ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সংসদে আলোচনা

বিএনপি কখনই স্বাধীনতার পক্ষ শক্তি হতে পারে না

প্রকাশিত: ২৩:১৪, ২৬ জানুয়ারি ২০২১

বিএনপি কখনই স্বাধীনতার পক্ষ শক্তি হতে পারে না

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ রাষ্ট্রপতির ভাষণের ওপর সাধারণ আলোচনায় বিএনপির সংরক্ষিত আসনের এক নারী সংসদ সদস্য ক্ষমতাসীন দলকে আওয়ামী লীগকে ‘স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি’ বলায় সোমবার সংসদ অধিবেশনে কিছুটা উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ে। জবাবে বিএনপির কঠোর সমালোচনা করে সরকারী দলের সংসদ সদস্যরা বলেছেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের সবচেয়ে বড় বেনিফিশিয়ারি হচ্ছে জিয়াউর রহমান, আর তার হাতে তৈরি দল বিএনপি সবচেয়ে বড় স্বাধীনতাবিরোধী। যারা বঙ্গবন্ধুর খুনী, যুদ্ধাপরাধী, একাত্তরের গণহত্যাকারীদের সঙ্গে দল করে, জোট করে, মন্ত্রী বানিয়ে রক্তস্নাত জাতীয় পতাকা তুলে দেয় তারা কখনই স্বাধীনতার পক্ষশক্তি হতে পারে না। বিএনপির উচিত জাতির কাছে ক্ষমা চেয়ে সুস্থ রাজনৈতিক ধারায় ফিরে আসা। প্রথমে স্পীকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী এবং পরে ডেপুটি স্পীকার এ্যাডভোকেট ফজলে রাব্বি মিয়ার সভাপতিত্বে সোমবার রাষ্ট্রপতির ভাষণের ওপর সাধারণ আলোচনায় অংশ নিয়ে তারা এসব কথা বলেন। আলোচনায় অংশ নেন সরকারী দলের এ কে এম রহমতুল্লাহ, ডাঃ হাবিবে মিল্লাত, সাইমুন সারোয়ার কমল, মাহমুদ-উস-সামাদ চৌধুরী, মমতাজ বেগম, তানভীর শাকিল জয়, আহসানুল হক টিটো, বেগম হোসনে আরা, বেগম জাকিয়া তাবাসসুম, জাসদের শিরিন আখতার, বিএনপির বেগম রুমীন ফারহানা এবং বিরোধী দল জাতীয় পার্টির মুজিবুল হক চুন্নু ও মুনিরউদ্দিন আহমেদ। আলোচনায় অংশ নিয়ে জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক চুন্নু করোনাভাইরাসের টিকা নিয়ে মানুষের সংশয় দূর করতে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রীসহ সব সংসদ সদস্যকে একইদিনে টিকা নেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিপরিষদের সব সদস্য এবং সব সংসদ সদস্য সবাই একদিনে ভ্যাকসিন নিলে কারও মধ্যে আর ভ্রান্তি থাকবে না। অর্থখাতের সমালোচনা করে তিনি বলেন, ব্যাংকের টাকা নিয়ে কথা এসেছে। পিকে হালদার সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা মেরে দিলেন। বাংলাদেশ ব্যাংক করে কী? হলমার্ক শত শত কোটি টাকা পাচার করেছে, বাংলাদেশ ব্যাংক কী এসব দেখে না? তিনি বলেন, দুর্নীতির অভিযোগ আসে শুধু রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে। কানাডার বেগম পাড়ায় ২৮টি বাড়ির মধ্যে ২৪টি বাড়িই হচ্ছে সরকারী কর্মচারীদের। আমলারা কী সবকিছুর উর্ধে? কোন কর্মকর্তার ছেলে-মেয়ে বিদেশে পড়ে না? তিনি বলেন, অবশ্যই স্বীকার করব যে বর্তমান সরকার দেশের অনেক উন্নয়ন করেছে। এরশাদ সাহেব যখন ক্ষমতায় ছিলেন তিনিও অনেক উন্নয়ন করেছেন। হাইকোর্টে বিচারপতি নিয়োগে কোন আইন হয়নি। বেসরকারী বিল এনেছিলাম, সেটির কিছুই হলো না। বিএনপির সংরক্ষিত আসনের রুমীন ফারহানা আলোচনায় অংশ নিয়ে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারকে মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষের শক্তি হিসেবে উল্লেখ করলে সংসদে উপস্থিত সংসদ সদস্যরা তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেন। রুমীন ফারহানা সরকারের সমালোচনা করে বলেন, সরকারের সকল ব্যর্থতাকে ছাড়িয়ে গেছে করোনাকালীন ব্যর্থতা। শুরু থেকে করোনা পরীক্ষা, মাস্ক, পিপিই, হাসপাতাল শয্যা, অক্সিজেন সরবরাহ, আইসিইউ, প্রণোদনাসহ সকল ক্ষেত্রে দুর্নীতি আর অব্যবস্থাপনা এই কঠিন সময়কে কঠিনতর করেছে। তিনি অভিযোগ করেন, পৃথিবীতে একমাত্র দেশ বাংলাদেশ যেখানে নকল করোনা সার্টিফিকেট বিক্রি হয়েছে। এই সবকিছুর পরে এখন যুক্ত হয়েছে করোনার ভ্যাকসিন নিয়ে ব্যবসা। সেরাম ইনস্টিটিউটের সঙ্গে সরাসরি চুক্তি না করে বেক্সিমকোর সঙ্গে চুক্তি করার কারণে বাংলাদেশকে ভারতের তুলনায় ৪৭ ভাগ বেশি দামে করোনা টিকা কিনতে হচ্ছে। তাতে ৩২৫ কোটি টাকা যাবে কোম্পানির পকেটে। তিনি দাবি করেন, মিথ্যা হয়রানিমূলক রাজনৈতিক মামলায় বিএনপি চেয়ারপার্সনকে কারাগারে পাঠানো, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপার্সনকে দেশে ফিরতে না দেয়া এবং দলের মহাসচিবকে দফায় দফায় জেলে পাঠানো সবকিছুই হয়েছে বিএনপিকে ধ্বংস করে ফেলার উদ্দেশ্যে। বিএনপির এই সংসদ সদস্যদের এসব অভিযোগের কড়া জবাব দেন সরকারী দলের সংসদ সদস্য ডাঃ হাবিবে মিল্লাত। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু হত্যার সবচেয়ে বড় বেনিফিশিয়ারি হচ্ছে জেনারেল জিয়াউর রহমান। স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি কে? সেটি তো আপনারাই (বিএনপি)। যারা বঙ্গবন্ধুর খুনী, স্বাধীনতাবিরোধী, একাত্তরের গণহত্যাকারীদের নিয়ে জোট করে, মন্ত্রী করে তাদের গাড়িতে পতাকা তুলে দেয়- তারা কী স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি? তিনি বলেন, জিয়াউর রহমান ২৫ আগস্ট রাতে সোয়াত জাহাজ থেকে পাকিস্তানের পক্ষে অস্ত্র নামাতে গিয়েছিল। আওয়ামী লীগের চাপে ও নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য ২৭ মার্চ কালুরঘাট থেকে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা জিয়া পাঠ করেছিলেন। তারা (বিএনপির এমপি) আইএমএফ’র কতকগুলো ডাটা দেন এবং বিভিন্ন সংগঠনের কথা বলেন। এসব ভুঁইফোড় সংগঠন যেমন বাংলাদেশে আছে, তেমনি সারা পৃথিবীতে আছে। এদের ফান্ড করলে তারা যে কোন রিপোর্ট আপনাকে তৈরি করে দেবে। বিএনপির সমালোচনা করে তিনি আরও বলেন, সুযোগ পেলেই তারা নির্বাচন নিয়ে কথা বলে। নির্বাচন করেন না কিন্তু সংসদে ঠিকই এসে বসেন, নির্বাচনের বিরুদ্ধে কথা বলেন। এতই যদি নির্বাচন খারাপ হয়ে থাকে তবে এমপি হিসেবে কেন সুযোগ-সুবিধাগুলো নিচ্ছেন? কেন ১০ কাঠা জমির আবেদন করেছিলেন? জিয়াউর রহমানের হ্যাঁ-না ভোটের নির্বাচন? ১১০ ভাগ হ্যাঁ ভোট, না ভোট একটিও পড়েনি। ওই নির্বাচন আপনারা চান? এমন নির্বাচন বাংলাদেশের জনগণ হতে দেবে না। হতে পারে না এই বাংলাদেশে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। ওই দুই চারজন কুচক্রির জন্য এই অগ্রযাত্রাকে থামিয়ে রাখা যাবে না। আর আপনারা (বিএনপি) খুন-গুমের কথা বলেন। জিয়াউর রহমান কত হাজার মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করেছে, আমাদের দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীর কত অফিসারকে কোর্ট মার্শাল দিয়ে হত্যা করেছে, অপরারেশন ক্লিনহার্ট করে কত আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীকে হত্যা ও নির্বাচন ঠেকানোর নামে শত শত মানুষকে পুড়িয়ে হত্যা করেছেন- এসব কী স্মরণে নেই? এখনও সময় আছে জনগণের কাছে ক্ষমা চান। জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী ও আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য মমতাজ বেগম বলেন, যাদের (বিএনপি) কিছু ভাল লাগে না তারা বলেন সরকার ভ্যাকসিন আনতে পারবে না। এখন টিকা আসার পর বলছে এগুলো কী ভাল? আসলে সরকারের কোন ভাল কাজই তাদের চোখে পড়ে না। এমন নজির বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা সৃষ্টি করেছেন- কেউ কোনদিন দেখেনি, বিশ্বের কেউ করতে পারেনি। ভূমিহীন-গৃহহীনদের ৭০ হাজার পাকা ঘর করে দিয়েছেন, আরও এক লাখ দেয়ার প্রস্তুতি চলছে। তখন সমালোচকরা বলেন- এত ভাল ভাল না। তিনি শিল্প সম্প্রদায়কে ভ্যাকসিনে অগ্রাধিকার প্রদানের দাবি জানান। সরকারী দলের সাইমুন সরওয়ার কমল বিএনপির সমালোচনা করে বলেন, মিথ্যা কথা বলতে বলতে বিএনপি এখন করোনা রোগী হয়ে গেছে। তাই বিএনপি নেতাদের করোনা ভ্যাকসিন দেয়া উচিত। বিএনপি যতই ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত করুক না কেন দেশের মানুষের কাছে তারা বিশ্বের সেরা মিথ্যাবাদী রাজনৈতিক দল হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশ যে দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলেছে তার প্রমাণ একাত্তরের পরাজিত রাষ্ট্র পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান নিজেই বলেছেন- ইউরোপ-আমেরিকা থেকে নয়, উন্নয়ন করতে হলে বাংলাদেশ থেকে শিখতে হবে। জাসদের সাধারণ সম্পাদক শিরিন আখতার স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে বিশেষ অধিবেশন ডাকার প্রস্তাব রেখে বলেন, বিএনপি-জামায়াত জোটসহ অশুভ শক্তির ষড়যন্ত্র থেমে নেই, তারা সুযোগ পেলেই ছোবল দিতে পারে। তাই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তিকে ঐক্যবদ্ধভাবেই অপশক্তির সকল ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। তিনি বলেন, অনেকে অনেক কথা বলেন, কিন্তু কখনও শুনি না ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্রের কথা। তবে কিভাবে চার মূলনীতি বাস্তবায়ন হবে বুঝি না। দেশের প্রবৃদ্ধি হয়েছে, অনেকদূর এগিয়েছে। তবে ক্ষমতা এককেন্দ্রিক হওয়ায় ঘুষ, দুর্নীতি, লুটপাট বেড়ে গেছে। প্রয়াত জাতীয় নেতা মোহাম্মদ নাসিমের পুত্র প্রকৌশলী তানভীর শাকিল জয় বলেন, করোনায় মানব সভ্যতা গভীর সঙ্কটে। এ সময় দেশের মানুষের একমাত্র আশার বাতিঘরই হচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বাংলাদেশের সমৃদ্ধ অর্থনীতি এখন বিশ্বের বিস্ময়। একসঙ্গে ৭০ হাজার পরিবারকে বিনামূল্য জমিসহ বাড়ি নির্মাণ করে দিয়ে বিশ্বে বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। এটাও প্রধানমন্ত্রীর কালজয়ী মানবতার আরেক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
×