ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

স্বপ্নের নীড়ে নবযাত্রা ॥ সারাদেশে গৃহহীন ও ভূমিহীনদের আনন্দের দিন

প্রকাশিত: ২৩:০২, ২৪ জানুয়ারি ২০২১

স্বপ্নের নীড়ে নবযাত্রা ॥ সারাদেশে গৃহহীন ও ভূমিহীনদের আনন্দের দিন

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ মুজিববর্ষের উপহার হিসেবে ‘স্বপ্নের স্থায়ী নীড়’ পেয়ে বিশাল প্রাপ্তি, মুখে আনন্দের হাসি, উচ্ছ্বাস ও আনন্দাশ্রুতে শনিবার সারাদেশের ভিক্ষুক, ছিন্নমূল, বিধবা, দিনমজুর, বেদে, দলিত, হরিজন, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীসহ যুগ যুগ ধরে ভাসমান হয়ে চলা গৃহহীন-ভূমিহীন ৭০ হাজার পরিবারের প্রায় তিন লাখ মানুষের সত্যিই এক অন্যরকম দিন কেটেছে। যুগের পর যুগ ঠিকানাবিহীন মানুষগুলোর স্থায়ী নিবাস প্রাপ্তি উপলক্ষে সারাদেশের উপজেলা প্রান্তগুলোতেও ছিল রীতিমতো উৎসবের আমেজ, দেশজুড়ে বইছে আনন্দধারা। স্বাধীন বাংলাদেশের মহান স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আজীবনের লালিত স্বপ্নই ছিল দেশের দুখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানো। তাঁরই জন্মশতবার্ষিকীতে চলা মুজিববর্ষে সরকারীভাবে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে প্রায় ৭০ হাজার ভূমিহীন-গৃহহীন পরিবারকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বপ্নের স্থায়ী ঠিকানা একখণ্ড জমির ওপর সুদৃশ্য বাড়ি নির্মাণ করে তা হস্তান্তরকালে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাও ছিলেন আবেগতাড়িত, তেমনি এত মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে পেরে নিজের জাতির পিতার স্বপ্ন পূরণের তৃপ্তি ও উচ্ছ্বাসও ঢাকতে পারেননি। এর মাধ্যমে শুধু দেশেই নয়, সারাবিশ্বের মধ্যে মানব কল্যাণে এক নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা। তাই বিশ্বে নজির স্থাপন করা এই অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্যেও উঠে আসে মুজিববর্ষেই ধারাবাহিকভাবে দেশের সব ভূমিহীন-গৃহহীন মানুষকে স্থানীয় স্বপ্নের নীড় গড়ে দেয়ার দৃঢ় প্রত্যয়। মুজিববর্ষে গৃহহীন-ভূমিহীনদের ঘর উপহার বাংলাদেশের মানুষের জন্য সবচেয়ে বড় উৎসব জানিয়ে আবেগজড়িত কণ্ঠে প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশের ভূমিহীন-গৃহহীন মানুষকে ঘর দিতে পারার চেয়ে বড় কোন উৎসব আর কিছুই হতে পারে না। আজকে সত্যিই আমার জন্য একটা আনন্দের দিন। ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারকে জমি এবং ঘর প্রদান করতে পারা বড় আনন্দের। যখন এই মানুষগুলো এই ঘরে থাকবে, তখন আমার বাবা-মার আত্মা শান্তি পাবে। লাখো শহীদের আত্মা শান্তি পাবে। কারণ এসব দুখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোই তো ছিল আমার বাবার (বঙ্গবন্ধু) লক্ষ্য। প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধি সকলের সম্মিলিত প্রয়াসেই এত বড় অসাধ্য সাধন হয়েছে। সকলে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করেছেন বলেই বিশ্বে একসঙ্গে এত মানুষকে ঘর দেয়া নজিরবিহীন ঘটনা। