ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ডানলপ সাহেবের নীলকুঠি

মাদারীপুরে কৃষক নির্যাতনের নীরব সাক্ষী

প্রকাশিত: ২৩:১৪, ২১ জানুয়ারি ২০২১

মাদারীপুরে কৃষক নির্যাতনের নীরব সাক্ষী

সুবল বিশ্বাস ॥ লোকে বলে ডানলপ সাহেবের নীলকুঠি। এই নীলকুঠি ইংরেজ আমলে মাদারীপুর সদর উপজেলার ছিলারচর ইউনিয়নের আউলিয়াপুর গ্রামে স্থাপন করা হয়। এর সবকিছু ধ্বংস হয়ে গেলেও কৃষক নির্যাতনের অভিশপ্ত নীলকুঠির চুল্লীর একটি চিমনী কালের নীরব সাক্ষী হয়ে আজও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ইংরেজ ডানলপ সাহেব ছিলেন একজন নীলকর এবং নীলকুঠির ম্যানেজার। ডানলপ সাহেবের বিশ্বস্ত গোমস্তা ছিল পাচ্চরের কালী প্রসাদ নামে এক ব্যক্তি। ইংরেজরা নীলের ব্যবসা করে রাতারাতি কোটিপতি হওয়ার বাসনা নিয়ে এ অঞ্চলে এসেছিলেন। আজ থেকে প্রায় আড়াইশ’ বছর আগে এখানে এসে আউলিয়াপুর গ্রামের প্রায় ১২ একর জমির ওপর নীলকুঠি স্থাপন করেন ডানলপ। কৃষকদের আপত্তির পরও তাদের ওপর নির্যাতন চালিয়ে কৃষকদের বাধ্য করা হয় নীল চাষে। এই আউলিয়াপুর গ্রামটি মাদারীপুর সদর থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার পূর্ব দিকে অবস্থিত। ধ্বংস হয়ে যাওয়া নীলকুঠি অভিশপ্ত হলেও মানুষের কাছে এটাকে ঘিরে নানা কৌতূহল রয়েছে। এ অঞ্চলের কৃষকদের ওপর ব্রিটিশ নীলকর সাহেবদের নির্যাতনের করুন ইতিহাস জানার আগ্রহটাও কম নয়। তাই ঐতিহ্য অভিশপ্ত হলেও প্রাচীন স্মৃতি তুলে ধরতে ডানলপ সাহেবের নীলকুঠি হতে পারে জেলার একটি সম্ভাবনাময় পর্যটন কেন্দ্র। যা দেশের পর্যটন শিল্প বিকাশে সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে। জনশ্রুতি রয়েছে. গভীর বনজঙ্গলে ঘেরা জনমানবহীন এই এলাকায় বহুকাল পূর্বে বিভিন্ন স্থান থেকে কয়েকজন আউলিয়া এসে ধ্যানমগ্ন ছিলেন। সে সময় এই জঙ্গলে বাঘ-ভাল্লুকসহ নানা প্রজাতির হিংস্র জীবজন্তু বাস করত। তাঁদের পদস্পর্শে ধন্য বলে এর এই এলাকার নাম হয়েছে আউলিয়াপুর। এখনও এই গ্রামে রয়েছে খ্যাতিমান আউলিয়া হযরত শাহ সুফী খাজা ইউসুফ শাহ আহসানের দরগা শরীফ। অযত্ন অবহেলায় এই দরগা শরীফটি আজ জরাজীর্ণ। দরগা শরীফটির অবস্থান নীলকুঠির পাশেই। স্বাধীনতার আগে অর্থাৎ ৫০/৬০ বছর পূর্বেও এলাকাটি ছিলো ঘন বনজঙ্গলে আবৃত। অবশ্য এখন এখানে আর জঙ্গল নেই। নীলকুঠির জমি বিভিন্ন লোক বিভিন্নভাবে দখল করে নিয়েছে। গড়ে তুলেছে ঘরবাড়ি। স্মৃতি হিসেবে রয়েছে শুধু চুল্লীর চিমনী। তাও