ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মানবজাতিকে রক্ষায় ভ্যাকসিন বিপ্লব

প্রকাশিত: ২১:০১, ২৬ জানুয়ারি ২০২১

মানবজাতিকে রক্ষায় ভ্যাকসিন বিপ্লব

আরএনএ বছরের সেরা মলিকুল উপাধি পাওয়ার দাবি রাখে। কারণ আরএনএ এখন বিস্ময়কর নতুন নতুন ভূমিকা পালন করছে। এই জেনেটিক উপাদানটি হচ্ছে নতুন ধরনের ভ্যাকসিন, ক্যান্সার চিকিৎসা ও জিন সম্পাদনার হাতিয়ারের প্রাণকেন্দ্র। আরএনএর সহোদররা হচ্ছে ডিএনএ। ডিএনএর খ্যাতি ও পরিচিতিই বেশি। কিন্তু অনেক খ্যাতিমান সহোদর বা সহোদরের মতো ডিএনএ খুব বেশি একটা কাজ করে না। এই পৃথিবীতে সকল প্রাণের উৎপত্তি হয়ত হয়েছে আরএনএ থেকে। আরএনএর গুরুত্ব বুঝতে হলে ব্যাকটেরিয়ার কিছু ক্রিয়াকলাপ জানতে হবে। বিশেষ করে ভাইরাসের বিরুদ্ধে ব্যাকটেরিয়া কিভাবে লড়াই করে। ব্যাকটেরিয়া তাদের ডিএনএতে গুচ্ছবদ্ধ পুনরাবৃত্ত অনুক্রম (ঈষঁংঃবৎবফ ৎবঢ়বধঃবফ ংবয়ঁবহপব) গড়ে তোলে, যা ক্রিসপার (ঈজওঝচজ) নামে পরিচিত। এই ক্রিসপার বিপজ্জনক ভাইরাসগুলোকে চিনে রাখে এবং তারপর সেগুলো ধ্বংস করার জন্য আরএনএ পরিচালিত কাঁচি নিয়োগ করে। অন্য কথায় বলতে গেলে এটা হলো এক ইমিউন ব্যবস্থা যা ভাইরাসগুলোর প্রতিটি নতুন নতুন জোয়ারের মোকাবেলার এবং এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য নিজেকে অভিযোজন করে নিতে বা খাপ খাইয়ে নিতে পারে। ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য আমাদের অর্থাৎ মানুষের ঠিক এই কৌশলটাই প্রয়োজন। আর সে জন্যই সম্পূর্ণ নতুন ধরনের ভ্যাকসিন তৈরিতে আরএনএ নিয়োগ করা হয়েছে। যেমন কোভিড-১৯ এর ভ্যাকসিনে যা এই মহামারীর গতিধারা বদলে দিতে পারে। গত বছরের আগ পর্যন্ত ভ্যাকসিনের ক্ষেত্রে দুশ বছরেরও বেশি সময়কাল ধরে খুব একটা পরিবর্তন ঘটেনি অন্তত ধারণার দিক দিয়ে। ১৭৯৬ সালে ইংরেজ ডাক্তার এডওয়ার্ড জেনার গুটিবসন্তের টিকা আবিষ্কার করেন। যেভাবে তা করা হয় পরবর্তী বেশিরভাগ টিকা সেই মডেলকেই অনুসরণ করে করা হয়েছে। জেনার লক্ষ্য করেছিলেন যে, অনেক গোয়ালিনীর গুটিবসন্ত হয় না। তারা সবাই এক ধরনের বসন্তে সংক্রমিত হয় যা গরুকে পীড়াগ্রস্ত করলেও তুলনামূলকভাবে মানুষের তেমন ক্ষতি হয় না। এ থেকে জেনার ধারণা করে যে গরুর বসন্ত তাদের শরীরে গুটিবসন্তের ইমিউনিটি সৃষ্টি করেছে। সেই ধারণা থেকে তিনি গরুর বসন্তের গুটি থেকে নেয়া কিছু পুঁজ তার মালীর ৮ বছরের ছেলের বাহুতে নিজেরই তৈরি করা আঁচড়ে লাগিয়ে দিয়ে তাকে গুটিবসন্তের ঝুঁকির মুখে ঠেলে দেন। কিন্তু ছেলেটির গুটিবসন্ত হয়নি। এর আগে সত্যিকারের গুটিবসন্তের ভাইরাস সামান্য