ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ভ্যাকসিন এসে গেছে ॥ ভারতের উপহার ২০ লাখ ডোজ

প্রকাশিত: ২২:৪৫, ২২ জানুয়ারি ২০২১

ভ্যাকসিন এসে গেছে ॥ ভারতের উপহার ২০ লাখ ডোজ

স্টাফ রিপোর্টার ॥ সকাল ৮টায় মুম্বাইয়ের ছত্রপতি শিবাজি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, এয়ার ইন্ডিয়ার একটি বিশেষ বিমান উড়াল দিল হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের উদ্দেশে। বিমানটি যখন ভারতীয় আকাশসীমা ত্যাগ করে তখন ভারতের হাইকমিশন এয়ার ইন্ডিয়ার সেই বিমানের ছবি দিয়ে নিজেদের ফেসবুক পেজে ভ্যাকসিন আসার খবরটি জানায়। এর মধ্যে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর এক টুইট বার্তায় বলেন, বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ককে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয় ভারত, ভ্যাকসিনমৈত্রী তারই নজির। তখন ঢাকা প্রস্তুত হচ্ছিল বন্ধুত্বের নিদর্শন ভারতের পাঠানো ২০ লাখ ডোজ করোনা ভ্যাকসিন বুঝে নেয়ার জন্য। বিমানবন্দর, রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মা আর তেজগাঁওয়ে ইপিআই সেন্টারে তখন ভ্যাকসিন বুঝে নেয়ার তোড়জোড় চলছিল। বৃহস্পতিবার বেলা ১১টা বিশের দিকে ভ্যাকসিন নিয়ে ভারতীয় বিশেষ বিমানটি ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করে। ভারতীয় জনগণের কাছ থেকে উপহার হিসেবে এলো করোনাভাইরাস প্রতিরোধের টিকা। অক্সফোর্ড-এ্যাস্ট্রাজেনেকা উদ্ভাবিত ও দেশটির সেরাম ইনস্টিটিউট প্রস্তুতকৃত ২০ লাখ চার হাজার ডোজ করোনার ভ্যাকসিন বাংলাদেশকে দিল ভারত। বৃহস্পতিবার দুপুর দেড়টার দিকে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় ভারতের রাষ্ট্রদূত বিক্রম দোরাইস্বামী এক অনুষ্ঠানে এই টিকা হস্তান্তর করেন। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের হাতে পৃথকভাবে করোনার টিকার দুটি বক্স তুলে দেন বিক্রম দোরাইস্বামী। অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মাদ শাহরিয়ার আলমসহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। বিমানবন্দর থেকে দুটি ফ্রিজার ভ্যানে করে ভ্যাকসিনের সর্বমোট ১৬৭ কার্টন নিয়ে যাওয়া হয় তেজগাঁও ইপিআই স্টোরেজে। ‘ভ্যাকসিনমৈত্রীর’ আকাশী রঙের ব্যানারে ঢাকা সেই ভ্যানের গায়ে আঁকা ছিল দুই দেশের পতাকা, লেখা ছিল- ‘ভারতীয় জনগণের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের জনগণের জন্য উপহারস্বরূপ ভারতে উৎপাদিত ২০ লাখ ৪ হাজার ডোজ কোভিড ভ্যাকসিন। ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট এর কাছ থেকে একই ভ্যাকসিনের আরও তিন কোটি ডোজ কিনেছে বাংলাদেশ। আগামী ২৫ জানুয়ারি এই ভ্যাকসিনের প্রথম চালান বাংলাদেশে আসার কথা রয়েছে। তবে এখনও ফ্লাইট জটিলতা রয়েছে বলে জানা গেছে। দুপুরে ভ্যাকসিন হস্তান্তর অনুষ্ঠানে উপহার হিসেবে টিকা দেয়ার জন্য ভারত সরকারকে ধন্যবাদ জানান স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারত বাংলাদেশের পাশে দাঁড়িয়ে বন্ধুত্বের পরিচয় দিয়েছিল। আজ মহামারীর সময় তারা আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছে। করোনার টিকা উপহার দিয়ে ভারত আবার বন্ধুত্বের পরিচয় দিয়েছে। মন্ত্রী বলেন, বাণিজ্যিক চুক্তি অনুযায়ী এ মাসের শেষে ৫০ লাখ ভ্যাকসিন আসার কথা এবং সে অনুযায়ী ভ্যাকসিন আসবে। ফ্লাইট সিডিউল হাতে পেলে জানিয়ে দেব কবে