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন পূরণে দৃঢ় অঙ্গীকার ব্যক্ত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সকলের জন্য নিরাপদ বাসস্থানের ব্যবস্থা করাই হবে মুজিববর্ষের লক্ষ্য, যাতে দেশের প্রতিটি মানুষ উন্নত জীবন-যাপন করতে পারে। দেশের ভূমিহীন-গৃহহীন মানুষকে ঘর দিতে পারার চেয়ে বড় কোন উৎসব আর কিছুই হতে পারে না। এভাবেই মুজিববর্ষ এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে পুরো বাংলাদেশের গৃহহীনদের নিরাপদ বাসস্থান তৈরি করে দেয়া হবে, যাতে দেশের একটি লোকও গৃহহীন না থাকে। যাতে তারা উন্নত জীবন-যাপন করতে পারে, আমরা সে ব্যবস্থা করে দিব। যাদের থাকার ঘর নেই, ঠিকানা নেই আমরা তাদের যেভাবেই হোক একটা ঠিকানা করে দেব। শনিবার মুজিববর্ষ উপলক্ষে সারাদেশে ভূমিহীন এবং গৃহহীন পরিবারকে জমি ও গৃহ প্রদানের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন। প্রধানমন্ত্রী তাঁর সরকারী বাসভবন গণভবন থেকে প্রথমবারের মতো বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের মাধ্যমে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে মূল অনুষ্ঠানে ভার্চুয়াল যুক্ত হয়ে অনুষ্ঠান উদ্বোধন করেন। অনুষ্ঠানের মাধ্যমে দেশের ৬৬ হাজার ১৮৯টি ভূমিহীন-গৃহহীন পরিবারকে জমি ও গৃহ প্রদান করা হয় এবং একই সঙ্গে ৩ হাজার ৭১৫ পরিবারকে ব্যারাকে পুনর্বাসন করা হয়। এসব পরিবার শুধু ঘর নয়, সঙ্গে পেয়েছেন জমির মালিকানাও। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে যুক্ত ছিলেন সারাদেশের ৪৯২ উপজেলার মানুষ- যাদের হাতে দেয়া হলো মুজিববর্ষের সেরা উপহার স্বপ্নের স্থায়ী ঠিকানা। আগামী মাসে গৃহহীনদের মাঝে আরও প্রায় এক লাখ গৃহ বিতরণ করা হবে। অনুষ্ঠানে সরকারের আশ্রায়ণ প্রকল্পের ওপর একটি ভিডিও ডকুমেন্টারি পরিবেশিত হয়। প্রধানমন্ত্রী ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে খুলনা জেলার ডুমুরিয়া উপজেলার কাঁঠালতলা গ্রাম, নীলফামারি জেলার সৈয়দপুর উপজেলার কামারপুর গ্রাম, হবিগঞ্জের চুনারুঘাট এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার সদর উপজেলার উপকারভোগীদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন এবং তাদের হাতে সরকারীভাবে নির্মিত জমিসহ বাড়িগুলো উপহার হিসেবে হস্তান্তর করেন। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব তোফাজ্জল হোসেন মিয়া ভিডিও কনফারেন্সটি সঞ্চালনা করেন। প্রধানমন্ত্রী এই স্বল্প সময়ে সফলভাবে গৃহনির্মাণ এবং কাগজপত্র তৈরির মতো জটিল কাজ ঠিকাদার নিয়োগ না দিয়ে সম্পন্ন করতে পারায় জেলা প্রশাসন এবং তাঁর দফতর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়সহ স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও সর্বস্তরের কর্মকর্তাদের ধন্যবাদ জানান। এই চারটি স্থানের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী সরাসরি মতবিনিময় করলেও দেশের বিভিন্ন প্রান্তের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাগণ তাদের এবং স্থানীয় জনগণের ভিডিও বার্তা মূল অনুষ্ঠানে প্রেরণ করেন। নতুন গৃহপ্রবেশ উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে সারাদেশের উপকারভোগীদের নিয়ে বিশেষ মোনাজাত অনুষ্ঠিত হয়। সেইসঙ্গে উপকারভোগী পরিবার ও এই বিশাল কর্মযজ্ঞের সঙ্গে জড়িতদের মিষ্টি মুখও করানো হয়। ‘মুজিববর্ষে একজন মানুষও গৃহহীন থাকবে না’- প্রধানমন্ত্রী ও বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার এমন ঘোষণার ধারাবাহিকতায় শনিবার ৬৬ হাজার ১৮৯ বাড়ির মালিকানা দেয়া হলো গৃহহীন ও ভূমিহীন পরিবারগুলোর হাতে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পছন্দ করা নক্সায় নির্মাণ করা হয়েছে প্রতিটি বাড়ি। প্রতিটি বাড়িতে রয়েছে দুটি শয়ন কক্ষ, একটি লম্বা বারান্দা, একটি রান্নাঘর ও একটি টয়লেট। এসব ঘরের জন্য নিশ্চিত করা হয়েছে বিদ্যুত ও সুপেয় পানির ব্যবস্থা। পরিবারগুলোর কর্মসংস্থানের সুযোগ রেখেছে সরকার। এসব পরিবার শুধু ঘর নয়, সঙ্গে পেয়েছেন জমির মালিকানাও। প্রত্যেককে তার জমি ও ঘরের দলিল নিবন্ধন ও নামজারিও করে দেয়া হচ্ছে। দেশের ৫০ বছরের ইতিহাসে এর আগে একদিনে এত বেশি মানুষকে সরকারী ঘর হস্তান্তর করা হয়নি। সারাবিশ্বেও এমন একটির নজির নেই, যে অসম্ভবকে সম্ভব করে বাংলাদেশ যে এখন সব পারে, গোটা বিশ্ববাসীকে সেই জানানই দিয়েছে সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা। অনুষ্ঠানে জানানো হয়, ইতোমধ্যে সারাদেশের ৮ লাখ ৮৫ হাজার ৬শ’ ২২টি ভূমিহীন-গৃহহীন পরিবারের তালিকা প্রস্তুত করা হয়েছে। এ তালিকা অনুযায়ী গৃহ নির্মাণ ও পরিবার পুনর্বাসনের কার্যক্রম চলবে। পরে প্রধানমন্ত্রী উপকারভোগীদের সঙ্গেও ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে কথা বলেন। অনুষ্ঠানে রাজশাহীর ঐতিহ্যবাহী গম্ভীরা গানসহ উপকারভোগীরা গান গেয়ে এবং প্রধানমন্ত্রীর সুস্থ ও দীর্ঘায়ু কামনা করে সেøাগানও দিতে দেখা গেছে। আবেগজড়িত কণ্ঠে প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশের প্রতিটা মানুষ যাতে সুন্দরভাবে বাঁচতে পারে, তাদের জীবন যেন উন্নত হয়, বিশ্ব দরবারে আমরা বাঙালী হিসেবে মাথা উঁচু করে সম্মানের সঙ্গে যেন চলতে পারি। এদেশটাকে জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলা হিসেবে গড়তে পারি। বাংলাদেশের প্রত্যেকটা মানুষ যেন সুখে-শান্তিতে বসবাস করতে পারে- সেটাই আমার একমাত্র লক্ষ্য। মুজিববর্ষ এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে কোন মানুষ গৃহহারা থাকবে না। মুজিববর্ষে অনেক কর্মসূচী করতে পারিনি করোনার কারণে। কারণ করোনা একদিকে কিছুটা আশীর্বাদও হয়েছে, কারণ আমরা এই একটি কাজের দিকেই (ভূমিহীনদের ঘর করে দেয়া) নজর দিতে পেরেছি। গৃহহীন-ভূমিহীন মানুষকে ঘর দিতে পারলাম, এর থেকে বড় উৎসব বাংলাদেশে হতে পারে না। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের সম্পদের সীমাবদ্ধতা রয়েছে তারপরেও সীমিত আকারে আমরা করে দিচ্ছি এবং একটা ঠিকানা আমি সমস্ত মানুষের জন্য করে দেব। কারণ আমি বিশ^াস করি যখন এই মানুষগুলো ঘরে থাকবে তখন আমার বাবা এবং মা-যারা সারাটা জীবন এদেশের জন্য তাগ স্বীকার করে গিয়েছেন তাদের আত্মা শান্তি পাবে। তিনি বলেন, আজকে আমি সবচেয়ে খুশি যে এত অল্প সময়ে এত পরিবারকে আমরা একটা ঠিকানা দিতে পেরেছি। এই শীতের মধ্যে তারা থাকতে পারবে। কেননা আমাদের যারা শরণার্থী (রোহিঙ্গা) তাদের জন্যও আমরা ভাসানচরে ঘর করে দিয়েছি। প্রধানমন্ত্রী বলেন, খালেদা জিয়া যখন ক্ষমতায় ছিল ’৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্তদেরও