ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

এ পর্যন্ত ৩১ প্যাকেজ দিয়েছে সরকার

প্রণোদনার মেয়াদ ও আকার বাড়ছে

প্রকাশিত: ২৩:০৫, ২৪ জানুয়ারি ২০২১

প্রণোদনার মেয়াদ ও আকার বাড়ছে

রহিম শেখ ॥ করোনা মহামারীর প্রভাব মোকাবেলায় একের পর এক আর্থিক ও নীতি সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে সরকার। কমসুদে ঋণনির্ভর সুবিধা ও নীতি সহায়তা বাবদ এ পর্যন্ত ৩১টি প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা হয়েছে। এবার ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজগুলোর মেয়াদ ও আকার আরও বাড়ানো হচ্ছে। সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে এমন সিদ্ধান্তের কথা সম্প্রতি কেন্দ্রীয় ব্যাংককে জানানো হয়েছে। করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের কারণে ব্যবসা বাণিজ্যে এর প্রভাব দীর্ঘায়িত হওয়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকেও বিষয়গুলো ইতিবাচকভাবে দেখা হচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিভিন্ন প্যাকেজ বাস্তবায়ন ও অন্যান্য তথ্য চেয়ে বাণিজ্যিক ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে সম্প্রতি চিঠি দিয়েছে। এসব তথ্য পাওয়ার পরই কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। এ লক্ষ্যে প্যাকেজগুলোর মেয়াদ ও আকার বাড়ানোর বিষয়ে একটি খসড়া তৈরি করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এদিকে দেশের কুটির, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতে গতি সঞ্চার, গ্রামীণ প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন এবং অতি দরিদ্র বয়স্ক ও বিধবাদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচী সম্প্রসারণের লক্ষ্যে সম্প্রতি নতুন দুটি প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সূত্র জানায়, করোনার প্রভাব মোকাবেলায় আর্থিক ও নীতি সহায়তা বাবদ এখন পর্যন্ত ৩১টি প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা হয়েছে। এর মধ্যে ১০টি কমসুদে ঋণনির্ভর প্রণোদনা এবং বাকি ২১টি হচ্ছে নীতি সহায়তা। এছাড়া সম্প্রতি দুই হাজার ৭০০ কোটি টাকার নতুন দুইটি প্রণোদনা কর্মসূচী অনুমোদন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর মধ্যে নতুন অনুমোদিত প্রথম প্যাকেজটির জন্য বরাদ্দকৃত ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকার আওতায় ক্ষুদ্র, কুটির ও মাঝারি শিল্প খাত ও নারী উদ্যোক্তাদের জন্য গৃহীত কার্যক্রম সম্প্রসারণের লক্ষ্যে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (এসএমই) ফাউন্ডেশনকে দেয়া হবে ৩০০ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশনকে (বিসিক) দেয়া হবে ১০০ কোটি টাকা। জয়িতা ফাউন্ডেশনকে ৫০ কোটি টাকা প্রদান করা হবে। পাশাপাশি, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ করতে এনজিও ফাউন্ডেশনকে ৫০ কোটি টাকা, সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশনকে ৩০০ কোটি টাকা, পল্লী দারিদ্র্য বিমোচন ফাউন্ডেশনকে ৩০০ কোটি টাকা দেয়া হবে। এ ছাড়া ক্ষুদ্র কৃষক উন্নয়ন ফাউন্ডেশনকে ১০০ কোটি টাকা এবং বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন বোর্ডকে ৩০০ কোটি টাকা দেয়া হবে। অনুমোদিত দ্বিতীয় প্যাকেজের আওতায় ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশের ১৫০টি উপজেলায় দরিদ্র সব বয়স্ক এবং বিধবা ও স্বামী পরিত্যক্তা সব নারীকে ভাতার আওতায় আনা হবে। জানা গেছে, করোনার নেতিবাচক প্রভাব মোকাবেলায় প্রথম প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা হয় রফতানিমুখী শিল্পের শ্রমিক ও কর্মচারীদের বেতনভাতা পরিশোধ বাবদ ৫ হাজার কোটি টাকার তহবিল। পরে এর আকার আরও ৩ হাজার কোটি টাকা