ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

বর্গাকার স্থাপনা- সবাই বলে ফাঁসির মঞ্চ

প্রকাশিত: ২২:৩৬, ২৩ জানুয়ারি ২০২১

বর্গাকার স্থাপনা- সবাই বলে ফাঁসির মঞ্চ

সাজেদ রহমান ॥ ঝিকরগাছার পায়রাডাঙ্গার পুরনো স্থাপনা। সুউচ্চ বর্গাকার স্থাপনাটিকে সবাই বলেন ফাঁসির মঞ্চ। শিশু থেকে বৃদ্ধ- সবাই এটাকে ফাঁসির মঞ্চ হিসেবে জানেন। কিন্তু কার ফাঁসির মঞ্চ? এ প্রশ্নের কোন জবাব নেই। শুধু পায়রাডাঙ্গা নয়, আশপাশের মানুষ সবাই এটাকে ফাঁসির মঞ্চ বলে জানেন। কিন্তু তারা কেউ জানেন না, এখানে কাদের ফাঁসি দেয়া হয়েছিল। পাশের মির্জাপুর গ্রামের শাহ জামাল শিশির বলেন, ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি, এটা ফাঁসির মঞ্চ। আবার কেউ কেউ বলেন, এটা ওয়াচ টাওয়ার। এখানে নাকি ব্রিটিশ সৈন্যরা বসে আশপাশের সবকিছু পর্যবেক্ষণ করতেন। এর বেশি কিছু জানা যায় না। যশোরের ঝিকরগাছা ব্রিটিশ আমলে বিখ্যাত হয়ে আছে মোটা দাগে দুই কারণে। এক- নীলচাষের নির্মম সাক্ষী হিসেবে, দুই- ব্রিটিশ আমলের বিখ্যাত ‘অমৃতবাজার পত্রিকা’টির জন্ম ঝিকরগাছাতেই, পরবর্তীতে যেটা ভারতবর্ষের সবচেয়ে জনপ্রিয় পত্রিকা হিসেবে আবির্ভূত হয়। অথচ সাত দশক আগে যে জনপদ রঞ্জিত হয়েছিল আজাদ হিন্দের বীর শহীদদের পবিত্র রক্তে, কপোতাক্ষ নদে যাদের অন্তিম ঠাঁই হয়েছিল-তাদের কথা অনেকেরই অজানা, এমনকি সুকৌশলে ইতিহাসবিদদের কাছেও এই ইতিহাস একেবারেই অধরা। মুছে যাচ্ছে বীর সেনানীদের স্মৃতিচিহ্ন। নেই সংরক্ষণের কোন উদ্যোগ। পশ্চিমবঙ্গের ব্যারাকপুরের নীলগঞ্জে ব্রিটিশ আর্মির ট্রানজিট ক্যাম্পে বহু আজাদ হিন্দ সেনাদের ‘নেতাজি জিন্দাবাদ’ ‘আজাদহিন্দ জিন্দাবাদ’ ধ্বনি দেয়ার অপরাধে নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করা হয়। স্থানীয়দের সরব তৎপরতা ও নেতাজিপ্রেমী-গবেষকদের প্রয়াসে নীলগঞ্জ ট্র্যাজেডির অনেক কিছুই এখন উদ্ঘাটিত। কিন্তু দেশভাগের পরিণতিতে চাপা পড়ে যায় ঝিকরগাছার বর্বরতার ইতিহাস। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভারত সরকার নেতাজি ও আজাদ হিন্দ ফৌজসংক্রান্ত বেশকিছু সরকারী নথি সর্বসাধারণের জন্য উন্মূক্ত করলে সেখানেও মেলে ব্রিটিশ আর্মির ট্রানজিট ক্যাম্পগুলোতে বন্দী সেনানিদের ওপর বর্বরতার প্রমাণ। ব্যারাকপুরের নীলগঞ্জের সঙ্গে যশোরের ঝিকরগাছার নাম পাওয়া যাচ্ছে অসংখ্য ডকুমেন্টে। কানাইলাল বসুর ‘নেতাজি : রিডিসকভার্ড’ গ্রন্থেও স্পষ্ট করে রয়েছে ঝিকরগাছার নাম। লেখক সেখানে সংখ্যা উল্লেখ করতে না পারলেও বহু আজাদ হিন্দের সেনাদের এখানে অন্তরীণ রাখার কথা তিনি জানাচ্ছেন। এসব সেনার ভাগ্যে কী পরিণতি ঘটেছিল তা তিনি জানাতে পারেননি। সাত দশক আগে যে জনপদ রঞ্জিত হয়েছিল