ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

নিজের জন্য গান গাই

প্রকাশিত: ০০:৪৮, ২৪ জানুয়ারি ২০২১

নিজের জন্য গান গাই

বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে ক্লাস, টিউশনির ফাঁকে আড্ডা একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। আর আড্ডাতে গান-বাজনা থাকবে না এমন তো হয় না। আড্ডাতে সাধারণত এমন দু-একজন লোক থাকেন যারা তাদের গায়কী গুণের বদৌলতে প্রধান গায়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে আড্ডা চালিয়ে নিয়ে যান স্বাচ্ছন্দ্যে। গায়ক শ্রেণীর আড্ডাবাজ তরুণেরাই থাকেন সমস্ত আড্ডার মধ্যমণি। আড্ডাতে সচরাচর জনপ্রিয় কোনো গান গাওয়া হয় যাতে অন্যরাও গানের তাল লয়ের সঙ্গে গলা মেলাতে পারে। এমন কয়েকজনকে আপনি সব জায়গাতেই পেয়ে যাবেন যারা অন্য কোন শিল্পীর গান গাওয়ার পরিবর্তে নিজেই গান লিখে ফেলেন। তারপর গানে সুর দিয়ে সাহস করে একদিন আড্ডাতে নিজের গান গাইতে শুরু করেন। এমনই একজন গায়ক নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্র রায়হান রাহী। যিনি পড়ছেন মাইক্রোবয়োলজি বিভাগ। বিভাগের অন্য সব বন্ধুরা যখন ল্যাব, এ্যাসাইনমেন্ট, টিউটোরিয়াল নিয়ে মহাব্যস্ত তখন তিনি সুযোগ পেলেই এ্যাকাডেমিক ভবনের ছাদ, ফাঁকা ক্যাম্পাসে অথবা হলে রাতের আড্ডায় নিজের গিটার নিয়ে বসে যান হুটহাট। আর আড্ডাতে পটু গায়কের মতো গলা ছেড়ে গাইতে শুরু করেন। ক্লাস, আড্ডা, গান সবকিছু সময়ের আপন নিয়মে চলছিলো ঠিকঠাকই। কিন্তু যাপিত জীবনে ছেদ ঘটল করোনা মহামারীর প্রাক্কালে। বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা হলো অনির্দিষ্টকালের জন্য। আড্ডা আর গানে যার সময় কাটে ক্যাম্পাস বন্ধের সময় তার প্রাণ ওষ্ঠাগত হবে এটাই তো স্বাভাবিক। প্রথমে হয়তো ভেবেছিলেন মাসখানেক পরেই ক্যাম্পাস খুলে যাবে কিন্তু সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাড়তে লাগল করোনার প্রকোপ তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাজতে শুরু করল ছুটির ঘণ্টা। এই ঘণ্টা যেন আর থামবার নয়, শুধু বেজেই চলেছে। একদিন ক্যামেরা সামনে বসে গাইতে শুরু করলেন, ‘আমার ধুলাবালি জমা বই আমার বন্ধুরা সব কই, আমার ভাল্লাগেনা এ মিথ্যে শহর রাতের আড়ালে রই।’ গানটি রেকর্ড করাই ছিল। খুলে ফেললেন একটি ইউটিউব চ্যানেল। তারপর নিজের চ্যানেলেই সেটি আপলোড দেন। গানের নাম দেন ‘টাইটেল ১০১’। লকডাউনে বন্ধু, ক্লাস, আড্ডা থেকে দূরে থাকা চার দেয়ালে বন্দী অন্য শিক্ষার্থীদেরও তখন দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। দিকশূন্য অন্তহীন নাবিকের মতো পথ চলতে চলতে তারাও যেন নিজেদের অনুভূতির মিল খুঁজে পেল গানটিতে। রাতারাতি গানটির ভিউয়ের সঙ্গে বাড়তে থাকে চ্যানেলটির সাবস্ক্রাইবার। এখন পর্যন্ত গানটির ভিউ প্রায় ৩.১ মিলিয়ন এবং চ্যানেলের সাবস্ক্রাইবার ৫৬.১ হাজার। এই গানটিই ছিল তার চ্যানেলের প্রথম গান। প্রথম গানেই রাহী জায়গা করে নিয়েছেন দর্শকশ্রোতার হৃদয়ে। পাচ্ছেন ভালবাসা সিক্ত মন্তব্য। গান লেখার চিন্তা কিভাবে মাথায় এলো জানতে চাইলে রাহী বলেন, ‘গান গাইতে খুব ভালবাসি। নিজের জন্য গান গাই। গানের প্রতি ভালবাসা থেকেই গান লেখা শুরু।’ কোন গান লেখার সময় তিনি এটা ভাবতে চান না শ্রোতারা গানটা পছন্দ করবে কিনা। অন্যদের সন্তুষ্ট করার জন্য লিখতে গেলে নিজের স্বাতন্ত্র্য নষ্ট হয়ে যায় বলে তিনি বিশ্বাস করেন। ‘আমি আশপাশের মানুষজনকে খুব মনোযোগ সহকারে দেখার চেষ্টা করি, আশপাশে কি ঘটছে, সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিষয়গুলোও পর্যবেক্ষণ করার চেষ্টা করি। যেমন, দোকানদার কিভাবে চায়ে চিনি দিচ্ছে, জেলে কিভাবে জাল ফেলছে, গরম ভাত থেকে ধোঁয়া ওঠা। সবগুলোর অনুভূতি যখন আমি আমার নিজস্ব ভঙ্গিমায় গানে ফুটিয়ে তুলি তখন মানুষও সহজেই তাদের জীবনের সঙ্গে এটার যোগসূত্র খুঁজে পান। আর মানুষ যেটার সঙ্গে নিজের জীবনের যোগসূত্র খুঁজে পায় সেটাকে পছন্দ করে। সেটাই বারবার শুনতে চায়, সেটাই বার বার দেখতে চায়।’ ‘টাইটেল ১০১’ এর পেছনের গল্প টেনে বললেন, ‘গানটা ২০১৮ সালে কম্পোজ করছি। ওই সময় ডিপার্টমেন্টের একটা ট্যুর ছিল। ট্যুরের পর এক সপ্তাহের একটা ছুটি ছিল। ছুটিতে বাড়িতে এসে খুব ‘নস্টালজিয়ায়’ ভুগছিলাম। তখন বাসায় বসেই গানটা লিখেছি। লিখতে লিখতে দেখেছি অল্প একটু লিখে আর বাড়াইতে পারছি না। ধরে নিলাম লেখাটা সম্পূর্ণ হয়ে গেছে। অনেকে ইউটিউবে কমেন্ট করতেছে গানটা আরেকটু বড় হলে বোধহয় ভাল হতো। কিন্তু আমি সবসময় অল্প শব্দে এবং অল্প সময়ে আমার মনের ভাব প্রকাশ করতে এবং শ্রোতাদের সামনে তুলে ধরতে পছন্দ করি। এজন্য আমি পরবর্তীতে আর গানটা দীর্ঘায়িত করতে চাইনি। আমি চেয়েছি যেন অল্প শব্দের মধ্যেই বেসিক জিনিসগুলো রিলেট করতে পারি।’ গান যেমন মনকে উদ্বেলিত করতে পারে আবার মনকে নিরানন্দেও ভরিয়ে দেয় কখনও কখনও। আমরা একাকীত্ব দূর করার জন্য গান শুনি। আনন্দের মুহূর্তে আনন্দকে আরও বহুগুণে বাড়িয়ে তুলতে গান শুনি, প্রেমের শুরুতে রোমান্টিক গান শুনি, সম্পর্কের ভাঙনের পর শুনি বিচ্ছেদের গান। যেমন ধরনের গানই হোক গান শুনতে সবাই ভালবাসে। তবে কোন গায়ক যদি তার গানের প্রতি অকৃত্রিম দরদ দিয়ে কোন গান করে এবং শ্রোতা যদি ওই গান শোনার প্রতিটা মুহূর্তে নিজেকেই খুঁজে পায় তবে নিঃসন্দেহে সেই গানটিকে একটি সার্থক গান বলা চলে। তাই সব ছাপিয়ে চায়ের কাপের আড্ডায় গিটারের টুং টাং শব্দে ঝড় তোলা গায়ক রায়হান রাহীকে সবাই গ্রহণ করেছে। গান গাওয়া এবং শোনোনোর অভিজ্ঞতা বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে রাহী বলেন, ‘আমি ছোটবেলা থেকেই গান করছি। গানে হাতেখড়ি আমার মায়ের কাছে। বাবা-মায়ের অনুপ্রেরণা থেকেই আমার এ কাজে আসা। ক্যাম্পাসের কিছু ব্যান্ড দল এবং বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন আছে তাদের সঙ্গে যখন একসঙ্গে বসি তখন আড্ডাতে গান বাজনা হয়। তবে সরাসরি কোন সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত নই। নিজের গান নিজেই কম্পোজ করি, নিজেই সুর দিই। নিজের ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখার জন্য এবং খুশিমাফিক কাজ করার জন্য কোন ব্যান্ডের সঙ্গে যুক্ত হইনি।’ পপ এবং মেলোডি ঘরানার গান পছন্দ করেন তিনি। লিরিক্স লেখার ক্ষেত্রে অনুপ্রেরণা পেয়ে থাকেন অনুপম রায়ের থেকে। অনেক বেশি সহযোগিতামূলক আচরণ পেয়ে থাকেন শিক্ষক এবং সহপাঠীদের কাছ থেকে। তিনি জানান, আগে আমি গিটার বাজাইতে পারতাম না। আমি গিটার বাজানো শিখছি বিশ^বিদ্যালয়ে ভর্তি হবার পরে। আব্বু আম্মুর খুব ভাল একটা সাপোর্ট আছে। আম্মু সবসময় খোঁজ খবর নেয় আমি গিটার বাজাইতেছি কিনা, বা ভুলে যাইতেছি কিনা। আম্মু চায় যেন মিউজিকে ভাল কিছু করতে পারি। আম্মুর নিজেরও গান গাওয়ার শখ ছিল। ছোট থেকেই আম্মু সবসময় চাইতো পড়ালেখার পাশাপাশি যেন মিউজিকটাও শিখি। দর্শকশ্রোতাদের ভালবাসা ধরে রাখতে চান রাহী। পড়াশোনার পাশাপাশি একটা এক্সপেরিমেন্ট চালাচ্ছেন তিনি। ফোক গানের প্রতি রয়েছে দুর্বলতা। জানালেন, এখনও কোন ফোক কম্পোজ করা হয়নি। ফোক গান কম্পোজের ইচ্ছা আছে। মিউজিক যেমনই হোক আমি সবসময় লিরিক্যালি রিচ গান শুনতে পছন্দ করি। এজন্য নিজের গানের লিরিক্সের প্রতিও আলাদাভাবে জোর দেয়ার চেষ্টা করি। এবং আমি মূলত নিজের জন্যই গান গাই।’
×