ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বেসরকারী হাসপাতালেও স্বল্প খরচে কিডনি প্রতিস্থাপন হচ্ছে

প্রকাশিত: ২৩:২৯, ২৪ জানুয়ারি ২০২১

বেসরকারী হাসপাতালেও স্বল্প খরচে কিডনি প্রতিস্থাপন হচ্ছে

বশিরুল ইসলাম ॥ স্বল্প খরচে দেশেই হচ্ছে কিডনি প্রতিস্থাপন। দেশের সরকারীর পাশাপাশি বেসরকারী হাসপাতাল ঢাকার শ্যামলীর সিকেডি এ্যান্ড ইউরোলজি হাসপাতালে কম খরচে কিডনি সংযোজন করা হচ্ছে। এখানে ২০০৭ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ৮০০ জনের কিডনি সফলভাবে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। সাফল্যের হার শতকরা ৯৫ ভাগ, যা আন্তর্জাতিক পর্যায়ের সমকক্ষ। করোনা মধ্যেও বর্তমানে প্রতি সপ্তাহে দুটি করে কিডনি প্রতিস্থাপন করা হচ্ছে। কিডনি প্রতিস্থাপন হয়েছে এমন রোগীকে পরবর্তী ফলোআপ চিকিৎসারও খুব ভাল ব্যবস্থা আছে এ হাসপাতালে। এক্ষেত্রে বিনামূল্যেই দেয়া হচ্ছে ফলোআপ চিকিৎসা সেবা। বিদেশে না গিয়ে দেশেই কম খরচে কিডনি সংযোজনের পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের। ২ লাখ টাকার প্যাকেজ মূল্যে কিডনি প্রতিস্থাপন সেবা দিচ্ছে ঢাকার শ্যামলীর সিকেডি এ্যান্ড ইউরোলজি হাসপাতাল। ১৫ দিনের এ প্যাকেজের মধ্যে আছে দুজনের অস্ত্রোপচার খরচ (রোগী ও ডোনার), বেড ভাড়া এবং ওষুধ খরচ। এর বাইরে পরীক্ষা খরচ হয় লাখ টাকা। এ খরচ দেশের বেসরকারী হাসপাতালে মধ্যে সর্বনিম্ন। দেশের বাইরে অন্য যেকোন দেশের চাইতেও অনেক কম। উন্নত বিশ্বের মতোই সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের তত্ত্বাবধানে কিডনি প্রতিস্থাপন করা হচ্ছে এ হাসপাতালে। কুমিল্লার বুড়িচংরে আব্দুল কাইয়ুম দীর্ঘদিন কিডনি জটিলতায় ভোগার পর এখন তার দুটো কিডনিই বিকল। কাইয়ুমের মা তাকে একটি কিডনি দিবেন। এই অস্ত্রোপচারের জন্য ভারতের একটি হাসপাতালে যোগাযোগ করলে ১৫ লাখ টাকা খরচের কথা জানানো হয়। এই অর্থ ব্যয়ে অসমর্থ আব্দুল কাইয়ুম পরে জানতে পারেন ঢাকার শ্যামলীর সিকেডি এ্যান্ড ইউরোলজি হাসপাতালের কথা। এখানে তিনি ২ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ সালে কিডনি প্রতিস্থাপন করেন। ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে এ হাসপাতালেই কিডনি সংযোজন হয় নরসিংদীর আল আমিনের (২০)। এ দেড় বছরের মধ্যে কোন শারীরিক সমস্যা হয়নি তার। তিন মাস পর পর চেকআপ করাতে আসেন এ হাসপাতালে। ফোনে কথা হয় আল আমিনের সঙ্গে। আল আমিন জানান ভারি কাজ ছাড়া সকল কাজই সে বতর্মানে করতে পারছে। কিডনিদাতা তার মাও সম্পন্ন সুস্থ আছে। সিকেডি এ্যান্ড ইউরোলজি হাসপাতালের অধ্যাপক ডাঃ মোঃ কামরুল ইসলাম জানান, সিকেডি হাসপাতালে স্বল্পমূল্যে কিডনি প্রতিস্থাপন করা যাচ্ছে। এখন ২ লাখ টাকা হচ্ছে যিনি কিডনি দেবে ও যিনি গ্রহণ করবে তাদের জন্য একটি প্যাকেজ। এই পাকেজে রয়েছে ১৫ দিনের মেডিসিন ও সকল পরীক্ষা-নিরীক্ষার খরচ। এছাড়া ১৫ দিন পরেও যদি তার চিকিৎসার প্রয়োজন হয় তবে তাকে থাকতে হবে কিডনি আইসিউইতে এ ক্ষেত্রে কোন খরচ লাগবে না। তিনি আরও জানান, ভারতে এ ধরনের চিকিৎসায় ১২-১৩ লাখ টাকা খরচ হচ্ছে তবে আমাদের দেশে কম কেন? এমন প্রশ্নের জবাবে বলেন, রোগী ও ডোনার দুটি অপারেশনই তিনি নিজেই করেন। বিনিময়ে অপারেশন খরচ তিনি গ্রহণ করেন না। ফলে রোগীর ৫০-৬০ হাজার টাকা সেইভ হচ্ছে। এটি একটি সেবামূলক প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশের মানুষের সেবা দেয়াই আমাদের মূল লক্ষ্য। আমাদের কাছে অর্থ নয় সেবাই প্রথম। পাবনার ঈশ্বরদীর শহীদ মুক্তিযোদ্ধা মোঃ আমিনুল ইসলামের ছেলে ডাঃ কামরুল ইসলাম দেশের একজন প্রখ্যাত কিডনি চিকিৎসক। ১৯৯০ সালে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ থেকে স্বর্ণপদকসহ এমবিবিএস ডিগ্রী লাভ করে। ১৯৯৫ সালে এফসিপিএস এবং ২০০০ সালে বিএসএমএমইউ থেকে ইউরোলজিতে এমএস ডিগ্রী অর্জন করেন। ২০০৩ সালে ইংল্যান্ডের রয়েল কলেজ থেকে তিনি এফআরসিএস ডিগ্রী অর্জন করেন। কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট বিষয়ে বিশেষ অবদানের জন্য তাকে ইউরোলজি সোসাইটি স্বর্ণপদক প্রদান করে। ডাঃ কামরুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশে কিডনি রোগীদের দুর্দশা দেখে তিনি একজন চিকিৎসক হিসেবে এ বিষয়টি বেছে নেন। কিডনি রোগের চিকিৎসা প্রদানের জন্য ঢাকার শ্যামলীতে সিকেডি ও ইউরোলজি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি বিকল কিডনি রোগীদের জন্য অল্প খরচে কিডনি ডায়ালাইসিস ও ট্রান্সপ্লান্টের ব্যবস্থা করেন। নিজে কিডনিদাতা ও গ্রহীতার অপারেশন করেন। বিনিময়ে কোন পারিশ্রমিক নেন না। এ পর্যন্ত তার কিডনি প্রতিস্থাপনের সংখ্যা ৮০০টি। শুধু অপারেশনই নয়, ট্রান্সপ্লান্ট-পরবর্তী রোগীর সব চিকিৎসাসেবা তিনি বিনা পয়সায় করেন। সিকেডি হাসপাতালে ট্রান্সপ্লান্ট রোগীদের অপারেশন-পরবর্তী পরীক্ষা-নিরীক্ষা বিনামূল্যে করার ব্যবস্থা করেছেন। ডাঃ কামরুল ইসলাম আরও জানান, কিডনি স্থায়ী অকার্যকর হলে প্রতিস্থাপন বা সংযোজনই শেষ কথা নয়। অস্ত্রোপচারের পর সারাজীবন এই রোগীদের ফলোআপ চিকিৎসা চালিয়ে যেতে হয়, নইলে আবারও কিডনি অকার্যকর বা মারাত্মক জটিলতায় ভুগতে হয়। আশার কথা হলো এখন দেশেই পাওয়া যাচ্ছে কিডনি প্রতিস্থাপন চিকিৎসা। দেশের দু’তিনটি সরকারী ও বেসরকারী হাসপাতালে কিডনির এ চিকিৎসা করা হচ্ছে সফলভাবে। এর মধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়, শ্যামলী সিকেডি, জাতীয় কিডনি ফাউন্ডেশন ও হাসপাতাল, বারডেম হাসপাতাল, পপুলার স্পেশালাইজড হাসপাতাল, ল্যাবএইড স্পেশালাইজড হাসপাতাল, এ্যাপোলো হাসপাতাল, ইউনাইটেড হাসপাতাল অন্যতম। ১ লাখ ৬০ হাজার টাকায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে করা হয় কিডনি প্রতিস্থাপন। কিডনি ফাউন্ডেশন হাসপাতাল ও রিসার্চ ইনস্টিটিউটে খরচ হয় ২ লাখ ৬০ হাজার টাকা এবং বারডেম হাসপাতালে ৩ লাখ ৭৫ হাজার টাকা। আর সিকেডি হাসপাতালে ২ লাখ টাকা। কিডনি সংযোজনের সাফল্য হিসেবে অধ্যাপক ড. কামরুল ইসলাম জানান, সিকেডি হাসপাতালে কিডনি সংযোজনের সাফল্যের হার শতকরা ৯০ থেকে ৯৫ ভাগ। কিডনি সংযোজন করার ৫ বছর পর বেঁচে থাকে শতকরা ৮০ ভাগ রোগী এবং ১০-১৫ বছর বেঁচে থাকে শতকরা ৭০-৭৫ ভাগ রোগী। তিনি আরও জানান, অনেক দরিদ্র রোগী দামী ওষুধ নিয়মিত সেবন করে না, ফলে তাদের কিডনির কার্যকারিতা লোপ পায় এবং তা রিজেকশন হয়ে যায়। কিছু রোগী ২ থেকে ৩ বছর পর না জেনে ওষুধ বন্ধ করে দেয়, ফলে সংযোজিত কিডনি নষ্ট হয়ে যায়। ১৯৮৮ সালে প্রথম কিডনি প্রতিস্থাপন অস্ত্রোপচার করা এই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে।
×