আজাদ হিন্দের বীর শহীদদের পবিত্র রক্তে, কপোতাক্ষ নদে যাদের অন্তিম ঠাঁই হয়েছিল তাদের কথা হয়ত অনেকে জানেন না। দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধের সময় রেল, নৌ ও সড়ক যোগাযোগের সুবিধার্থে ব্রিটিশ বাহিনী কলকাতা থেকে অগ্রগামী ঘাঁটি তৈরি করে ঝিকরগাছায়। যুদ্ধের শুরুতেই ১৯৩৯ সালে ঝিকরগাছা রেলস্টেশন, নৌ ঘাটসংলগ্ন এলাকার চারটি গ্রাম কৃষ্ণনগর, মোবারকপুর, পায়রাডাঙ্গা ও কীর্তিপুরে চারটি ক্যাম্প করে ব্রিটিশ সৈন্যরা। ১৯৪৫ সালে কিশোর তমিজ উদ্দিন মোড়লের স্মৃতিতে এখনও জ্বলজ্বল করছে সেইসব দিনের কথা। বর্তমানে বয়োবৃদ্ধ তমিজ মোড়ল জানালেন, বড় সাইজের সব পেরেকে ঘেরা ব্রিটিশের সেনা ছাউনির কাছে স্থানীয়দের যাওয়ার সুযোগ ছিল না। কিছু সৈন্যকে এখানে এনে বন্দী করে রাখা হতো, তারা কারা, কেউ চিনতেন না। মাঝে মধ্যে তাদের চিৎকার ধ্বনিও শোনা যেত দূর থেকে। কাছে গিয়ে দেখার সুযোগ ছিল না। অবসরপ্রাপ্ত স্কুলশিক্ষক মোশাররফ হোসেন জানান, সেনা ছাউনি বা আর্মিদের কর্মকাণ্ডের গোপনীয়তা রক্ষায় কৃষ্ণনগরের জনবসতির সিংহভাগই খালি করে ফেলা হয়। অনেকের মতো তাদের পরিবারকেও চলে আসতে হয় অনেকটা দূরে। সেনা ছাউনির ভেতরে বহু হত্যাযজ্ঞ হলেও ধামাচাপা দিতে ব্রিটিশরা নজিরবিহীন গোপনীয়তা রক্ষা করে। ফলে ঝিকরগাছায় আজাদ হিন্দের সেনাদের ভাগ্যে আসলে কী ঘটেছে, তা স্থানীয়রা তখন ভালভাবে জানতে পারেননি। সংরক্ষণের অভাবে বিস্মৃতপ্রায় কৃষ্ণনগরের সেনা ছাউনির কিছু ধ্বংসাবশেষ পাওয়া যায় কপোতাক্ষ নদ ও কাটাখালের মোহনায় কাটাখাল ব্রিজসংলগ্ন এলাকায়। কাটাখাল ব্রিজের এখানেই ঊনসত্তর বছরের মুদি দোকানি মোঃ রওশান আলীর পরিবার বসবাস করেন। কৈশোর থেকে কাটাখালেই বেড়ে উঠে এখন জীবনের অন্তিম মুহূর্তে পৌঁছেছেন তিনি। মুদি দোকানি রওশান আলীর তথ্যানুযায়ী, ব্রিটিশ আর্মির সামরিক বাংকারের অস্তিত্ব পাওয়া যায় কাটাখাল ব্রিজের পাশে কপোতাক্ষের মোহনায়। পরবর্তীতে বিভিন্ন অবকাঠামো-বসতি গড়ে ওঠায় অনেক সামরিক স্থাপনার এখন আর ব্রিটিশ আমলের সামরিক স্থাপনার কোন কাঠামো টিকে নেই। তবুও কপোতাক্ষ নদের তীরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে কিছু। তিনি বলেন, কৈশোরে এই কাটাখালে ও কপোতাক্ষের মোহনায় বহু মানব কঙ্কাল দেখেছি। বর্তমানে যেটা ঝিকরগাছা উপজেলা পরিষদ, সেখানেও ব্রিটিশ মিলিটারিরা থাকত। দেয়ালে-সীমানা প্রাচীরের চারদিকে তারকাঁটা-পেরেক পোঁতা থাকত। এদের সামলাতো গোর্খা সৈন্যরা বলেন রওশন আলী। এই সামরিক ব্যারাক থেকে কিছু সেনার মুক্তি মিলেছিল। এই অঞ্চলের ইতিহাস-ঐতিহ্য ও সাহিত্য চর্চার অন্যতম পুরোধা ইতিহাসবিদ হোসেনউদ্দীন হোসেন বলেন, ব্রিটিশ আর্মি ঝিকরগাছায় কৌশলগত কারণে