মাত্রায় শরীরে দিয়ে টিকা দেয়ার কাজ সম্পন্ন করা হতো। আশঙ্কা করা হতো যে, টিকা দেয়া ব্যক্তিদের হাল্কা ধরনের রোগ হয়ে এই রোগের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে উঠবে। জেনারের বিশাল অবদান ছিল এখানে যে, তিনি এই সম্পর্কিত অথচ তুলনামূলক নির্দোষ ভাইরাস ব্যবহার করেছিলেন। তারপর থেকে কাজটা একটা বিপজ্জনক ভাইরাস বা অন্য কোন জীবাণুর নিরাপদ প্রতিরূপ শরীরে প্রবেশ করিয়ে দিয়ে টিকা দেয়ার কাজটা করা হতো। উদ্দেশ্য হচ্ছে সেই ব্যক্তির খাপ খাওয়ার উপযোগী ইমিউন ব্যবস্থাকে সক্রিয় করে তোলা। ইমিউন ব্যবস্থা সক্রিয় হলে দেহ এ্যান্টিবডি তৈরি করে, যা কখনও কখনও বহু বছর ধরে সত্যিকারের কোন জীবাণুর আক্রমণ ঘটলে সংক্রমণ প্রতিহত করতে পারে। এ ক্ষেত্রে একটি কৌশল হলো নিরাপদ দুর্বল হয়ে পড়া ভাইরাসের একটি সংস্করণ শরীরে ইনজেক্ট করে দেয়া। এটা এক ভাল ব্যবস্থা। কারণ এটা দেখতে অনেকটা সত্যিকারের ভাইরাসের মতো দেখায়। শরীরে ইনজেক্ট করা হলে শরীর এর প্রতিক্রিয়া হিসেবে ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য এ্যান্টিবডি তেরি করে এবং এই ইমিউনিটি আজীবন স্থায়ী হয়। এলবার্ট সাবিন এই কৌশল কাজে লাগিয়ে ১৯৫০ এর দশকে ওরাল পোলিও ভ্যাকসিন তৈরি করেছিলেন। আর এই একই কৌশল কাজে লাগিয়ে আজ হাম, মাম্পস, রুবেলা ও চিকেন পক্সের টিকা তৈরি হচ্ছে। সাবিন একই সময় একটি দুর্বল পোলিও ভাইরাসের ওপর ভিত্তি করে একটি ভ্যাকসিন বের করার চেষ্টা করছিলেন। এর পাশাপাশি জোনাস সালক অপেক্ষাকৃত নিরাপদ একটি কৌশল উদ্ভাবনে সফল হন। আর সেটা হলো মেরে ফেলা কিংবা নিষ্ক্রিয় করে ফেলা ভাইরাসের ব্যবহার। এভাবে তৈরি হওয়া ভ্যাকসিন ও ব্যক্তির ইমিউন ব্যবস্থাকে শেখাতে পারে কিভাবে জ্যান্ত ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়তে হয়। তবে এমন ভ্যাকসিনের গুরুতর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কম হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। চীনের দুই কোম্পানি সিনোফার্ম ও সিনোভাক এই কৌশল কাজে লাগিয়ে কোভিড-১৯ এর ভ্যাকসিন বের করেছে, যেগুলো এখন চীন, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও ইন্দোনেশিয়ার সীমিত পরিসরে প্রয়োগ করা হচ্ছে। আরেক প্রচলিত কৌশল হলো ভাইরাসের একটি সাব-ইউনিট, যেমন ভাইরাসের আবরণে থাকা প্রোটিনগুলোর একটিকে ইনজেকশনের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করিয়ে দেয়া। ওগুলো শরীরে ঢুকলে ইমিউন সিস্টেম সেগুলোকে চিনে রেখে দেয়। তারপর সত্যিকারের ভাইরাসের সম্মুখীন হলে শরীরের পক্ষের দ্রুত ও বলিষ্ঠ জবাব দেয়া সম্ভব হয়। দৃষ্টান্ত দিয়ে বলা যায় যে, হেপাটাইটিস-বি ভাইরাসের বিরুদ্ধে ভ্যাকসিন এভাবেই কাজ করে। ভাইরাসের একটি খণ্ডিত অংশকে ব্যবহার করার অর্থ হলো এগুলো রোগীর শরীরে ইনজেক্ট করা নিরাপদ এবং তৈরি করাও সহজ। তবে অনেক ক্ষেত্রে এতে দীর্ঘমেয়াদী ইমিউনিটি গড়ে ওঠে না। মেরিল্যাল্ডের বায়োটেক কোম্পানি লোভাবেক্স এই পদ্ধতি ব্যবহার করে কোভিড-১৯ এর যে ভ্যাকসিন তৈরি করেছে, তা এখন ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের শেষ পর্যায়ে রয়েছে। রাশিয়ায় যে দুটো ভ্যাকসিন ইতোমধ্যে প্রয়োগ শুরু হয়েছে তার একটির ভিত্তি হলো এই কৌশল। ওপরের যত ভ্যাকসিনের কথা বলা হলো সবই হলো প্রচলিত কৌশলের ভ্যাকসিন। তবে ২০২০ সালের মহামারীর বছরটা স্মরণীয় হয়ে থাকবে সম্পূর্ণ নতুন ধরনের ভ্যাকসিন উদ্ভাবিত হওয়ার জন্য। সেটা হলো জিনেটিক ভ্যাকসিন। এই ভ্যাকসিন জিনেটিক কোডের একটি জিন বা অংশ মানুষের দেহকোষে ঢুকিয়ে দেয়। এরপর জিনের নির্দেশ অনুসারে সেই কোষগুলো নিজের থেকে টার্গেট ভাইরাসের নিরাপদ অংশ তৈরি করে সেই ব্যক্তির ইমিউন সিস্টেমকে উদ্দীপ্ত করার জন্য। কোভিড-১৯ রোগের জন্য যে ভাইরাস দায়ী তার নাম সার্স-কোভ-২। এই ভাইরাসের টার্গেট উপাদানটি হলো এর স্পাইক প্রোটিন, যা ভাইরাসের বহিরাবরণে খচিত অবস্থায় থাকে এবং মানুষের দেহকোষে ভাইরাসের অনুপ্রবেশ সক্ষম করে তোলে। সেই ভাইরাসের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার একটি উপায় হলো রিকমবিনেন্ট ডিএনএ নামে পরিচিত একটি কৌশলকে কাজে লাগিয়ে নির্দোষ প্রকৃতির একটি ভাইরাসের ভেতরে ঢুকিয়ে দেয়া, যা সেই জিনটিকে মানব দেহকোষে প্রবেশ করাতে পারে। কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন তৈরি করার জন্য করোনাভাইরাসের স্পাইক প্রোটিনের অংশ তৈরির নির্দেশাবলী সংবলিত একটি জিন সম্পাদনা করে এডিনোভাইরাসের মতো এমন এক দুর্বল ধরনের ভাইরাসের ডিএনএর ভেতরে দেয়া হয়, যা সাধারণ সর্দিগর্মি ঘটিয়ে থাকে। উদ্দেশ্য হচ্ছে এই যে পুনঃপ্রকৌশলজাত এডিনো ভাইরাস সঙ্গোপনে মানব দেহকোষের মধ্যে ঢুকে পড়বে, সেখানে নতুন জিন কোষগুলোতে দিয়ে এ জাতীয় স্পাইক প্রোটিন প্রচুর পরিমাণে তৈরি করবে। এর ফলে সেই ব্যক্তির শরীরে সত্যিকারের করোনাভাইরাস আঘাত হানলে তার দেহ দ্রুত প্রতিঘাত তৈরির জন্য নিজের ইমিউন ব্যবস্থাকে উদ্দীপ্ত করে তুলবে। এই কৌশল থেকেই অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনার ইনস্টিটিউটে একদম প্রথম দিকের একটি কোভিড ভ্যাকসিন উদ্ভাবিত হয়। সেখানকার বিজ্ঞানীরা স্পাইক-প্রোটিন জিনকে এমন এক এডিনো