ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

রংপুরে মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্রে 'টর্চার সেল'

প্রকাশিত: ২১:৩০, ২৭ জানুয়ারি ২০২১

রংপুরে মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্রে 'টর্চার সেল'

নিজস্ব সংবাদদাতা, রংপুর ॥ মাদকাসক্তি নিরাময়ের জন্য রংপুরে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠেছে অসংখ্য মাদকাসক্তি নিরাময় ও পুনর্বাসন কেন্দ্র। কিন্তু এসব প্রতিষ্ঠানে নেই পর্যন্ত অভিজ্ঞ চিকিৎসক বা কর্মী। পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজনীয় উপকরণও নেই। ন্যূনতম মান বজায় রেখে মাদকাসক্তদের চিকিৎসার নামে চলছে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন। নজরদারির অভাবে এসব কেন্দ্র হয়ে উঠেছে রোগীদের জন্য"টর্চার সেল" এমন একটি টর্চার সেলের সন্ধান পাওয়া গেছে রংপুর নগরের মেডিকেল পূর্ব গেট এলাকায়। স্থানীয়রা জানান, “প্রধান মাদকাসক্তি নিরাময় ও পুনর্বাসন কেন্দ্র” নামে বিশেষায়িত এই চিকিৎসাকেন্দ্র থেকে প্রায়ই ভেসে আসে রোগীর কান্নার আওয়াজ। কখনো কখনো রাতে গগণবিদারী কান্নায় ঘুম ভেঙে যায় তাদের। বুধবার (২৭ জানুয়ারি) মধ্যরাতেও এমন কান্নার আওয়াজ শুনে নিরাময় কেন্দ্রের কাছে জড়ো হয় এলাকার কয়েকজন। কিন্তু তাদেরকে কেন্দ্রের ভিতরে ঢুকতে দেয়নি নিরাময় কেন্দ্র কর্তৃপক্ষ। পরে বাধ্য হয়ে মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরে এবং পুলিশে খবর দেয়া হলে অভিযুক্তরা পালিয়ে যান। এর আগে লোহার পাইপ দিয়ে এক রোগীকে মারপিট করার খবর পেয়ে মঙ্গলবার (২৬ জানুয়ারি) রাত সাড়ে ১১টার দিকে ওই রোগীর কয়েকজন স্বজন “প্রধান মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র” নামে ওই প্রতিষ্ঠানটিতে যান। এ সময় প্রায় সব রোগী চিকিৎসার নামে নিজেদের ওপর চলা শারীরিক নির্যাতনের ফলে সৃষ্টি হওয়া ক্ষত দেখিয়ে উদ্ধারের আঁকুতি জানায় । রাত বারোটার পর প্রধান মাদকাসক্তি নিরাময় ও পুনর্বাসন কেন্দ্রটিতে পুলিশ ও মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাসহ স্থানীয়রা প্রবেশ করলে বেরিয়ে আসে থলের বিড়াল। তারা দেখতে পান, সেখানে ভর্তি হওয়া রোগীদের ওপর চলছিল শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন। যে পাশবিকতা সহ্য করতে না পেরে চিৎকার করতে থাকেন ভারসাম্যহীন মাদকাসক্ত রোগীরা। স্থানীয়রা অভিযোগ করেন, নিরাময় কেন্দ্রটিতে প্রতিদিনই রোগীদের ওপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের ঘটনা ঘটে। রোগীর স্বজনদের কাছ থেকে ইচ্ছামতো টাকা আদায় করে থাকে। ভিতরে চিকিৎসাসেবা দানের আড়ালে যে আলাদা টর্চার সেল রছে, য়তা তাদের অজানা ছিল। এদিকে ওই নিরাময় কেন্দ্রে থাকা রোগীদের অভিযোগ, প্রতিদিনই তাদের ওপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালানো হয়। কেন্দ্রের ইনচার্জ আকিল ও মোহন মিলে তাদেরকে এসএস পাইপ দিয়ে পায়ের ও ঘাড়ের মধ্যে চেপে ধরে মারধর করে। ইলেকট্রিক শক দেয়া ছাড়াও বিবস্ত্র করে শরীরের বিভিন্ন অংশে মরিচের গুঁড়া লাগিয়ে দেয়। তিন বেলা ঠিক মতো খাবার দেয় না। এই শীতের মধ্যে তিনটা রুমে কখনো চল্লিশজন, কখনো ত্রিশ-পয়ত্রিশ জনকে একসঙ্গে মেঝেতে থাকতে দেয়া হয়। রাত হলেই কাউকে না কাউকে আলাদা রুমে ডেকে নিয়ে ইচ্ছে মতো পেটান কেন্দ্রটির কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা। এখানে কয়েক মাস ধরে চিকিৎসাধীন রয়েছে এক রোগী। দশ বছর আগে শখের বশে বন্ধুদের আড্ডায় প্রথম গাঁজা সেবন করেছিলেন এই যুবক। তিনি গাঁজা সেবনের সাথে সাথে হিরোইন ও ইয়াবায় মারাত্মকভাবে আসক্ত হয়ে ছিলেন। তার বাবা-মা তাকে মাস চারেক আগে এই মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে ভর্তি করান। তিনি বলেন, মারধর করা, ঘুষি দেওয়া এবং শাস্তি হিসেবে না খাইয়ে রাখা হয়। কখনো রাতের বেলা দাঁড় করিয়ে রাখে। খাবারের কোনো