ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ সংক্রান্ত রিপোর্ট প্রকাশকালে অর্থমন্ত্রী

১৮ বছরের বেশি সব নাগরিক বিনামূল্যে করোনার টিকা পাবেন

প্রকাশিত: ২২:৫৯, ২১ জানুয়ারি ২০২১

১৮ বছরের বেশি সব নাগরিক বিনামূল্যে করোনার টিকা পাবেন

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ দেশের ১৮ বছরের উর্ধে সকল নাগরিককে ধাপে ধাপে বিনামূল্যে করোনার টিকা দেয়া হবে। এজন্য ভাইরাসের টিকা আমদানি ও প্রয়োগের জন্য চলতি বাজেটে কোভিড-১৯ মোকাবেলায় দুটি প্রকল্পে জরুরী ভিত্তিতে সাড়ে ৫ হাজার ৬৫৯ কোটি টাকার বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। করোনার কারণে সামষ্টিক অর্থনীতিতে চ্যালেঞ্জ থাকলেও প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নের মাধ্যমে তা আবার ঘুরে দাঁড়াতে সক্ষম হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যকর ও গতিশীল নির্দেশনায় চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরে বাজেট বাস্তবায়ন, সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষা ও উন্নয়ন কার্যক্রম প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে। চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটের প্রথম প্রান্তিক (জুলাই-সেপ্টেম্বর) পর্যন্ত বাস্তবায়ন অগ্রগতি ও আয়-ব্যয়ের গতিধারা এবং সামষ্টিক অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ সংক্রান্ত প্রতিবেদনে অর্থমন্ত্রী এসব কথা বলেন। বুধবার অর্থমন্ত্রীর বক্তব্য সম্বলিত প্রতিবেদনটি অর্থমন্ত্রণালয় থেকে প্রকাশ করা হয়েছে। এতে করোনা মোকাবেলায় সরকারের গৃহীত পদক্ষেপ, সামগ্রিক বাজেট বাস্তবায়ন, অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা, এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন, রূপকল্প ২০২১-২০৪১, সামাজিক নিরাপত্তা, রেমিটেন্স আহরণ, সরকারের আয়-ব্যয়, রাজস্ব আহরণ পরিস্থিতি এবং ভবিষ্যত করণীয় নির্ধারণ সম্পর্কেও আলোকপাত করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কোভিড-১৯ এর প্রভাব মোকাবেলায় সরকার জনস্বাস্থ্য সুরক্ষা ব্যবস্থাকে সর্বাধিক অগ্রাধিকার প্রদান করে সার্বিক স্বাস্থ্যখাতে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ প্রদান অব্যাহত রেখেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরাসরি দিক নির্দেশনায় করোনাভাইরাসের প্রতিরোধ, সংক্রমণ হ্রাস ও চিকিৎসা প্রদানে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা গ্রহণ করা হয়েছে। অতিরিক্ত বরাদ্দ হতে ভ্যাকসিন সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও প্রয়োগসহ প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য ব্যয় নির্বাহ করা হবে। অর্থমন্ত্রী বলেন, সরকার করোনা মোকাবেলায় ভ্যাকসিন প্রয়োগকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে ব্যাপক কর্মপরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশে অক্সফোর্ড আসট্রা জিনিকা টিকার তিন কোটি ডোজ সরকারীভাবে আমদানির উদ্যোগ চূড়ান্ত হয়েছে। এ লক্ষ্যে চুক্তি স্বাক্ষর সম্পন্ন হয়েছে। পাশাপাশি গাভি কোভিক্স এর আওতায় আরও সাড়ে তিন কোটি ডোজ টিকা পাওয়া যাবে। এতে করে পর্যায়ক্রমে কয়েকটি ধাপে ১৮ বছরের উর্ধে সকল নাগরিককে বিনামূল্যে টিকার আওতায় আনা হবে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ভ্যাকসিন বিতরণের খসড়া পরিকল্পনা চূড়ান্ত করছে। ভ্যাকসিন সফলভাবে প্রয়োগ করার সকল প্রস্তুত ইতোমধ্যেই সম্পন্ন হয়েছে। তিনি বলেন, রূপকল্প-২০২১-২০৪১ এর বাস্তবায়নও শুরু করা হয়েছে। আমাদের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য হলো ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশের কাতারে শামিল হওয়া। বৈশ্বিক লক্ষ্যমাত্রার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে টেকসই উন্নয়ন অভিষ্ট বাস্তবায়ন এবং ব-দ্বীপ পরিকল্পনা, ২১০০ বাস্তবায়নের কাজ এগিয়ে চলছে। কোভিড-১৯ মহামারীজনিত বৈশ্বিক বিপর্যয়ের কারণে বাংলাদেশের উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জনের ধারা কিছুটা শ্লথ হয়েছে। জিডিপি প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে রেকর্ড ৮.১৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হলেও ২০১৯-২০ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির হার কিছুটা কমে ৫.২৪ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। মাথাপিছু জাতীয় আয় বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ২,০৬৪ মার্কিন ডলারে। ২০১৯ সালে দারিদ্র্য ও অতি দারিদ্র্যের হার কমে যথাক্রমে ২০.৫ ও ১০.৫ শতাংশে নেমে এসেছে। কোভিড-১৯ এর প্রভাব মোকাবেলা ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পুনরুজ্জীবিত করে পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রীর সরাসরি দিক নির্দেশনায় সরকার সামাজিক সুরক্ষা ও অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার সম্বলিত ১ লাখ ২১ হাজার ৩৫৩ কোটি টাকা (জিডিপি’র ৪.৩৪ শতাংশ) ২১টি প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে, যার বাস্তবায়ন কাজ বর্তমানে পুরোদমে চলছে। গড় আয়ু, মাথাপিছু আয়, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের বিভিন্ন সূচকে বাংলাদেশ অগ্রগতি সাধন করেছে। যার স্বীকৃতিস্বরূপ জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচী কর্তৃক প্রকাশিত ‘হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট ইনডেক্স ২০২০’ অনুযায়ী ১৮৯টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান বিগত বছরের তুলনায় দুই ধাপ এগিয়ে হয়েছে ১৩৩তম। যুক্তরাজ্যের সেন্টার ফর ইকোনমিকস এ্যান্ড বিজনেস রিসার্চ এর প্রক্ষেপন অনুযায়ী বাংলাদেশ ২০৩০ সাল নাগাদ বিশ্বের ২৮তম শীর্ষ অর্থনীতি এবং ২০৩৫ সাল নাগাদ বিশ্বের ২৫তম শীর্ষ অর্থনীতিতে উন্নীত হবে। বর্তমানে আমাদের অবস্থান ৪১তম। তবে কোভিড-১৯ বৈশ্বিক মহামারী হতে উত্তরণে সরকার কর্তৃক সময়োপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণ এবং প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নের ফলে বাংলাদেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোর ইঙ্গিত দিচ্ছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিক, প্রবাস আয়, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, ব্যাপক মুদ্রা সরবরাহ, মূল্যস্ফীতি প্রভৃতি মৌলিক সামষ্টিক অর্থনৈতিক চলকসমূহের অবস্থান বেশ সন্তোষজনক। সার্বিক লেনদেন ভারসাম্যে উদ্বৃত্ত অবস্থা বিরাজ করছে। টাকা-ডলার বিনিময় হার স্থিতিশীল অবস্থায় রয়েছে। অন্যদিকে রফতানি ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে। সরকারের মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নে গতি আসায় অচিরেই আমদানি বিশেষত মূলধন যন্ত্রপাতি আমদানিতে গতি ফিরে আসবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করা যাচ্ছে। জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে সামষ্টিক অর্থনীতির গতিপ্রকৃতি ॥ করোনার প্রভাবে মোট সরকারী ব্যয় ৭.৫৭ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে, তবে সামনের দিনগুলোতে সরকারী ব্যয় বৃদ্ধির জোর পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) এর তথ্য অনুযায়ী চলতি অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচী বাস্তবায়নের হার দাঁড়িয়েছে মোট বরাদ্দের ৮.২ শতাংশে, যা বিগত অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ৮.