ভাইরাসের বিজ্ঞানীরা স্পাইক-প্রোটিন জিনকে এমন এক এডিনোভাইরাসের মধ্যে ঢুকিয়ে দেন যা শিম্পাঞ্জিদের শরীরের সাধারণ সদিগর্মি ঘটালেও মানবদেহের ক্ষেত্রে তুলনামূলকভাবে অনুপোককারী। ইনস্টিটিউটের প্রধান গবেষকের নাম সারা গিলবার্ট। তিনি শিম্পাঞ্জির শরীরে সেই একই এডিনোভাইরাস ব্যবহার করে মিডনইস্ট রেসপিরেটরি সিনড্রোম বা মার্সের ভ্যাকসিন বের করেছিলেন। কিন্তু তার ভ্যাকসিন প্রয়োগ করতে পারার আগেই মহামারী ধীরে ধীরে শেষ হয়ে আসে। তবে কোভিড-১৯ আঘাত হানলে তিনি ওই সূত্র ধরে এগিয়ে যান। তিনি ইতোমধ্যে জেনে ফেলেছেন যে, শিম্পাঞ্জির এডিনোভাইরাস সাফল্যের সঙ্গে মানবদেহে সার্সের স্পাইক প্রোটিনের জিন সরবরাহ করতে পেরেছে। চীনারা ২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে নতুন করোনাভাইরাসের জিনেটিক সিকোয়েন্স প্রকাশ করার পর থেকে তিনি সেই ভাইরাসের স্পাইক-প্রোটিন জিন শিম্পাঞ্জির ভাইরাসের ভেতরে প্রবেশ করানো শুরু করেন। এভাবে তিনিও তার দল তৈরি করেন ভ্যাকসিন। এরপর দেখা হয় সেই ভ্যাকসিন কাক্সিক্ষত এ্যান্ডিবডি তৈরি করে কিনা! দেখা গেল এ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে। মার্চ মাসে মন্টানার প্রাইমেট সেন্টারে বানরদের শরীরে পরীক্ষা চালিয়ে আশাব্যঞ্জক ফল পাওয়া যায়। এরপর এলো সেই ভ্যাকসিন ব্যাপক পরিসরে পরীক্ষা, উৎপাদন ও বিতরণের প্রশ্ন। অক্সফোর্ডের সেই দলটি ব্রিটিশ সুইডিশ ওষুধ কোম্পানি এ্যাস্ট্রোজেনেকার সঙ্গে অংশীদারিত্ব গড়ে তুলে সেই কাজ চালাতে থাকে। দুর্ভাগ্যবশত মানবদেহে ক্লিনিক্যাল পরীক্ষা চলাকালে কিছু কিছু অংশগ্রহণকারীকে ভুল ডোজ দেয়ার ফলে ত্রুটিপূর্ণ ফল আসতে থাকে। এ জন্য কিছু দেরি হয়ে যায়। অবশেষে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ গত ডিসেম্বর মাসের শেষ দিকে ভ্যাকসিনটি জরুরী ভিত্তিতে ব্যবহারের অনুমোদন দেয়। জনসন এন্ড জনসন কোম্পানি স্পাইক প্রোটিনের কিয়দংশ তৈরির সঙ্কেত ধারণকারী জিন বহনের জন্য ডেলিভারি ব্যবস্থা হিসেবে শিম্পাঞ্জির এডিনোভাইরাসের পরিবর্তে মানুষের এডিনোভাইরাস ব্যবহার করে একই ধরনের ভ্যাকসিন তৈরি করেছে এবং তা নিয়ে ক্লিনিক্যাল পরীক্ষা চালাচ্ছে। পরীক্ষার ফল এই জানুয়ারি মাসেই পাওয়া যাবে বলে আশা করা হচ্ছে। জেনেটিক উপাদানকে মানুষের দেহকোষে প্রবেশ করানো এবং সেই কোষকে স্পাইক প্রোটিনের মতো বিপজ্জনক ভাইরাসের অংশ তৈরির আরেকটা উপায় আছে যাতে করে সেই স্পাইক প্রোটিন ইমিউন ব্যবস্থাকে উদ্দীপ্ত করতে পারে। এডিনোভাইরাসের ভেতরে ভাইরাসের কোন উপাদন প্রবেশ করানোর জন্য জিন প্রকৌশল করার পরিবর্তে ভাইরাসের