থেকে ভ্যাকসিন পাচ্ছি। এখনও ফ্লাইট সিডিউল পাইনি। এরপর প্রতিমাসে ৫০ লাখ করে ভ্যাকসিন আসার কথা রয়েছে। টিকা আসার একটি সিডিউল আছে। যদি এদিক সেদিক হয় তবে যখন আমরা জানব তখন আপনাদের জানাব। ভ্যাকসিন দেয়া কবে শুরু হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা আজ টিকা গ্রহণ করেছি। এ নিয়ে আমরা পরিকল্পনা করছি। পরিকল্পনা শতভাগ তৈরি হয়ে গেছে তা কিন্তু নয়। টিকার ট্রায়াল রানের বিষয়ে তিনি বলেন, আগামী ছয়-সাত দিনের মধ্যে টিকার একটি ট্রায়াল রান করার চিন্তাভাবনা আছে। সেই তারিখটি আপনাদের জানিয়ে দেব। তারিখ চূড়ান্ত হয়নি। চূড়ান্ত দিনের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় রয়েছি। কারণ ভিডিও কনফারেন্সের মধ্য দিয়ে টিকার ট্রায়ালে যুক্ত হতে চেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। ভ্যাকসিন দেয়া নিয়ে বা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নিয়ে কোনও গুজব না ছড়ানোর জন্য তিনি আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ভ্যাকসিন মানুষের জীবন রক্ষাকারী ওষুধ। যারা মানুষের জীবন নিয়ে ষড়যন্ত্র, রাজনীতি করে তারা সঠিক লোক নয়। আমরা করোনা মোকাবেলায় আছি, জীবন রক্ষায় আছি। এই মোকাবেলায় ভ্যাকসিন একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার। এজন্য কেউ যাতে জাতিকে বিভ্রান্ত না করে সেজন্য সবাইকে আহ্বান জানাচ্ছি। পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল মোমেন বলেন, এই উপহার বাংলাদেশ ও ভারতের বন্ধুত্ব আরও দৃঢ় করবে। ভবিষ্যতে দুই দেশ একসঙ্গে পথচলা সুগম হবে। তিনি বলেন, বিশ্বের মধ্যে করোনা সংক্রমিত দেশের তালিকায় বাংলাদেশ ২০তম অবস্থানে। এখন করোনার টিকা আমদানিতে আমরা ভারতের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছি। পর্যায়ক্রমে আমাদের চাহিদা অনুযায়ী টিকা আমদানি করব। ভারতীয় হাইকমিশনার বলেন, করোনার টিকা আমদানি নিয়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ও ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা হয়েছে। এর মধ্যে ২০ লাখ টিকা উপহার হিসেবে পাঠিয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। এই উপহার দুই দেশের বন্ধুত্ব আরও মজবুত করবে। এর আগে টিকা নিয়ে এয়ার ইন্ডিয়ার একটি উড়োজাহাজ বৃহস্পতিবার বেলা ১১টার দিকে ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করে। সেখান থেকে দুটি ফ্রিজার ভ্যানে করে তেজগাঁও এর ইপিআই স্টোরেজে। ‘ভ্যাকসিনমৈত্রীর’ আকাশী রঙের ব্যানারে ঢাকা সেই ভ্যানের গায়ে আঁকা ছিল দুই দেশের পতাকা, লেখা ছিল- ‘ভারতীয় জনগণের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের জনগণের জন্য উপহারস্বরূপ ভারতে উৎপাদিত ২০ লাখ ডোজ কোভিড ভ্যাকসিন। স্বাস্থ্য অধিদফতরের সরকারী পরিচালক ডাঃ রওশন জাহান আক্তার জানান, সর্বমোট ১৬৭ কার্টন টিকা এসেছে, যেখানে ২০ লাখ চার হাজার ডোজ ভ্যাকসিন আছে। প্রতি বক্সে আছে ১২০০ ভায়াল ভ্যাকসিন। এক ভায়ালে ১০ জনকে টিকা দেয়া যাবে। অনলাইনে নিবন্ধন ছাড়া কাউকে করোনার এই টিকা দেয়া হবে না। রাজধানীর চারটি হাসপাতালে এ মাসের শেষদিকে টিকাদানের মহড়া বা ড্রাই রান হবে। ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে দেশব্যাপী টিকা কার্যক্রম শুরু করার প্রস্তুতি নিচ্ছে স্বাস্থ্য বিভাগ। শুরুতে বেসরকারী প্রতিষ্ঠান ভ্যাকসিন দেয়ার অনুমতি পাচ্ছে না। তেজগাঁও এর ইপিআই সেন্টারে ৫০ লাখ ভ্যাকসিন রাখার সক্ষমতা আছে। ইতোমধ্যে দুটি ফ্রিজার খালি করা হয়েছে। প্রতিটি ফ্রিজারে ২০ লাখ ভ্যাকসিন রাখা যাবে। ভ্যাকসিনের নিরাপত্তা রক্ষায় ইপিআই সংরক্ষণাগার ও আশপাশের এলাকার নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে বলে কর্মকর্তারা জানান। ইউপিআই এর প্রোগ্রাম ম্যানেজার গোলাম মাওলা বলেন, এই স্টোরেজের তাপমাত্রা মাইনাস ৮ ডিগ্রী সেলসিয়াসের নিচে। সে কারণে এই টিকা এখানে রাখা যাবে। ভ্যাকসিন সংরক্ষণের জন্য আমাদের কোল্ড বক্স আছে, সেখানে ২৪টি আইস প্যাক দিয়ে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা হয়। সেই কোল্ড বক্সে ৭২ ঘণ্টা পর্যন্ত ভ্যাকসিন রাখা যায়। দেশের যেকোন জায়গায় যদি এই ভ্যাকসিনটি পরিবহন করি, তবে ১২-১৮ ঘণ্টার মধ্যে সবচেয়ে দূরে যে জেলাটি আছে পঞ্চগড় অথবা কক্সবাজারে যাওয়া যাবে। যদিও আমাদের হাতে আছে ৭২ ঘণ্টা। ভ্যাকসিন পরিবহনের ক্ষেত্রে সড়কের সব স্থানে ইনফরমেশন দেয়া থাকে। যদি ফেরি পারাপারের বিষয় থাকে তবে সেখানেও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের (পুলিশ, জেলা প্রশাসন, সিভিল সার্জন) ইনফরমেশন দেয়া থাকবে। এই ভ্যাকসিন সংরক্ষণের জন্য সারাদেশেই ব্যবস্থা আছে। সেই সক্ষমতা আমাদের আছে। আজকের সম্পূর্ণ ভ্যাকসিন আমরা জেলা ই পি আই স্টোরে রাখব। সংরক্ষণাগারে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুত ॥ করোনার ভ্যাকসিন সংরক্ষণে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুত সরবরাহের নির্দেশ দিয়েছেন বিদ্যুত, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। ভ্যাকসিন সংরক্ষণ ও প্রদানের স্থানে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুত নিশ্চিত সংক্রান্ত সার্বিক বিষয় সমন্বয় করার জন্য বিদ্যুত বিভাগের পক্ষ হতে যুগ্ম-সচিব রেজওয়ানুর রহমান ও উপসচিব তাহমিনা ইয়াসমিনকে ফোকাল পয়েন্ট করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার করোনাভাইরাস এর প্রতিষেধক টিকা সংরক্ষণ স্থানে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুত সরবরাহ নিশ্চিত করতে বিদ্যুত বিতরণ কোম্পানিগুলোর সঙ্গে কর্মপরিকল্পনা নিয়ে অনুষ্ঠিত সভায় প্রতিমন্ত্রী বলেন, করোনাভাইরাস-এর প্রতিষেধক টিকা সংরক্ষণের স্থানে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুত নিশ্চিত করতে হবে। নিয়মিত সোর্সের পাশাপাশি বিকল্প সোর্স হতে বিদ্যুত সরবরাহের ব্যবস্থা রাখা আবশ্যক। তাছাড়া স্ট্যান্ডবাই জেনারেটরের ব্যবস্থাও রাখতে হবে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্থানীয় প্রশাসন ও স্থানীয় স্বাস্থ্য বিভাগের সঙ্গে সমন্বয় করে কর্মপন্থা নির্ধারণ করার নির্দেশ দিয়ে প্রতিমন্ত্রী বলেন, কোন অবস্থাতেই বিদ্যুত বিভ্রাট যেন না ঘটে। এমনকি বিতরণ যন্ত্রাদি, ট্রান্সফরমার, কন্ডাক্টর, ক্যাবল, ফিউজ প্রভৃতি সম্পর্কে আগে থেকেই সচেতন হতে হবে। যে সকল প্রতিষ্ঠানের বা হাসপাতালের নিজস্ব জেনারেটর রয়েছে সেগুলোকেও সচল রাখতে তৃতীয় বা চতুর্থ বিকল্প হিসেবে সংশ্লিষ্ট বিদ্যুত বিতরণ সংস্থা প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন সংরক্ষণ ও প্রদানের স্থানে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুত নিশ্চিত সংক্রান্ত বিষয় সমন্বয় করার জন্য এ সময় তিনি বিদ্যুত বিভাগের পক্ষ থেকে ফোকাল পয়েন্ট নির্ধারণের নির্দেশ দেন।
×