বাড়িয়ে ৮ হাজার কোটি টাকা করা হয়। দুই বছরের মধ্যে প্রথম ৬ মাস গ্রেস পিরিয়ডসহ মোট ১৮টি সমান কিস্তিতে এ ঋণ শোধ করার কথা। ঋণের বিপরীতে ২ শতাংশ হারে সার্ভিস চার্জ দিতে হবে। এ প্যাকেজের অর্থ ছাড়ের ৬ মাস পেরিয়ে গেছে। সে হিসেবে চলতি মাস থেকে কিস্তি পরিশোধের কথা। এর আগেই বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রফতানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) পক্ষ থেকে ঋণ পরিশোধের মেয়াদ ৫ বছর বাড়ানোর দাবি করা হয়েছে। তারা বলেছে, রফতানি খাত এখনও করোনার নেতিবাচক প্রভাব মোকাবেলা করে ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। এছাড়া করোনার দ্বিতীয় ধাক্কায় রফতানি কার্যক্রম নতুন করে আবার বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে সরকার থেকে এখনও কোন সিদ্ধান্ত হয়নি। বিষয়টি এখন পর্যালোচনা পর্যায়ে রয়েছে। তবে ঋণ পরিশোধের মেয়াদ আগামী মার্চ পর্যন্ত বাড়ানো হতে পারে বলে জানা গেছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি রুবানা হক জনকণ্ঠকে বলেন, ‘করোনার প্রথম ধাক্কা তারা কোন রকমে কাটিয়ে উঠেছেন। তবে ইউরোপে দ্বিতীয় ধাক্কার পর এখন পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে। সরকার সহায়তার হাত না বাড়ালে উত্তরণ কঠিন হবে।’ তিনি বলেন, ‘আগে পোশাক খাতে যে ঋণ দেয়া হয়েছে, তার পরিশোধে গ্রেস পিরিয়ড সুবিধাসহ দুই বছরের পরিবর্তে পাঁচ বছরে পরিশোধে আমরা দাবি জানিয়েছি। সরকার এ দাবির প্রতি সহানূভূতিশীল হবেন বলে আমরা আশাবাদী।’ করোনার প্রকোপ সামলাতে বড় শিল্প ও সেবা খাতে চলতি মূলধনের জোগান দিতে ৩০ হাজার কোটি টাকার তহবিল গঠন করে সরকার। পরে এর আকার দুই দফায় বাড়িয়ে ৪০ হাজার কোটি টাকা করা হয়। এ তহবিল থেকে সাড়ে ৪ শতাংশ সুদে উদ্যোক্তাদের ঋণ দেয়া হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের দেয়া তথ্য মতে, গত ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত প্যাকেজটি ৯২ দশমিক ৭১ শতাংশ বাস্তবায়ন হয়েছে। বাকি অংশ বাস্তবায়নে এর মেয়াদ আগামী জুন পর্যন্ত বাড়ানো হচ্ছে। জানতে চাইলে ঢাকা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এমরানুল হক বলেন, ‘বড় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো অত্যন্ত সুসংহত এবং তারা দ্রুততম সময়ে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ব্যাংকের কাছে জমা দিয়েছে। ফলে প্রণোদনা প্যাকেজের সুবিধা তারা সহজেই নিতে পেরেছে।’ তিনি জানান, ‘বড় ব্যবসায়ীরা তাদের ব্যবসায়িক ধারাবাহিকতার পরিকল্পনা সময়মতো ব্যাংকগুলোতে জমা দিয়েছে। ফলে ঋণদাতাদের দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে সহজ হয়েছে। এর ফলে এ খাতে ঋণ বিতরণও বেড়েছে।’ বাংলাদেশে কুটির, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগের সংখ্যা ৭৭ লাখ ৬০ হাজার। এর মধ্যে ৯৯ দশমিক ৮৪ শতাংশ ব্যক্তি মালিকানাধীন। কিন্তু প্রণোদনা প্যাকেজ থেকে এ খাতে ঋণ বিতরণের হার খুব হতাশাজনক। কুটির, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে চলতি মূলধনের জোগান দিতে ২০ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজের তহবিল থেকে উদ্যোক্তাদের সাড়ে ৪ শতাংশ সুদে ঋণ দেয়া হচ্ছে। এ থেকে মাঝারি উদ্যোক্তারা ঋণ পেলেও কুটির ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা পাচ্ছেন খুবই কম। গত ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত এ খাতে ঋণ বিতরণ হয়েছে ১ হাজার ৮২৫ কোটি টাকা। এটির মেয়াদও বাড়িয়ে আগামী মার্চ পর্যন্ত করা হয়েছে। ঋণের বিপরীতে কিস্তি আদায় ও ঋণ শ্রেণীকরণের মেয়াদ গত ৩১ ডিসেম্বরে শেষ হওয়ার পর আর বাড়ানো হয়নি। উদ্যোক্তাদের পক্ষ থেকে এর মেয়াদ বাড়ানোর দাবি করা হয়েছে। বিষয়টি কেন্দ্রীয় ব্যাংক চিন্তাভাবনা করছে। বাংলাদেশ পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর জানান, ‘এসএমই খাতের ক্রেডিট গ্যারান্টির বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক দায় এড়াতে পারে না।’ এসএমই খাতের জন্য বরাদ্দ বাড়িয়ে ৪০ হাজার থেকে ৫০ হাজার কোটি টাকা করা উচিত ছিল জানিয়ে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের সাবেক এই শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা লক্ষ্য থেকে অনেক দূরে আছি। অথচ করোনায় এসএমই খাত অর্থনৈতিকভাবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।’ এদিকে প্রান্তিক পর্যায়ে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের মধ্যে ঋণ বিতরণ করতে ক্ষুদ্রঋণ সংস্থাগুলোর (এমএফআই) মাধ্যমে ১০ হাজার কোটি টাকার নতুন প্রণোদনা প্যাকেজ নেয়া হচ্ছে। প্যাকেজে ঋণের বার্ষিক সুদ বা মুনাফা বা সার্ভিস চার্জের হার হবে সর্বোচ্চ সাড়ে ৯ শতাংশ। গ্রাহক দেবে ৪ শতাংশ, বাকিটা সরকার ভর্তুকি হিসেবে দেবে। সরকার বাংলাদেশ ব্যাংককে ০.৫ শতাংশ, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে ১ শতাংশ এবং সংশ্লিষ্ট ঋণ বিতরণকারী প্রতিষ্ঠানকে (এমএফআই) ৪ শতাংশ ভর্তুকি হিসেবে দেবে। এ জন্য সরকারের ব্যয় হবে ৫৫০ কোটি টাকা। ঋণগ্রহীতারা শুধু জাতীয় পরিচয়পত্র দাখিল করে ঋণের আবেদন করতে পারবেন। নতুন প্রণোদনা প্যাকেজ এরই মধ্যে অর্থমন্ত্রীর অনুমোদন পেয়েছে। চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য এটি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো হয়েছে। এছাড়া ক্ষুদ্র শিল্পকে বাঁচাতে ইতোমধ্যে ১ হাজার ৫০০ কোটি ও ১ হাজার ২০০ কোটি টাকার নতুন দুটি প্রণোদনা প্যাকেজ আসছে। আশা করা হচ্ছে, এই উদ্যোগের ফলে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা করোনার দ্বিতীয় ঢেউ সফলভাবে মোকাবেলা করতে পারবেন। কৃষি খাতে করোনাভাইরাসের নেতিবাচক প্রভাব মোকাবেলা করতে কৃষকদের ৪ শতাংশ সুদে ঋণ দেয়া হচ্ছে। এ খাতে বিতরণ করা ঋণের সুদের হার ৯ শতাংশ। এর মধ্যে কৃষক দেবে ৪ শতাংশ। বাকি ৫ শতাংশ বাংলাদেশ ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে ভর্তুকি হিসেবে প্রদান করবে। গত ১ এপ্রিল থেকে যেসব কৃষিঋণ দেয়া হয়েছে, সেগুলো এর আওতায় পড়বে। একই সঙ্গে চলতি বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত এ প্রণোদনার আওতায় ঋণ দেয়া যাবে। কৃষিভিত্তিক শিল্প খাতে ঋণ দিতে ৫ হাজার কোটি টাকার একটি তহবিল গঠন করা হয়েছে। এ তহবিল থেকে উদ্যোক্তাদের ৪ শতাংশ সুদে ঋণ দেয়া হচ্ছে। তবে ঋণ বিতরণের হার খুবই কম। গত ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত এ তহবিল থেকে ঋণ বিতরণ করা হয়েছে ৩ হাজার ৩৫০ কোটি টাকা। যে কারণে এর মেয়াদও বাড়ানো হচ্ছে। পরিবেশবান্ধব শিল্প প্রকল্প বাস্তবায়নে অর্থায়নের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তহবিলের আকার ২০০ কোটি টাকা বাড়িয়ে ৪০০ কোটি টাকা করা হয়েছে। এ তহবিল থেকে উদ্যোক্তারা পরিবেশবান্ধব পণ্য উৎপাদন, উদ্যোগ গ্রহণ ও প্রকল্প বাস্তবায়নে ঋণ নিতে পারছেন। গ্রাহক পর্যায়ে ঋণের সুদের হার হবে ৭ থেকে ৮ শতাংশ। এটিও চলমান থাকবে। অতি ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা ও কৃষকদের ঋণ দিতে ৩ হাজার কোটি টাকার একটি তহবিল গঠন করা হয়েছে। এ তহবিল থেকে ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে ঋণ দেয়া হবে। ক্ষুদ্রঋণের সুদের হার যেখানে ২৫ শতাংশ, সেখানে এ তহবিল থেকে ৯ শতাংশ সুদে ঋণ পাবেন ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা ও কৃষকরা। এটি প্রায় ৮০ শতাংশ বাস্তবায়ন হয়েছে। এর মেয়াদ বাড়িয়ে আগামী জুন পর্যন্ত করা হচ্ছে। নীতিসহায়তার ক্ষেত্রে বেশির ভাগ প্রণোদনাই বহাল রাখা হচ্ছে।
×