ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ধন নয়, মান নয় একটুকু বাসা...

প্রকাশিত: ২৩:০৫, ২২ জানুয়ারি ২০২১

ধন নয়, মান নয় একটুকু বাসা...

মোরসালিন মিজান, রূপগঞ্জ থেকে ॥ বহুদিন মনে ছিল আশা/ধরণীর এক কোণে/রহিব আপন-মনে;/ধন নয়, মান নয়, একটুকু বাসা। একটুকু বাসা পাওয়ার সুখ এখন নারায়ণগঞ্জের ভূমিহীন গৃহহীনদের চোখে। এত বড় পৃথিবীতে মাথা গোঁজার একটা ঠাঁই হচ্ছিল না যাদের তারা এখন রূপগঞ্জের আপন নিবাসে! জীবন হঠাৎ এভাবে বদলে যায়? যেতে পারে? এখনও ঘোর কাটছে না তাদের। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষে সরকারী উদ্যোগে বিনামূল্যে ঘর করে দেয়া হয়েছে তাদের। ভাবতে অবাক লাগে, যে মানুষের ভেতর রাষ্ট্র বা কল্যাণ রাষ্ট্রের ধারণা জন্মায়নি আজও, নিজের দায় থেকে রাষ্ট্র পৌঁছে গেছে তার কাছে। সরকার কী? কেন? বহু মানুষ এসব প্রশ্নের কোন উত্তর জানে না। অথচ সরকার উদ্যোগী হয়ে তাদের খুঁজে নিয়েছে। মৌলিক অধিকার সম্পর্কে অজ্ঞ মানুষগুলোকে ঘর করে দিচ্ছে সরকার। বলছে, না, দয়া বা দান নয়, উপহার। সারাদেশে লাখ লাখ অসহায় গৃহহীনকে ভূমিহীনকে এমন উপহার দিয়ে বিরল ইতিহাস গড়তে চলেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ‘উপহার’ শব্দটি ব্যবহারের মধ্য দিয়ে তিনি গৃহহীনদের ঘর দেয়ার পাশাপাশি মর্যাদার একটি আসনও দিয়েছেন। এর চেয়ে ভাল আর কী হতে পারে! হ্যাঁ, উদ্যোগটির কথা জানা গিয়েছিল অনেক আগেই। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ উদ্যাপনের অংশ হিসেবে অত্যন্ত সুচিন্তিত এ কর্মসূচী গ্রহণ করা হয়। কিন্তু চিন্তার অনুরূপ বাস্তবায়ন কি সম্ভব? হলেও কতটা? জানতে সরেজমিন ঘুরে দেখা হলো নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের মুড়াপাড়ায় বাস্তবায়ন করা আশ্রয়ণ প্রকল্পটি। দেখে ভুল শুধু ভাঙালো না, মন নতুন করে আশাবাদী হয়ে উঠল। শীতলক্ষ্যা নদীর ধারে ছোট্ট একটা চরের মতো জায়গা। দেখে বোঝা যায়, একেবারেই নতুন করে গড়ে নেয়া হয়েছে। সমতল ভূমিতে চার সারিতে মোট ২০টি আধাপাকা বাড়ি। ইট সিমেন্টের শক্ত কাঠামো। অফহোয়াইট রঙের দেয়াল। আর উপরে টিনের ছাউনী। নীল ছাউনী আকাশের নীলের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। প্রতিটি বাড়ি নির্মিত হয়েছে দুই শতক জমির ওপর। নির্মাণে ব্যয় হয়েছে এক লাখ ৭১ হাজার টাকা। ভূমিহীনদের ঘরের পাশাপাশি দুই শতক জমির মালিকানাও দেয়া হচ্ছে। আশ্রয়ণ প্রকল্পের কয়েকটি বাড়িতে প্রবেশ করে দেখা যায়, বাহিরের মতো ভেতরটাও এক ও অভিন্ন। প্রতি বাড়িতে বসবাসের জন্য রয়েছে দুটি কামরা। পেছনের দিকে সংযুক্ত রয়েছে একটি রান্নাঘর। একটি টয়লেট। বাদ যায়নি বিদ্যুত সংযোগও। বাড়ির সামনে আছে এক চিলতে ওঠোন। আর্সেনিকমুক্ত খাবার পানির ব্যবস্থা করা হয়েছে। সব মিলিয়ে অসাধারণ। এসব অসাধারণ সেবা যারা গ্রহণ করছেন তারা সমাজের অতিসাধারণ মানুষ। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সর্বনিম্নস্তরে যাদের অবস্থান তারা এসব দালানকোঠার মালিক! এত বড় বাংলাদেশে গতকাল পর্যন্ত ভূমিহীন, ঠিকানাহীন ছিলেন তারা। আজ নিজের জায়গা। নিজের বাড়ি। কেউ কেউ হয়ত বলবেন, স্বপ্ন সত্যি হয়ে গেল। আদতে দালান কোঠার স্বপ্ন পরিবারগুলো কোনদিন দেখেনি। শেখেনি। শেখার বলা চলে শুরুটা হলো। যাকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলছেন, ‘এমপাওয়ারমেন্ট’ (ক্ষমতায়ন)। প্রতিটি বাসার সামনের দেয়ালে নাম্বার লিখে রাখা রয়েছে। সে অনুযায়ী, ১ নম্বর বাসায় গিয়ে পাওয়া গেল বৃদ্ধাকে। বয়স তার নিজেরও সঠিক জানা নেই। অনুমান করে বললেন, ৭০ বছর। তা খালা, এত বড় জীবনে কোনদিন কি এমন একটি বাড়ির স্বপ্ন দেখেছিলেন আপনি? জানতে চাইলে পরিষ্কার করে কিছু বললেন না তিনি। মনে হলো প্রশ্নটি বুঝে উঠতে পারেননি। তাই আরও কয়েকটি প্রশ্ন করা। করতে করতেই চোখ গেল তার চোখের পানে। আধমরা ঘোলা দুটি চোখে তার আনন্দ অশ্রু। যেন এই প্রথম বড় সুখে তিনি কাঁদছেন। এক পর্যায়ে নিজেকে সামলে নিয়ে বৃদ্ধা বললেন, ‘আমি ভিক্ষা কইরা খাই, বাবা। এইহানই থাকতাম। মাছিমপুর গেরাম। নয় দশ বছর আগে জামাই মইরা গেল। পর থেইক্যা ভিক্ষা কইরা খাই। বাড়ি ঘরের কই পামু? চিন্তাও করিনাই। ভাইয়েরাও গরিব। গেছিলাম। কয়, আমরাই খাইতে পারি না। তোরে কেমনে রাখি? বাবারে, কত মাইষের লাত্থি উষ্ঠা খাইছি। পাকঘরে হুইয়া রইছি...।’ আবারও শীতের চাদর টেনে চোখের জল মুছেন তিনি। জানান, এখন নিজের মেয়ে নাতনীদেরও নিজের কাছে এনে রাখবেন। এখন তার সামর্থ্য হয়েছে। কী করে সামর্থ্য হলো? কে দিল ঘর করে? জানেন? এমন প্রশ্নে তার উত্তর: ‘মেম্বর দিসে!’ আরেক বৃদ্ধার বসয় প্রায় ৮০ হলেও, চিন্তায় বেশ স্বচ্ছ বলেই মনে হলো। নাম আসিয়া বেগম। নিজের বাসার সামনে একটি প্লাস্টিকের চেয়ারে বসেছিলেন। তিনি পরিষ্কার করেই বললেন, এই তো বাড়িডা। আমার। শেখ হাসিনায় দিসে।’ শেখ হাসিনা কেন দিলেন আপনাকে? উনাকে চেনেন? জানতে চাইলে তার কণ্ঠ আরও জোরালো হয়ে ওঠে। বলেন, ক্যান চিনুম না? শেখ মজিবরের মাইয়া।’ প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা হলে সালাম জানাবেন বলেও জানান তিনি। সন্ধ্যা রানী ও বিনা রানী নামে আরও দুই নারী ভিক্ষুক ঘর পেয়েছেন। দালানকোঠার মালিকদের কি আর ভিক্ষে করা মানায়? মজার ছলে এ প্রশ্ন করতেই তাতের জবাব, ‘ভিক্ষা আর করুম না। দেহি, একটা কাজ কাম খুইজা নিমু।’ আশ্রয়ণ প্রকল্পে অগ্রাধিকার দেয়া হচ্ছে শারীরিক প্রতিবন্ধীদের। তাদেরই একজন শফিকুল আলম। ১০ নম্বর বাসাটি তার। ৬৫ বছর বয়সী লিকলিকে লম্বা শরীর। এক হাতে লাঠিতে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। লক্ষ্য করে দেখা গেল, শরীরের বাম পাশ তার কাজ করছে না। একটি হাত ও একটি পা অসার। অনেকটা ঝুলে আছে। বললেন, ‘আমি ঢাকার মিরপুরে এক বস্তিতে থাকতাম। বেরেইনস্টোক কইরা অচল হয়া গেছি। বউ এখনও ঢাকায়। মাইষের বাসায় কাম করে।’ তবে এত সুন্দর বাসা পাওয়ার পর স্ত্রীকে নিজের ঘরে এনে রাখবেন বলে জানান তিনি। দুঃখ দিনের স্মৃতি তুলে ধরে শফিকুল বলেন, ‘হাত পা অবশ হওয়ার পর থেইক্যা কত আত্মীয়র কাছে গেছি, নেতার অফিসে গেছি। দুই টেকা কেউ দেয় নাই। শেখ হাসিনা দিসে।’ অনেকটা মুনাজাতের মতো করে তিনি বলতে থাকেন, ‘প্রধানমন্ত্রী আমরারে ভাল রাখছে। উনারে যেন আল্লায় ভাল রাখে।’ ৪ নম্বর বাসায় গিয়ে পাওয়া যায় মিনারা বেগমকে। মাঝবয়সী নারী। তার নামেই এ বাসা। দেখে অতো দুস্থ মনে হয়নি পরিবারটিকে। তবে ছোট্ট জীবনে অনেক সংগ্রাম করতে হয়েছে। এখন ক্লান্তশ্রান্ত। তিনি নিজে কয়েল ফ্যাক্টরিতে কাজ করতেন। অসুস্থতার কারণে এখন আর কাজে যেতে পারেন না। স্বামী আছে। রিক্সা চালান। তবে যা পান তাতে সংসার চলে না। মিনারা বলেন, ‘গ্রামের মাইনষে টেকা তুইল্যা দুই মেয়ের বিয়া দিয়া দিসে। এক ছেলে ছোডো। হেরে নিয়া চলতেও কষ্ট অয়।’ তাহলে ঘর দিয়ে কী হবে? জানতে চাইলে হাসি ফুটে ওঠে তার মুখে। বলেন, ‘খাই না খাই, ঘর পাইয়া ফুর্তি লাগতাসে। মনের আশা পূরণ হইছে।’ আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাসাবাড়ির পরিবেশ চঞ্চল হয়ে উঠছে শিশু কিশোরদের উপস্থিতিতে। ইভা নামের ফুটফুটে এক শিশু তো এই প্রতিবেদকে তাদের ঘরে নিয়ে গিয়ে তার নিজের কক্ষটি দেখালো। সে কী উচ্ছ্বাস তার। বলল, ‘এই ঘরে আমি থাকব। আর আমার বইনেরা থাকবে।’ ফুল দিয়ে ঘর সাজাবে বলেও জানায় সে। ২ নম্বর বাসাটিতে থাকবে আফরোজারা। ছোট দুই বোন সঙ্গে নিয়ে আশপাশ ঘুরে দেখছিল সে। বলল, ‘কোন বাড়িতে কারা আইছে দেখতাছি। কাউরে পাইলে খেলতে যামু।’ অর্থাৎ ক্রমেই পরিপূর্ণ হয়ে উঠবে প্রকল্প এলাকা। জীবন যুদ্ধে পরাজয় ভুলে সামনে এগিয়ে যাওয়ার শক্তি সাহস ফিরে পাবে অসহায় মানুষ। এই তো চাওয়া। বুধবার রূপগঞ্জের মুড়াপাড়া আশ্রায়ণ প্রকল্পটি ঘুরে দেখান আশ্রয়ণ ২ প্রকল্পের পরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) মোঃ মাহবুব হোসেন। তিনি জানান, দেশের একজন মানুষও গৃহহীন থাকবে না- প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এ ঘোষণা বাস্তবায়নে সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তারা। এরই মধ্যে প্রায় সারা দেশের সব ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারের তালিকা করা হয়েছে। ঘর এবং জমি নেই এমন পরিবারের সংখ্যা দুই লাখ ৯৩ হাজার ৩৬১ জন। জমি আছে, ঘর নেই এমন পরিবারের সংখ্যা পাঁচ লাখ ৯২ হাজার ২৬১টি। সর্বমোট আট লাখ ৮৫ হাজার ৬২২টি পরিবারকে পর্যায়ক্রমে বাসস্থান নির্মাণ করে দেয়া হবে। ইতোমধ্যে প্রথম পর্যায়ে প্রায় ৬৬ হাজার পরিবারের জন্য গৃহ নির্মাণ করা হয়েছে। প্রকল্প পরিচালক বলেন, রূপগঞ্জের ঘরগুলোও এখন সম্পূর্ণরূপে প্রস্তুত। কার ঘর কোনটি হবে, লটারির মাধ্যমে নির্ধারণ করা হয়েছে। মালিকানা বুঝিয়ে দেয়ার অধিকাংশ প্রক্রিয়াও সম্পন্ন হয়েছে। সম্পূর্ণ বিনামূল্যে এ ঘরগুলো উপকারভোগীদের দেয়া হবে। আগামীকাল শনিবার ঘরগুলো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভূমি ও গৃহহীন দুস্থ মানুষদের মধ্যে বিতরণ করবেন। প্রথম পর্যায়ে প্রায় ৬৬ হাজার পরিবারকেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ মাসেই ঘর বুঝিয়ে দেবেন। মুজিববর্ষে এক বছরের মধ্যে আরও এক লাখ ঘর নির্মাণ সম্পূর্ণ হয়ে যাবে বলে জানান তিনি।
×