নিয়ম নেই। পঁচাবাসি খাবার জোর করে খাওয়ানো হয়। শুধু কথায় কথায় মারধর আর ঘুমের ওষুধ খাওয়ানোই এখানকার চিকিৎসা। তিনি আরও বলেন, আসক্তির কারণে অস্থির হয়ে উঠলে কর্মীরা আমাকে লাঠি দিয়ে পেটান। গোপনাঙ্গে মেরে জখম করে দেন। কিল ঘুষি তো আছেই। মাঝে মাঝে এই অমানবিক আচরণ সহ্য করতে আমার মতো অনেকেই গলা ছেড়ে চিৎকার করি। কেউ আমাদেরকে বাঁচাতে আসে না। সবাই মনে করে এখানে চিকিৎসা হচ্ছে। এ কেন্দ্রে যে অভিজ্ঞতা হয়েছে, তা আব্দুর রহিমের মনে গভীর দাগ ফেলেছে। তার ভাষায়, তার সঙ্গে নির্দয় আচরণ করা হয়েছে। কারণে অকারণে তাকে একজন ‘অপরাধী’র মতো মারধর করা হয়। মাদকাসক্ত আব্দুর রহিম বলেন, কাউন্সিলিং করার নামে আমাদের ওপর কোনো কারণ ছাড়াই অমানবিক আচরণ ও নির্যাতন করা হয়। কখনো কখনো সারারাত দাঁড় করিয়ে রাখে। ঘুম ধরলে চোখে মরিচ লাগিয়ে দেয়। খাবার দাবার ঠিক নেই। নাম না প্রকাশের শর্তে আরেক রোগী বলেন, আমাকে আকিল ও মোহন শুধু মারে। মুখে গামছা দিয়ে চেপে ধরে, হাত-পা বেঁধে রাখে। কখনো কখনো রাতে ঠান্ডা পানি দিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা জোরপূর্বক গোসল করতে বাধ্য করে। তিনি বলেন, আমরা ভীষণ অসহায়। কান্নাকাটি করি, কিন্তু কেউ তো ভিতরের অবস্থাটা দেখেন না। এ ধরনের চিকিৎসাসেবা দিয়ে সুস্থ হবার আগেই মানসিক নির্যাতনে আমার মৃত্যু হবে। মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রটি থেকে বিপর্যয় ও আসিফ নামে দুই জনকে আটক করেছে পুলিশ। তবে কেন্দ্রটির পরিচালক আদিব বসুনিয়া, ইনচার্জ আকিল, কর্মচারী মোহনসহ অন্যরা ঘটনার সময় পালিয়ে যায়। তাদেরকে আইনের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছে এলাকাবাসী। চিকিৎসার নামে চলা লোমহর্ষক নির্যাতনের খবর পেয়ে রাতেই অন্যান্য রোগীর স্বজনরা চলে আসে নিরাময় কেন্দ্রটিতে। জেলা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সাব ইন্সপেক্টর তাহেদুল আলম সোহাগ বলেন, নিরাময় কেন্দ্রটিতে এসে রোগীদের ওপর নির্যাতনের সত্যতা পেয়েছি। এখানকার খাবারের মান খুবই খারাপ। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ এবং বেশ কিছু অব্যবস্থাপনা লক্ষ্য করেছি। তিনি আরো বলেন, মাদকাসক্ত নিরাময় ও পুনর্বাসন কেন্দ্রটি অনুমোদনপ্রাপ্ত। তবে ১০ জন রোগীর চিকিৎসার অনুমতিসহ এক সময় প্রতিষ্ঠানটির লাইসেন্স থাকলেও তা নবায়ন করা হয়নি। রোগী ও স্থানীয় এলাকাবাসীদের পক্ষ থেকে যেসব অভিযোগ উঠেছে, তার প্রাথমিক সত্যতা মিলেছে। উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতিক্রমে এই নিরাময় কেন্দ্রটি বন্ধ করে দেয়াসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে। অন্যদিকে রংপুর জেলা প্রশাসনেরসহকারী কমিশনার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট (নেজারত শাখা, ফরমস, স্টেশনারী এন্ড লাইব্রেরী শাখা) মোহাম্মদ রায়হানুল ইসলাম বলেন, আমরা গোপন সংবাদের ভিত্তিতে এখানে এসে অভিযান চালাই। রোগীদের ওপর নির্যাতনের আলামত পেয়েছি। সকল রোগীর শরীরে আঘাতের জখম চিন্থ রয়েছে। এখানকার বর্তমান উনত্রিশ জন রোগীর মধ্যে ১৯ জনকে তাদের স্বজন ও অভিভাবকদের উপস্থিতিতে হস্তান্তর করা হয়েছে। বাকি দশজন এখন পুলিশে হেফাজতে থাকলেও সকালে তাদেরকে পরিবারের লোকজনের কাছে হস্তান্তর করা হবে। তিনি আরো বলেন, মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্রে চিকিৎসার নামে যেভাবে রোগীদের ওপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালানো হয়েছে, তা খুবই স্পর্শকাতর। আজকের ঘটনা থেকে আমরাও সজাগ হযিেছ। এখন অন্য সব মাদকাসক্ত নিরাময় ও পুনর্বাসন কেন্দ্রের তদারকি বাড়ানোর পাশাপাশি নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করা হবে। রংপুর মহানগর পুলিশের অপরাধ বিভাগের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার শহিদুল্লাহহ কায়সার জানান, পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।
×