সেই অংশের জিনেটিক কোড ডিএনএ অথবা আরএনএ হিসেবে মানবদেহের ভেতর সোজাসুজি ইনজেক্ট করে দেয়া যেতে পারে। কিছু ওষুধ কোম্পানি ২০২০ সালে ডিএনএর একটি ক্ষুদ্র বৃত্ত তৈরি করে যার মধ্যে করোনাভাইরাস স্পাইক প্রোটিনের অংশবিশেষের সাঙ্কেতিক ভাষা ধারণ করে ছিল। এটা তৈরির উদ্দেশ্য ছিল ওই ব্তৃ যদি কোন দেহকোষের নিউক্লিয়াসের ভেতর যেতে পারে তা হলে ডিএনএ স্পাইক প্রোটিনের অংশ উৎপাদনের নির্দেশাবলী খুব দক্ষতার সঙ্গেই দিতে পারত এবং ওই স্পাইক প্রোটিনের অংশ তখন প্রকৃত ভাইরাসকে মোকাবেলা করার জন্য ইমিউন সিস্টেমকে উদ্দীপ্ত করতে পারত। তবে ডিএনএ ভ্যাকসিনের সামনে বড় চ্যালেঞ্জটি ছিল এর ডেলিভারি সিস্টেম। ডিএনএর সেই ক্ষুদে বৃত্তকে মানবদেহের কোষের ভেতরেই শুধু নয়, কোষের একেবারে প্রাণকেন্দ্রে কিভাবে ঢুকিয়ে দেয়া সম্ভব? ইনজেকশনের মাধ্যমে প্রচুর ডিএনএ ভ্যাকসিন রোগীর বাহুতে দেয়া হলে কিছু কিছু ডিএনএ দেহকোষের ভেতরে গিয়ে ঢুকবে বটে, তবে ব্যাপারটা মোটেও দক্ষতার পরিচায়ক হবে না। কোভিড ভ্যাকসিন তৈরির প্রতিযোগিতায় যে মলিকুলটি শেষ পর্যন্ত বিজয়ী হয়েছে এবং টাইম ম্যাগাজিনের ভাষায় বছরের সেরা মলিকুল হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে তা হলো আরএনএ। এর সহোদররা ডিএনএ অধিকতর পরিচিত ও বিখ্যাত। তবে অনেক বিখ্যাত সহোদরের মতো ডিএনএ খুব বেশি একটা কাজ করে না। এটি মূলত আমাদের কোষের নিউক্লিয়াসে ঘাপটি মেরে থেকে এর সঙ্কেতাবদ্ধ তথ্যগুলোকে রক্ষা করে। অন্যদিকে আরএনএ প্রকৃতপক্ষে বেরিয়ে এসে আসল কাজগুলো সম্পন্ন করে। আমাদের ডিএনএ কর্তৃক সঙ্কেতাবদ্ধ জিনগুলো আরএনএর টুকরো টুকরো অংশে অনুলিপি করা হয়, যেগুলো কোষের নিউক্লিয়াস থেকে বেরিয়ে এসে প্রোটিন তৈরির অঞ্চলে গিয়ে ঢোকে। সেখানে এই বার্তাবাহক আরএনএ (এমআরএনএ) সুনির্র্দিষ্ট প্রোটিনের সমাবেশ তত্ত্বাবধান করে। অন্য কথায় বলতে গেলে ঘরে বসে তথ্য সংগ্রহ করার পরিবর্তে আরএনএ আসল জিনিসগুলো তৈরি করে। এমআরএন মলিকুলগুলোকে প্রথম চিহ্নিত ও আলদা করা হয়েছিল ১৯৬১ সালে। কিন্তু সেগুলোকে কোন উদ্দেশ্য সাধনে কাজে লাগানো ছিল কঠিন। কারণ গবেষকদের প্রকৌশলজাত এমআরএনএ শরীরের ভেতরে ঢুকিয়ে দেয়ার চেষ্টা করার সময় শরীরের ইমিউন ব্যবস্থার দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে না। এক বছর আগে কোভিড-১৯ মহামারী আঘাত হানলে উদ্ভাবনপ্রিয় দুই নবীন ওষুধ কোম্পানি ম্যাসেঞ্জার আরএনএর এই ভূমিকাকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করার সিদ্ধান্ত নেয়। একটি হলো জার্মান কোম্পানি বায়োএনটেক, যা মার্কিন কোম্পানি ফাইজারের