ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

দেশের ছোট দলগুলো অস্তিত্ব সঙ্কটে, ১০টি বিলুপ্ত

প্রকাশিত: ২২:৩৭, ২৩ জানুয়ারি ২০২১

দেশের ছোট দলগুলো অস্তিত্ব সঙ্কটে, ১০টি বিলুপ্ত

রাজন ভট্টাচার্য ॥ অস্তিত্ব সঙ্কটে দেশের ছোট রাজনৈতিক দলগুলো। দিন দিন এসব দলের ভোট কমছে। কমছে গ্রহণযোগ্যতা, কদর। সাংগঠনিক শক্তি কমে যাওয়ায় সংসদেও বিভিন্ন দলের একক প্রতিনিধিত্ব কমছে। টিকে থাকার প্রয়োজনে বড় দলগুলোর তুরুপের তাসে পরিণত হয়েছে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলগুলো। বেশিরভাগ ছোট দল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোটে নিজেদের যুক্ত করেছে। পাওয়া না পাওয়ার হিসাবে ক্ষোভ থাকলেও এসব দল প্রধান শরিকের প্রতি অনুগত। তাছাড়া কোন্দলের আগুনে পুড়ে খণ্ড বিখণ্ড বাম দলগুলো রাজনীতি। গত প্রায় এক দশকে বিরোধী রাজনীতি কার্যত শিকেয় উঠেছে। ১৫ বছরে ২০টি রাজনৈতিক দল এলেও সবকটি জনসমর্থন আদায়ে ব্যর্থ হয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে দেশের রাজনীতিতে শক্তিশালী দল বা জোট আসাও অনিশ্চিত। গত ১১ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ফলাফল হিসাব করে দেখা গেছে, ১৯৭৩-২০১৮ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন নির্বাচনে অংশ নিয়ে সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী ১০টির বেশি রাজনৈতিক দলের এখন আর কোন অস্তিত্ব নেই। ১৯৯১ সালের পর সিপিবি ও ন্যাপ মোজাফফর দলের পক্ষে থেকে সরাসরি ভোটে কেউ পাস করতে পারেনি। ২৭ বছরে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন গণফোমের পক্ষ থেকে একাদশ সংসদে প্রথম ঐক্যফ্রন্টের ব্যানারে দুইজন নির্বাচিত হয়েছেন। এরমধ্যে ১৯৯৬ সাল থেকে প্রায় ২৫ বছর সংসদে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে মাত্র ১৪টি দল প্রতিনিধিত্ব করে আসছে। এরমধ্যে সাত দলের প্রার্থীরা কমবেশি সবকটি নির্বাচনেই সংসদে প্রতিনিধিত্ব করেছে। আবার কোনটি এক থেকে দুইবার। কোনটি একবার। বর্তমানে নিবন্ধিত ৪৫টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে নাম সর্বস্ব সংখ্যা বাড়ছে। যাদের ভোটের রাজনীতিতে কত ভাগ অংশীদারিত্ব তা নিয়েও প্রশ্ন আছে। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো ছোট ছোট রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের শক্তি না বাড়িয়ে বারবার পড়ছে ভাঙ্গনের মুখে। নেতৃত্বের কোন্দল, রাজনৈতিক মতপার্থক্যের কারণে আদর্শিক দলগুলো ভেঙে খান খান। যোগ্য নেতৃত্বের অভাবেও তৃতীয় বৃহৎ রাজনৈতিক শক্তি গড়ে উঠছে না। সেইসঙ্গে বড় দলগুলোর মধ্যেও এ নিয়ে রয়েছে সঙ্কীর্ণতা। গত ১৫ বছরে ২০টির বেশি রাজনৈতিক দলের আবির্ভাব দেখা গেলেও কোনটিই মানুষের সমর্থন আদায় করতে পারেনি। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা বলছেন, তৃতীয় শক্তিধর রাজনৈতিক দল জাতীয় পার্টি এখন পাঁচটি ধারায় বিভক্ত, এক সময়ের ন্যাপও এখন পাঁচ ধারায় চলছে। ওয়ার্কার্স ও জাসদেও রয়েছে তিনটি ধারা। ভাঙনের মুখে গণফোরাম। বিকল্পধারা ও এলডিপি, তরিকত ফেডারেশনসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলে ভাঙন রয়েছে। প্রশ্ন হলো নতুন রাজনৈতিক দলগুলো কেন শক্তিশালী হতে পারছে না। কেনই বা এসব দল ‘জোট নির্ভর’ রাজনীতিতে বিশ্বাসী। তাছাড়া পুরনো ছোট দলগুলোও দিন দিন ছোট হয়ে আসছে। প্রবীণ রাজনীতিক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক থেকে শুরু করে দেশের বিশিষ্টজনরা বলছেন, নতুন দলগুলো সাধারণ মানুষের জন্য ব্যতিক্রম চিন্তা বা জনমুখী কর্মসূচী নিয়ে ভোটারদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে ব্যর্থ হচ্ছে। বাস্তবতা বিবর্জিত রাজনৈতিক দর্শনের কারণেও অনেক দল মানুষের কাছাকাছি পৌঁছাতে পারেনি। ফলে জনসমর্থন বাড়ছে না। এজন্য সাধারণ মানুষ পুরনো বড় দলগুলোর বৃত্তেই বন্দউ। সেইসঙ্গে পুরনো ছোট দলগুলো আস্তে আস্তে সাংগঠনিক শক্তি হারিয়ে বড় দলগুলোতে বিলীন হতে চলেছে। তৃতীয় প্রধান রাজনৈতিক দল হিসেবে জাতীয় পার্টি দিন দিন শক্তি হারাচ্ছে। সেইসঙ্গে বড় দলগুলোর কঠোর নীতির কারণে তৃতীয় বৃহৎ রাজনৈতিক দল বা জোট তৈরি হচ্ছে না বলেও মনে করেন অনেকে। জানতে চাইলে প্রবীণ রাজনীতিক নূরুর রহমান সেলিম বলেন, বড় বড় রাজনৈতিক দলগুলো কখনই চায় না নতুন কোন রাজনৈতিক শক্তি দেশে বেড়ে উঠুক। অন্য দেশের মতো আমাদের দেশের বড় বড় দলগুলো ছোট দলগুলোকে এক হতে দিচ্ছে না। বড় রাজনৈতিক শক্তিগুলো সব সময় মনে করে নতুন কোন দল বা জোট শক্তিশালী হলে নিজেদের রাজনীতি শেষ হয়ে যাবে। এই জায়গা থেকে আমরা রাজনীতিতে নতুন কিছু পাচ্ছি না। ছোট ছোট দলগুলোতে মতপার্থক্য ও নেতৃত্বের লোভে টুকরো টুকরো উল্লেখ করে তিনি বলেন, এমন অনেক দল আছে সেগুলো কত ভাগে বিভক্ত কেউ জানে না। সেইসঙ্গে তৃতীয় রাজনৈতিক ধারা সৃষ্টির জন্য ভাল লিডারশিপ নেই। ফলে ছোট দলগুলোর সংসদে একক অংশীদারিত্ব যেমন কমছে তেমনি দিন দিন সাংগঠনিক শক্তি হারিয়ে বড় দলে মিশে যাচ্ছে। পাশাপাশি এক সময়ের শক্তিশালী অনেক রাজনৈতিক দল একেবারেই বিলীন হয়ে গেছে। যা একটি গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার জন্য সুখকর নয়। দেশপ্রেম ও প্রকৃত রাজনৈতিক দর্শন বা আদর্শ না থাকায় দেশের রাজনৈতিক বিকাশ হচ্ছে না বলে মনে করেন বিশিষ্ট রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী। তিনি বলেন, দেশের সবকটি দলেই প্রকৃত অর্থে রাজনৈতিক দর্শনের অভাব রয়েছে। মূলধারার রাজনীতি যেখানে দুর্বল, অনেকটা লক্ষ্যহীন সেখানে তৃতীয় রাজনৈতিক শক্তি সৃষ্টির কোন সম্ভাবনা নেই। সবচেয়ে বড় কথা হলো রাজনীতির দ্বিতীয় ধারা হিসেবে বিএনপিও লক্ষ্যচ্যুত। তিনি বলেন, ২০১৩ সালে হেফাজতের সাম্প্রদায়িক ইস্যুর পর বড় দলগুলোর সমর্থকরা অর্ধেক অর্ধেক সাম্প্রদায়িক চেতনার সঙ্গে নিজেদের যুক্ত করে ফেলেছেন। বাস্তবে তাদের মধ্যে কোন চেতনা নেই। তবে মুখে মুখে অনেকেই অসাম্প্রদায়িকতার কথা বলছেন। তিনি বলেন, ১৯৯১ সালে সাম্প্রদায়িক ইস্যুতে আওয়ামী লীগ বড় রকমের ধাক্কা খাওয়ার পর এখন এ দলটি প্রকৃত রাজনৈতিক চর্চার মধ্যে নেই। এটা দেশের রাজনীতিতে বড় সঙ্কট। আগামীতে বিএনপির যেমন উত্থান হওয়া কঠিন তেমনি তৃতীয় রাজনৈতিক শক্তির বিকাশ এত সহজ হবে না। রাজনীতিতে এমন সম্ভাবনাও দেখছি না। তিনি বলেন, বাম ধারার দলগুলো যদি বাস্তববোধের রাজনীতি করত তাহলে সমাজের একটি সচেতন অংশ তাদের সঙ্গে থাকত। বাম নেতারা শিক্ষিত ও জানাশোনা হলেও মানুষ তাদের গ্রহণ করে না। গণতন্ত্র সব সময় সেকুলার এ কথা উল্লেখ করে প্রবীণ এই রাজনৈতিক বিশ্লেষক বলেন, ’৭৫ এর পর জিয়াউর রহমান বোলডোজার দিয়ে রাজনীতির আদর্শকে গুঁড়িয়ে দিয়েছেন। ’৯১ সালে অসাম্প্রদায়িক চেতনার যখন বিকাশ ঘটছে ঠিক তখন স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের কারণে