিতে হবে। বেশি ছোট বাচ্চার পালস অক্সিমিটার যে আঙ্গুলে ধরা সেটি আসলে বড়দের সেটি আঙ্গুলের মাপের মধ্যে নিয়ে যথাযথ কার্যক্রম করা। তিন চার বছরের শিশুদের পালস অক্সিমিটার আলাদা। করোনা তো অবশ্যই যেকোন ক্ষেত্রেই বাচ্চাদের অধিক যত্ন নিতে হবে। লালমাটিয়ার আফজাল হোসেন তার ৮ বছরের ছেলের করোনার লক্ষণ দেখে পরীক্ষার পর করোনা পজিটিভ পান। ছেলে সুস্থ হলেও তার বাসায় আরও দুইজন ইতোমধ্যেই অসুস্থ হয়েছেন। আফজাল হোসেন বলেন, একদিন জ্বর ছিল পরের দিন ভাল হলেও পরীক্ষা করিয়েছি এবং ততদিনেই বাসায় এটি ছড়িয়ে যায়। মগবাজারের রায়হান (৬) ইতোমধ্যেই করোন আক্রান্ত। বাবা-মা নিয়মিত যত্ন করছেন। বেসরকারী হাসপাতালে ডাক্তারদের নিয়মিত পরামর্শ নিচ্ছেন। রায়হানের বাবা একজন বেসরকারী চাকরিজীবী। তিনি বলেন, প্রথমে ভেবেছিলাম হয়তো আবহাওয়াগত পরিবর্তন এখন দেখি করোনা হয়েছে। উদ্বিগ্ন তবে ডাক্তারদের নানা পরামর্শ মেনে চলছি। সম্প্রতি আবার করোনায় শিশু সংখ্যা বাড়ছে। অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে শিশু হাসপাতালের করোনা আক্রান্ত রোগী ছিল ১০। নবেম্বরের প্রথম সপ্তাহে সেটা হয়েছে ১৬। নবেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে ২৩ জন। শীত যত বাড়ছে সঙ্কটও বাড়ছে বলে মনে করছেন চিকিৎসকরা। ঢাকা শিশু হাসপাতালের এক চিকিৎসক জানান, মাঝখানে করোনা রোগীর সংখ্যা অনেক কমে এসেছিল। প্রায় অর্ধেক বেডে ফাঁকা থাকত। এখন আবার রোগী বাড়ছে। বেডের চেয়ে রোগীর সংখ্যা বেশি। আর সব ধরনের বাচ্চার ক্ষেত্রে লক্ষণগুলো এক নাও হতে পারে। কোন কোন বাচ্চা শান্ত প্রকৃতির আর কেউ চঞ্চল তাই বাচ্চাদের ক্ষেত্রেও নানা ধরনের সাবধানতার বিষয়টি মাথায় রাখতেই হয় বলেন ওই ডাক্তার। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের শিশু করোনা ইউনিটে এখন রোগী ২৫ জনের বেশি। এক মাস আগেও ছিল ১২-১৩ জন। গত ১৩ জুলাই শিশু হাসপাতালে কোভিড ওয়ার্ড চালু হওয়া পর গত মাস পর্যন্ত চিকিৎসা নিয়েছে ১০৬টি শিশু। বেশিরভাগেরই বয়স পাঁচ বছরের নিচে। সম্প্রতি চাইল্ড হেলথ রিসার্চ ফাউন্ডেশন (সিএইচআরএফ) ও শিশু হাসপাতাল যৌথ উদ্যোগে এক গবেষণা করে ২৮ দিনের কম বয়সী শিশুদের নিয়ে। মার্চের শুরু থেকে ৮৪টি শিশুকে নিয়ে করা এ গবেষণায় দেখা যায় ২৬ জন শিশুর করোনা শনাক্ত হয়। এর মধ্যে মারা গেছে ৮ জন। এই ৮ জনের ভেতর ৪ জনই অপুষ্টিতে ভুগছিল। শিশুরা কেন এত আক্রান্ত হচ্ছে ঢাকা শিশু হাসপাতালে রোগতত্ত্ববিদ ডাঃ কিংকর ঘোষ বলেছেন, পাঁচ বছরের কম বয়সীরা কিন্তু সাধারণত বাড়ির বাইরে যায় না, বেশিরভাগ আক্রান্ত হচ্ছে পরিবারের অন্য সদস্যদের মাধ্যমে। যদিও শিশুদের মৃত্যুহার খুব কম, সুস্থও হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু তাদের মাধ্যমে আবার বাড়ির বৃদ্ধরা আক্রান্ত হচ্ছেন। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের শিশু বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ১০ মে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে শিশু ইউনিট ১৪ বেড দিয়ে শুরু করলেও এখন সেখানে বেড রয়েছে ৪২টি। যেখানে ৫-১২ বছরের বয়সী শিশুর সংখ্যাই বেশি। তিন থেকে চার দিনের নবজাতকদেরও এখানে ভর্তি করা হয়েছে। কোভিড আক্রান্ত মায়ের সংস্পর্শে থাকার কারণেই নবজাতকরা আক্রান্ত হচ্ছেন বলে মত শিশু ডাক্তারদের। শিশু ডাক্তারদের পরামর্শ হলো পরিবারের অন্য সদস্যদের বাইরে থেকে আসার পর বিশেষ করে মায়েরা বাইরে থেকে এসে শিশুদের স্পর্শ করার আগে সাবান পানি দিয়ে ভালভাবে