সঙ্গে অংশীদারিত্ব গঠন করে এবং অন্যটি হলো ম্যাসাচুসেটসের কেম্ব্রিজে অবস্থিত মডার্না। তাদের মিশন ছিল সাঙ্কেতিক অক্ষর বহনকারী ম্যাসেঞ্জার আরএনএকে কাজে লাগিয়ে করোনাভাইরাসের স্পাইক প্রোটিনের অংশবিশেষ তৈরি করা এবং তারপর সেটাকে মানব দেহকোষের ভেতরে স্থাপন করা। বায়োএনটেক কোম্পানিটি প্রতিষ্ঠা করেন ২০০৮ সালে ইউগুর সাহিন, ওজলেম তুবেসি। তারা স্বামী-স্ত্রী। দুজনেই তুর্কী বংশোদ্ভূত জার্মান। জার্মানিতেই ডাক্তারির ওপর পড়াশোনা করেছেন। চিকিৎসাশাস্ত্রে গবেষণার ওপর অত্যুৎসাহী এ দুজনে ক্যান্সার কোষের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য ইমিউন সিস্টিমকে উদ্দীপ্ত করার থেরাপি সৃষ্টির লক্ষ্য নিয়ে বায়োএনটেক প্রতিষ্ঠা করেন। অচিরেই বায়োএনটেক ভাইরাসের বিরুদ্ধে ভ্যাকসিনে এমআর এনএ ব্যবহার করা ওষুধ উদ্ভাবনে পথিকৃৎ হয়ে দাঁড়ায়। চীনে নতুন করোনাভাইরাস দেখা দেয়ার পর সাহিন বলেছিলেন এই ভাইরাসটি মার্স ও সার্সের মতো সহজে এসে চলে যাবে এমন ধারণা করা ভুল হবে। এবারের ভাইরাসটি হবে ভিন্ন ধরনের। এর পরই বায়োএনটেক আরএনএ সিকোয়েন্সর ভিত্তিতে ভ্যাকসিন উদ্ভাবনের জরুরী প্রকল্পের কাজ শুরু করে এবং তাদের নিরলস প্রচেষ্টার ফলে তৈরি হয় কোভিড ভ্যাকসিন। ততদিন মডার্না নামে অনেক ছোট একটি কোম্পানি একই রকমের এমআরএনএ ভ্যাকসিন তৈরির চেষ্টা চালাচ্ছিল। নউবার আফিয়ান নামে বৈরুতে জন্মগ্রহণকারী এক আর্মেনিয়ান, যিনি পরে আমেরিকায় চলে এসে সেখানকার নাগরিকত্ব লাভ করেন, তিনি হার্ভার্ড ও এমআইটির গবেষকদের সঙ্গে আলোচনার পর ২০১০ সালে এমআরএনএর ব্যাপারে অত্যুৎসাহী হয়ে ওঠেন। ওই গবেষকদের সঙ্গে একত্রে তারা মডার্না প্রতিষ্ঠা করেন, যার গোড়ার দিকে লক্ষ্য ছিল ক্যান্সার চিকিৎসায় এমআরএনএ ব্যবহার করা। কিন্তু অচিরেই তারা বিভিন্ন ভাইরাসের বিরুদ্ধে ভ্যাকসিন তৈরির জন্য এই কৌশলকে কাজে লাগানোর ব্যাপারে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করে দেন। ফাইজার-বায়োএনটেক এবং মডার্না এই দুই কোম্পানিই এমআরএনকে কাজে লাগিয়ে শেষ পর্যন্ত কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন উদ্ভাবন করেছে এবং উভয় ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা ৯০ শতাংশেরও বেশি। যুক্তরাষ্ট্রে ইতোমধ্যে এই দুই কোম্পানির ভ্যাকসিন প্রয়োগ শুরু হয়েছে তৃতীয় ধাপের ক্লিনিক্যাল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর। যদিও এই সুযোগটা শুরু হয়েছে জরুরী ভিত্তিতে টিকা প্রদানের জন্য। এর দীর্ঘমেয়াদী ফল দেখার জন্য এখনও দীর্ঘ সময় বাকি আছে। সূত্র : টাইম
×