সবকিছু স্থিমিত হয়ে যায়। মোট কথা হলো বাস্তব বিজর্জিত রাজনীতি সব দলে চলছে। মূলত এ কারণেই রাজনীতির বিকাশ ঘটছে না। ছোট দলগুলো আরও ছোট হয়ে বড় দলে বিলীন হচ্ছে। যোগ্য নেতৃত্ব ও সঠিক দর্শন নিয়ে নতুন ধারার রাজনীতি দেখছি না। সাম্প্রতিক সময়ে যেসব দল সামনে এসেছে সবই কাগজে কলমে সীমাবদ্ধ। তাছাড়া বড় সমস্যা হলো দেশের সব মানুষ রাজনীতি করে কিন্তু রাজনৈতিকভাবে কেউই সচেতন নয়। মমতাজউদ্দীন বলেন, বঙ্গবন্ধু ও চার নেতা হত্যার মধ্য দিয়ে মূলধারার রাজনীতিতে বিলীন করার চেষ্টা হয়েছে। এই সুযোগে বিএনপি-জামায়াতসহ সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক গোষ্ঠী সমাজে দাঁড়িয়েছে। তারা আদর্শ সম্পর্কে সচেতন ছিল না। তাদের রাজনীতি ছিল সস্তা ইস্যু অর্থাৎ সাম্প্রদায়িক রাজনীতি, ধর্মীয় আদর্শ ও ভারত বিরোধিতা। মুসলিম ছাড়া অন্যদের বিরোধিতার চোখে দেখা। অর্থাৎ পাকিস্তানের ভাবাদর্শের নীতি। মূলত সাম্প্রদায়িক দল ও চিন্তা দিয়ে গণতন্ত্র হয় না। ’৭৫ পর দীর্ঘ সময় দেশে গণতন্ত্র ছিল না। মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল ভেঙে টুকরো করা হয়েছিল। সব মিলিয়ে রাজনীতিতে ভাল কিছু হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়নি। তিন দলের ৪৭ বছর ॥ স্বাধীনতার পর একাদশ সংসদ নির্বাচনসহ মোট ১১ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঘুরে ফিরে তিনটি রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় আসে। এরইমধ্যে আওয়ামী লীগ পাঁচবার। বিএনপি চারবার। জাতীয় পার্টি দুবার জয়লাভ করে সরকার গঠন করে। আওয়ামী লীগ প্রথম, সপ্তম, নবম, দশম ও একাদশ সংসদ নির্বাচনে; বিএনপি দ্বিতীয়, পঞ্চম, ষষ্ঠ ও অষ্টম সংসদ নির্বাচনে জয়লাভ করে। জাতীয় পার্টি তৃতীয় ও চতুর্থ সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হয়। সংসদের মেয়াদ পাঁচ বছর হলেও প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ ও ষষ্ঠ সংসদ রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেনি। তবে পঞ্চম, সপ্তম, অষ্টম, নবম ও দশম সংসদ এর মেয়াদকাল পূরণ করে। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন শেষে ইতোমধ্যে সরকার দুই বছর পূর্তি পালন করল। এরমধ্যে নতুন কোন রাজনৈতিক দলকে ওঠে দাঁড়াতে দেখা যায়নি। ১১ নির্বাচনে ভোটের চিত্র ॥ জাতীয় সংসদ নির্বাচনগুলোর মধ্যে ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত নবম সংসদ নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি ভোট পড়ে। এ নির্বাচনে সর্বোচ্চ ৮৭ শতাংশ ভোট পড়ে। অন্যদিকে ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সবচেয়ে কম ভোট পড়ে। এ নির্বাচনে ২৬ দশমমিক ৫ ভাগ ভোট পড়ে। এছাড়া প্রথম সংসদ নির্বাচনে ভোট পড়ে ৫৪ দশমিক ৯ শতাংশ, দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচনে ৫১ দশমিক ৩ শতাংশ, তৃতীয় সংসদ নির্বাচনে ৬১ দশমিক ৩ শতাংশ, চতুর্থ সংসদ নির্বাচনে ৫২ দশমিক ৫ শতাংশ, পঞ্চম সংসদ নির্বাচনে ৫৫ দশমিক ৪ শতাংশ, সপ্তম সংসদ নির্বাচনে ৭৫ দশমিক ৪৯ শতাংশ, অষ্টম সংসদ নির্বাচনে ৭৫ শতাংশ ও দশম সংসদ নির্বাচনে প্রায় ৪০ শতাংশ সর্বশেষ একাদশ সংসদ নির্বাচনে ৮০ ভাগ ভোট পড়ার কথা নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। নিবন্ধিত ৪৪ দলের মধ্যে প্রতিনিধিত্ব আছে আটটির ॥ নির্বাচন কমিশনের সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের সংখ্যা এখন ৪৪। এগুলোর মধ্যে রয়েছে, এলডিপি, জেপি (মঞ্জু), সাম্যবাদী দল, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ, সিপিবি, আওয়ামী লীগ, বিএনপি, গণতন্ত্রী পার্টি, বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, ওয়ার্কার্স পার্টি, বিকল্পধারা বাংলাদেশ, জাতীয় পার্টি (এরশাদ), জাসদ, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি), জাকের পার্টি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ), বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি), তরিকত ফেডারেশন, খেলাফত আন্দোলন, বাংলাদেশ মুসলীম লীগ, ন্যাশনাল পিপলস পার্টি (এনপিপি), জমিয়তে ওলামায়ে ইসলাম, গণফোরাম, গণফ্রন্ট, বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ), বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি, ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশ, কল্যাণ পার্টি, ইসলামী ঐক্যজোট, খেলাফত মজলিশ, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট, জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি (জাগপা), বাংলাদেশ বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, খেলাফত মজলিশ, বাংলাদেশ মুসলিম লীগ (বিএমএল), বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক মুক্তি জোট, বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্ট (বিএনএফ), জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন (এনডিএম) ও বাংলাদেশ কংগ্রেস। হিসাবে দেখা গেছে, ৪৪টি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের মধ্যে সংসদে প্রতিনিধিত্ব করছে মাত্র আটটি দল। এরমধ্যে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দল তথা মহাজোট ও বিএনপির ২১ দলীয় জোট তথা ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে যুক্ত সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী সবকটি দল। এগুলোর মধ্যে রয়েছে, আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি (এরশাদ), ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ, গণফোরাম, তরিকত ফেডারেশন ও বিকল্পধারা বাংলাদেশ। নিবন্ধিত দলগুলোর বেশিরভাগই দুর্বল। তাদের জনসমর্থন নেই। ফলে নির্বাচনে দাঁড়ালেও অনেক দলের প্রার্থীরা জামানত হারাচ্ছেন। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ॥ ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনে ৩৯টি নিবন্ধিত দলের সব কয়টি দল অংশগ্রহণ করে। নির্বাচনে মোট প্রার্থীর সংখ্যা ছিল ১ হাজার ৮৬১ জন। এর মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ১ হাজার ৭৩৩ জন এবং ১২৮ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশ নেয়। ৩০০ আসনের মধ্যে ১টি আসনের প্রার্থী মারা যাওয়ায় ২৯৯টি আসনে নির্বাচন হয়। ১টি আসনের ফলাফল স্থগিত থাকায় বাকি ২৯৮টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ নৌকা প্রতীকে এককভাবে ২৫৯টি আসনে জয়লাভ করে। এছাড়াও জাতীয় পার্টি লাঙ্গল প্রতীকে ২০টি, বিএনপি ধানের শীষ প্রতীকে ৫টি, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি ৩টি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) ২টি, বিকল্পধারা বাংলাদেশ ২টি এবং জাতীয় পার্টি (জেপি) ১টি, তরিকত ফেডারেশন ২টি , গণফোরাম ২টি আসনে জয়লাভ করে। অন্যদিকে, ৩টি আসনে জয় পেয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। এর বাইরে অনেক দলের পক্ষ থেকে পৃথক পৃথক অংশ নিলেও সেসব প্রার্থীরা জামানত হারিয়েছেন। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন ॥ ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি বাংলাদেশের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনে ৩০০ আসনের মধ্যে ১৫৩টি আসনে প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। বাকি ১৪৭ আসনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মোট ২৩৪টি, জাতীয় পার্টি ৩৪টি, ওয়ার্কার্স পার্টি ৬টি, জাসদ ৫টি, জাতীয় পার্টি (জেপি) ২টি, তরিকত ফেডারেশন ২টি, বিএনএফ ১টি, স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ১৬ আসনে জয়লাভ করেন। প্রধান বিরোধী দল বিএনপিসহ অধিকাংশ রাজনৈতিক দল এই নির্বাচন বর্জন করে। ১৭টি দল এতে অংশ নিয়েছিল। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন ॥ ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নবম সংসদে আওয়ামী লীগ ২৩০ আসনে জয়লাভ করে। এই নির্বাচনে বিএনপি ৩০, জাতীয় পার্টি ২৭, জাসদ ৩, জামায়াত ইসলামী ২টি, ওয়ার্কার্স পার্টি ২, বিজেপি ১, এলডিপি ১ ও স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ৪টি আসনে জয়লাভ করে। ১০ রাজনৈতিক দল এতে অংশ নিয়েছিল। অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচন ॥ ২০০১ সালের ১ অক্টোবর অষ্টম সংসদ নির্বাচেন বিএনপি ১৯৩ আসনে জয়লাভ করে। এছাড়াও আওয়ামী লীগ ৬২, জাতীয় পার্টি ১৪, জামায়াত ইসলামী ১৭, বিজেপি ৪, জেপি (মঞ্জু) ১, ইসলামী ঐক্যজোট ২, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ ১ ও স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ৬ আসনে বিজয়ী হয়। ৫৪ রাজনৈতিক দল এই নির্বাচনে অংশ নেয়। সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচন ॥ ১৯৯৬ সালের ১২ জুন অনুষ্ঠিত সপ্তম সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ১৪৬ আসনে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করে। এছাড়াও নির্বাচনে বিএনপি ১১৬, জাতীয় পার্টি ৩২, জামায়াত ইসলামী ৩, ইসলামী ঐক্যজোট ১, জাসদ ১ ও স্বতন্ত্র প্রার্থী ১টি আসনে বিজয়ী হয়। এ নির্বাচনে ২৮১ জন স্বতন্ত্র প্রার্থীসহ ৮১টি দল থেকে দুই হাজার ৫৭৪ প্রার্থী অংশ নেন। ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ॥ ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত হয় ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। তিন দল এতে অংশ নেয়। নির্বাচনে বিএনপি ২৭৮ আসনে, ফ্রিডম পার্টি ১টি এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ১০ আসনে জয়লাভ করে। বাকি ১১ আসনে ভোটগ্রহণ গোলযোগের কারণে স্থগিত থাকে। নির্বাচনে ৪৯ আসনে প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী হয়। আওয়ামী লীগ জাতীয় পার্টিসহ প্রায় সব বিরোধী দল এই নির্বাচন বর্জন করে। ফলে তিন পাঁচ মাসের মধ্যে আরেকটি নির্বাচন দিতে হয়। এ সংসদের মেয়াদ ছিল ১১ দিন। পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচন ॥ ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারিতে পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়। এতে ৭৫টি দল অংশ নেয়। বিএনপি ১৪০টি আসনে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করে। এছাড়াও আওয়ামী লীগ ৮৮, জাতীয় পার্টি ৩৫, বাংলাদেশ জামায়াত ইসলামী ১৮, সিপিবি ৫, বাংলাদেশ, কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল) ৫টি, জাসদ (সিরাজ) ১টি, ইসলামী ঐক্যজোট ১, ওয়ার্কার্স পার্টি ১, এনডিপি ১, গণতন্ত্রী পার্টি ১, ন্যাপ (মোজাফফর) ১, অনান্য দল ৩ আসনে জয়লাভ করে। এই নির্বাচনের পর ন্যাপ, গণতন্ত্রী পার্টি, এনডিপি, কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ আর কোন নির্বাচনে বিজয়ী হতে পারেনি। চতুর্থ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ॥ ১৯৮৮ সালের ৩ মার্চ চতুর্থ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে জাতীয় পার্টি ২৫১টি আসনে জয়লাভ করে। ছয়টি দলের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আ স ম আব্দুর রব এর নেতৃত্বাধীন সম্মিলিত বিরোধী দল ১৯টি, জাসদ (সিরাজ) ৩টি, ফ্রিডম পার্টি ২টি এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ২৫টি আসনে বিজয়ী হন। এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, সিপিবিসহ অধিকাংশ রাজনৈতিক দল বর্জন করে। সংসদ নেতা নির্বাচিত হন মওদুদ/কাজী জাফর আহমেদ। বিরোধী দলের নেতা হন আ স ম আব্দু রব। সংসদের মেয়াদ ছিল দুই বছর সাত মাস। তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন ॥ ১৯৮৬ সালের ৭ মে তৃতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ১৩ দল এতে অংশ নেয়। এই নির্বাচনে জাতীয় পার্টি ১৫৩ আসনে বিজয়ী হয়। এছাড়াও আওয়ামী লীগ ৭৬, জামায়াত ইসলামী ১০, সিপিবি ৫, ন্যাপ (মোজাফফর) ২, ন্যাপ ৫, বাকশাল ৩, জাসদ (রব) ৪টি, জাসদ (সিরাজ) ৩টি, মুসলিম লীগ ৪, ওয়ার্কার্স পার্টি ৩টি এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ৩২ আসনে জয়লাভ করেন। বিএনপিসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দল এই নির্বাচন বর্জন করে। এ সংসদের মেয়াদ ছিল ১৭ মাস। দ্বিতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন ॥ ৩০টি রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণে ১৯৭৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি জিয়াউর রহমানের আমলে দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এতে বিএনপি ২০৭ আসনে জয়লাভ করে। এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে অংশগ্রহণ করে। এরমধ্যে আওয়ামী লীগ (মালেক) ৩৯, আওয়ামী লীগ (মিজান) ২, জাসদ ৮, মুসলিম লীগ ও ডেমোক্র্যাটিক লীগ ২০টি, ন্যাপ (মোজাফফর) ১টি, বাংলাদেশ জাতীয় লীগ ২, বাংলাদেশ গণফ্রন্ট ২, বাংলাদেশ সাম্যবাদী দল ১, বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক আন্দোলন ১, জাতীয় একদা পার্টি ১টি এবং ১৬ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা জয়লাভ করেন। সংসদের মেয়াদ ছিল তিন বছর। প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন ॥ বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ১৫ দল এ নির্বাচনে অংশ নেয়। এই নির্বাচনে ৩০০ আসনের মধ্যে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ নৌকা প্রতীক নিয়ে ২৯৩ আসনে জয়লাভ করে সরকার গঠন করে। এছাড়াও জাসদ ১, বাংলাদেশ জাতীয় লীগ ১ এবং ৫টি আসন স্বতন্ত্র প্রার্থীরা জয়লাভ করেন। প্রথম সংসদে ১১ প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। এ সংসদের মেয়াদ ছিল দুই বছর ছয় মাস।
×