ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

এক বাগানে একাধিক ফল

মিশ্র পদ্ধতির ফলের চাষ, সাফল্যে চমকিত কৃষক

প্রকাশিত: ২৩:১৩, ২৬ জানুয়ারি ২০২১

মিশ্র পদ্ধতির ফলের চাষ, সাফল্যে চমকিত কৃষক

মাহমুদুল আলম নয়ন ॥ সুদূর অস্ট্রেলিয়ার বল সুন্দরী এখন শোভা বধর্ন করেছে বগুড়ার শেরপুর উপজেলার খামারকান্দী এলাকার এক প্রত্যন্ত গ্রামের প্রান্তরে। শুধু বল সুন্দরী নয়, রয়েছে কাশ্মীরী বিভিন্ন জাতের কুল। একই জামিতে বিভিন্ন জাতের কুলের সঙ্গে বারোমাসী আম ও পেয়ারার মিশ্র বাগান করে সাফল্যের চমক সৃষ্টি করেছেন এক সময়ের শিক্ষিত বেকার মামুন ও তার দুই সহযোগী। যখন শুরু করেছিলেন, তখন অনেকেই বলেছিলেন, শ্রেফ পাগলামি। এখনও অনেকে বলেন, ‘পাতারের ভিতর (ধু-ধু প্রান্তর)’ বাগান করা পাগলামি ছাড়া আর কিছুই না। তবে মামুন ও তার সহযোগীদের এ নিয়ে কোন আক্ষেপ নেই। জনবসতি ছেড়ে উন্মুক্ত ধু-ধু প্রান্তরে গিয়ে মিশ্র ঘরানার ফলের বিশাল বাগান করে শুধু তৃপ্তি নয়, আত্মনির্ভরশীল হয়ে উঠেছেন বাগানচারী তিন উদ্যোক্তা। কোন মৌসুম নয়, এখন সারাবছর ধরেই তারা ফলাচ্ছেন আম ও পেয়ারা। একই জমিতে আম পেয়ারার সঙ্গে শোভা পাচ্ছে বিভিন্ন জাতের রকমারী বরই। রয়েছে মাল্টার বিভিন্ন ফলন। এর মাধ্যমে গড়ে উঠছে ৪০ বিঘার বিশাল ফলের বাগান। প্রত্যন্ত এলাকায় মিশ্র পদ্ধতি এই সফল বাগান গড়ে তোলার পেছনে রয়েছে ছোট্ট গল্প। বগুড়ার শেরপুরের ভাটরা এলাকার মামুনুর রশিদ ও তার ভাই সোহেল রেজা রাজশাহী কলেজ থেকে সমাজ কর্ম বিষয়ে প্রথম শ্রেণীতে মাস্টার্স করার পরে বেকারের তকমা সরছিল না। লেখাড়ার সঙ্গে নিজ গ্রামে কীটনাশক ছাড়া নিারাপদ সবজি বাগান গড়ার ক্ষেত্রে মামুনের সাফল্য ছিল আগে থেকেই। তবে এতে তার মন ভরছিল না। শুরু করেন মাল্টার বাগান। আর খামারকান্দী ইউনিয়নের মাগুড়ার তাইর গ্রামের শহিদুল ইসলামের ছিল বড় ধরনের বাগান করার স্বপ্ন। মামুনের মাল্টার বাগান দেখতে গিয়েছিলেন শহিদুল। তারপর দু’বছর আগে শহিদুলের বাগানের সঙ্গে আরও জমি বাৎসরিক ভাড়ায় নিয়ে তিন জন মিলে গড়ে তোলেন ৪০ বিঘার বাগান। খামারকান্দী ইউনিয়নের প্রত্যন্ত এলাকায় গড়ে ওঠা এই বাগান এখন চমক সৃষ্টি করেছে মিশ্র পদ্ধতির ফলন নিয়ে। একই জমিতে বরইয়ের সঙ্গে রয়েছে বারোমাসী আম। আবার ফলছে আম বড়ই পেয়ারা একই সঙ্গে। সরকারী বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণ নিয়ে অর্জিত অভিজ্ঞতা এখন নিজদের বাগানে প্রয়োগ করছেন দুই ভাই মামুন ও সোহেল। ফলের বাগানের সাফল্যের পেছনে রয়েছে মামুনের শ্রমের সঙ্গে প্রায়োগিক জ্ঞান। ফলের বাগানে ফলনে ঢের সময় লাগে। তাই সময়কে কাজে লাগাতে তিনি বেছে নিয়েছেন মিশ্র পদ্ধতি। এতে সারাবছরই বাগানে কোন না কোন ফল ফলছে। মামুন, সোহেল ও শহিদুল তিনজনের কাজ ভিন্ন। এক জন দেখেন বাগানের ফলন বাজারজাত করণ, আরেক জন প্রায়োগিক দিক এবং অন্যজন ফলের বাগনের নার্সারি। বাগানের পুরো জমি যেন সব সময় কাজে লাগে সে জন্য মিশ্র ফলন পদ্ধতিতে বাগান গড়ে তোলাসহ এতে নার্সারির বিষয়টিও রাখা হয়েছে। বিক্রির উপযোগী করে ফলের বাগানে বাড়তি আয়ের জন্য নার্সারি গড়ে তোলা হয়েছে। এতে প্রতি মৌসুমেই নানা জাতের চারা বিক্রির জন্য ফলের বাগানে তৈরি হচ্ছে। বাগানের তিনজনই সমান অংশীদার বলে জানালেন বেশিরভাগ জমির যোগানদাতা শহিদুল। মামুনের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে বললেন, এই বাগানই তাদের সংসার। সপ্তাহের বেশিরভাগ সময়ই তারা বাড়িতে যেতে পারেন না বাগানের কারণে। ঘুমান ও স্বপ্ন দেখেন এই বাগান নিয়েই। তারা জানালেন, বাগানের সবচেয়ে কম অংশ মাল্টা চাষ। বারি ১ ও ৩ এই দুই জাতের মাল্টা, থাই সেভেন, সুপার এইট ও সুপার টেন জাতের পেয়ারা, অস্ট্রেলিয়ার বল সুন্দরী, বাউ ৩ ও দু’ ধরনের কাশ্মীরী জাতের বরই এবং ৪ ধরনের বারোমাসী আমের ফলন হচ্ছে বাগানে। মিশ্র পদ্ধতির আবাদের কারণে আম, পেয়ারা ও কুল ১৫ থেকে ২০ বিঘা জমিতে ফলছে। তারা আশা করছেন, চলতি বছর শুধু বিভিন্ন্ ধরনের কুল বা বরই বিক্রি করতে পারবেন এক কোটি টাকার বেশি। পর পর দুবছর বন্যার কারণে তাদের ক্ষতি হলেও এখন তারা স্বপ্ন দেখছেন। শুধু কুল নয় বারোমাসের আম নিয়েই তারা সমান আশাবাদী। পরিশ্রম আর পদ্ধতির কারণে চমক সৃষ্টি করা এই ফল বাগান নিয়ে তিন বাগানচারীর স্বপ্ন তাদের বাগান একদিন দেশের সর্বত্র সাড়া ফেলবে, হয়ে উঠবে উত্তরের অন্যতম সেরা ফলের বাগান।
×