প্রায় ধ্বংসের পথে। রয়েছে কুঠির বেশকিছু ভাঙাচুরা ইটের চিহ্ন। ১২ কক্ষের নীলকুঠির ধ্বংসাবশেষ এখনও আউলিয়াপুরে বিদ্যমান। জেলার ইতিহাস ঐতিহ্যের তথ্য সংগ্রহ করার সময় আউলিয়াপুরে খুঁজে পাওয়া যায় শতবর্ষ বয়সী রহিম ফরাজী নামের এক বৃদ্ধকে। তখন তিনি একটি ঘটনার কথা বলেছিলেন, ‘আমি আমার বাবার কাছে শুনেছি, এই গ্রামে করিম বক্স নামে এক ব্যক্তি ছিলেন খুব সাহসী ও পালোয়ানের মতো। সেই করিম বক্স একদিন এই জঙ্গল থেকে একটি বাঘ হত্যা করেছিলেন। জঙ্গলে গাছ কাটতে গেলে বাঘটি তাকে আক্রমণ করেছিল। তিনি বাঘের সঙ্গে ধস্তাধস্তির সময় নিজেও আহত হয়েছিলেন।’ করিম বক্সের বাঘ শিকারের কাহিনী নিয়ে দীর্ঘদিন এলাকার মানুষ নানা মুখরোচক গল্প করত। ব্রিটিশ আমলে বৃহত্তর ফরিদপুর জেলার বিভিন্ন এলাকার হিন্দু জমিদারদের সহায়তায় ডানলপ সাহেব কুঠিয়াল বাহিনী গঠন করেন এবং তাদের দ্বারা আউলিয়াপুর এলাকার বনজঙ্গল কেটে নীলকুঠি স্থাপন করেন ১৭৫৭ সালের অনেক পরে। ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধের কিছুকাল পর ফরিদপুরের অংশ হিসেবে মাদারীপুরে নীল চাষ শুরু হয়। এলাকাটি নীল চাষের জন্য বিশেষ উপযোগী ছিল। তখন শুধু ডানলপ সাহেব নয়, অনেক ইংরেজ সাহেবই এদিকে ভির জমিয়েছিল নীল চাষ করতে। তবে যে জমিতে নীল চাষ করা হয় সে জমিতে ধান-পাট বা অন্য কোন ফসল ফলে না বলে কৃষকরা বাধা দিয়েছিল। বর্তমানে বিলুপ্ত ডানলপ সাহেবের নীলকুঠির পূর্ব দিকে রণখোলা, পশ্চিমে আউলিয়াপুর বাজার, উত্তরে কালীতলা ও দক্ষিণে আউলিয়াপুর দরগা শরীফ। ১২ কক্ষ বিশিষ্ট এই কুঠির মাঝামাঝি অংশে রয়েছে চুল্লী, যেখানে নীল তৈরি করা হতো। চুল্লীর পাশেই রয়েছে প্রায় ৪০ ফুট উঁচু একটি চিমনী। নীল কুঠিয়াল ও তাদের দোসর জমিদার মহাজনদের অত্যাচারে এ অঞ্চলের কৃষকরা যখন জর্জরিত, ঠিক সেই সময় ফরায়েজী আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা হাজী শরীয়তউল্লাহ এবং তাঁর পুত্র পীর মহসিন উদ্দিন দুদু মিয়া নীল কুঠিয়ালদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ও প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। এ সময় বৃহত্তর ফরিদপুর, ঢাকা, ময়মনসিংহ, বরিশাল, কুমিল্লা, নোয়াখালীসহ বিভিন্ন অঞ্চলের হাজার হাজার মানুষ ফরায়েজী আন্দোলনের প্রতি একাত্মতা ঘোষণা করেন। তিনি ও তাঁর অনুসারীরা মুসলমান সমাজ ও কৃষকদের ওপর ইংরেজ নীল কুঠিয়াল ও জমিদারদের নিপীড়ন-নির্যাতন মেনে নিতে পারেননি। ইংরেজ ও জমিদারদের হাত থেকে কৃষকদের রক্ষা করাই ছিল নীল বিদ্রোহে হাজী শরীয়তউল্লাহর উদ্দেশ্য। পাশাপাশি সমাজে সকল অনৈসলামিক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন সোচ্চার। পরবর্তীতে শরীয়তপুর জেলা তাঁরই নামে নামকরণ করা হয়েছে। ১৮৪০ সালের ১৮ জানুয়ারি হাজী শরীয়তউল্লাহ মৃত্যুবরণ করলে তাঁর অসমাপ্ত কাজ সম্পন্ন কারার দায়িত্ব তাঁর পুত্র পীর মহসিনউদ্দিন দুদু মিয়ার ওপর বর্তায়। হাজী শরীয়তউল্লাহ মৃত্যুর পর ফরায়েজী নেতা ও অনুসারীরা পীর মহসিনউদ্দিন দুদু মিয়াকে ফরায়েজী আন্দোলনের নেতা নির্বাচিত করেন। তখন থেকেই শুরু হয় তাঁর সংগ্রামী জীবন। অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ করতে ফরায়েজীদের নিয়ে গড়ে তোলেন এক বিশাল লাঠিয়াল বাহিনী। এই লাঠিয়াল বাহিনীকে উপযুক্ত প্রশিক্ষণ ও সুসংগঠিত করে গড়ে তোলার দায়িত্ব দেন ফরিদপুরের বিখ্যাত লাঠিয়াল জালালউদ্দিন মোল্লাকে। এক বছরের মধ্যে লাঠিয়াল বাহিনী উপযুক্ত প্রশিক্ষণ নিয়ে প্রস্তুত হয়ে ওঠে। পরের বছর ১৮৪১ সালে দুদু মিয়ার নেতৃত্বে তাঁর বিশাল লাঠিয়াল বাহিনী ফরিদপুরের কানাইপুর জমিদার বাড়ি এবং ১৮৪২ সালে ফরিদপুরের আরেক জমিদার জয় নারায়ণ ঘোষের বাড়ি আক্রমণ করে ব্যাপক ক্ষতিসাধন করেন। পরবর্তীতে দুদু মিয়াসহ ১২৭ জন ফরায়েজীর নামে মামলা হয়। মামলার রায়ে ২২ জনের ৭ বছর করে কারাদণ্ড দেয়া হয়। পীর মহসিনউদ্দিন দুদু মিয়াসহ অন্যরা মামলা থেকে অব্যাহতি লাভ করেন। ১৮৪৫ সালের ৫ ডিসেম্বর পীর মহসিনউদ্দিন দুদু মিয়ার নেতৃত্বে তাঁর বিশাল লাঠিয়াল বাহিনী আউলিয়াপুর ডানলপ সাহেবের নীলকুঠি আক্রমণ করেন। এ আক্রমণের সংবাদ পেয়ে নীল কুঠিয়াল বাহিনীর একটি অংশ পালিয়ে যায়। ওইদিন রণখোলা নামক স্থানে দুপক্ষের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে ডানলপ বাহিনী পরাজিত হয় এবং নীলকর ডানলপ পালিয়ে ফরিদপুরের উদ্দেশে যাওয়ার সময় বর্তমান গোপালগঞ্জ জেলার মুকসুদপুর এলাকার কৃষকরা তাকে কাঁচি, খোন্তা, কোদাল দিয়ে কুপিয়ে হত্য করে। ওই দিন দুদু মিয়ার ক্ষুব্ধ লাঠিয়াল বাহিনী অরক্ষিত নীলকুঠিতে ব্যাপক ভাংচুর চালায় এবং চুল্লী ভেঙ্গে ফেলেন। অক্ষত থাকে চুল্লীর চিমনী। যা এখনও কালের সাক্ষী হয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ১৮৪৫ সালে আউলিয়াপুরের অদূরে যেখানে যুদ্ধ হয়েছিল পরবর্তীতে সেই স্থানের নাম রণখোলা নামকরণ প্রচলিত হয়ে যায় মানুষের মুখে মুখে।
×