হাত ধুয়ে নিতে হবে। গোসল করে নিলে আরও ভাল। এতে বাচ্চা নিরাপদ সুরক্ষা নিশ্চিত হয়। সম্প্রতি করোনার সঙ্গে ডেঙ্গু এবং নিউমোনিয়া শিশুদের বাবা-মাকে আরও আতঙ্ক বাড়িয়ে দিচ্ছে। প্রতিদিনই ডেঙ্গু নিউমোনিয়া আক্রান্ত হয়ে অনেক শিশু হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে। তবে ডাক্তারদের পরামর্শ হলো জ্বর হলেও করোনা নিয়ে আতঙ্ক যেন না হয় বাবা-মা। শিশু হাসপাতালে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কয়েকদিন ধরে হাসপাতালে রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। ঠাণ্ডাজনিত বিভিন্ন অসুখ যেমনÑ জ্বর, ঠাণ্ডা, কাশি, ডায়রিয়া, শ্বাসকষ্ট ইত্যাদি নিয়ে বেশি রোগী আসছে। তবে ইনডোরে যারা ভর্তি হচ্ছে তাদের মধ্যে ডেঙ্গু, নিউমোনিয়া ও করোনা রোগী রয়েছে। হাসপাতালের ওয়ার্ড ঘুরে দেখা যায়, করোনার মতোই ডেঙ্গু ও নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত শিশুদের নিয়ে উদ্বিগ্ন অভিভাবকরা। এদিকে বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউ চলাকালীন সময়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু) নতুন নির্দেশিকা জারি করে জানিয়েছে, করোনা সংক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে পাঁচ বছরের নিচের শিশুদের মাস্ক পরতে হবে না। যেসব ব্যক্তি অসুস্থ বা করোনায় আক্রান্ত হওয়ার ভয় রয়েছে, তারা শুধু সার্জিক্যাল মাস্ক ব্যবহার করবেন বলে নির্দেশ দিয়েছে ডব্লিউএইচও। এর আগে ইউনিসেফ ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছিল, যাদের শ্বাসকষ্টের সমস্যা রয়েছে বা নিজে থেকে মাস্ক খুলতে পারেন না, তাদের মাস্ক পরা উচিত নয়। এবার সংস্থাটি জানাচ্ছে, পাঁচ বছর কম বয়সের শিশুদের মাস্ক পরানোর প্রয়োজন নেই বরং মাস্ক পরলে আরও বেশি ক্ষতি হতে পারে। কারণ তারা মাস্কের সঠিক ব্যবহার জানে না। আর খুব ছোট শিশুদের করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হওয়ার সম্ভাবনা অনেক কম বলে জানিয়েছে সংস্থাটি। সংস্থাটির দাবি, ছয় থেকে ১১ বছরের শিশুদের ক্ষেত্রে নিয়ম অন্য। এই বয়সের শিশুরা করোনা সংক্রমণ নিয়ে খুব বেশি জানে না। মাস্কের ব্যবহার সম্পর্কেও তাদের ধারণা নেই। তাই বড়দের উপস্থিতি ছাড়া এদের মাস্ক পরানো উচিত নয়। তবে ১২ বছরের ওপরের শিশুদের বড়দের মতোই মাস্ক পরার নিয়ম ও স্যানিটাইজার ব্যবহারের নিয়ম মানার পরামর্শ দিয়েছে সংস্থাটি। একাধিক অভিভাবকরাও জানিয়েছেন ছোট শিশুদের ক্ষেত্রে মাস্ক পরানোটা মুশকিলই। বাচ্চারা চঞ্চল প্রকৃতির ফলে করোনার লক্ষণগুলো বুঝতেই অনেক সময় লেগে যায় অভিভাবকদের। একাধিক ডাক্তারের মতে, শিশুদের অকারণে ওষুধ না খাওয়ানো পরামর্শ দিয়েছেন। কেননা, তাদের নিজেদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অনেক ভাল। তাদের স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়ার অভ্যাস করাতে হবে এবং অতিরিক্ত রিচ ফুড থেকে দূরে নিয়ে আসতে হবে। কম বয়সে ওজন নিয়ন্ত্রণে আনা অনেক বেশি সহজ। শিশুর করোনা পজিটিভের দায় অভিভাবকরা এড়াতে পারেন না জানিয়ে চিকিৎসকরা বলছেন, বিকল্প নেই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার। চিকিৎসকরা বলছেন, অভিভাবকরা শীতকালীন সাধারণ রোগের ব্যাপারে সচেতন হলে অনেক বড় বড় রোগের সংক্রমণের হাত থেকে শিশুদের রক্ষা সম্ভব। শিশুর যে কোন সমস্যায় বিভ্রান্ত না হয়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসের পরামর্শ নেয়ার অনুরোধ চিকিৎসকদের।
×