সেনা ছাউনি স্থাপন করে। এর মাঝে মুখ্য কারণ হচ্ছে- স্থানটি ব্যারাকপুরের কাছে এবং রেল ও নৌপথে যাতায়াত সুবিধা ছিল। এই ইতিহাসবিদ জানান, তার জন্ম ১৯৪১ সালে। যখন এই ঘটনা ঘটে, তখন তিনি অনেক ছোট। বাবা এবং মায়ের কাছে শুনছেন, ব্রিটিশ আর্মি এখানে ক্যাম্প করার জন্য ৩৬ ঘণ্টা সময় বেঁধে দিয়ে স্থানীয়দের সরে যেতে বাধ্য করে। ফলে তার পরিবার এখান থেকে ছয় কিলোমিটার দূরে এক গ্রামে গিয়ে বসবাস করতেন। ব্রিটিশ আর্মি চলে গেলে তার পরিবার আবার ঝিকরগাছায় ফিরে আসে। তিনি বলেন, শুনেছি বন্দী সেনারা যেন বিদ্রোহ করতে না পারে তার জন্য ঝিকরগাছায় চারটি ট্রানজিট ক্যাম্পে বিভক্ত করে রাখা হয় আজাদ হিন্দের সেনাদের। ক্যাম্পগুলো হচ্ছে- কৃষ্ণনগর, কীর্তিপুর, মোবারকপুর ও পায়রাডাঙ্গা। এর মধ্যে পায়রাডাঙ্গায় রাখা হতো সবচে বিপজ্জনক সেনাদের। বর্তমানে সরকারী শিশুসদন হিসেবে ব্যবহৃত ওই স্থানটিতে আজাদ হিন্দের সেনাদের খুব গোপনে ফাঁসি দেয়া হতো। ফাঁসি কার্যকরে একটি বিশালাকারের বর্গাকার সুউচ্চ স্থাপনা তৈরি করা হয়। যার নিচে ছিল অন্ধকূপ। এই কূপের সঙ্গে সংযোগ ছিল স্রোতস্বিনী কপোতাক্ষের। ফাঁসি হওয়া সেনার দেহ নদীতে ভেসে যেত জোয়ার-ভাটায়। নদীর সঙ্গে সেই সুড়ঙ্গ বা কূপটি না থাকলেও বর্বরতার সেই স্মৃতি হয়ে আজও টিকে আছে ফাঁসি কার্যকরের উঁচু ঘরটি। তিনি জানাচ্ছেন, নির্মম নির্যাতন করে আজাদ হিন্দ সেনাদের হত্যার দৃশ্য মনে করে আজও শিউরে ওঠেন। কৃষ্ণনগরে ঝিকরগাছা উপজেলা পরিষদের পাশে একটি প্রকাণ্ড বটগাছ ছিল। ব্রিটিশ আর্মি এই বটগাছে বেঁধে আজাদ হিন্দের জওয়ানদের নির্মম নির্যাতন করত। একপর্যায়ে গুলি করে হত্যা করত। হোসেনউদ্দীন হোসেন বলেন, তিনি শুনেছেন মীর জাহান আলী নামে পেশোয়ারের আজাদ হিন্দ সেনাদের হত্যা করা হয়েছিল। তিনি বলেন, ‘কৃষ্ণনগরের ক্যাম্পের ভেতর দিয়ে একটি ট্রেঞ্চ রেলস্ট্রেশন, পাশে পৌরখাল হয়ে কপোতাক্ষ নদীতে পতিত হয়েছে। এই খাল দিয়ে নদীতে লাশ ভাসিয়ে দিত ব্রিটিশ সৈন্যরা। কালের পরিক্রমায় বাড়িঘর হয়ে যাওয়ায় ট্রেঞ্চটি হারিয়ে গেছে।’ পায়রাডাঙ্গার শিশু সদনের ভেতরে এখনও টিকে আছে বর্বরতার সেই নিদর্শন ফাঁসির ঘরটি। ঘরটির চূড়ায় একটি মেশিন বসানো ছিল বলেও জানালেন শিশু সদনে কর্মরত কর্মচারী ও স্থানীয়রা। স্বাধীন ভারতের কোন রাজনৈতিক নেতা বা সরকারী কর্মকর্তা স্থানটিতে শহীদদের জন্য কোন স্মৃতিফলক নির্মাণের উদ্যোগ নেননি। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের দীর্ঘ পথপরিক্রমায় মুক্তিসংগ্রামীদের এতবড় আত্মত্যাগের কোন মূল্যই দেননি কেউ, অযত্নে অবহেলায় অধিকাংশ স্মৃতিচিহ্ন ধ্বংসের পথে, বাকিগুলোও ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে।
×