৩ শতাংশ। রাজস্ব খাতে চলমান সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়নের ফলে রাজস্ব আদায়ে গতি পরিলক্ষিত হচ্ছে। এনবিআর এর তথ্যমতে প্রথম প্রান্তিকে এনবিআর কর রাজস্ব আদায়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৪.১১ শতাংশ। প্রবাস আয়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৪৮.৫৪ শতাংশ, যা বিগত অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ১৬.৮১ শতাংশ। সরকার কর্তৃক ২ শতাংশ হারে প্রণোদনা প্রদান ও রেমিটেন্স প্রেরণ প্রক্রিয়া সহজীকরণের কারণে প্রবাস আয় বিপুলভাবে বেড়েছে এবং আগামীতে এ খাতে প্রবৃদ্ধির চলমান ধারা অব্যাহত থাকবে মর্মে আশাবাদ ব্যক্ত করছি। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ রেকর্ড পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়ে ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২০ তারিখে দাঁড়িয়েছে ৩৯.৩১ বিলিয়ন ডলার। রফতানি আয়ের ক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২.৫৪ শতাংশ। বিগত বছরের এ সময়ে প্রবৃদ্ধির হার ছিল ঋণাত্মক (-২.৯৪ শতাংশ)। রফতানি বাণিজ্যের এই প্রবৃদ্ধি করোনার প্রভাব হতে অর্থনীতির ঘুরে দাঁড়ানোর একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্ধারক হিসেবে বিবেচিত। আমদানি ব্যয় ১১.৪৩ শতাংশ হ্রাস পেয়ে ১২.৬৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার হয়েছে। মূলত মূলধনী যন্ত্রপাতির আমদানি কিছুটা কম হওয়ায় এবং আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য হ্রাসের প্রেক্ষাপটে আমদানি ব্যয় হ্রাস পেয়েছে। সামাজিক নিরাপত্তা ও কল্যাণ ॥ করোনাকালীন সময়ে সামাজিক নিরাপত্তা ও কল্যাণ খাতের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। বিশেষ করে, দারিদ্র্য ও চরম দারিদ্র্য দূরীকরণের লক্ষ্যে সুনির্দিষ্টভাবে এবং দক্ষ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বাস্তবায়িত সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কর্মসূচীসমূহ আমাদের অগ্রাধিকারভুক্ত কার্যক্রমের মধ্যে অন্যতম। কোভিড-১৯ মহামারী মোকাবেলায় আমরা সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচীর আওতাভুক্ত সুবিধাসমূহের ব্যাপ্তি বাড়িয়েছি। যেমন, সর্বাধিক দারিদ্র্যপ্রবণ ১১২টি উপজেলায় সকল দারিদ্র্যপ্রবণ ব্যক্তিকে বয়স্ক ভাতার আওতায় আনার লক্ষ্যে চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরে ভাতাভোগীর সংখ্যা ৪৪ লক্ষ জন থেকে ৪৯ লক্ষ জনে উন্নীত করা হয়। ২০২০-২১ অর্থবছরে উক্ত খাতের জন্য বাজেটে ২,৯৪০ কোটি টাকা বরাদ্দ প্রদান করা হয়েছে। জুলাই-সেপ্টেম্বর ২০২০ পর্যন্ত সময়ে ১ম কিস্তির বরাদ্দ ৭৩৫ কোটি টাকা ছাড় করা হয়েছে। একইভাবে সর্বাধিক দারিদ্র্যপ্রবণ ১১২টি উপজেলায় সকল বিধবা ও স্বামী পরিত্যক্তাদের ভাতার আওতায় আনার লক্ষ্যে চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরে বিধবা ও স্বামী নিগৃহিতা মহিলা ভাতাভোগীর সংখ্যা ১৭ লক্ষ জন থেকে ২০ লক্ষ ৫০ জনে উন্নীত করা হয়। ২০২০-২১ অর্থবছরে উক্ত খাতের জন্য বাজেটে ১,২৩০ কোটি টাকা বরাদ্দ প্রদান করা হয়েছে। জুলাই-সেপ্টেম্বর ২০২০ পর্যন্ত সময়ে ১ম কিস্তির বরাদ্দ ৩০৭ কোটি ৫০ লাখ টাকা ছাড় করা হয়েছে। পুনরায়, দেশের সকল প্রতিবন্ধীকে অন্তর্ভুক্ত করার লক্ষ্যে চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরে অস্বচ্ছল প্রতিবন্ধী ভাতাভোগীর সংখ্যা ১৫ লক্ষ ৪৫ হাজার জন থেকে ১৮ লক্ষ জনে উন্নীত করে বাজেট বরাদ্দ বৃদ্ধি করা হয়। ২০২০-২১ অর্থবছরে উক্ত খাতে ১,৬২০ কোটি টাকা বরাদ্দ প্রদান করা হয়েছে। জুলাই-সেপ্টেম্বর ২০২০ পর্যন্ত সময়ে ১ম কিস্তির বরাদ্দ ৪০৫ কোটি টাকা ছাড় করা হয়েছে। চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটে পল্লী সমাজসেবা কার্যক্রম (আবর্তক ক্ষুদ্রঋণ) খাতে ১০০ কোটি টাকার বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।
×