কক্সবাজার এবং পিরোজপুরে আমরা ফ্লাট করে দিয়েছি অর্থাৎ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্তদেরও ঘর করে দিয়েছি এবং সেখানে শীঘ্রই আরও ১শ’টি ভবন তৈরি করা হবে। আজ এক লাখ ৬৬ হাজার ১৮৯টি ঘর করে দিলাম এবং শীঘ্রই আরও এক লাখ ঘর আমরা করে দেব। তিনি বলেন, এত দ্রুত সময়ে পৃথিবীর কোন দেশে কোন সময় কোন সরকার একসঙ্গে ৬৬ হাজার ১৮৯টি ঘর করে দিয়েছে কি-না আমার জানা নেই। সরকারপ্রধান বলেন, যেহেতু যারা প্রশাসনে রয়েছেন তারা সরাসরি ঘরগুলো তৈরি করেছেন। তাই সম্ভব হয়েছে এবং মানসম্মত হয়েছে, সেজন্য সবাইকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আমাদের সরকারী কর্মচারীরা যেভাবে সবসময় আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করেছেন এটা অতুলনীয়। আর সেই সঙ্গে আমাদের নির্বাচিত প্রতিনিধি সংসদ সদস্য, উপজেলা চেয়ারম্যান, মেয়র থেকে শুরু করে সকলে সহযোগিতা করেছেন। এই একটি কাজে আমরা দেখেছি সকলের সম্মিলিত প্রয়াস। তাই আজ আমরা এত বড় একটা দায়িত্ব পালন করতে পেরেছি। তিনি বলেন, এই গৃহায়ন প্রকল্পে কোন শ্রেণী বাদ যাচ্ছে না, বেদে শ্রেণীকেও আমরা ঘর করে দিয়েছি। হিজড়াদের স্বীকৃতি দিয়েছি এবং তাদেরও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। দলিত বা হরিজন শ্রেণীর জন্য উচ্চমানের ফ্লাট তৈরি করে দিচ্ছি। চা শ্রমিকদের জন্য করে দিয়েছি। এভাবে প্রত্যেকটা শ্রেণীর মানুষের পুনর্বাসনে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। উদ্বোধনী বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সাধারণ মানুষের ঘর করে দেয়ার চিন্তাটা বঙ্গবন্ধুই প্রথম করেছিলেন। জাতির পিতা তাঁর সাড়ে তিন বছরের দেশ পরিচালনায় যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনকালে যে সংবিধান প্রণয়ন করেন তাঁর ১৫(ক) অনুচ্ছেদে দেশের প্রতিটি নাগরিকের বাসস্থান পাওয়ার অধিকারের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করে যান। জাতির পিতা গৃহহীন-অসহায় মানুষের পুনর্বাসনে উদ্যোগও গ্রহণ করেছিলেন। জাতির পিতা ১৯৭২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি নোয়াখালী জেলার (বর্তমান লক্ষ্মীপুর জেলা) চরপোড়াগাছা গ্রাম পরিদর্শনে যান এবং ভূমি ও গৃহহীন অসহায় মানুষের পুনর্বাসনের নির্দেশ দেন। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনাতেই ভূমি ও গৃহহীন, ছিন্নমূল মানুষের পুনর্বাসন কার্যক্রম শুরু হয়। শেখ হাসিনা বলেন, ১৯৭৫ সালে আমাদের পুরো পরিবারকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। আমাকে ছয় বছর কাটাতে হয় বাইরে। শুধু মানুষের কথা ভেবে, মানুষের শক্তি নিয়েই দেশে ফিরি। আমার কেউ ছিল না এবং আমার কোন থাকারও ঘর নাই। আমি কোথায় গিয়ে উঠব তাও আমি জানি না। আমি কিভাবে চলব তাও জানি না। কিন্তু আমার কেবলই কটা কথা মনে হচ্ছিল যে, আমাকে যেতে হবে। যেতে হবে এই কারণে যে সামরিক শাসক দিয়ে নিষ্পেষিত হচ্ছে আমার দেশের মানুষ। তাদের মুক্তি দিতে হবে। তাদের অধিকার ফিরিয়ে দিতে হবে। তাদের জন্য কাজ করতে হবে। সেই আদর্শ সামনে নিয়ে আমি ফিরে আসি। আমি কখনও আমার ছোট ফুফুর বাড়ি, কখনও মেজো ফুফুর বাড়ি- এরকমভাবে দিন কাটাই। কিন্তু আমার লক্ষ্য একটাই সামনে ছিল যে- আমি কী পেলাম, না পেলাম সেটা বড় কথা নয়। দেশের মানুষের জন্য কতটুকু কী করব সেটাই বড় কথা। ওই সময় সমগ্র বাংলাদেশ ঘুরে মানুষের দুঃখ কষ্ট দেখেছি। তিনি বলেন, আজকে সত্যিই আমার জন্য একটা আনন্দের দিন। কারণ এদেশে যারা সব থেকে বঞ্চিত মানুষ, যাদের কোন ঠিকানা ছিল না, ঘরবাড়ি ছিল না তাদের অন্তত একটা ঠিকানা, মাথা গোঁজার ঠাঁই করে দিতে পারছি। এজন্যই আমার বাবা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সারাজীবন সংগ্রাম করেছেন। তাদের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্যই নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন। কখনও নিজের জন্য নিজে কী পেলেন, না পেলেন সেটা চিন্তা করেননি। এদেশের মানুষের কথাই অজীবন চিন্তা করেছেন। বিএনপি-জামায়াত জোটের সমালোচনা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিএনপি-জামায়াত সরকার ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকাকালীন বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের ’৯৭ পরবর্তী সময়ে চালু করা আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে ভূমিহীনদের ঘর দেয়ার প্রকল্পটি বন্ধ করে দেয়। ২০০১ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত সময় বাংলাদেশের জন্য একটি অন্ধকার যুগ ছিল। সন্ত্রাস, জঙ্গীবাদ, নৈরাজ্যের কারণেই দেশে জরুরী অবস্থা জারি করা হয়েছিল। সে সময়ে বিরোধী দলে থাকলেও বিনা কারণে কারাবন্দী হওয়ার স্মৃতিচারণ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বন্দী হয়ে গেলাম আমি। তারপরেও আমি আশা ছাড়িনি, আল্লাহ একদিন সময় দেবে এবং এদেশের মানুষের জন্য কাজ করতে পারব। তিনি ভোট দিয়ে আওয়ামী লীগকে জয় যুক্ত করায় পুনরায় জনগণের প্রতি কৃতজ্ঞতা ব্যক্ত করে বলেন, নৌকা মার্কায় ভোট পেয়েছিলাম বলেই জয়ী হয়ে ২০০৯ সালে সরকার গঠন করতে পারলাম এবং পুনরায় আমাদের প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন শুরু করলাম। করোনাভাইরাসের কারণে বিশ্বের স্থবিরতায় ঘরগুলো হস্তান্তরকালে সশরীরে ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকতে না পারার আক্ষেপ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘ইচ্ছে ছিল নিজ হাতে আপনাদের কাছে বাড়ির দলিলগুলো তুলে দেব। কিন্তু এই করোনাভাইরাসের কারণে সেটা করতে পারলাম না। তবে, প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তুলেছিলাম বলেই আপনাদের সামনে এভাবে হাজির হতে পেরেছি। তিনি বলেন, ইতোমধ্যে আমরা একটা হিসাব নিয়েছি, সারাদেশে আমাদের যেমন ভূমিহীন লোকও আছে, আবার হয়ত ভিটা আছে কিন্তু ঘরবাড়ি নেই। ঠিক এভাবেই হিসাব করে প্রায় ৮ লাখ ৮৫ হাজার মানুষের তালিকা আমরা করেছি। সরকারের পাশাপাশি দেশের বিত্তশালীদেরও এ কাজে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, যারা বিত্তশালী আছে, তাদেরও আহ্বান করব- যার যার নিজ এলাকায় তারাও খুঁজে দেখতে পারেন। যারা গৃহহীন, তাদের একটা গৃহ তৈরি করে দেয়া বা তাদের জীবনটাকে অর্থবহ করে দেয়ার কাজটি করবেন- এটাই আমাদের প্রত্যাশা। গণতান্ত্রিক অধিকারটা কী? প্রধানমন্ত্রী তাঁর বক্তব্যে ’৭৫ পরবর্তী সরকারগুলোর বিশেষ করে সেনাশাসক জিয়াউর রহমানের তথাকথিত গণতন্ত্রায়নের নামে দেশের বি-রাজনীতিকরণেরও কঠোর সমালোচনা করেন। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, অনেকে গাল ভরে কথা বলে গণতান্ত্রিক অধিকার পেয়েছে, গণতান্ত্রিক অধিকারটা কী? একজন মিলিটারি ডিক্টেটর রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে একদিন ঘোষণা দিল আজকে রাষ্ট্রপতি হলাম, আর সেটাই গণতন্ত্র হয়ে গেল? তিনি বলেন, ওই সময় অনেক রাজনৈতিক দল করার সুযোগ করে দিল (যুদ্ধাপরাধী এবং কারাগারে আটক খুনী অপরাধীদের) কিন্তু মানুষকে দুর্নীতি করার, মানি লন্ডারিং করা, ব্যাংকে ঋণখেলাপী করা, টাকা ব্যাংক থেকে ছাপিয়ে নিয়ে এসে সেগুলো ছড়িয়ে দিয়ে ‘মানি ইজ নো প্রবলেম’ সেই কথা শুনানো। ‘আই উইল মেক ডিফিকাল্ট ফর দ্য পলিটিশিয়ান’- এ কথাও জিয়াউর রহমান বলে গেছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, জিয়াউর রহমানের কাজই ছিল এদেশের মানুষের ভাগ্য নিয়ে খেলা, এদেশের মানুষকে দরিদ্র থেকে দরিদ্র করে রাখা, আর মুষ্টিমেয় লোককে টাকা পয়সা দিয়ে একটু অর্থশালী-সম্পদশালী করে দিয়ে তাদেরও তাঁর (জিয়াউর রহমান) ক্ষমতাকে যেন চিরস্থায়ীভাবে ব্যবহার করতে পারে, তার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা। মেধাবী ছেলে-মেয়েদের হাতে অস্ত্র তুলে দিয়ে তাদের বিপথে ঠেলে দেয়া, নির্বাচনের নামে প্রহসন সবই করা হয়েছে। জিয়াউর রহমানের নির্বাচনের নামে প্রহসনের উদাহরণ টেনে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা বলেন, ‘হ্যাঁ-না’ ভোটে ‘না’ বাক্স না রাখা বা বা ‘হ্যাঁ’ বাক্সে ১১০ শতাংশ ভোট পড়ার ঘটনাও ঘটেছে। তারপর সংসদ নির্বাচন দিল, সেটাও আরেক প্রহসন। তিনি বলেন, যারা গণতন্ত্র নিয়ে আজকে কথা বলেন তাদের কাছে আমার এটাই প্রশ্ন্ন এটা কি করে গণতন্ত্র হতে পারে? একটা দল (বিএনপি) হলো, হাঁটতে চলতেও শিখল না। ক্ষমতায় বসে, ক্ষমতার উচ্ছিষ্ট বিলিয়ে যে দলের সৃষ্টি, সেই ক্ষমতায় আসে, আর মানুষ পায় না- এটা হয় কখনও? জিয়ার পর এরশাদ এসেছে, খালেদা জিয়া এসেছে- প্রত্যেকেরই একই চরিত্র। আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়ে দেশ পরিচালনার সুযোগ প্রদানের জন্য দেশবাসীকে আবারও ধন্যবাদ জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়েছিলেন বলেই ১৯৯৬ সালে আমরা ক্ষমতায় আসতে পারি। জনগণই কিন্তু ভোট চুরির অপরাধে খালেদা জিয়াকে পদত্যাগ বাধ্য করে। আমাদের অগ্রাধিকার ছিল খেটে খাওয়া মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন করা। ২০০৮ সালের নির্বাচনে জনগণ আবারও আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়েছিল বলেই আমরা থমকে যাওয়া প্রকল্পগুলো আবার শুরু করতে পারি। প্রধানমন্ত্রী বলেন, প্রত্যেক শ্রেণীর মানুষের জন্য কাজ করে যাচ্ছি যেন সবাই মানসম্মতভাবে বাঁচতে পারে। বিশে^র দরবারের সম্মানের সঙ্গে মাথা উঁচু করে যেন চলতে পারি, সেটাই আমাদের প্রত্যাশা। হয়ত সম্পদের সীমাবদ্ধতা আছে, তবে গৃহহীন সব মানুষকে একটা ঠিকানা আমি করে দেব। এ সময় বাংলাদেশকে জাতির পিতার স্বপ্নের উন্নত-সমৃদ্ধ সোনার বাংলাদেশ হিসেবে গড়ে তোলায় সকলের দোয়া এবং সহযোগিতার প্রত্যাশাও পুনর্ব্যক্ত করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
×